বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ
থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন
ডলার চুরি যাওয়ার ঘটনায় এখন
বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে। চুরি
যাওয়া ওই অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কা
থেকে ২ কোটি ডলার উদ্ধার করা
হয়েছে।
আর ফিলিপাইনে চলে
যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের
সিংহভাগেরই কোনো হদিস
মিলছে না। এ ঘটনায় আনুষ্ঠানিকভাবে
বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনে আলাদা
তদন্ত চলছে। অর্থ চুরির মূল ঘটনাটি গত ৫
থেকে ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সম্পন্ন
হলেও এর প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল অনেক
আগেই।

সেসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে
দিনপঞ্জির হিসেবে:

১৫ মে, ২০১৫ —ফিলিপাইনের মাকাতি
শহরের রিজাল কমার্শিয়াল
ব্যাংকিং করপোরেশনের
(আরসিবিসি) জুপিটার স্ট্রিট শাখায়
সন্দেহভাজন চার ব্যক্তির নামে চারটি
আলাদা ব্যাংক হিসাব খোলা হয়।

৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬—যুক্তরাষ্ট্রের
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব
নিউইয়র্কে থাকা বাংলাদেশ
ব্যাংকের রিজার্ভ হিসাব থেকে
হ্যাকাররা ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার
স্থানান্তরের জন্য বাংলাদেশ
ব্যাংকের দিক থেকে ৩৫টি
নির্দেশনা পাঠানো হয়। এর জন্য
আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-
প্রদানের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক
সুইফটকে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ৩০টি
নির্দেশনা আটকে দিলেও পাঁচটি
নির্দেশনা কার্যকর করে নিউইয়র্ক ফেড।
চারটি নির্দেশনার মাধ্যমে ৮
কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনে
আর একটি নির্দেশনার মাধ্যমে ২
কোটি ডলার শ্রীলঙ্কায় পাঠানো
হয়।

৫ ফেব্রুয়ারি —সুইফটের মাধ্যমে যেসব
আর্থিক লেনদেন করা হয়, তার একটি
নিশ্চিতকরণ বার্তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে
প্রতিদিন প্রিন্ট হয়। ওই দিন বাংলাদেশ
ব্যাংকের হিসাব ও বাজেট বিভাগের
যুগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা
দেখতে পান, প্রিন্টার মেশিনে
সুইফটের স্বয়ংক্রিয় বার্তা প্রতিবেদন
প্রিন্ট হয়নি। জোবায়ের ও তাঁর
সহকর্মীদের একই প্রতিবেদন সনাতন
পদ্ধতিতে প্রিন্ট করতে ২৪ ঘণ্টা সময়
লেগে যায়।
একই দিনে ফিলিপাইনের রিজাল
ব্যাংকে উইলিয়াম গোর নামে
আরেকটি হিসাব খোলা হয়।
পাশাপাশি একই ব্যাংকে জেসি
ক্রিস্টোফার ল্যাগরোসাস নামে
খোলা একটি হিসাব থেকে ২
কোটি ২৭ ডলার তুলে নেওয়া হয়। পরে
সেই অর্থ জমা হয় উইলিয়াম গোর
হিসাবে।
বর্তমানে ফিলিপাইনে এ ঘটনার যে
তদন্ত চলছে, তা থেকে জানা গেছে,

৫ ফেব্রুয়ারি রিজাল ব্যাংকের
জুপিটার শাখার ব্যবস্থাপক মায়া
সান্তোস দেগুইতো নিজের
গাড়িতে করে ওই দিন বিপুল অর্থ
সরিয়েছেন।

৬ ফেব্রুয়ারি —বাংলাদেশ ব্যাংকের
কর্মকর্তা জোবায়ের বিন হুদা এদিন
কার্যালয়ে এসে দেখেন সুইফট
সিস্টেমটি যথাযথভাবে কাজ করছে
না। পরে বিকল্প উপায়ে সিস্টেমটি
চালু করে বেশ কিছু নিশ্চিতকরণ বার্তা
দেখতে পান, যেগুলো এসেছিল

নিউইয়র্ক ফেডের কাছ থেকে।

৮ ফেব্রুয়ারি —বাংলাদেশ ব্যাংকের
কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন, পাঁচটি
অনুমোদিত সুইফট বার্তার মাধ্যমে
নিউইয়র্ক ফেডের হিসাব থেকে ১০
কোটি ১০ লাখ ডলার সরানো
হয়েছে। এর মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ
ডলার গেছে ফিলিপাইনের রিজাল
ব্যাংকে। আর ২ কোটি ডলার গেছে
শ্রীলঙ্কার প্যান এশিয়ান
ব্যাংকিংয়ে। আরও ৮৫ কোটি ডলার
স্থানান্তরের নির্দেশনা আটকে
দেওয়া হয়েছে। ওই দিনই বাংলাদেশ
ব্যাংকের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের
নিউইয়র্ক ফেড, ব্যাংক অব নিউইয়র্ক
মেলোন, সিটিগ্রুপ, ওয়েলস ফার্গো,
ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংক ও
শ্রীলঙ্কার প্যান এশিয়ান ব্যাংকের
কাছে অর্থের লেনদেন বন্ধের বার্তা
পাঠানো হয়।
৯ ফেব্রুয়ারি —রিজাল ব্যাংকের
চারটি হিসাব থেকে ৫ কোটি ৮১
লাখ ডলার জমা করা হয় একই ব্যাংকের
উইলিয়াম গোর হিসাবে। এদিন
ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকের পক্ষ
থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে
জানানো হয়, চারটি হিসাবের
লেনদেন আটকে দিয়েছে, কিন্তু
ততক্ষণে ওই সব হিসাব থেকে সিংহভাগ
অর্থই সরিয়ে ফেলা হয়।

৫ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি—এই কয়েক
দিনে রিজাল ব্যাংকের উইলিয়াম
গোর হিসাব থেকে অর্থ চলে যায়
ম্যানিলাভিত্তিক বৈদেশিক মুদ্রা
লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান ফিলরেমের
কাছে। প্রতিষ্ঠানটি ওই অর্থ
ফিলিপাইনের স্থানীয় মুদ্রা
পেসোতে রূপান্তর করে। এরপর সেই
অর্থের ২ কোটি ৯০ লাখ ডলার
ব্লুমবেরি রিসোর্ট করপোরেশনে, ২
কোটি ১২ লাখ ডলার ইস্টার্ন হাওয়াই
লেইজার কোম্পানিতে আর ৩
কোটি ৬ লাখ ডলার পাঠানো হয়
ওয়েক্যাং জু নামের এক ব্যক্তির কাছে।

১১ ফেব্রুয়ারি —ফিলিপাইনের অ্যান্টি
মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি)
আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পারে যে
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮
কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইন
থেকে অন্যত্র চলে গেছে। এদিনই
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
আতিউর রহমান ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের গভর্নর আমান্দো
তেতাংকোর কাছে ফোন করে চুরি
যাওয়া অর্থ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে
সহযোগিতা চান।
১৬ ফেব্রুয়ারি —বাংলাদেশ ব্যাংক ও
বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা
ইউনিটের প্রতিনিধিরা
ফিলিপাইনের ম্যানিলায় গিয়ে সে
দেশের এএমএলসির সঙ্গে বৈঠক করে।
১৭ ফেব্রুয়ারি —শ্রীলঙ্কার প্যান
এশিয়া ব্যাংকিং বাংলাদেশ
ব্যাংকের নিউইয়র্ক ফেড শাখায় ২
কোটি ডলার ফেরত দেয়।
২৯ ফেব্রুয়ারি —পাঁচটি ব্যাংক হিসাব
জব্দ করার জন্য ফিলিপাইনের এএমএলসির
পক্ষ থেকে আদালতে মামলা করা হয়।
এদিন অর্থ চুরির ঘটনাটি নিয়ে
ফিলিপাইনের পত্রিকা ইনকোয়ারার
প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

১ মার্চ —ফিলিপাইনের আদালত ব্যাংক
হিসাব জব্দের আদেশ দেন।
৭ মার্চ —বাংলাদেশ ব্যাংক
আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমকে
রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনাটি জানায়।
এদিন দেশের সংবাদমাধ্যমে
রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা নিয়ে
বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
১১ মার্চ —ফিলিপাইনের এএমএলসি অর্থ
পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে
রিজাল ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক

মায়া সান্তোস দেগুইতোর বিরুদ্ধে
ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসে
অভিযোগ দায়ের করে।
১৩ মার্চ —বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী
আবুল মাল আবদুল মুহিত ঘোষণা দেন,
ব্যর্থতার দায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
১৫ মার্চ —বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর
আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন।
ফিলিপাইনের সিনেট এ বিষয়ে
শুনানি শুরু করে। তাতে রিজাল
ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জো
তান সিনেটের অনেক প্রশ্নের জবাব
এড়িয়ে যান। আর ব্যাংকটির শাখা
ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতো
রুদ্ধদ্বার শুনানির অনুরোধ করেন। এদিন
ফিলিপাইনের শেয়ারবাজারে
রিজাল ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৫
দশমিক ১ শতাংশ কমে যায়।

১৭ মার্চ —মায়া সান্তোস দেগুইতো
রুদ্ধদ্বার শুনানিতে সাক্ষ্য দেন। পরে
তাঁর আইনজীবী জানান, রিজাল
ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে
তিনি এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন।
অন্যদিকে এদিন রিজাল ব্যাংকের
অভ্যন্তরীণ তদন্তে মায়া সান্তোসকে
দায়ী করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা
হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধ
উপেক্ষা করে মায়া অর্থ স্থানান্তর
করেছেন।
১৮ মার্চ —ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের গভর্নর আমান্দো
তেতাংকো বলেন, অর্থনৈতিক ঝুঁকি
এড়াতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিন রিজাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপক
মায়া সান্তোস দেগুইতোর বিরুদ্ধে
অভিযোগ দায়ের করেন সে দেশের
ব্যবসায়ী উইলিয়াম গো।

২১ মার্চ —শ্রীলঙ্কার বেসরকারি
সংস্থা (এনজিও) শালিকা
ফাউন্ডেশনের ছয় পরিচালকের
দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা
আরোপ করেন দেশটির আদালত। এই
শালিকা ফাউন্ডেশনের নামে
খোলা ব্যাংক হিসাবে
বাংলাদেশের রিজার্ভের ২ কোটি
টাকা স্থানান্তর করা হয়েছিল।
২২ মার্চ —রিজাল ব্যাংকের শাখা
ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস ও তাঁর
সহকারী অ্যাঞ্জেলা তোরেসকে
ব্যাংকের চাকরি থেকে বহিষ্কার
করা হয়।
২৩ মার্চ —রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায়
নিউইয়র্কের ফেডের গাফিলতি রয়েছে
কি না এবং সে বিষয়ে আইনগত
কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না,
তা খতিয়ে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রে একজন
আইনজীবী নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ
ব্যাংক। এদিন সিঙ্গাপুর থেকে
ফিলিপাইনে ফেরেন অর্থ
কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযুক্ত সে
দেশের ব্যবসায়ী কিম ওয়ং। এ ছাড়া এ
ঘটনায় রিজাল ব্যাংক দুঃখ প্রকাশ করে
এবং ব্যাংকটির চেয়ারম্যান
লরেঞ্জো তান ছুটিতে যান।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ
অবলম্বনে দিনপঞ্জিটি তৈরি করেছেন

ধন্যবাদ


তথ্য প্রযুক্তি সেবায়, আপনাদের পাশে।

…♦ ♦….(ফেসবুকে আমি)..♦…♦.

Leave a Reply