1. সূরা নাযিলের কারণ
2. সুন্দরতম কাহিনী
3. আরবী ভাষায় কেন?
4. কাহিনীর সার-সংক্ষেপ
5. সূরাটি মক্কায় নাযিল হওয়ার কারণ
6. ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনী
7. মিসরে ইউসুফের সময়কাল
8. শৈশবে ইউসুফের লালন-পালন ও চুরির ঘটনা
9. ইউসুফ-এর স্বপ্ন
10. ভাইদের হিংসার শিকার হলেন
11. ইউসুফ অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হ’লেন
12. পিতার নিকটে ভাইদের কৈফিয়ত
13. কাফেলার হাতে ইউসুফ
14. ইউসুফ মিসরের অর্থমন্ত্রীর গৃহে
15. ইউসুফ যৌবনে পদার্পণ করলেন
16. যৌবনের মহা পরীক্ষায় ইউসুফ
17. মহিলাদের সমাবেশে ইউসুফ
18. নবীগণ নিষ্পাপ মানুষ ছিলেন
19. ইউসুফের সাক্ষী কে ছিলেন?
20. ইউসুফ জেলে গেলেন
21. কারাগারের জীবন
22. জেলখানার সাথীদের নিকটে ইউসুফের দাওয়াত
23. ইউসুফের দাওয়াতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূ হ
24. বাদশাহর স্বপ্ন ও কারাগার থেকে ইউসুফের ব্যাখ্যা দান
25. বাদশাহর দূতকে ফেরৎ দানে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ
26. বাদশাহর দরবারে ইউসুফ (আঃ)
27. ইউসুফের অর্থমন্ত্রীর পদ লাভ এবং সাথে সাথে বাদশাহীর ক্ষমতা লাভ 28. ইউসুফের দক্ষ শাসন ও দুর্ভিক্ষ মুকাবিলায় অপূর্ব ব্যবস্থাপনা
29. ভাইদের মিসরে আগমন
30. ইউসুফের কৌশল অবলম্বন ও বেনিয়ামীনের মিসর আগমন
31. বেনিয়ামীনকে আটকে রাখা হ’ল
32. শিক্ষণীয় বিষয়
33. বেনিয়ামীনকে ফিরিয়ে নেবার জন্য ভাইদের প্রচেষ্টা
34. বেনিয়ামীনকে রেখেই মিসর থেকে ফিরল ভাইয়েরা
35. পিতার নিকটে ছেলেদের কৈফিয়ত
36. পিতার নির্দেশে ছেলেদের পুনরায় মিসরে গমন
37. ইউসুফের আত্মপ্রকাশ এবং ভাইদের ক্ষমা প্রার্থনা
38. ইউসুফের ব্যবহৃত জামা প্রেরণ
39. ভাইদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের তাৎপর্য
40. ইয়াকূব (আঃ) দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন
41. ঘামের গন্ধে দৃষ্টিশক্তি ফেরা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য
42. পিতার নিকটে ছেলেদের ক্ষমা প্রার্থনা
43. ইয়াকূব-পরিবারের মিসর উপস্থিতি ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন
44. ইউসুফের দো‘আ
45. ইউসুফের প্রশংসায় আল্লাহ তা‘আলা
46. শেষনবীর প্রতি আল্লাহর সম্বোধন ও সান্ত্বনা প্রদান
47. ইউসুফের কাহিনী এক নযরে
48. ইয়াকূব (আঃ)-এর মৃত্যু
49. ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যু
50. সংশয় নিরসন
51. ইউসুফের নিষ্পাপত্ব
52. ‘বুরহান’ কি?
53. ইউসুফের কাহিনীতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইউসুফ (আঃ) সম্পর্কে বলেন, ﺍﻟﻜﺮﻳﻢُ ﺑﻦُ ﺍﻟﻜﺮﻳﻢِ ﺑﻦِ ﺍﻟﻜﺮﻳﻢِ ﺑﻦِ ﺍﻟﻜﺮﻳﻢِ ﻳﻮﺳﻒُ ﺑﻦُ ﻳﻌﻘﻮﺏَ ﺑﻦِ ﺍﺳﺤﺎﻕَ ﺑﻦِ ﺍﺑﺮﺍﻫﻴﻢَ ﻋﻠﻴﻬﻢُ ﺍﻟﺴﻼﻡُ – ‘নিশ্চয়ই মর্যাদাবানের পুত্র মর্যাদাবান, তাঁর পুত্র মর্যাদাবান, তাঁর পুত্র মর্যাদাবান। তাঁরা হলেন ইবরাহীমের পুত্র ইসহাক, তাঁর পুত্র ইয়াকূব ও তাঁর পুত্র ইউসুফ ‘আলাইহিমুস সালাম’ (তাঁদের উপর শান্তি বর্ষিত হৌক!)। [1]
নবীগণের মধ্যে হযরত ইউসুফ (আঃ) হ’লেন একমাত্র নবী, যাঁর পুরা কাহিনী একটি মাত্র সূরায় ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। সূরা ইউসুফ-এর ১১১টি আয়াতের মধ্যে ৩ থেকে ১০১ আয়াত পর্যন্ত ৯৯টি আয়াতে ইউসুফের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। এ ছাড়া অন্যত্র কেবল সূরা আন‘আম ৮৪ এবং সূরা মুমিন ৩৪ আয়াতে তাঁর নাম এসেছে।
সূরা নাযিলের কারণ :
সত্যনবী এবং শেষনবী জেনেও কপট ইহুদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রতি পদে পদে কষ্ট দিত এবং পরীক্ষা করার চেষ্টা করত। তাদের সমাজনেতা ও ধর্মনেতাদের কাজই ছিল সর্বদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা ও তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা। এ সময় মক্কায় কোন আহলে কিতাব বসবাস করত না এবং মক্কার লোকেরা ইউসুফ বা অন্য নবীদের সম্পর্কে কিছু জানতও না। ফলে মদীনার কুচক্রী ইহুদীদের একটি দল মক্কায় এসে একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করল যে, বলুন দেখি, কোন নবী শামে (সিরিয়ায়) ছিলেন। অতঃপর তার ছেলেকে সেখান থেকে মিসরে বহিষ্কার করা হয়। তাতে ঐ ব্যক্তি কেঁদে অন্ধ হয়ে যান? (এটি বানোয়াট কথা। কেননা কেবলমাত্র কেঁদে কারু চোখ অন্ধ হয় না এবং এটি নবীগণের মর্যাদার খেলাফ)। একথার জওয়াবে অতঃপর সূরা ইউসুফ পুরাটা একত্রে নাযিল হয়।[2] তাদের পন্ডিতেরা তওরাত-ইঞ্জীলে বর্ণিত উক্ত ঘটনা আগে থেকেই জানতো। তাওরাত-যবূর-ইনজীল সবই ছিল হিব্রু ভাষায় রচিত। আমাদের রাসূল নিজের ভাষাতেই লেখাপড়া জানতেন না, অন্যের ভাষা জানা তো দূরের কথা। ইহুদী নেতাদের সূক্ষ্ম পলিসি ছিল এই যে, উক্ত বিষয়ে উম্মী নবী মুহাম্মাদ-এর পক্ষে জবাব দেওয়া আদৌ সম্ভব হবে না। ফলে লোকদের মধ্যে তার নবুঅতের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হবে এবং তার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা যোরদার করা যাবে।
বস্ত্ততঃ তাদের প্রশ্নের উত্তরে ইউসুফ (আঃ) ও ইয়াকূব পরিবারের প্রকৃত ঘটনা ‘অহি’ মারফত ধারাবাহিকভাবে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বর্ণনা করে দেন। যা ছিল রাসূলের জন্য নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ মু‘জেযা। [3] শুধু ইউসুফের ঘটনাই নয়, আদম থেকে ঈসা পর্যন্ত কুরআনে বর্ণিত বাকী ২৪ জন নবী ও তাঁদের কওমের ঘটনাবলী বর্ণনা ছিল শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অন্যতম উল্লেখযোগ্য মু‘জেযা। কেননা তাঁদের কারু সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি। তাদের সম্পর্কে লিখিত কোন বই-পত্র সে যুগে ছিল না। আর তিনি নিজে কারু কাছে কখনো লেখাপড়া শিখেননি। অথচ বিশ্ব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া বিগত যুগের শিক্ষণীয় ঘটনাবলী তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে উম্মতকে শুনিয়ে গেছেন কুরআনের মাধ্যমে। এগুলিই তাঁর নবুঅতের অন্যতম প্রধান দলীল ছিল। এরপরেও খাছ করে ইউসুফ (আঃ) ও তাঁর পিতা ইয়াকূব (আঃ)-এর পরিবারের ঘটনাবলী ছিল বিগত ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। যার প্রয়োজনীয় অংশগুলি গুছিয়ে একত্রিতভাবে উপস্থাপন করাই হ’ল সূরা ইউসুফের অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য।
সুন্দরতম কাহিনী :
অন্যান্য নবীদের কাহিনী কুরআনের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজন অনুসারে বিক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ইউসুফ নবীর ঘটনাবলী একত্রে সাজিয়ে একটি সূরাতে সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। সম্ভবতঃ সেকারণে এটিকে ﺃَﺣْﺴَﻦُ ﺍﻟْﻘَﺼَﺺِ ‘সুন্দরতম কাহিনী’ বলা হয়েছে (ইউসুফ ১২/৩) । দ্বিতীয়তঃ এর মধ্যে যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তা যেমনি অলৌকিক, তেমনি চমকপ্রদ ও শিক্ষণীয়। তৃতীয়তঃ অন্যান্য নবীদের কাহিনীতে প্রধানতঃ উম্মতের অবাধ্যতা ও পরিণামে তাদের উপরে আপতিত গযবের কাহিনী এবং অন্যান্য উপদেশ ও হিকমত সমূহ প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনীতে রয়েছে দুনিয়ার তিক্ত বাস্তবতা এবং আল্লাহর উপরে অকুণ্ঠ নির্ভরতার সমন্বয়ে সৃষ্ট এক অতুলনীয় ও অভাবনীয় এক ট্রাজিক জীবন নাট্য। যা পাঠ করলে যেকোন বোদ্ধা পাঠকের জীবনে সৃষ্টি হবে সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপরে ভরসা ও তাঁর নিকটে আত্মসমর্পণের এক অনুপম উদ্দীপনা।
আরবী ভাষায় কেন?
আল্লাহ বলেন, ‘আমরা একে আরবী কুরআন হিসাবে নাযিল করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার’ (ইউসুফ ১২/২) । এর অন্যতম কারণ ছিল এই যে, ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনী যারা জানতে চেয়েছিল, তারা ছিল আরবীয় ইহুদী এবং মক্কার কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ। তাই তাদের বোধগম্য হিসাবে আরবী ভাষায় উক্ত কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে এবং আরবীতেই সমগ্র কুরআন নাযিল করা হয়েছে। এতে একদিকে যেমন ভাষাগর্বী আরবরা কুরআনের অপূর্ব ভাষাশৈলীর কাছে হার মেনেছে, অন্যদিকে তেমনি কিতাবধারী ইহুদী-নাছারা পন্ডিতেরা কুরআনের বিষয়বস্ত্ত ও বক্তব্য সমূহের সত্যতা ও সারবত্তা উপলব্ধি করে নিশ্চুপ হয়েছে।
কাহিনীর সার-সংক্ষেপ :
কাহিনীটি শৈশবে দেখা ইউসুফের একটি স্বপ্ন দিয়ে শুরু হয়েছে এবং তার সমাপ্তি ঘটেছে উক্ত স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে। মাঝখানের ২২/২৩ বছর মতান্তরে চল্লিশ বছর অনেকগুলি বিয়োগান্ত ও চমকপ্রদ ঘটনায় পূর্ণ। কাহিনী অনুযায়ী ইউসুফ শৈশবকালে স্বপ্ন দেখেন যে, ১১টি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চন্দ্র তাকে সিজদা করছে। তিনি এই স্বপ্ন পিতা হযরত ইয়াকূবকে বললে তিনি তাকে সেটা গোপন রাখতে বলেন। কিন্তু তা ফাঁস হয়ে যায়। ফলে এটা তার সুন্দর ভবিষ্যতের হাতছানি ভেবে সৎ ভাইয়েরা হিংসায় জ্বলে ওঠে এবং তারা তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করে। অতঃপর তারা তাকে জঙ্গলের একটি পরিত্যক্ত অন্ধকূপে নিক্ষেপ করে। তিনদিন পরে পথহারা ব্যবসায়ী কাফেলার নিক্ষিপ্ত বালতিতে করে তিনি উপরে উঠে আসেন। পরে ঐ ব্যবসায়ীরা তাকে মিসরের রাজধানীতে বিক্রি করে দেয়। ভাগ্যক্রমে মিসরের অর্থ ও রাজস্ব মন্ত্রী ক্বিৎফীর ‏( ﻗﻄﻔﻴﺮ ‏) তাকে খরিদ করে বাড়ীতে নিয়ে যান ক্রীতদাস হিসাবে। কয়েক বছরের মধ্যে যৌবনে পদার্পণকারী অনিন্দ্য সুন্দর ইউসুফের প্রতি মন্ত্রীর নিঃসন্তান স্ত্রী যুলায়খার আসক্তি জন্মে। ফলে শুরু হয় ইউসুফের জীবনে আরেক পরীক্ষা। একদিন যুলায়খা ইউসুফকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে কুপ্রস্তাব দেয়। তাতে ইউসুফ সম্মত না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলে পিছন থেকে যুলায়খা তার জামা টেনে ধরলে তা ছিঁড়ে যায়। দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই দু’জনে ধরা পড়ে যায় বাড়ীর মালিক ক্বিৎফীরের কাছে। পরে যুলায়খার সাজানো কথামতে নির্দোষ ইউসুফের জেল হয়। যুলায়খা ছিলেন মিসররাজ রাইয়ান ইবনু অলীদের ভাগিনেয়ী। [4]
অন্যূন সাত বছর জেল খাটার পর বাদশাহর এক স্বপ্নের ব্যাখ্যা দানের পুরস্কার স্বরূপ তাঁর মুক্তি হয়। পরে তিনি বাদশাহর অর্থ ও রাজস্ব মন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং বাদশাহর আনুকূল্যে তিনিই হন সমগ্র মিসরের একচ্ছত্র শাসক। ইতিমধ্যে ক্বিৎফীরের মৃত্যু হ’লে বাদশাহর উদ্যোগে বিধবা যুলায়খার সাথে তাঁর বিবাহ হয়।[5] বাদশাহর দেখা স্বপ্ন মোতাবেক মিসরে প্রথম সাত বছর ভাল ফসল হয় এবং পরের সাত বছর ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষের সময় সুদূর কেন‘আন থেকে তাঁর বিমাতা দশ ভাই তাঁর নিকটে খাদ্য সাহায্য নিতে এলে তিনি তাদের চিনতে পারেন। কিন্তু নিজ পরিচয় গোপন রাখেন। পরে তাঁর সহোদর একমাত্র ছোট ভাই বেনিয়ামীনকে আনা হ’লে তিনি তাদের সামনে নিজের পরিচয় দেন এবং নিজের ব্যবহৃত জামাটি ভাইদের মাধ্যমে পিতার নিকটে পাঠিয়ে দেন। বার্ধক্য তাড়িত অন্ধ পিতা ইয়াকূবের মুখের উপরে উক্ত জামা রেখে দেওয়ার সাথে সাথে তাঁর দু’চোখ খুলে যায়। অতঃপর ইউসুফের আবেদন ক্রমে তিনি সপরিবারে মিসর চলে আসেন। ইউসুফ তার ভাইদের ক্ষমা করে দেন। অতঃপর ১১ ভাই ও বাপ-মা তাঁর প্রতি সম্মানের সিজদা করেন। এভাবেই শৈশবে দেখা ইউসুফের স্বপ্ন সার্থক রূপ পায় (অবশ্য ইসলামী শরী‘আতে কারু প্রতি সম্মানের সিজদা নিষিদ্ধ)। সংক্ষেপে এটাই হ’ল ইউসুফ (আঃ) ও ইয়াকূব পরিবারের ফিলিস্তীন হ’তে মিসরে হিজরতের কারণ ও প্রেক্ষাপট, যে বিষয়ে ইহুদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করেছিল মূলতঃ তাঁকে ঠকাবার জন্য।
সূরাটি মক্কায় নাযিল হওয়ার কারণ :
মক্কায় কোন ইহুদী-নাছারা বাস করত না। ইউসুফ ও ইয়াকূব পরিবারের ঘটনা মক্কায় প্রসিদ্ধ ছিল না এবং মক্কার কেউ এ বিষয়ে অবগতও ছিল না। তাহ’লে সূরা ইউসুফ কেন মক্কায় নাযিল হ’ল?
এর জবাব এই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আবির্ভাবের সংবাদ মদীনায় পৌঁছে গেলে সেখানকার ইহুদী-নাছারা নেতৃবর্গ তাওরাত-ইনজীলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তাঁকে ঠিকই চিনে ফেলে (বাক্বারাহ ২/১৪৬; আন‘আম ৬/২০) । কিন্তু অহংকার বশে মানতে অস্বীকার করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল বুনতে শুরু করে। সে মোতাবেক শেষনবী (ছাঃ) যাতে মদীনায় হিজরত করতে না পারেন এবং মক্কাতেই তাঁকে শেষ করে ফেলা যায়, সেই কপট উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের একদল ধুরন্ধর লোক মক্কায় প্রেরিত হয়। তারা এসে অস্পষ্ট ভঙ্গিতে প্রশ্ন করতে লাগল যে, বলুন কোন্ নবীর এক পুত্রকে শাম হ’তে মিসরে স্থানান্তরিত করা হয়। কোন্ নবী সন্তানের বিরহ-বেদনায় কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে যান ইত্যাদি।
জিজ্ঞাসার জন্য এ ঘটনাটি বাছাই করার অন্যতম কারণ ছিল এই যে, এ ঘটনাটি মক্কায় ছিল অপরিচিত এবং একটি সম্পূর্ণ নতুন বিষয়। অতএব মক্কার লোকেরাই যে বিষয়ে জানে না, সে বিষয়ে উম্মী নবী মুহাম্মাদ-এর জানার প্রশ্নই ওঠে না। ফলে নিশ্চয়ই তিনি বলতে পারবেন না এবং অবশ্যই তিনি অপদস্থ হবেন। তখন মক্কার কাফেরদের কাছে একথা রটিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে যে, মুহাম্মাদ কোন নবী নন, তিনি একজন ভন্ড ও মতলববাজ লোক। বাপ-দাদার ধর্মের বিরোধিতা করার কারণে তখন লোকেরা তাকে হয়ত পিটিয়ে মেরে ফেলবে।
যাইহোক ইহুদীদের এ কুটচাল ও কপট উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তাদের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে সূরা ইউসুফ নাযিল হয় এবং তাতে ইউসুফ ও ইয়াকূব-পরিবারের ঘটনাবলী এমন নিখুঁতভাবে পরিবেশিত হয়, যা তওরাত ও ইনজীলেও ছিল না। বস্ত্ততঃ এটি ছিল শেষনবী (ছাঃ)-এর একটি প্রকাশ্য মু‘জেযা।
ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনী :
ইউসুফ (আঃ)-এর পিতা ছিলেন ইয়াকূব ইবনে ইসহাক্ব ইবনে ইবরাহীম (আঃ)। তাঁরা সবাই কেন‘আন বা ফিলিস্তীনের হেবরন এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। ইয়াকূব (আঃ)-এর দ্বিতীয়া স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন ইউসুফ ও বেনিয়ামীন। শেষোক্ত সন্তান জন্মের পরপরই তার মা মৃত্যুবরণ করেন। পরে ইয়াকূব (আঃ) তাঁর স্ত্রীর অপর এক বোন লায়লা-কে বিবাহ করেন। ইউসুফ-এর সাথে মিসরে পুনর্মিলনের সময় ইনিই মা হিসাবে সেখানে পিতার সাথে উপস্থিত ছিলেন। [6]
হযরত ইয়াকূব (আঃ) মিসরে পুত্র ইউসুফের সাথে ১৭ বছর মতান্তরে ২০ বছরের অধিককাল অতিবাহিত করেন। অতঃপর ১৪৭ বছর বয়সে সেখানেই ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে অছিয়ত করে যান যেন তাঁকে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নিকটবর্তী হেবরন মহল্লায় পিতা ইসহাক ও দাদা ইবরাহীম (আঃ)-এর পাশে সমাহিত করা হয় এবং তিনি সেখানেই সমাধিস্থ হন। যা এখন ‘খলীল’ মহল্লা বলে খ্যাত। হযরত ইউসুফ (আঃ) ১১০ বছর বয়সে মিসরে ইন্তেকাল করেন এবং তিনিও হেবরনের একই স্থানে সমাধিস্থ হওয়ার জন্য সন্তানদের নিকটে অছিয়ত করে যান। এর দ্বারা বায়তুল মুক্বাদ্দাস অঞ্চলের বরকত ও উচ্চ মর্যাদা প্রমাণিত হয়। হযরত ইয়াকূব-এর বংশধরগণ সকলে ‘বনু ইসরাঈল’ নামে খ্যাত হয়। তাঁর বারো পুত্রের মধ্যে মাত্র ইউসুফ নবী হয়েছিলেন। তাঁর রূপ-লাবণ্য ছিল অতুলনীয়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমি মি‘রাজ রজনীতে ইউসুফ (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ হলে দেখলাম যে, আল্লাহ তাকে সমগ্র বিশ্বের রূপ-সৌন্দর্যের অর্ধেক দান করেছেন’। [7] উল্লেখ্য যে, ছাহাবী বারা ইবনে আযেব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চেহারাকে ‘পূর্ণ চনেদ্রর’ সাথে তুলনা করেছেন’। [8] যেদিকে ইঙ্গিত করেই ফারসী কবি গেয়েছেন-
ﺣﺴﻦ ﻳﻮﺳﻒ ﺩﻡ ﻋﻴﺴﻰ ﻳﺪ ﺑﻴﻀﺎ ﺩﺍﺭﻯ
ﺁﻧﭽﻪ ﺧﻮﺑﻪ ﻫﻤﻪ ﺩﺍﺭﻧﺪ ﺗﻮ ﺗﻨﻬﺎ ﺩﺍﺭﻯ
‘ইউসুফের সৌন্দর্য, ঈসার ফুঁক ও মূসার দীপ্ত হস্ততালু- সবকিছুই যে হে নবী, তোমার মাঝেই একীভূত’।
যুলায়খা-র গর্ভে ইউসুফ (আঃ)-এর দু’টি পুত্র সন্তান হয়। তাদের নাম ছিল ইফরাঈম ও মানশা। ইফরাঈমের একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান হয়। পুত্র ছিলেন ‘নূন’ যার পুত্র ‘ইউশা’ নবী হন এবং কন্যা ছিলেন ‘লাইয়া’ অথবা ‘রাহ্মাহ’, যিনি আইয়ূব (আঃ)-এর স্ত্রী ছিলেন’। [9] উল্লেখ্য যে, বিগত নবীদের বংশ তালিকার অধিকাংশ নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত নয়। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
মিসরে ইউসুফের সময়কাল :
মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব (৮০-১৫০ হিঃ) বলেন, ঐ সময় মিসরের সম্রাট ছিলেন ‘আমালেক্বা’ জাতির জনৈক রাইয়ান ইবনে ওয়ালীদ। তিনি পরবর্তীকালে ইউসুফের কাছে মুসলমান হন এবং ইউসুফকে মিসরের সর্বময় ক্ষমতায় বসিয়ে বলেন, ﻟﺴﺖُ ﺃﻋﻈﻢَ ﻣﻨﻚ ﺇﻻ ﺑﺎﻟﻜﺮﺳﻰ
‘আমি আপনার চাইতে বড় নই, সিংহাসন ব্যতীত’। এ সময় ইউসুফের বয়স ছিল মাত্র ৩০ বছর। [10] পক্ষান্তরে তারীখুল আম্বিয়ার লেখক বলেন, ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনীতে মিসরে যুগ যুগ ধরে রাজত্বকারী ফেরাঊন রাজাদের কোন উল্লেখ না থাকায় অনেকে প্রমাণ করেন যে, ঐ সময় ‘হাকসূস’ রাজারা ‏( ﻣﻠﻮﻙ ﺍﻟﻬﻜﺴﻮﺱ ‏) ফেরাঊনদের হটিয়ে মিসর দখল করেন এবং দু’শো বছর যাবত তারা সেখানে রাজত্ব করেন। যা ছিল ঈসা (আঃ)-এর আবির্ভাবের প্রায় দু’হাযার বছর পূর্বের ঘটনা’। [11]
উল্লেখ্য যে, ইউসুফ (আঃ)-এর সময়কাল ছিল ঈসা (আঃ)-এর অন্যূন আঠারশ’ বছর পূর্বেকার। তবে সুলায়মান মানছূরপুরী বলেন, আনুমানিক ১৬৮৬ বছর পূর্বের। হ’তে পারে কেউ ইউসুফের সময়কালের শুরু থেকে এবং কেউ তাঁর মৃত্যু থেকে হিসাব করেছেন। তবে তাঁর সময় থেকেই বনু ইস্রাঈলগণ মিসরে বসবাস শুরু করে।
শৈশবে ইউসুফের লালন-পালন ও চুরির ঘটনা :
হাফেয ইবনু কাছীর বর্ণনা করেন যে, ইউসুফ-এর জন্মের কিছুকাল পরেই বেনিয়ামীন জন্মগ্রহণ করেন। বেনিয়ামীন জন্মের পরপরই তাদের মায়ের মৃত্যু ঘটে।[12] তখন মাতৃহীন দুই শিশুর লালন-পালনের ভার তাদের ফুফুর উপরে অর্পিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফকে এত বেশী রূপ-লাবণ্য এবং মায়াশীল ব্যবহার দান করেছিলেন যে, যেই-ই তাকে দেখত, সেই-ই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ত। ফুফু তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। একদন্ড চোখের আড়াল হ’তে দিতেন না। এদিকে বিপত্নীক ইয়াকূব (আঃ) মাতৃহীনা দুই শিশু পুত্রের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই অধিকতর দুর্বল এবং সর্বদা ব্যাকুল থাকতেন। ইতিমধ্যে ইউসুফ একটু বড় হ’লে এবং হাঁটাচলা করার মত বয়স হ’লে পিতা ইয়াকূব (আঃ) তাকে ফুফুর নিকট থেকে আনতে চাইলেন। কিন্তু ফুফু তাকে ছাড়তে নারায। ওদিকে পিতাও তাকে নিয়ে আসতে সংকল্পবদ্ধ। শুরু হ’ল পিতা ও ফুফুর মধ্যে মহববতের টানাপড়েন। ফলে ঘটে গেল এক অঘটন।
অধিক পীড়াপীড়ির কারণে ইউসুফকে যখন তার পিতার হাতে তুলে দিতেই হ’ল, তখন স্নেহান্ধ ফুফু গোপনে এক ফন্দি করলেন। তিনি স্বীয় পিতা হযরত ইসহাক্ব (আঃ)-এর নিকট থেকে যে একটা হাঁসুলি পেয়েছিলেন এবং যেটাকে অত্যন্ত মূল্যবান ও বরকতময় মনে করা হ’ত, ফুফু সেই হাঁসুলিটিকে ইউসুফ-এর কাপড়ের নীচে গোপনে বেঁধে দিলেন।
অতঃপর ইউসুফ তার পিতার সাথে চলে যাওয়ার পর ফুফু জোরেশোরে প্রচার শুরু করলেন যে, তার মূল্যবান হাঁসুলিটি চুরি হয়ে গেছে। পরে তল্লাশী করে তা ইউসুফের কাছে পাওয়া গেল। ইয়াকূবী শরী‘আতের বিধান অনুযায়ী ফুফু ইউসুফকে তার গোলাম হিসাবে রাখার অধিকার পেলেন। ইয়াকূব (আঃ)ও দ্বিরুক্তি না করে সন্তানকে তার ফুফুর হাতে পুনরায় সমর্পণ করলেন। এরপর যতদিন ফুফু জীবিত ছিলেন, ততদিন ইউসুফ তার কাছেই রইলেন। [13]
এই ছিল ঘটনা, যাতে ইউসুফ নিজের অজান্তে চুরির অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এরপর বিষয়টি সবার কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল যে, তিনি ছিলেন এ ব্যাপারে একেবারেই নির্দোষ। ফুফুর অপত্য স্নেহই তাকে ঘিরে এ চক্রান্ত জাল বিস্তার করেছিল। এ সত্য কথাটি তার সৎভাইদেরও জানা ছিল। কিন্তু এটাকেই তারা ইউসুফের মুখের উপরে বলে দেয় যখন আরেক বানোয়াট চুরির অভিযোগে বেনিয়ামীনকে মিসরে গ্রেফতার করা হয়। ইউসুফ তাতে দারুণ মনোকষ্ট পেলেও তা চেপে রাখেন।
বলা বাহুল্য, শৈশবে যেমন ইউসুফ স্বীয় ফুফুর স্নেহের ফাঁদে পড়ে চোর (?) সাব্যস্ত হয়ে ফুফুর গোলামী করেন, যৌবনে তেমনি যুলায়খার চক্রান্তে পড়ে মিথ্যা অপবাদে অন্যূন সাত বছর জেল খাটেন- যে ঘটনা পরে বর্ণিত হবে।
ইউসুফ-এর স্বপ্ন :
বালক ইউসুফ একদিন তার পিতা ইয়াকূব (আঃ)-এর কাছে এসে বলল,
ﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَ ﻳُﻮْﺳُﻒُ ﻟِﺄَﺑِﻴْﻪِ ﻳَﺎ ﺃَﺑﺖِ ﺇِﻧِّﻲْ ﺭَﺃَﻳْﺖُ ﺃَﺣَﺪَ ﻋَﺸَﺮَ ﻛَﻮْﻛَﺒﺎً ﻭَّﺍﻟﺸَّﻤْﺲَ ﻭَﺍﻟْﻘَﻤَﺮَ ﺭَﺃَﻳْﺘُﻬُﻢْ ﻟِﻲْ ﺳَﺎﺟِﺪِﻳْﻦَ –
‘আমি স্বপ্ন দেখেছি যে, ১১টি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চন্দ্র আমাকে সিজদা করছে’। একথা শুনে পিতা বললেন, ﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﺑُﻨَﻲَّ ﻻَ ﺗَﻘْﺼُﺺْ ﺭُﺅْﻳَﺎﻙَ ﻋَﻠَﻰ ﺇِﺧْﻮَﺗِﻚَ ﻓَﻴَﻜِﻴْﺪُﻭﺍْ ﻟَﻚَ ﻛَﻴْﺪﺍً ﺇِﻥَّ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥَ ﻟِﻠْﺈِﻧﺴَﺎﻥِ ﻋَﺪُﻭٌّ ﻣُّﺒِﻴْﻦٌ – ‘বৎস, তোমার ভাইদের সামনে এ স্বপ্ন বর্ণনা করো না। তাহ’লে ওরা তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু (ইউসুফ ১২/৪-৫) । ইবনু আববাস (রাঃ) ও ক্বাতাদাহ বলেন, এগারোটি নক্ষত্রের অর্থ হচ্ছে ইউসুফ (আঃ)-এর এগারো ভাই এবং সূর্য ও চন্দ্রের অর্থ পিতা ও মাতা বা খালা’। [14] বস্ত্ততঃ এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রকাশ পায় যখন মিসরে পিতা-পুত্রের মিলন হয়।
উল্লেখ্য যে, স্বপ্ন ব্যাখ্যা করা জ্ঞানের একটি পৃথক শাখা। হযরত ইবরাহীম, ইসহাক্ব ও ইয়াকূব সকলে এ বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। সম্ভবতঃ একারণেই ইয়াকূব (আঃ) নিশ্চিত ধারণা করেছিলেন যে, বালক ইউসুফ একদিন নবী হবে। হযরত ইউসুফকেও আল্লাহ এ ক্ষমতা দান করেছিলেন। যেমন আল্লাহ এদিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন,
ﻭَﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻳَﺠْﺘَﺒِﻴْﻚَ ﺭَﺑُّﻚَ ﻭَﻳُﻌَﻠِّﻤُﻚَ ﻣِﻦ ﺗَﺄْﻭِﻳْﻞِ ﺍﻷَﺣَﺎﺩِﻳْﺚِ ﻭَﻳُﺘِﻢُّ ﻧِﻌْﻤَﺘَﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻚَ ﻭَﻋَﻠَﻰ ﺁﻝِ ﻳَﻌْﻘُﻮْﺏَ ﻛَﻤَﺎ ﺃَﺗَﻤَّﻬَﺎ ﻋَﻠَﻰ ﺃَﺑَﻮَﻳْﻚَ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻞُ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ ﻭَﺇِﺳْﺤَﺎﻕَ ﺇِﻥَّ ﺭَﺑَّﻚَ ﻋَﻠِﻴْﻢٌ ﺣَﻜِﻴْﻢٌ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৬)-
‘এমনিভাবে তোমার পালনকর্তা তোমাকে মনোনীত করবেন (নবী হিসাবে) এবং তোমাকে শিক্ষা দিবেন বাণী সমূহের (অর্থাৎ স্বপ্নাদিষ্ট বাণী সমূহের) নিগুঢ় তত্ত্ব এবং পূর্ণ করবেন স্বীয় অনুগ্রহ সমূহ (যেমন মিসরের রাজত্ব, সর্বোচ্চ সম্মান ও ধন-সম্পদ লাভ এবং পিতার সাথে মিলন প্রভৃতি) তোমার প্রতি ও ইয়াকূব-পরিবারের প্রতি, যেমন তিনি পূর্ণ করেছিলেন ইতিপূর্বে তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাক্বের প্রতি। নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তা সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (ইউসুফ ১২/৬) ।
উপরোক্ত ৫ ও ৬ আয়াতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি ফুটে ওঠে। যেমন, (১) ইয়াকূব (আঃ) ইউসুফের দেখা স্বপ্নকে একটি সত্য স্বপ্ন হিসাবে গণ্য করেছিলেন এবং এটাও উপলব্ধি করেছিলেন যে, ইউসুফ-এর জীবনে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। সেজন্য তার জীবনে আসতে পারে কঠিন পরীক্ষা সমূহ। (২) ভাল স্বপ্নের কথা এমন লোকের কাছে বলা উচিত নয়, যারা তার হিতাকাংখী নয়। সেজন্যেই ইযাকূব (আঃ) বালক ইউসুফকে তার স্বপ্ন বৃত্তান্ত তার সৎ ভাইদের কাছে বলতে নিষেধ করেছিলেন। (৩) ইউসুফকে আল্লাহ তিনটি নে‘মত দানের সুসংবাদ দেন। (ক) আল্লাহ তাকে মনোনীত করেছেন নবী হিসাবে (খ) তাকে স্বপ্ন বৃত্তান্ত ব্যাখ্যা করার যোগ্যতা দান করবেন (গ) তার প্রতি স্বীয় নে‘মত সমূহ পূর্ণ করবেন। বলা বাহুল্য, এগুলির প্রতিটিই পরবর্তীতে বাস্তবায়িত হয়েছে অত্যন্ত সুন্দরভাবে, যা আমরা পরবর্তী কাহিনীতে অবলোকন করব।
এক্ষণে ইউসুফকে উপরোক্ত ৬ আয়াতে বর্ণিত অহী আল্লাহ কখন নাযিল করেছিলেন, সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। তবে ১৫ আয়াতের মর্মে বুঝা যায় যে, তাঁকে কূপে নিক্ষেপ করার আগেই উপরোক্ত অহীর মাধ্যমে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়। এটি নবুঅতের ‘অহিয়ে কালাম’ ছিল না। বরং এটি ছিল মূসার মায়ের কাছে অহী করার ন্যায় ‘অহিয়ে ইলহাম’। কেননা নবুঅতের ‘অহি’ সাধারণতঃ চল্লিশ বছর বয়সে হয়ে থাকে।
ভাইদের হিংসার শিকার হলেন :
এটা একটা স্বভাবগত রীতি যে, বিমাতা ভাইয়েরা সাধারণতঃ পরস্পরের বিদ্বেষী হয়ে থাকে। সম্ভবতঃ এই বিদ্বেষ যাতে মাথাচাড়া না দেয়, সেকারণ ইয়াকূব (আঃ) একই শ্বশুরের পরপর তিন মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। এরপরেও শ্বশুর ছিলেন আপন মামু। পরস্পরে রক্ত সম্পর্কীয় এবং ঘনিষ্ঠ নিকটাত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও এবং নবী পরিবারের সার্বক্ষণিক দ্বীনী পরিবেশ ও নৈতিক প্রশিক্ষণ থাকা সত্ত্বেও বৈমাত্রেয় হিংসার কবল থেকে ইয়াকূব (আঃ)-এর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তানেরা রক্ষা পায়নি। তাই বলা চলে যে, ইউসুফের প্রতি তার সৎভাইদের হিংসার প্রথম কারণ ছিল বৈমাত্রেয় বিদ্বেষ। দ্বিতীয় কারণ ছিল- সদ্য মাতৃহীন শিশু হওয়ার কারণে তাদের দু’ভাইয়ের প্রতি পিতার স্বভাবগত স্নেহের আধিক্য। তৃতীয় কারণ ছিল, ইউসুফের অতুলনীয় রূপ-লাবণ্য, অনিন্দ্যসুন্দর দেহসৌষ্ঠব, আকর্ষণীয় ব্যবহার-মাধুর্য এবং অনন্য সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। চতুর্থ ইউসুফের স্বপ্নবৃত্তান্তের কথা যেকোন ভাবেই হৌক তাদের কানে পৌঁছে যাওয়া। বলা চলে যে, শেষোক্ত কারণটিই তাদের হিংসার আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় এবং তাকে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে দেওয়ার শয়তানী চক্রান্তে তারা প্ররোচিত হয়। কিন্তু শয়তান যতই চক্রান্ত করুক, আল্লাহ বলেন, ﺇِﻥَّ ﻛَﻴْﺪَ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥِ ﻛَﺎﻥَ ﺿَﻌِﻴْﻔًﺎ –
‘শয়তানের চক্রান্ত সর্বদাই দুর্বল হয়ে থাকে’ (নিসা ৪/৭৬) । ইউসুফের মধ্যে ভবিষ্যৎ নবুঅত লুকিয়ে আছে বুঝতে পেরেই ইয়াকূব (আঃ) তার প্রতি অধিক স্নেহশীল ছিলেন। আর সেকারণে সৎ ভাইয়েরাও ছিল অধিক হিংসাপরায়ণ। বস্ত্ততঃ এই হিংসাত্মক আচরণের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ইউসুফের ভবিষ্যৎ উন্নতির সোপান।
ইউসুফ অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হ’লেন :
দশ জন বিমাতা ভাই মিলে ইউসুফকে হত্যার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য তাকে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতারণার আশ্রয় নিল। তারা একদিন পিতা ইয়াকূব (আঃ)-এর কাছে এসে ইউসুফকে সাথে নিয়ে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে আনন্দ ভ্রমণে যাবার প্রস্তাব করল। তারা পিতাকে বলল যে, ‘আপনি তাকে আগামীকাল আমাদের সাথে প্রেরণ করুন। সে আমাদের সঙ্গে যাবে, তৃপ্তিসহ খাবে আর খেলাধূলা করবে এবং আমরা অবশ্যই তার রক্ষণাবেক্ষণ করব’। জবাবে পিতা বললেন, আমার ভয় হয় যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে, আর কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে তাকে বাঘে খেয়ে ফেলবে’। ‘তারা বলল, আমরা এতগুলো ভাই থাকতে তাকে বাঘে খেয়ে ফেলবে, তাহ’লে তো আমাদের সবই শেষ হয়ে যাবে’ (ইউসুফ ১২/১২-১৪) । উল্লেখ্য যে, কেন‘আন অঞ্চলে সে সময়ে বাঘের প্রাদুর্ভাব ছিল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) প্রমুখাত বর্ণিত হয়েছে যে, ইয়াকূব (আঃ) পূর্বরাতে স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, তিনি পাহাড়ের উপরে আছেন। নীচে পাহাড়ের পাদদেশে ইউসুফ খেলা করছে। হঠাৎ দশটি বাঘ এসে তাকে ঘেরাও করে ফেলে এবং আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু তাদের মধ্যকার একটি বাঘ এসে তাকে মুক্ত করে দেয়। অতঃপর ইউসুফ মাটির ভিতরে লুকিয়ে যায়’। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন যে, উক্ত স্বপ্নের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইয়াকূব (আঃ) তার দশ পুত্রকেই দশ ব্যাঘ্র গণ্য করেছিলেন। কিন্তু তাদের কাছে রূপকভাবে সেটা পেশ করেন। যাতে তারা বুঝতে না পারে (কুরতুবী) ।
যাইহোক ছেলেদের পীড়াপীড়িতে অবশেষে তিনি রাযী হলেন। কিন্তু তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলেন যাতে তারা ইউসুফকে কোনরূপ কষ্ট না দেয় এবং তার প্রতি সর্বদা খেয়াল রাখে। অতঃপর তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্র ইয়াহুদা বা রুবীল-এর হাতে ইউসুফকে সোপর্দ করলেন এবং বললেন, তুমিই এর খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য সকল ব্যাপারে দেখাশুনা করবে। কিন্তু জঙ্গলে পৌঁছেই শয়তানী চক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্য তারা তৎপর হয়ে উঠলো। তারা ইউসুফকে হত্যা করার জন্য প্রস্ত্তত হ’ল। তখন বড় ভাই ইয়াহুদা তাদের বাধা দিল এবং পিতার নিকটে তাদের অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। কিন্তু শয়তান তাদেরকে আরও বেশী যেদী করে তুলল। অবশেষে বড় ভাই একা পেরে না উঠে প্রস্তাব করল, বেশ তবে ওকে হত্যা না করে বরং ঐ দূরের একটা পরিত্যক্ত কূয়ায় ফেলে দাও। যাতে কোন পথিক এসে ওকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তাতে তোমাদের দু’টো লাভ হবে। এক- সে পিতার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে ও তোমরা তখন পিতার নিকটবর্তী হবে। দুই- নিরপরাধ বালককে হত্যা করার পাপ থেকে তোমরা বেঁচে যাবে।
ভাইদের এই চক্রান্তের কথা আল্লাহ ব্যক্ত করেছেন নিম্নোক্তভাবে-
ﻟَﻘَﺪْ ﻛَﺎﻥَ ﻓِﻲْ ﻳُﻮﺳُﻒَ ﻭَﺇِﺧْﻮَﺗِﻪِ ﺁﻳَﺎﺕٌ ﻟِّﻠﺴَّﺎﺋِﻠِﻴْﻦَ، ﺇِﺫْ ﻗَﺎﻟُﻮﺍْ ﻟَﻴُﻮْﺳُﻒُ ﻭَﺃَﺧُﻮْﻩُ ﺃَﺣَﺐُّ ﺇِﻟَﻰ ﺃَﺑِﻴْﻨَﺎ ﻣِﻨَّﺎ ﻭَﻧَﺤْﻦُ ﻋُﺼْﺒَﺔٌ ﺇِﻥَّ ﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﻟَﻔِﻲْ ﺿَﻼَﻝٍ ﻣُّﺒِﻴْﻦٍ، ﺍﻗْﺘُﻠُﻮﺍْ ﻳُﻮﺳُﻒَ ﺃَﻭِ ﺍﻃْﺮَﺣُﻮْﻩُ ﺃَﺭْﺿﺎً ﻳَﺨْﻞُ ﻟَﻜُﻢْ ﻭَﺟْﻪُ ﺃَﺑِﻴﻜُﻢْ ﻭَﺗَﻜُﻮْﻧُﻮﺍْ ﻣِﻦ ﺑَﻌْﺪِﻩِ ﻗَﻮْﻣﺎً ﺻَﺎﻟِﺤِﻴْﻦَ، ﻗَﺎﻝَ ﻗَﺂﺋِﻞٌ ﻣَّﻨْﻬُﻢْ ﻻَ ﺗَﻘْﺘُﻠُﻮﺍْ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ﻭَﺃَﻟْﻘُﻮْﻩُ ﻓِﻲ ﻏَﻴَﺎﺑَﺔِ ﺍﻟْﺠُﺐِّ ﻳَﻠْﺘَﻘِﻄْﻪُ ﺑَﻌْﺾُ ﺍﻟﺴَّﻴَّﺎﺭَﺓِ ﺇِﻥْ ﻛُﻨﺘُﻢْ ﻓَﺎﻋِﻠِﻴْﻦَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৭-১০)-
‘নিশ্চয়ই ইউসুফ ও তার ভাইদের কাহিনীতে জিজ্ঞাসুদের জন্য রয়েছে নিদর্শনাবলী’ (৭) । ‘যখন তারা বলল, অবশ্যই ইউসুফ ও তার ভাই আমাদের পিতার কাছে আমাদের চাইতে অধিক প্রিয়। অথচ আমরা একটা ঐক্যবদ্ধ শক্তি বিশেষ। নিশ্চয়ই আমাদের পিতা স্পষ্ট ভ্রান্তিতে রয়েছেন’ (৮) । ‘তোমরা ইউসুফকে হত্যা কর অথবা তাকে কোথাও ফেলে আস। এতে শুধু তোমাদের প্রতিই তোমাদের পিতার মনোযোগ নিবিষ্ট হবে এবং এরপর তোমরাই (পিতার নিকটে) যোগ্য বিবেচিত হয়ে থাকবে’ (৯) । ‘তখন তাদের মধ্যেকার একজন (বড় ভাই) বলে উঠল, তোমরা ইউসুফকে হত্যা করো না, বরং ফেলে দাও তাকে অন্ধকূপে, যাতে কোন পথিক তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়, যদি একান্তই তোমাদের কিছু করতে হয়’ (ইউসুফ ১২/৭-১০) ।
বড় ভাইয়ের কথায় সবাই একমত হয়ে ইউসুফকে কূয়ার ধারে নিয়ে গেল। এ সময় তারা তার গায়ের জামা খুলে নিল। নিঃসন্দেহে ধরে নেওয়া যায় যে, এ সময় ৬/৭ বছরের কচি বালক ইউসুফ তার ভাইদের কাছে নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল। কিন্তু শয়তান তাদেরকে হিংসায় উন্মত্ত করে দিয়েছিল। এই কঠিন মুহূর্তে ইউসুফকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ তার নিকটে অহী নাযিল করেন। নিঃসন্দেহে এটি নবুঅতের অহী ছিল না। কেননা সাধারণতঃ চল্লিশ বছর বয়স হওয়ার পূর্বে আল্লাহ কাউকে নবী করেন না। এ অহী ছিল সেইরূপ, যেরূপ অহী বা ইলহাম এসেছিল শিশু মূসার মায়ের কাছে মূসাকে বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেবার জন্য (ত্বোয়াহা ২০/৩৮-৩৯) ।
এ সময়কার মর্মন্তুদ অবস্থা আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবে,
ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺫَﻫَﺒُﻮْﺍ ﺑِﻪِ ﻭَﺃَﺟْﻤَﻌُﻮْﺍ ﺃَﻥ ﻳَﺠْﻌَﻠُﻮْﻩُ ﻓِﻲْ ﻏَﻴَﺎﺑَﺔِ ﺍﻟْﺠُﺐِّ ﻭَﺃَﻭْﺣَﻴْﻨَﺎ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﻟَﺘُﻨَﺒِّﺌَﻨَّﻬُﻢ ﺑِﺄَﻣْﺮِﻫِﻢْ ﻫَـﺬَﺍ ﻭَﻫُﻢْ ﻻَ ﻳَﺸْﻌُﺮُﻭْﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ১৫)-
‘যখন তারা তাকে নিয়ে চলল এবং অন্ধকূপে নিক্ষেপ করতে একমত হ’ল, এমতাবস্থায় আমি তাকে (ইউসুফকে) অহী (ইলহাম) করলাম যে, (এমন একটা দিন আসবে, যখন) অবশ্যই তুমি তাদেরকে তাদের এ কুকর্মের কথা অবহিত করবে। অথচ তারা তোমাকে চিনতে পারবে না’ (ইউসুফ ১২/১৫) ।
ইমাম কুরতুবী বলেন যে, কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বেই অথবা পরে ইউসুফকে সান্ত্বনা ও মুক্তির সুসংবাদ দিয়ে এ অহী নাযিল হয়েছিল। ইউসুফকে তার ভাইয়েরা কূপে নিক্ষেপ করল। সেখানেও আল্লাহ তাকে সাহায্য করলেন। তিনি কূয়ার নীচে একখন্ড পাথরের উপরে স্বচ্ছন্দে বসে পড়লেন। বড় ভাই ইয়াহুদা গোপনে তার জন্য দৈনিক একটা পাত্রের মাধ্যমে উপর থেকে খাদ্য ও পানীয় নামিয়ে দিত এবং দূর থেকে সর্বক্ষণ তদারকি করত।
পিতার নিকটে ভাইদের কৈফিয়ত :
ইউসুফকে অন্ধকূপে ফেলে দিয়ে একটা ছাগলছানা যবেহ করে তার রক্ত ইউসুফের পরিত্যক্ত জামায় মাখিয়ে তারা সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরল এবং কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে হাযির হয়ে ইউসুফকে বাঘে নিয়ে গেছে বলে কৈফিয়ত পেশ করল। প্রমাণ স্বরূপ তারা ইউসুফের রক্ত মাখা জামা পেশ করল। হতভাগারা এটা বুঝেনি যে, বাঘে নিয়ে গেলে জামাটা খুলে রেখে যায় না। আর খুললেও বাঘের নখের অাঁচড়ে জামা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার কথা। তাছাড়া যে পিতার কাছে তারা মিথ্যা কৈফিয়ত পেশ করছে, তিনি একজন নবী। অহীর মাধ্যমে তিনি সবই জানতে পারবেন। কিন্তু হিংসায় অন্ধ হয়ে গেলে মানুষ সবকিছু ভুলে যায়।
ইউসুফের ভাইদের দেওয়া কৈফিয়ত ও পিতার প্রতিক্রিয়া আল্লাহ বর্ণনা করেন নিম্নোক্ত রূপে,
ﻭَﺟَﺎﺅُﻭْﺍ ﺃَﺑَﺎﻫُﻢْ ﻋِﺸَﺎﺀً ﻳَّﺒْﻜُﻮْﻥَ، ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﺇِﻧَّﺎ ﺫَﻫَﺒْﻨَﺎ ﻧَﺴْﺘَﺒِﻖُ ﻭَﺗَﺮَﻛْﻨَﺎ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ﻋِﻨْﺪَ ﻣَﺘَﺎﻋِﻨَﺎ ﻓَﺄَﻛَﻠَﻪُ ﺍﻟﺬِّﺋْﺐُ ﻭَﻣَﺎ ﺃَﻧْﺖَ ﺑِﻤُﺆْﻣِﻦٍ ﻟَّﻨَﺎ ﻭَﻟَﻮْ ﻛُﻨَّﺎ ﺻَﺎﺩِﻗِﻴْﻦَ، ﻭَﺟَﺂﺅُﻭْﺍ ﻋَﻠَﻰ ﻗَﻤِﻴْﺼِﻪِ ﺑِﺪَﻡٍ ﻛَﺬِﺏٍ ﻗَﺎﻝَ ﺑَﻞْ ﺳَﻮَّﻟَﺖْ ﻟَﻜُﻢْ ﺃَﻧﻔُﺴُﻜُﻢْ ﺃَﻣْﺮﺍً ﻓَﺼَﺒْﺮٌ ﺟَﻤِﻴﻞٌ ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﺍﻟْﻤُﺴْﺘَﻌَﺎﻥُ ﻋَﻠَﻰ ﻣَﺎ ﺗَﺼِﻔُﻮْﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ১৬-১৮ ‏) –
‘তারা (ভাইয়েরা) রাতের বেলায় কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে এল’। ‘এবং বলল, হে পিতা! আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করছিলাম এবং ইউসুফকে আসবাবপত্রের কাছে বসিয়ে রেখেছিলাম। এমতাবস্থায় তাকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না, যদিও আমরা সত্যবাদী’। ‘এ সময় তারা তার মিথ্যা রক্ত মাখানো জামা হাযির করল। (এটা দেখে অবিশ্বাস করে ইয়াকূব বললেন, কখনোই নয়) বরং তোমাদের মন তোমাদের জন্য একটা কথা তৈরী করে দিয়েছে। (এখন আর করার কিছুই নেই), অতএব ‘ছবর করাই শ্রেয়। তোমরা যা কিছু বললে তাতে আল্লাহই আমার একমাত্র সাহায্যস্থল’
(ইউসুফ ১২/১৬-১৮) ।
কাফেলার হাতে ইউসুফ :
সিরিয়া থেকে মিসরে যাওয়ার পথে একটি ব্যবসায়ী কাফেলা পথ ভুলে জঙ্গলের মধ্যে উক্ত পরিত্যক্ত কূয়ার নিকটে এসে তাঁবু ফেলে। [15] তারা পানির সন্ধানে তাতে বালতি নিক্ষেপ করল। কিন্তু বালতিতে উঠে এল তরতাযা সুন্দর একটি বালক ‘ইউসুফ’। সাধারণ দৃষ্টিতে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হ’লেও সবকিছুই ছিল আল্লাহর পূর্ব পরিকল্পিত এবং পরস্পর সংযুক্ত অটুট ব্যবস্থাপনারই অংশ। ইউসুফকে উদ্ধার করার জন্যই আল্লাহ উক্ত কাফেলাকে পথ ভুলিয়ে এখানে এনেছেন। তাঁর গোপন রহস্য বুঝবার সাধ্য বান্দার নেই। আবুবকর ইবনু আইয়াশ বলেন, ইউসুফ কূয়াতে তিনদিন ছিলেন। [16] কিন্তু আহলে কিতাবগণ বলেন, সকালে নিক্ষেপের পর সন্ধ্যার আগেই ব্যবসায়ী কাফেলা তাকে তুলে নেয়। [17] আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
কাফেলার মধ্যকার জনৈক ব্যক্তির নিক্ষিপ্ত বালতিতে ইউসুফ উপরে উঠে আসেন। অনিন্দ্য সুন্দর বালক দেখে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলো ‘কি আনন্দের কথা। এ যে একটি বালক!’ এরপর তারা তাকে মালিকবিহীন পণ্যদ্রব্য মনে করে লুকিয়ে ফেলল। কেননা সেযুগে মানুষ কেনাবেচা হ’ত। কিন্তু তারা গোপন করতে পারল না। কারণ ইতিমধ্যে ইউসুফের বড় ভাই এসে কূয়ায় তাকে না পেয়ে অনতিদূরে কাফেলার খোঁজ পেয়ে গেল। তখন সে কাফেলার কাছে গিয়ে বলল, ছেলেটি আমাদের পলাতক গোলাম। তোমরা ওকে আমাদের কাছ থেকে খরিদ করে নিতে পার’। কাফেলা ভাবল খরিদ করে না নিলে চোর সাব্যস্ত হয়ে যেতে পারি। অতএব তারা দশ ভাইকে হাতে গণা কয়েকটি দিরহাম দিয়ে নিতান্ত সস্তা মূল্যে ইউসুফকে খরিদ করে নিল। এর দ্বারা ইউসুফের ভাইদের দু’টি উদ্দেশ্য ছিল। এক- যাতে ইউসুফ তার বাপ-ভাইদের নাম করে পুনরায় বাড়ী ফিরে আসার সুযোগ না পায়। দুই- যাতে ইউসুফ দেশান্তরী হয়ে যায় ও অন্যের ক্রীতদাস হয়ে জীবন অতিবাহিত করে এবং কখনোই দেশে ফিরতে না পারে। এই সময়কার দৃশ্য কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে। নিজের ভাইয়েরা ইউসুফকে পরদেশী কাফেলার হাতে তাদের পলাতক গোলাম হিসাবে বিক্রি করে দিচ্ছে। নবীপুত্র ইউসুফের মনের অবস্থা ঐ সময় কেমন হচ্ছিল। কল্পনা করা যায় কি? বালক ইউসুফ ঐ সময় বাড়ী যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তেমন কোন কথা কুরআনে বর্ণিত হয়নি। তাতে মনে হয়, বিক্রয়ের ঘটনাটি তার অগোচরে ঘটেছিল। ভাইদের সাথে পুনরায় দেখা হয়নি (আল্লাহ সর্বাধিক অবগত)। ইউসুফকে কূয়া থেকে উদ্ধার ও পরে পলাতক গোলাম হিসাবে স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করে দেবার ঘটনা আল্লাহর ভাষায় নিম্নরূপ-
ﻭَﺟَﺂﺀَﺕْ ﺳَﻴَّﺎﺭَﺓٌ ﻓَﺄَﺭْﺳَﻠُﻮﺍْ ﻭَﺍﺭِﺩَﻫُﻢْ ﻓَﺄَﺩْﻟَﻰ ﺩَﻟْﻮَﻩُ ﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﺑُﺸْﺮَﻯ ﻫَـﺬَﺍ ﻏُﻼَﻡٌ ﻭَﺃَﺳَﺮُّﻭْﻩُ ﺑِﻀَﺎﻋَﺔً ﻭَﺍﻟﻠﻪ ُ ﻋَﻠِﻴْﻢٌ ﺑِﻤَﺎ ﻳَﻌْﻤَﻠُﻮْﻥَ – ﻭَﺷَﺮَﻭْﻩُ ﺑِﺜَﻤَﻦٍ ﺑَﺨْﺲٍ ﺩَﺭَﺍﻫِﻢَ ﻣَﻌْﺪُﻭْﺩَﺓٍ ﻭَﻛَﺎﻧُﻮﺍْ ﻓِﻴْﻪِ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺰَّﺍﻫِﺪِﻳْﻦَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ১৯-২০ ‏) –
‘অতঃপর একটা কাফেলা এল এবং তারা তাদের পানি সংগ্রহকারীকে পাঠালো। সে বালতি নিক্ষেপ করল। (বালতিতে ইউসুফের উঠে আসা দেখে সে খুশীতে বলে উঠল) কি আনন্দের কথা! এযে একটি বালক! অতঃপর তারা তাকে পণ্যদ্রব্য গণ্য করে গোপন করে ফেলল। আল্লাহ ভালই জানেন, যা কিছু তারা করেছিল’। ‘অতঃপর ওরা (ইউসুফের ভাইয়েরা) তাকে কম মূল্যে বিক্রয় করে দিল হাতে গণা কয়েকটি দিরহামের (রৌপ্যমুদ্রার) বিনিময়ে এবং তারা তার (অর্থাৎ ইউসুফের) ব্যাপারে নিরাসক্ত ছিল’ (ইউসুফ ১২/১৯-২০) । মূলতঃ ইউসুফকে দূরে সরিয়ে দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য ছিল।
ইউসুফ মিসরের অর্থমন্ত্রীর গৃহে :
অন্ধকূপ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পর ব্যবসায়ী কাফেলা তাকে বিক্রির জন্য মিসরের বাজারে উপস্থিত করল। মানুষ কেনা-বেচার সেই হাটে এই অনিন্দ্য সুন্দর বালককে দেখে বড় বড় ধনশালী খরিদ্দাররা রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু করল। কিন্তু আল্লাহ পাক তাকে মর্যাদার স্থানে সমুন্নত করতে চেয়েছিলেন। তাই সব খরিদ্দারকে ডিঙিয়ে মিসরের তৎকালীন অর্থ ও রাজস্বমন্ত্রী ক্বিৎফীর ‏( ﻗﻄﻔﻴﺮ ‏) তাকে বহুমূল্য দিয়ে খরিদ করে নিলেন। ক্বিৎফীর ছিলেন নিঃসন্তান।
মিসরের অর্থমন্ত্রীর উপাধি ছিল ‘আযীয’ বা ‘আযীয মিছর’। ইউসুফকে ক্রয় করে এনে তিনি তাকে স্বীয় স্ত্রীর হাতে সমর্পণ করলেন এবং বললেন, একে সন্তানের ন্যায় উত্তম রূপে লালন-পালন কর। এর থাকার জন্য উত্তম ব্যবস্থা কর। ভবিষ্যতে সে আমাদের কল্যাণে আসবে’। বস্ত্ততঃ ইউসুফের কমনীয় চেহারা ও নম্র-ভদ্র ব্যবহারে তাদের মধ্যে সন্তানের মমতা জেগে ওঠে। ক্বিৎফীর তার দূরদর্শিতার মাধ্যমে ইউসুফের মধ্যে ভবিষ্যতের অশেষ কল্যাণ দেখতে পেয়েছিলেন। আর সেজন্য তাকে সর্বোত্তম যত্ন সহকারে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। মূলতঃ এসবই ছিল আল্লাহর পূর্ব-নির্ধারিত। এ বিষয়ে কুরআনী বক্তব্য নিম্নরূপঃ
ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﺍﺷْﺘَﺮَﺍﻩُ ﻣِﻦ ﻣِّﺼْﺮَ ﻻِﻣْﺮَﺃَﺗِﻪِ ﺃَﻛْﺮِﻣِﻲْ ﻣَﺜْﻮَﺍﻩُ ﻋَﺴَﻰ ﺃَﻥ ﻳَّﻨْﻔَﻌَﻨَﺎ ﺃَﻭْ ﻧَﺘَّﺨِﺬَﻩُ ﻭَﻟَﺪﺍً ﻭَﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻣَﻜَّﻨِّﺎ ﻟِﻴُﻮْﺳُﻒَ ﻓِﻲ ﺍﻷَﺭْﺽِ ﻭَﻟِﻨُﻌَﻠِّﻤَﻪُ ﻣِﻦْ ﺗَﺄْﻭِﻳْﻞِ ﺍﻷَﺣَﺎﺩِﻳْﺚِ ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﻏَﺎﻟِﺐٌ ﻋَﻠَﻰ ﺃَﻣْﺮِﻩِ ﻭَﻟَـﻜِﻦَّ ﺃَﻛْﺜَﺮَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻻَ ﻳَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ২১)-
‘মিসরে যে ব্যক্তি তাকে ক্রয় করল, সে তার স্ত্রীকে বলল, একে সম্মানজনকভাবে থাকার ব্যবস্থা কর। সম্ভবতঃ সে আমাদের কল্যাণে আসবে অথবা আমরা তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করে নেব। এভাবে আমরা ইউসুফকে সেদেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম এবং এজন্যে যে তাকে আমরা বাক্যাদির পূর্ণ মর্ম অনুধাবনের পদ্ধতি বিষয়ে শিক্ষা দেই। আল্লাহ স্বীয় কর্মে সর্বদা বিজয়ী। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না’ (ইউসুফ ১২/২১) ।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, দুনিয়াতে তিন ব্যক্তি ছিলেন সর্বাধিক সূক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পন্ন ‏( ﺃﻓﺮﺱ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﺛﻼﺛﺔ ‏) । একজন হ’লেন ‘আযীযে মিছর’ (যিনি ইউসুফের চেহারা দেখেই তাঁকে চিনেছিলেন)। দ্বিতীয় শো‘আয়েব (আঃ)-এর ঐ কন্যা, যে মূসা (আঃ) সম্পর্কে স্বীয় পিতাকে বলেছিল, হে পিতা! আপনি এঁকে আপনার কর্মসহযোগী হিসাবে রেখে দিন। কেননা উত্তম সহযোগী সেই-ই, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত হয়’
(ক্বাছাছ ২৮/২৬) । তৃতীয় হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব, যিনি ওমর ফারূককে পরবর্তী খলীফা নিয়োগ করেছিলেন’।
[18]
ইউসুফ যৌবনে পদার্পণ করলেন
আযীযে মিছরের গৃহে কয়েক বছর পুত্র স্নেহে লালিত পালিত হয়ে ইউসুফ অতঃপর যৌবনে পদার্পণ করলেন। আল্লাহ বলেন,
ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﺑَﻠَﻎَ ﺃَﺷُﺪَّﻩُ ﺁﺗَﻴْﻨَﺎﻩُ ﺣُﻜْﻤﺎً ﻭَّﻋِﻠْﻤﺎً ﻭَﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻧَﺠْﺰِﻱ ﺍﻟْﻤُﺤْﺴِﻨِﻴْﻦَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ২২)-
‘অতঃপর যখন সে পূর্ণ যৌবনে পৌঁছে গেল, তখন আমরা তাকে প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি দান করলাম। আমরা এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি’ (ইউসুফ ১২/২২) ।
উক্ত আয়াতে দু’টি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। পূর্ণ যৌবন প্রাপ্তি এবং প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি লাভ করা। সকলে এ বিষয়ে একমত যে, প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি লাভের অর্থ হ’ল নবুঅত লাভ করা। আর সেটা সাধারণতঃ চল্লিশ বছর বয়সে হয়ে থাকে। অন্যদিকে পূর্ণ যৌবন লাভ তার পূর্বেই হয়। যা বিশ বছর থেকে ত্রিশ বা তেত্রিশের মধ্যে হয়ে থাকে। হযরত ইবনু আববাস, মুজাহিদ, ক্বাতাদাহ প্রমুখ বিদ্বান তেত্রিশ বছর বলেছেন এবং যাহহাক বিশ বছর বলেছেন। যাহহাক সম্ভবতঃ প্রথম যৌবন এবং ইবনু আববাস পূর্ণ যৌবনের কথা বলেছেন।
এক্ষণে ইউসুফের প্রতি যুলায়খার আসক্তির ঘটনা নবুঅত লাভের পূর্বের না পরের, এ বিষয়ে বিদ্বানগণ একমত নন। আমাদের প্রবল ধারণা এই যে, যদিও যৌবন ও নবুঅতের কথা একই আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তথাপি ঘটনা একই সময়ের নয়। নবুঅত তিনি চল্লিশ বছর বয়সেই পেয়েছেন ধরে নিলে যুলায়খার ঘটনা অবশ্যই তার পূর্বে তার পূর্ণ যৌবনেই ঘটেছে। কারণ ঐ সময় ইউসুফের রূপ-লাবণ্য নিশ্চয়ই শৈশবের ও প্রৌঢ় বয়সের চাইতে বেশী ছিল, যা যুলায়খার ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়। অথচ ইউসুফের চরিত্রের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। কেননা নবীগণ ছোটবেলা থেকেই পাপ হ’তে পবিত্র থাকেন।
যৌবনের মহা পরীক্ষায় ইউসুফ :
রূপ-লাবণ্যে ভরা ইউসুফের প্রতি মন্ত্রীপত্নী যুলায়খার অন্যায় আকর্ষণ জেগে উঠলো। সে ইউসুফকে খারাব ইঙ্গিত দিতে লাগল। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺭَﺍﻭَﺩَﺗْﻪُ ﺍﻟَّﺘِﻲْ ﻫُﻮَ ﻓِﻲْ ﺑَﻴْﺘِﻬَﺎ ﻋَﻦ ﻧَّﻔْﺴِﻪِ ﻭَﻏَﻠَّﻘَﺖِ ﺍﻷَﺑْﻮَﺍﺏَ ﻭَﻗَﺎﻟَﺖْ ﻫَﻴْﺖَ ﻟَﻚَ ﻗَﺎﻝَ ﻣَﻌَﺎﺫَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺇِﻧَّﻪُ ﺭَﺑِّﻲ ﺃَﺣْﺴَﻦَ ﻣَﺜْﻮَﺍﻱَ ﺇِﻧَّﻪُ ﻻَ ﻳُﻔْﻠِﺢُ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤُﻮْﻥَ – ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﻫَﻤَّﺖْ ﺑِﻪِ ﻭَﻫَﻢَّ ﺑِﻬَﺎ ﻟَﻮْﻻ ﺃَﻥ ﺭَّﺃَﻯ ﺑُﺮْﻫَﺎﻥَ ﺭَﺑِّﻪِ ﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻟِﻨَﺼْﺮِﻑَ ﻋَﻨْﻪُ ﺍﻟﺴُّﻮﺀَ ﻭَﺍﻟْﻔَﺤْﺸَﺎﺀَ ﺇِﻧَّﻪُ ﻣِﻦْ ﻋِﺒَﺎﺩِﻧَﺎ ﺍﻟْﻤُﺨْﻠَﺼِﻴْﻦَ – ﻭَﺍﺳْﺘَﺒَﻘَﺎ ﺍﻟْﺒَﺎﺏَ ﻭَﻗَﺪَّﺕْ ﻗَﻤِﻴﺼَﻪُ ﻣِﻦ ﺩُﺑُﺮٍ ﻭَﺃَﻟْﻔَﻴَﺎ ﺳَﻴِّﺪَﻫَﺎ ﻟَﺪَﻯ ﺍﻟْﺒَﺎﺏِ ﻗَﺎﻟَﺖْ ﻣَﺎ ﺟَﺰَﺍﺀُ ﻣَﻦْ ﺃَﺭَﺍﺩَ ﺑِﺄَﻫْﻠِﻚَ ﺳُﻮْﺀﺍً ﺇِﻻَّ ﺃَﻥ ﻳُّﺴْﺠَﻦَ ﺃَﻭْ ﻋَﺬَﺍﺏٌ ﺃَﻟِﻴﻢٌ – ﻗَﺎﻝَ ﻫِﻲَ ﺭَﺍﻭَﺩَﺗْﻨِﻲ ﻋَﻦ ﻧَّﻔْﺴِﻲ ﻭَﺷَﻬِﺪَ ﺷَﺎﻫِﺪٌ ﻣِّﻦْ ﺃَﻫْﻠِﻬَﺎ ﺇِﻥْ ﻛَﺎﻥَ ﻗَﻤِﻴْﺼُﻪُ ﻗُﺪَّ ﻣِﻦ ﻗُﺒُﻞٍ ﻓَﺼَﺪَﻗَﺖْ ﻭَﻫُﻮَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻜَﺎﺫِﺑِﻴْﻦَ – ﻭَﺇِﻥْ ﻛَﺎﻥَ ﻗَﻤِﻴْﺼُﻪُ ﻗُﺪَّ ﻣِﻦ ﺩُﺑُﺮٍ ﻓَﻜَﺬَﺑَﺖْ ﻭَﻫُﻮَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴْﻦَ – ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺭَﺃَﻯ ﻗَﻤِﻴْﺼَﻪُ ﻗُﺪَّ ﻣِﻦ ﺩُﺑُﺮٍ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﻧَّﻪُ ﻣِﻦْ ﻛَﻴْﺪِﻛُﻦَّ ﺇِﻥَّ ﻛَﻴْﺪَﻛُﻦَّ ﻋَﻈِﻴْﻢٌ – ﻳُﻮﺳُﻒُ ﺃَﻋْﺮِﺽْ ﻋَﻦْ ﻫَـﺬَﺍ ﻭَﺍﺳْﺘَﻐْﻔِﺮِﻱْ ﻟِﺬَﻧْﺒِﻚِ ﺇِﻧَّﻚِ ﻛُﻨْﺖِ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﺨَﺎﻃِﺌِﻴْﻦَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ২৩-২৯)-
‘আর সে যে মহিলার বাড়ীতে থাকত, ঐ মহিলা তাকে ফুসলাতে লাগল এবং (একদিন) দরজা সমূহ বন্ধ করে দিয়ে বলল, কাছে এসো! ইউসুফ বলল, আল্লাহ আমাকে রক্ষা করুন! তিনি (অর্থাৎ আপনার স্বামী) আমার মনিব। তিনি আমার উত্তম বসবাসের ব্যবস্থা করেছেন। নিশ্চয়ই সীমা লংঘনকারীগণ সফলকাম হয় না’ (২৩) । ‘উক্ত মহিলা তার বিষয়ে কুচিন্তা করেছিল এবং ইউসুফ তার প্রতি (অনিচ্ছাকৃত) কল্পনা করেছিল। যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করত’ (অর্থাৎ আল্লাহ নির্ধারিত উপদেশদাতা ‘নফসে লাউয়ামাহ’ তথা শাণিত বিবেক যদি তাকে কঠোরভাবে বাধা না দিত)। এভাবেই এটা এজন্য হয়েছে যাতে আমরা তার থেকে যাবতীয় মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয়ই সে আমাদের মনোনীত বান্দাগণের একজন’ (২৪) । ‘তারা উভয়ে ছুটে দরজার দিকে গেল এবং মহিলাটি ইউসুফের জামা পিছন দিক থেকে ছিঁড়ে ফেলল। উভয়ে মহিলার স্বামীকে দরজার মুখে পেল। তখন মহিলাটি তাকে বলল, যে ব্যক্তি তোমার স্ত্রীর সাথে অন্যায় বাসনা করে, তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা অথবা (অন্য কোন) যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেওয়া ব্যতীত আর কি সাজা হ’তে পারে’?
(২৫) । ‘ইউসুফ বলল, সেই-ই আমাকে (তার কুমতলব সিদ্ধ করার জন্য) ফুসলিয়েছে। তখন মহিলার পরিবারের জনৈক ব্যক্তি সাক্ষ্য দিল যে, যদি ইউসুফের জামা সামনের দিকে ছেঁড়া হয়, তাহ’লে মহিলা সত্য কথা বলেছে এবং ইউসুফ মিথ্যাবাদী’ (২৬) । ‘আর যদি তার জামা পিছন দিক থেকে ছেঁড়া হয়, তবে মহিলা মিথ্যা বলেছে এবং ইউসুফ সত্যবাদী’ (২৭) । ‘অতঃপর গৃহস্বামী যখন দেখল যে, ইউসুফের জামা পিছন দিক থেকে ছেঁড়া, তখন সে (স্বীয় স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে) বলল, এটা তোমাদের ছলনা। নিঃসন্দেহে তোমাদের ছলনা খুবই মারাত্মক’ (২৮) । (অতঃপর তিনি ইউসুফকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,) ‘ইউসুফ! এ প্রসঙ্গ ছাড়। আর হে মহিলা! এ পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চিতভাবে তুমিই পাপাচারিনী’
(ইউসুফ ১২/২৩-২৯) ।
মহিলাদের সমাবেশে ইউসুফ :
গৃহস্বামী দু’জনকে নিরস্ত করে ঘটনা চেপে যেতে বললেও ঘটনা চেপে থাকেনি। বরং নানা ডাল-পালা গজিয়ে শহরময় বাষ্ট্র হয়ে গেল যে, আযীযের স্ত্রী স্বীয় পুত্রসম গোলামের সাথে অন্যায় কর্মে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তখন বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য যুলায়খা শহরের উচ্চশ্রেণীর মহিলাদের নিজ বাড়ীতে ভোজসভায় দাওয়াত দেবার মনস্থ করল। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপঃ
ﻭَﻗَﺎﻝَ ﻧِﺴْﻮَﺓٌ ﻓِﻲ ﺍﻟْﻤَﺪِﻳْﻨَﺔِ ﺍﻣْﺮَﺃَﺓُ ﺍﻟْﻌَﺰِﻳْﺰِ ﺗُﺮَﺍﻭِﺩُ ﻓَﺘَﺎﻫَﺎ ﻋَﻦ ﻧَّﻔْﺴِﻪِ ﻗَﺪْ ﺷَﻐَﻔَﻬَﺎ ﺣُﺒًّﺎ ﺇِﻧَّﺎ ﻟَﻨَﺮَﺍﻫَﺎ ﻓِﻲْ ﺿَﻼَﻝٍ ﻣُّﺒِﻴْﻦٍ – ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺳَﻤِﻌَﺖْ ﺑِﻤَﻜْﺮِﻫِﻦَّ ﺃَﺭْﺳَﻠَﺖْ ﺇِﻟَﻴْﻬِﻦَّ ﻭَﺃَﻋْﺘَﺪَﺕْ ﻟَﻬُﻦَّ ﻣُﺘَّﻜَﺄً ﻭَﺁﺗَﺖْ ﻛُﻞَّ ﻭَﺍﺣِﺪَﺓٍ ﻣِّﻨْﻬُﻦَّ ﺳِﻜِّﻴْﻨﺎً ﻭَﻗَﺎﻟَﺖِ ﺍﺧْﺮُﺝْ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻦَّ ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺭَﺃَﻳْﻨَﻪُ ﺃَﻛْﺒَﺮْﻧَﻪُ ﻭَﻗَﻄَّﻌْﻦَ ﺃَﻳْﺪِﻳَﻬُﻦَّ ﻭَﻗُﻠْﻦَ ﺣَﺎﺵَ ِﻟﻠﻪِ ﻣَﺎ ﻫَـﺬَﺍ ﺑَﺸَﺮﺍً ﺇِﻥْ ﻫَـﺬَﺍ ﺇِﻻَّ ﻣَﻠَﻚٌ ﻛَﺮِﻳْﻢٌ – ﻗَﺎﻟَﺖْ ﻓَﺬَﻟِﻜُﻦَّ ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﻟُﻤْﺘُﻨَّﻨِﻲْ ﻓِﻴْﻪِ ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﺭَﺍﻭَﺩﺗُّﻪُ ﻋَﻦ ﻧَّﻔْﺴِﻪِ ﻓَﺎﺳَﺘَﻌْﺼَﻢَ ﻭَﻟَﺌِﻦ ﻟَّﻢْ ﻳَﻔْﻌَﻞْ ﻣَﺎ ﺁﻣُﺮُﻩُ ﻟَﻴُﺴْﺠَﻨَﻦَّ ﻭَﻟَﻴَﻜُﻮﻧﺎً ﻣِّﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﻏِﺮِﻳْﻦَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৩০-৩২ ‏) –
‘নগরে মহিলারা বলাবলি করতে লাগল যে, আযীযের স্ত্রী স্বীয় গোলামকে অন্যায় কাজে ফুসলিয়েছে। সে তার প্রতি আসক্ত হয়ে গেছে। আমরা তো তাকে প্রকাশ্য ভ্রষ্টতার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি’ (৩০) । ‘যখন সে (অর্থাৎ যুলায়খা) তাদের চক্রান্তের কথা শুনল, তখন তাদের জন্য একটা ভোজসভার আয়োজন করল এবং (ফল কাটার জন্য) তাদের প্রত্যেককে একটা করে চাকু দিল। অতঃপর ইউসুফকে বলল, এদের সামনে চলে এস। (সেমতে ইউসুফ সেখানে এল) অতঃপর যখন তারা তাকে স্বচক্ষে দেখল, তখন সবাই হতভম্ব হয়ে গেল এবং (ফল কাটতে গিয়ে নিজেদের অজান্তে) স্ব স্ব হাত কেটে ফেলল। (ইউসুফের সৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তারা) বলে উঠল, হায় আল্লাহ! এ তো মানুষ নয়। এ যে মর্যাদাবান ফেরেশতা!’ (৩১) । ‘(মহিলাদের এই অবস্থা দেখে উৎসাহিত হয়ে) যুলায়খা বলে উঠল, এই হ’ল সেই যুবক, যার জন্য তোমরা আমাকে ভৎর্সনা করেছ। আমি তাকে প্ররোচিত করেছিলাম। কিন্তু সে নিজেকে সংযত রেখেছে। এক্ষণে আমি তাকে যা আদেশ দেই, তা যদি সে পালন না করে, তাহ’লে সে অবশ্যই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবে এবং সে অবশ্যই লাঞ্ছিত হবে’ (ইউসুফ ১২/৩০-৩২) ।
উপরোক্ত আয়াতে যুলায়খার প্রকাশ্য দম্ভোক্তি থেকে বুঝা যায় যে, উপস্থিত মহিলারাও ইউসুফের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং যুলায়খার কুপ্রস্তাবের সাথে তারাও ঐক্যমত পোষণ করে। যা ইউসুফের প্রার্থনায় বহুবচন ব্যবহার করায় বুঝা যায়। যেমন এই কঠিন পরীক্ষার সময়ে ইউসুফ আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে বলেন,
ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺏِّ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦُ ﺃَﺣَﺐُّ ﺇِﻟَﻲَّ ﻣِﻤَّﺎ ﻳَﺪْﻋُﻮْﻧَﻨِﻲْ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﻭَﺇِﻻَّ ﺗَﺼْﺮِﻑْ ﻋَﻨِّﻲْ ﻛَﻴْﺪَﻫُﻦَّ ﺃَﺻْﺐُ ﺇِﻟَﻴْﻬِﻦَّ ﻭَﺃَﻛُﻦ ﻣِّﻦَ ﺍﻟْﺠَﺎﻫِﻠِﻴْﻦَ – ﻓَﺎﺳْﺘَﺠَﺎﺏَ ﻟَﻪُ ﺭَﺑُّﻪُ ﻓَﺼَﺮَﻑَ ﻋَﻨْﻪُ ﻛَﻴْﺪَﻫُﻦَّ ﺇِﻧَّﻪُ ﻫُﻮَ ﺍﻟﺴَّﻤِﻴْﻊُ ﺍﻟْﻌَﻠِﻴْﻢُ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৩৩-৩৪ ‏) –
‘হে আমার পালনকর্তা! এরা আমাকে যে কাজের দিকে আহবান জানাচ্ছে, তার চাইতে কারাগারই আমার নিকটে অধিক পসন্দনীয়। (হে আল্লাহ!) যদি তুমি এদের চক্রান্তকে আমার থেকে ফিরিয়ে না নাও, তবে আমি (হয়ত) তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং আমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’। ‘অতঃপর তার পালনকর্তা তার প্রার্থনা কবুল করলেন ও তাদের চক্রান্ত প্রতিহত করলেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (ইউসুফ ১২/৩৩-৩৪) ।
শহরের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের নিজ বাড়ীতে জমা করে তাদের সামনে যুলায়খার নিজের লাম্পট্যকে প্রকাশ্যে বর্ণনার মাধ্যমে একথাও অনুমিত হয় যে, সে সময়কার মিসরীয় সমাজে বেহায়াপনা ও ব্যভিচার ব্যাপকতর ছিল।
নবীগণ নিষ্পাপ মানুষ ছিলেন :
ইউসুফের প্রার্থনায় ‘আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব’ কথার মধ্যে এ সত্য ফুটে উঠেছে যে, নবীগণ মানুষ ছিলেন এবং মনুষ্যসুলভ স্বাভাবিক প্রবণতা তাদের মধ্যেও ছিল। তবে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও ব্যবস্থাধীনে তাঁরা যাবতীয় কবীরা গোনাহ হ’তে মুক্ত থাকেন এবং নিষ্পাপ থাকেন। বেগানা নারী ও পুরুষের মাঝে চৌম্বিক আকর্ষণ এটা আল্লাহ সৃষ্ট প্রবণতা, যা অপরিহার্য। ফেরেশতাদের মধ্যে আল্লাহ এই প্রবণতা ও ক্ষমতা সৃষ্টি করেননি। তাই তারা এসব থেকে স্বাভাবিকভাবেই মুক্ত।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাদীছে কুদসীতে বলেন, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ফেরেশতামন্ডলীকে বলেন, আমার বান্দা যখন কোন সৎকর্মের আকাংখা করে, তখন তার ইচ্ছার কারণে তার আমলনামায় একটা নেকী লিখে দাও। যদি সে সৎকাজটি সম্পন্ন করে, তবে দশটি নেকী লিপিবদ্ধ কর। পক্ষান্তরে যদি কোন পাপকাজের ইচ্ছা করে, অতঃপর আল্লাহর ভয়ে তা পরিত্যাগ করে, তখন পাপের পরিবর্তে তার আমলনামায় একটি নেকী লিখে দাও। আর যদি পাপকাজটি সে করেই ফেলে, তবে একটির বদলে একটি গোনাহ লিপিবদ্ধ কর’। [19]
অতএব ইউসুফ-এর অন্তরে অনিচ্ছাকৃত অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টির আশংকাটি কেবল ধারণার পর্যায়ে ছিল। সেটা ছগীরা বা কবীরা কোনরূপ গোনাহের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। নিঃসন্দেহে ইউসুফ ছিলেন নির্দোষ ও নিষ্পাপ এবং পূত চরিত্রের যুবক।
ইউসুফের সাক্ষী কে ছিলেন?
উপরের আলোচনায় ২৬নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ﻭَﺷَﻬِﺪَ ﺷَﺎﻫِﺪٌ ﻣِّﻦْ ﺃَﻫْﻠِﻬَﺎ ‘ঐ মহিলার পরিবারের জনৈক ব্যক্তি সাক্ষ্য দিল’- কিন্তু কে সেই ব্যক্তি, সে বিষয়ে কুরআনে কিছু বলা হয়নি। তবে ইবনু জারীর, আহমাদ, ত্বাবারাণী, হাকেম প্রমুখ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে যে, চারটি শিশু দোলনায় থাকতে কথা বলেছিল। তন্মধ্যে ‘ইউসুফের সাক্ষী’ ‏( ﺷﺎﻫﺪ ﻳﻮﺳﻒ ‏)
হিসাবে একটি শিশুর কথা এসেছে। শায়খ আলবানী বলেন, হাদীছটি যঈফ।
[20] কুরতুবী বলেন, উক্ত ব্যক্তি ছিলেন, গৃহস্বামী ‘আযীযে মিছরের’ সাথী তাঁর একান্ত পরামর্শদাতা দূরদর্শী জ্ঞানী ব্যক্তি। যিনি যুলায়খার চাচাতো ভাই ছিলেন। তিনি ইউসুফের জামা সম্মুখ থেকে বা পিছন থেকে ছেঁড়া কি-না প্রমাণ হিসাবে পেশ করার কথা বলেন (ইউসুফ ১২/২৬-২৮) । যদি দোলনার শিশু সাক্ষ্য দিত, তাহ’লে সেটা অলৌকিক ঘটনা হ’ত এবং সেটাই যথেষ্ট হ’ত। অন্য কোন প্রমাণের দরকার হতো না’। [21]
ইউসুফ জেলে গেলেন :
শহরের বিশিষ্ট মহিলাদের সমাবেশে যুলায়খা নির্লজ্জভাবে বলেছিল, ইউসুফ হয় আমার ইচ্ছা পূরণ করবে, নয় জেলে যাবে’। অন্য মহিলারাও যুলায়খাকে সমর্থন করেছিল। এতে বুঝা যায় যে, সে যুগে নারী স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা চরমে উঠেছিল। তাদের চক্রান্তের কাছে পুরুষেরা অসহায় ছিল। নইলে স্ত্রীর দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরেও মন্ত্রী তার স্ত্রীকে শাস্তি দেওয়ার সাহস না করে নির্দোষ ইউসুফকে জেলে পাঠালেন কেন? অবশ্য লোকজনের মুখ বন্ধ করার জন্য ও নিজের ঘর রক্ষার জন্যও এটা হ’তে পারে।
ইউসুফ যখন বুঝলেন যে, এই মহিলাদের চক্রান্ত থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোন উপায় নেই, তখন তিনি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে বললেন, আল্লাহ এরা আমাকে যে কাজে আহবান করছে, তার চেয়ে কারাগারই আমার জন্য শ্রেয়:। আল্লাহ তার দো‘আ কবুল করলেন এবং তাদের চক্রান্তকে হটিয়ে দিলেন (ইউসুফ ১২/২৩-২৪) । এতে বুঝা যায় যে, চক্রান্তটা একপক্ষীয় ছিল এবং তাতে ইউসুফের লেশমাত্র সম্পৃক্ততা ছিল না। দ্বিতীয়তঃ ইউসুফ যদি জেলখানাকে ‘অধিকতর পসন্দনীয়’ না বলতেন এবং শুধুমাত্র আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতেন, তাহ’লে হয়তবা আল্লাহ তার জন্য নিরাপত্তার অন্য কোন ব্যবস্থা করতেন।
যাইহোক আযীযে মিছরের গৃহে বাস করে চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষা করা অসম্ভব বিবেচনা করে ইউসুফ যুলায়খার হুমকি মতে জেলখানাকেই অধিকতর শ্রেয়: বলেন। ফলে কারাগারই তার জন্য নির্ধারিত হয়ে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা মহিলাদের চক্রান্তজাল থেকে ইউসুফকে বাঁচানোর জন্য কৌশল করলেন। ‘আযীযে মিছর’ ও তার সভাসদগণের মধ্যে ইউসুফের সততা ও সচ্চরিত্রতা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা জন্মেছিল। তথাপি লোকজনের কানা-ঘুষা বন্ধ করার জন্য এবং সর্বোপরি নিজের ঘর রক্ষা করার জন্য ইউসুফকে কিছুদিনের জন্য কারাগারে আবদ্ধ রাখাকেই তারা সমীচীন মনে করলেন এবং সেমতে ইউসুফ জেলে প্রেরিত হলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ﺙﻡَُّ ﺑَﺪَﺍ ﻟَﻬُﻢ ﻣِّﻦ ﺑَﻌْﺪِ ﻣَﺎ ﺭَﺃَﻭُﺍ ﺍﻵﻳَﺎﺕِ ﻟَﻴَﺴْﺠُﻨُﻨَّﻪُ ﺣَﺘَّﻰ ﺣِﻴْﻦٍ – ‘অতঃপর এসব (সততার) নিদর্শন দেখার পর তারা (আযীয়ে মিছর ও তার সাথীরা) তাকে (ইউসুফকে) কিছুদিন কারাগারে রাখা সমীচীন মনে করল’ (ইউসুফ ১২/৩৫) ।
কারাগারের জীবন :
বালাখানা থেকে জেলখানায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর এক করুণ অভিজ্ঞতা শুরু হ’ল ইউসুফের জীবনে। মনোকষ্ট ও দৈহিক কষ্ট, সাথে সাথে স্নেহান্ধ ফুফু ও সন্তানহারা পাগলপরা বৃদ্ধ পিতাকে কেন‘আনে ফেলে আসার মানসিক কষ্ট সব মিলিয়ে ইউসুফের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। কেন‘আনে ভাইয়েরা শত্রু, মিসরে যুলায়খা শত্রু। নিরাপদ আশ্রয় কোথাও নেই। অতএব জেলখানাকেই আপাতত: জীবনসাথী করে নিলেন এবং নিজেকে আল্লাহর আশ্রয়ে সমর্পণ করে কয়েদী সাথীদের মধ্যে দ্বীনের দাওয়াতে মনোনিবেশ করলেন। ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে যে, ইউসুফকে আল্লাহ স্বপ্ন ব্যাখ্যা দানের বিশেষ জ্ঞান দান করেছিলেন (ইউসুফ ১২/৬) । দ্বীনের দাওয়াতের ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও তাঁর জন্য সহায়ক প্রমাণিত হয়।
জেলখানার সাথীদের নিকটে ইউসুফের দাওয়াত :
ইউসুফ কারাগারে পৌঁছলে সাথে আরও দু’জন অভিযুক্ত যুবক কারাগারে প্রবেশ করে। তাদের একজন বাদশাহকে মদ্য পান করাতো এবং অপরজন বাদশাহর বাবুর্চি ছিল। ইবনু কাছীর তাফসীরবিদগণের বরাত দিয়ে লেখেন যে, তারা উভয়েই বাদশাহর খাদ্যে বিষ মিশানোর দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেলে আসে। তখনও মামলার তদন্ত চলছিল এবং চূড়ান্ত রায় বাকী ছিল। তারা জেলে এসে ইউসুফের সততা, বিশ্বস্ততা, ইবাদতগুযারী ও স্বপ্ন ব্যাখ্যা দানের ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে। তখন তারা তাঁর নৈকট্য লাভে সচেষ্ট হয় এবং তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধুতে পরিণত হয়।

বন্ধুত্বের এই সুযোগকে ইউসুফ তাওহীদের দাওয়াতে কাজে লাগান। তাতে প্রতীতি জন্মে যে, সম্ভবতঃ কারাগারেই ই্উসুফকে ‘নবুঅত’ দান করা হয়। ইউসুফের কারা সঙ্গীদ্বয় এবং তাদের নিকটে প্রদত্ত দাওয়াতের বিবরণ আল্লাহ দিয়েছেন নিম্নোক্তভাবে:
ﻭَﺩَﺧَﻞَ ﻣَﻌَﻪُ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦَ ﻓَﺘَﻴَﺎﻥَ ﻗَﺎﻝَ ﺃَﺣَﺪُﻫُﻤَﺎ ﺇِﻧِّﻲ ﺃَﺭَﺍﻧِﻲ ﺃَﻋْﺼِﺮُ ﺧَﻤْﺮﺍً ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﻵﺧَﺮُ ﺇِﻧِّﻲ ﺃَﺭَﺍﻧِﻲ ﺃَﺣْﻤِﻞُ ﻓَﻮْﻕَ ﺭَﺃْﺳِﻲْ ﺧُﺒْﺰﺍً ﺗَﺄْﻛُﻞُ ﺍﻟﻄَّﻴْﺮُ ﻣِﻨْﻪُ ﻧَﺒِّﺌْﻨَﺎ ﺑِﺘَﺄْﻭْﻳﻠِﻪِ ﺇِﻧَّﺎ ﻧَﺮَﺍﻙَ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﺤْﺴِﻨِﻴْﻦَ – ﻗَﺎﻝَ ﻻَ ﻳَﺄْﺗِﻴﻜُﻤَﺎ ﻃَﻌَﺎﻡٌ ﺗُﺮْﺯَﻗَﺎﻧِﻪِ ﺇِﻻَّ ﻧَﺒَّﺄْﺗُﻜُﻤَﺎ ﺑِﺘَﺄْﻭِﻳﻠِﻪِ ﻗَﺒْﻞَ ﺃَﻥ ﻳَﺄْﺗِﻴﻜُﻤَﺎ ﺫَﻟِﻜُﻤَﺎ ﻣِﻤَّﺎ ﻋَﻠَّﻤَﻨِﻲ ﺭَﺑِّﻲ ﺇِﻧِّﻲ ﺗَﺮَﻛْﺖُ ﻣِﻠَّﺔَ ﻗَﻮْﻡٍ ﻻَّ ﻳُﺆْﻣِﻨُﻮﻥَ ﺑِﺎﻟﻠﻪِ ﻭَﻫُﻢ ﺑِﺎﻵﺧِﺮَﺓِ ﻫُﻢْ ﻛَﺎﻓِﺮُﻭﻥَ – ﻭَﺍﺗَّﺒَﻌْﺖُ ﻣِﻠَّﺔَ ﺁﺑَﺂﺋِـﻲ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴﻢَ ﻭَﺇِﺳْﺤَﺎﻕَ ﻭَﻳَﻌْﻘُﻮﺏَ ﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﻟَﻨَﺎ ﺃَﻥ ﻧُّﺸْﺮِﻙَ ﺑِﺎﻟﻠﻪِ ﻣِﻦ ﺷَﻲْﺀٍ ﺫَﻟِﻚَ ﻣِﻦ ﻓَﻀْﻞِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻋَﻠَﻴْﻨَﺎ ﻭَﻋَﻠَﻰ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻭَﻟَـﻜِﻦَّ ﺃَﻛْﺜَﺮَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻻَ ﻳَﺸْﻜُﺮُﻭﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৩৬-৩৮)-
‘ইউসুফের সাথে কারাগারে দু’জন যুবক প্রবেশ করল। তাদের একজন বলল, আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি মদ নিঙড়াচ্ছি। অপরজন বলল, আমি দেখলাম যে, আমি মাথায় করে রুটি বহন করছি। আর তা থেকে পাখি খেয়ে নিচ্ছে। আমাদেরকে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দিন। কেননা আমরা আপনাকে সৎকর্মশীলগণের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাচ্ছি’ (৩৬) । ‘ইউসুফ বলল, তোমাদেরকে প্রত্যহ যে খাদ্য দান করা হয়, তা তোমাদের কাছে আসার আগেই আমি তার ব্যাখ্যা বলে দিতে পারি। এ জ্ঞান আমার পালনকর্তা আমাকে দান করেছেন। আমি ঐসব লোকদের ধর্ম ত্যাগ করেছি, যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস পোষণ করে না এবং আখেরাতকে অস্বীকার করে’ (৩৭) । ‘আমি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক্ব ও ইয়াকূবের ধর্ম অনুসরণ করি। আমাদের জন্য শোভা পায় না যে, কোন বস্ত্তকে আল্লাহর অংশীদার করি। এটা আমাদের প্রতি এবং অন্য সব লোকদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। কিন্তু অধিকাংশ লোক কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না’
(ইউসুফ ১২/৩৬-৩৮) ।
অতঃপর তিনি সাথীদের প্রতি তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে বলেন,
ﻳَﺎ ﺻَﺎﺣِﺒَﻲِ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦِ ﺃَﺃَﺭْﺑَﺎﺏٌ ﻣُّﺘَﻔَﺮِّﻗُﻮْﻥَ ﺧَﻴْﺮٌ ﺃَﻡِ ﺍﻟﻠﻪُ ﺍﻟْﻮَﺍﺣِﺪُ ﺍﻟْﻘَﻬَّﺎﺭُ – ﻣَﺎ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭْﻥَ ﻣِﻦْ ﺩُﻭْﻧِﻪِ ﺇِﻻَّ ﺃَﺳْﻤَﺎﺀٌ ﺳَﻤَّﻴْﺘُﻤُﻮْﻫَﺎ ﺃَﻧﺘُﻢْ ﻭَﺁﺑَﺂﺅُﻛُﻢْ ﻣَّﺎ ﺃَﻧﺰَﻝَ ﺍﻟﻠﻪ ُﺑِﻬَﺎ ﻣِﻦْ ﺳُﻠْﻄَﺎﻥٍ، ﺇِﻥِ ﺍﻟْﺤُﻜْﻢُ ﺇِﻻَّ ِﻟﻠﻪِ ﺃَﻣَﺮَ ﺃَﻻَّ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭﺍْ ﺇِﻻَّ ﺇِﻳَّﺎﻩُ ﺫَﻟِﻚَ ﺍﻟﺪِّﻳْﻦُ ﺍﻟْﻘَﻴِّﻢُ ﻭَﻟَـﻜِﻦَّ ﺃَﻛْﺜَﺮَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻻَ ﻳَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৩৯-৪০)-
‘হে কারাগারের সাথীদ্বয়! পৃথক পৃথক অনেক উপাস্য ভাল, না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ’? ‘তোমরা আল্লাহ্কে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের পূজা করে থাক। যেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছ। এদের পক্ষে আল্লাহ কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। আল্লাহ ব্যতীত কারু বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ব্যতীত তোমরা অন্য কারু ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না’ (ইউসুফ ১২/৩৯-৪০) । এভাবে তাওহীদের দাওয়াত দেওয়ার পর তিনি স্বীয় কারা সাথীদ্বয়ের প্রশ্নের জওয়াব দিতে শুরু করলেন।-
ﻳَﺎ ﺻَﺎﺣِﺒَﻲِ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦِ ﺃَﻣَّﺎ ﺃَﺣَﺪُﻛُﻤَﺎ ﻓَﻴَﺴْﻘِﻲ ﺭَﺑَّﻪُ ﺧَﻤْﺮﺍً ﻭَﺃَﻣَّﺎ ﺍﻵﺧَﺮُ ﻓَﻴُﺼْﻠَﺐُ ﻓَﺘَﺄْﻛُﻞُ ﺍﻟﻄَّﻴْﺮُ ﻣِﻦ ﺭَّﺃْﺳِﻪِ ﻗُﻀِﻲَ ﺍﻷَﻣْﺮُ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﻓِﻴﻪِ ﺗَﺴْﺘَﻔْﺘِﻴَﺎﻥِ – ﻭَﻗَﺎﻝَ ﻟِﻠَّﺬِﻱ ﻇَﻦَّ ﺃَﻧَّﻪُ ﻧَﺎﺝٍ ﻣِّﻨْﻬُﻤَﺎ ﺍﺫْﻛُﺮْﻧِﻲ ﻋِﻨﺪَ ﺭَﺑِّﻚَ ﻓَﺄَﻧﺴَﺎﻩُ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥُ ﺫِﻛْﺮَ ﺭَﺑِّﻪِ ﻓَﻠَﺒِﺚَ ﻓِﻲ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦِ ﺑِﻀْﻊَ ﺳِﻨِﻴﻦَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৪১-৪২ ‏) –
‘হে কারাগারের সাথীদ্বয়! তোমাদের একজন তার মনিবকে মদ্যপান করাবে এবং দ্বিতীয়জন, তাকে শূলে চড়ানো হবে। অতঃপর তার মস্তক থেকে পাখি (ঘিলু) খেয়ে নিবে। তোমরা যে বিষয়ে জানতে আগ্রহী, তার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে’। ‘অতঃপর যে ব্যক্তি সম্পর্কে (স্বপ্নের ব্যাখ্যা অনুযায়ী) ধারণা ছিল যে, সে মুক্তি পাবে, তাকে ইউসুফ বলে দিল যে, তুমি তোমার মনিবের কাছে (অর্থাৎ বাদশাহর কাছে) আমার বিষয়ে আলোচনা করবে (যাতে আমাকে মুক্তি দেয়)। কিন্তু শয়তান তাকে তার মনিবের কাছে বলার বিষয়টি ভুলিয়ে দেয়। ফলে তাকে কয়েক বছর কারাগারে থাকতে হ’ল’ (ইউসুফ ১২/৪১-৪২) ।
ইউসুফের দাওয়াতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ:
(১) দাওয়াত দেওয়ার সময় নিজের পরিচয় স্পষ্টভাবে তুলে ধরা আবশ্যক। যাতে শ্রোতার মনে কোনরূপ দ্বৈত চিন্তা ঘর না করে। ইউসুফ তাঁর দাওয়াতের শুরুতেই বলে দিয়েছেন যে, আমি ঐসব লোকের ধর্ম পরিত্যাগ করেছি, যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস পোষণ করে না এবং আখেরাতে জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করে না’ (ইউসুফ ১২/৩৭) ।
(২) দাওয়াত দেওয়ার সময় নিজের অভিজাত বংশের পরিচয় তুলে ধরা মোটেই অসমীচীন নয়। এতে শ্রোতার মনে দাওয়াতের প্রভাব দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ইউসুফ (আঃ) সেকারণ নিজের নবী বংশের পরিচয় শুরুতেই তুলে ধরেছেন’ (ইউসুফ ১২/৩৮) ।
(৩) শ্রোতার সম্মুখে অনেক সময় নিজের কোন বাস্তব কৃতিত্ব তুলে ধরাও আবশ্যক হয়। যেমন ইউসুফ (আঃ) স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে নিজের আরেকটি মু‘জেযার কথা বর্ণনা করেন যে, কয়েদীদের খানা আসার আগেই আমি তার প্রকার, গুণাগুণ, পরিমাণ ও আসার সঠিক সময় বলে দিতে পারি (ইউসুফ ১২/৩৭) ।
(৪) নিজেকে কোনরূপ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী কিংবা ভবিষ্যদ্বক্তা বলে পেশ করা যাবে না। সেকারণ ইউসুফ সাথে সাথে বলে দিয়েছিলেন যে, ‘এ জ্ঞান আমার পালনকর্তা আমাকে দান করেছেন’
(ইউসুফ ১২/৩৭) ।
(৫) প্রশ্নের জওয়াব দানের পূর্বে প্রশ্নকারীর মন-মানসিকতাকে আল্লাহমুখী করে নেওয়া আবশ্যক। সেকারণ ইউসুফ তাঁর মুশরিক কারাসঙ্গীদের জওয়াব দানের পূর্বে তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন (১২/৩৯) ।
(৬) প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শ্রোতার মস্তিষ্ক যাচাই করে দাওয়াত দেওয়া একটি উত্তম পদ্ধতি। সেজন্য ইউসুফ (আঃ) তাঁর কারা সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘পৃথক পৃথক অনেক উপাস্য ভাল, না পরাক্রমশালী একক উপাস্য ভাল’?
(ইউসুফ ১২/৩৯) ।
(৭) শিরকের অসারতা হাতেনাতে ধরিয়ে দিয়ে মুশরিককে প্রথমেই লা-জওয়াব করে দেওয়া আবশ্যক। সেকারণ ইউসুফ (আঃ) বললেন, তোমরা আল্লাহ্কে ছেড়ে নিছক কিছু নামের পূজা কর মাত্র। এদের পূজা করার জন্য আল্লাহ কোন আদেশ প্রেরণ করেননি’
(ইউসুফ ১২/৪০) ।
(৮) তাওহীদের মূল কথা সংক্ষেপে বা এক কথায় পেশ করা আবশ্যক, যাতে শ্রোতার মগয সহজে সেটা ধারণ করতে পারে। সেজন্য ইউসুফ (আঃ) সোজাসুজি এক কথায় বলে দিলেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কারু কোন বিধান নেই… এবং এটাই সরল পথ’ (ইউসুফ ১২/৪০) ।
(৯) বিপদ হ’তে মুক্তি কামনা করা ও সেজন্য চেষ্টা করা আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়। সেজন্য ইউসুফ (আঃ) কারাগার থেকে মুক্তি চেয়েছেন এবং নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে যে কারাগারে দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হচ্ছে, সে বিষয়টি বাদশাহর কাছে তুলে ধরার জন্য মুক্তিকামী কারা সাথীকে বলে দিলেন (ইউসুফ ১২/৪২) ।
(১০) বান্দা চেষ্টা করার মালিক। কিন্তু অবশেষে তাক্বদীর জয়লাভ করে। সেকারণ ইউসুফের মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদী বন্ধু বাদশাহর কাছে তার কথা বলতে ভুলে গেল এবং কয়েক বছর তাকে কয়েদখানায় থাকতে হ’ল। কুরআনে ﺑﻀﻊ ﺳﻨﻴﻦ শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে (ইউসুফ ১২/৪২) । যা দ্বারা তিন থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যা বুঝানো হয়। অধিকাংশ তাফসীরবিদগণ তাঁর কারাজীবনের মেয়াদ সাত বছর বলেছেন। এভাবে অবশেষে তাক্বদীর বিজয়ী হ’ল। কারণ আল্লাহর মঙ্গল ইচ্ছা বান্দা বুঝতে পারেনা।
বাদশাহর স্বপ্ন ও কারাগার থেকে ইউসুফের ব্যাখ্যা দান:
মিসরের বাদশাহ একটি স্বপ্ন দেখলেন এবং এটিই ছিল আল্লাহর পক্ষ হ’তে ইউসুফের কারামুক্তির অসীলা। অতঃপর বাদশাহ তার সভাসদগণকে ডেকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু কেউ জবাব দিতে পারল না। অবশেষে তারা বাদশাহকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বলল, এগুলি ‘কল্পনা প্রসূত স্বপ্ন’ ( ﺃﺿﻐﺎﺙ ﺃﺣﻼﻡ ) মাত্র। এগুলির কোন বাস্তবতা নেই। কিন্তু বাদশাহ তাতে স্বস্তি পান না। এমন সময় কারামুক্ত সেই খাদেম বাদশাহর কাছে তার কারাসঙ্গী ও বন্ধু ইউসুফের কথা বলল। তখন বাদশাহ ইউসুফের কাছে স্বপ্ন ব্যাখ্যা জানার জন্য উক্ত খাদেমকে কারাগারে পাঠালেন। সে স্বপ্নব্যাখ্যা শুনে এসে বাদশাহকে সব বৃত্তান্ত বলল। উক্ত বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:
ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﻟْﻤَﻠِﻚُ ﺇِﻧِّﻲ ﺃَﺭَﻯ ﺳَﺒْﻊَ ﺑَﻘَﺮَﺍﺕٍ ﺳِﻤَﺎﻥٍ ﻳَﺄْﻛُﻠُﻬُﻦَّ ﺳَﺒْﻊٌ ﻋِﺠَﺎﻑٌ ﻭَﺳَﺒْﻊَ ﺳُﻨْﺒُﻼَﺕٍ ﺧُﻀْﺮٍ ﻭَﺃُﺧَﺮَ ﻳَﺎﺑِﺴَﺎﺕٍ، ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟْﻤَﻸُ ﺃَﻓْﺘُﻮْﻧِﻲْ ﻓِﻲ ﺭُﺅْﻳَﺎﻱَ ﺇِﻥْ ﻛُﻨﺘُﻢْ ﻟِﻠﺮُّﺅْﻳَﺎ ﺗَﻌْﺒُﺮُﻭﻥَ – ﻗَﺎﻟُﻮﺍ ﺃَﺿْﻐَﺎﺙُ ﺃَﺣْﻼَﻡٍ ﻭَﻣَﺎ ﻧَﺤْﻦُ ﺑِﺘَﺄْﻭِﻳﻞِ ﺍﻷَﺣْﻼَﻡِ ﺑِﻌَﺎﻟِﻤِﻴْﻦَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৪৩-৪৪)-
‘বাদশাহ বলল, আমি স্বপ্নে দেখলাম, সাতটি মোটা-তাজা গাভী, এদেরকে সাতটি শীর্ণ গাভী খেয়ে ফেলছে এবং সাতটি সবুজ শিষ ও অন্যগুলো শুষ্ক। হে সভাসদবর্গ! তোমরা আমাকে আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দাও, যদি তোমরা স্বপ্ন ব্যাখ্যায় পারদর্শী হয়ে থাক’। ‘তারা বলল, এটি কল্পনা প্রসূত স্বপ্ন মাত্র। এরূপ স্বপ্নের ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই’ (ইউসুফ ১২/৪৩-৪৪) ।
‘তখন দু’জন কারাবন্দীর মধ্যে যে ব্যক্তি মুক্তি পেয়েছিল, দীর্ঘকাল পরে তার (ইউসুফের কথা) স্মরণ হ’ল এবং বলল, আমি আপনাদেরকে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দেব, আপনারা আমাকে (জেলখানায়) পাঠিয়ে দিন’। ‘অতঃপর সে জেলখানায় পৌঁছে বলল, ইউসুফ হে আমার সত্যবাদী বন্ধু! (বাদশাহ স্বপ্ন দেখেছেন যে,) সাতটি মোটাতাজা গাভী, তাদেরকে খেয়ে ফেলছে সাতটি শীর্ণ গাভী এবং সাতটি সবুজ শিষ ও অন্যগুলি শুষ্ক। আপনি আমাদেরকে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দিন, যাতে আমি তাদের কাছে ফিরে গিয়ে তা জানাতে পারি’ (ইউসুফ ১২/৪৫-৪৬) । জবাবে ইউসুফ বলল,
ﻗَﺎﻝَ ﺗَﺰْﺭَﻋُﻮﻥَ ﺳَﺒْﻊَ ﺳِﻨِﻴْﻦَ ﺩَﺃَﺑﺎً ﻓَﻤَﺎ ﺣَﺼَﺪﺗُّﻢْ ﻓَﺬَﺭُﻭﻩُ ﻓِﻲ ﺳُﻨْﺒُﻠِﻪِ ﺇِﻻَّ ﻗَﻠِﻴﻼً ﻣِّﻤَّﺎ ﺗَﺄْﻛُﻠُﻮﻥَ – ﺛُﻢَّ ﻳَﺄْﺗِﻲ ﻣِﻦ ﺑَﻌْﺪِ ﺫَﻟِﻚَ ﺳَﺒْﻊٌ ﺷِﺪَﺍﺩٌ ﻳَﺄْﻛُﻠْﻦَ ﻣَﺎ ﻗَﺪَّﻣْﺘُﻢْ ﻟَﻬُﻦَّ ﺇِﻻَّ ﻗَﻠِﻴﻼً ﻣِّﻤَّﺎ ﺗُﺤْﺼِﻨُﻮﻥَ – ﺛُﻢَّ ﻳَﺄْﺗِﻲْ ﻣِﻦ ﺑَﻌْﺪِ ﺫَﻟِﻚَ ﻋَﺎﻡٌ ﻓِﻴﻪِ ﻳُﻐَﺎﺙُ ﺍﻟﻨَّﺎﺱُ ﻭَﻓِﻴﻪِ ﻳَﻌْﺼِﺮُﻭﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৪৭-৪৯)-
‘তোমরা সাত বছর উত্তমরূপে চাষাবাদ করবে। অতঃপর যখন ফসল কাটবে, তখন খোরাকি বাদে বাকী ফসল শিষ সমেত রেখে দিবে’ (৪৭) । ‘এরপর আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর। তখন তোমরা খাবে ইতিপূর্বে যা রেখে দিয়েছিলে, তবে কিছু পরিমাণ ব্যতীত যা তোমরা (বীজ বা সঞ্চয় হিসাবে) তুলে রাখবে’ (৪৮) । ‘এরপরে আসবে এক বছর, যাতে লোকদের উপরে বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং তখন তারা (আঙ্গুরের) রস নিঙড়াবে (অর্থাৎ উদ্বৃত্ত ফসল হবে)’ (ইউসুফ ১২/৪৭-৪৯) ।
ঐ খাদেমটি ফিরে এসে স্বপ্ন ব্যাখ্যা বর্ণনা করলে বাদশাহ তাকে বললেন,
ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﻟْﻤَﻠِﻚُ ﺍﺋْﺘُﻮﻧِﻲْ ﺑِﻪِ ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺟَﺎﺀَﻩُ ﺍﻟﺮَّﺳُﻮﻝُ ﻗَﺎﻝَ ﺍﺭْﺟِﻊْ ﺇِﻟَﻰ ﺭَﺑِّﻚَ ﻓَﺎﺳْﺄَﻟْﻪُ ﻣَﺎ ﺑَﺎﻝُ ﺍﻟﻨِّﺴْﻮَﺓِ ﺍﻟﻼَّﺗِﻲ ﻗَﻄَّﻌْﻦَ ﺃَﻳْﺪِﻳَﻬُﻦَّ ﺇِﻥَّ ﺭَﺑِّﻲ ﺑِﻜَﻴْﺪِﻫِﻦَّ ﻋَﻠِﻴﻢٌ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৫০)-
‘তুমি পুনরায় কারাগারে ফিরে যাও এবং তাকে (অর্থাৎ ইউসুফকে) আমার কাছে নিয়ে এস। অতঃপর যখন বাদশাহর দূত তার কাছে পৌঁছলো, তখন ইউসুফ তাকে বলল, তুমি তোমার মনিবের (অর্থাৎ বাদশাহর) কাছে ফিরে যাও এবং তাঁকে জিজ্ঞেস কর যে, নগরীর সেই মহিলাদের খবর কি? যারা নিজেদের হাত কেটে ফেলেছিল। আমার পালনকর্তা তো তাদের ছলনা সবই জানেন’ (ইউসুফ ১২/৫০) ।
বাদশাহর দূতকে ফেরৎ দানের শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ:
(১) দীর্ঘ কারাভোগের দুঃসহ যন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে ইউসুফ (আঃ) নিশ্চয়ই মুক্তির জন্য উন্মুখ ছিলেন। কিন্তু বাদশাহর পক্ষ থেকে মুক্তির নির্দেশ পাওয়া সত্ত্বেও তিনি দূতকে ফেরত দিলেন। এর কারণ এই যে, উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিগণ কারামুক্তির চাইতে তার উপরে আপতিত অপবাদ মুক্তিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ইউসুফ (আঃ) সেকারণেই ঘটনার মূলে যারা ছিল, তাদের অবস্থা জানতে চেয়েছিলেন।
(২) তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, জেল থেকে বের হওয়ার আগেই বাদশাহ বা গৃহস্বামী ‘আযীযে মিছর’ তাঁর ব্যাপারে সন্দেহ মুক্ত কি-না সেটা জেনে নেওয়া এবং ঐ মহিলাদের মুখ দিয়ে তার নির্দোষিতার বিষয়টি প্রকাশিত হওয়া।
(৩) ইউসুফ তার বক্তব্যে ‘মহিলাদের’ কথা বলেছেন। আযীয-পত্নী যুলায়খার কথা নির্দিষ্টভাবে বলেননি। অথচ সেই-ই ছিল ঘটনার মূল। এটার কারণ ছিল এই যে, (ক) ঐ মহিলাগণ সবাই যুলায়খার কু-প্রস্তাবের সমর্থক হওয়ায় তারা সবাই একই পর্যায়ে চলে এসেছিল (খ) তাছাড়া আরেকটি কারণ ছিল- সৌজন্যবোধ। কেননা নির্দিষ্টভাবে তার নাম নিলে আযীযের মর্যাদায় আঘাত আসত। এতদ্ব্যতীত আযীয ছিলেন ইউসুফের আশ্রয়দাতা ও লালন-পালনকারী। তার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধের আধিক্য ইউসুফকে আযীয-পত্নীর নাম নিতে দ্বিধান্বিত করেছে। ইউসুফ (আঃ)-এর এবম্বিধ উন্নত আচরণের মধ্যে যেকোন মর্যাদাবান ব্যক্তির জন্য শিক্ষণীয় বিষয় লুকিয়ে রয়েছে।
(৪) ইউসুফ চেয়েছিলেন এ সত্য প্রমাণ করে দিতে যে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে মন্দপ্রবণতা থাকলেও তা নেককার মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের কারণে। যদি আমি সেই অনুগ্রহ না পেতাম, তাহ’লে হয়ত আমিও পথভ্রষ্ট হয়ে যেতাম। অতএব আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর অনুগ্রহ লাভে সদা সচেষ্ট থাকাই বান্দার সর্বাপেক্ষা বড় কর্তব্য। বস্ত্ততঃ এইরূপ পবিত্র হৃদয়কে কুরআনে ‘নফসে মুত্বমাইন্নাহ’ বা প্রশান্ত হৃদয় বলা হয়েছে (ফাজর ৮৯/২৭) । যা অর্জন করার জন্য সকলকেই সচেষ্ট হওয়া উচিত। নবীগণ সবাই ছিলেন উক্ত প্রশান্ত হৃদয়ের অধিকারী। আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে ইউসুফ (আঃ)ও অনুরূপ পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন এবং তিনি চেয়েছিলেন বাদশাহও তাঁর পবিত্রতা সম্পর্কে নিশ্চিত হৌন।
(৫) পবিত্রতার অহংকারঃ বাদশাহর দূতকে ফিরিয়ে দেবার মধ্যে ইউসুফের হৃদয়ে পবিত্রতার যে অহংকার জন্মেছিল, তা প্রত্যেক নির্দোষ মানুষের মধ্যে থাকা উচিত। ইউসুফের এই সাহসী আচরণে অভিভূত হয়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলেন,
ﺇﻥَّ ﺍﻟﻜﺮﻳﻢَ ﺍﺑﻦَ ﺍﻟﻜﺮﻳﻢِ ﺍﺑﻦِ ﺍﻟﻜﺮﻳﻢِ ﺑﻦِ ﺍﻟﻜﺮﻳﻢِ : ﻳﻮﺳﻒُ ﺑﻦُ ﻳﻌﻘﻮﺏَ ﺑﻦِ ﺍﺳﺤﺎﻕَ ﺑﻦِ ﺇﺑﺮﺍﻫﻴﻢَ، ﻭَﻟَﻮ ﻟﺒِﺜْﺖُ ﻓﻰ ﺍﻟﺴﺠﻦ ﻣﺎﻟﺒﺚَ ﺛﻢ ﺟﺎﺀﻧﻰ ﺍﻟﺮﺳﻮﻝُ ﻷَﺟَﺒْﺖُ ﺛﻢ ﻗﺮﺃ ‏( ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺟَﺎﺀَﻩُ ﺍﻟﺮَّﺳُﻮْﻝُ ﻗَﺎﻝَ ﺍﺭْﺟِﻊْ ﺇِﻟَﻰ ﺭَﺑِّﻚَ ﻓَﺎﺳْﺄَﻟْﻪُ ﻣَﺎ ﺑَﺎﻝُ ﺍﻟﻨِّﺴْﻮَﺓِ ﺍﻟﻼَّﺗِﻲ ﻗَﻄَّﻌْﻦَ ﺃَﻳْﺪِﻳَﻬُﻦَّ ﺇِﻥَّ ﺭَﺑِّﻲ ﺑِﻜَﻴْﺪِﻫِﻦَّ ﻋَﻠِﻴﻢٌ ‏) ، ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺘﺮﻣﺬﻯ ﺑﺴﻨﺪ ﺣﺴﻦ –
‘নিশ্চয়ই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির পুত্র সম্ভ্রান্ত, তার পুত্র সম্ভ্রান্ত, তার পুত্র সম্ভ্রান্ত- (তাঁরা হ’লেন) ইবরাহীমের পুত্র ইসহাক্ব, তাঁর পুত্র ইয়াকূব ও তাঁর পুত্র ইউসুফ। যদি আমি অতদিন কারাগারে থাকতাম, যতদিন তিনি ছিলেন, তাহ’লে বাদশাহর দূত প্রথমবার আসার সাথে সাথে আমি তার প্রস্তাব কবুল করতাম’। এ কথা বলার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরা ইউসুফ ৫০ আয়াতটি পাঠ করেন’। [22]
বাদশাহর দরবারে ইউসুফ (আঃ):
কারাগার থেকে পাঠানো ইউসুফের দাবী অনুযায়ী মহিলাদের কাছে বাদশাহ ঘটনার তদন্ত করলেন। আল্লাহ বলেন, বাদশাহ মহিলাদের ডেকে বলল,
ﻗَﺎﻝَ ﻣَﺎ ﺧَﻄْﺒُﻜُﻦَّ ﺇِﺫْ ﺭَﺍﻭَﺩﺗُّﻦَّ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ﻋَﻦ ﻧَّﻔْﺴِﻪِ
‘তোমাদের খবর কি যখন তোমরা ইউসুফকে কুকর্মে ফুসলিয়েছিলে? তারা বলল, ﺣَﺎﺵَ ِﻟﻠﻪِ ﻣَﺎ ﻋَﻠِﻤْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻣِﻦْ ﺳُﻮْﺀٍ
‘আল্লাহ পবিত্র। আমরা তাঁর (ইউসুফ) সম্পর্কে মন্দ কিছুই জানি না’। আযীয-পত্নী বলল, ﺍﻵﻥَ ﺣَﺼْﺤَﺺَ ﺍﻟْﺤَﻖُّ ﺃَﻧَﺎ ﺭَﺍﻭَﺩﺗُّﻪُ ﻋَﻦْ ﻧَّﻔْﺴِﻪِ ﻭَﺇِﻧَّﻪُ ﻟَﻤِﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴﻦَ ‘এখন সত্য প্রকাশিত হ’ল। আমিই তাকে ফুসলিয়েছিলাম এবং সে ছিল সত্যবাদী’ (ইউসুফ ১২/৫১) । ইতিপূর্বে একবার শহরের মহিলাদের সম্মুখে যুলায়খা উক্ত স্বীকৃতি দিয়ে বলেছিল, ﻟَﻘَﺪْ ﺭَﺍﻭَﺩﺗُّﻪُ ﻋَﻦ ﻧَّﻔْﺴِﻪِ ﻓَﺎﺳَﺘَﻌْﺼَﻢَ ‘আমি তাকে ফুসলিয়েছিলাম। কিন্তু সে নিজেকে সংযত রেখেছিল’ (ইউসুফ ১২/৩২) ।
অতঃপর আযীয-পত্নী বলল, ﺫَﻟِﻚَ ﻟِﻴَﻌْﻠَﻢَ ﺃَﻧِّﻲ ﻟَﻢْ ﺃَﺧُﻨْﻪُ ﺑِﺎﻟْﻐَﻴْﺐِ ﻭَﺃَﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻻَ ﻳَﻬْﺪِﻱ ﻛَﻴْﺪَ ﺍﻟْﺨَﺎﺋِﻨِﻴْﻦَ ‘এটা (অর্থাৎ এই স্বীকৃতিটা) এজন্যে যেন গৃহস্বামী জানতে পারেন যে, তার অগোচরে আমি তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। বস্ত্ততঃ আল্লাহ বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্র সফল করেন না’ (৫২) । ‘আর আমি নিজেকে নির্দোষ মনে করি না। নিশ্চয়ই মানুষের মন মন্দপ্রবণ। কেবল ঐ ব্যক্তি ছাড়া যার প্রতি আমার প্রভু দয়া করেন। নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (৫৩) ।
এভাবে আযীয-পত্নী ও নগরীর মহিলারা যখন বাস্তব ঘটনা স্বীকার করল, তখন বাদশাহ নির্দেশ দিলেন, ইউসুফকে আমার কাছে নিয়ে এস। কুরআনের ভাষায়- ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﻟْﻤَﻠِﻚُ ﺍﺋْﺘُﻮْﻧِﻲْ ﺑِﻪِ ﺃَﺳْﺘَﺨْﻠِﺼْﻪُ ﻟِﻨَﻔْﺴِﻲْ ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﻛَﻠَّﻤَﻪُ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﻧَّﻚَ ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﻟَﺪَﻳْﻨَﺎ ﻣِﻜِﻴْﻦٌ ﺃَﻣِﻴْﻦٌ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৫৪ ‏) –
‘বাদশাহ বলল, তাকে তোমরা আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে আমার নিজের জন্য একান্ত সহচর করে নেব। অতঃপর যখন বাদশাহ ইউসুফের সাথে মতবিনিময় করলেন, তখন তিনি তাকে বললেন, নিশ্চয়ই আপনি আজ থেকে আমাদের নিকট বিশ্বস্ত ও মর্যাদাপূর্ণ স্থানের অধিকারী’
(ইউসুফ ১২/৫৪) ।
ইউসুফের অর্থমন্ত্রীর পদ লাভ এবং সাথে সাথে বাদশাহীর ক্ষমতা লাভ:
কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এসে বাদশাহর সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে বাদশাহ যখন দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় দক্ষ ও বিশ্বস্ত লোক কোথায় পাবেন বলে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করছিলেন, তখন ইউসুফ (আঃ) নিজেকে এজন্য পেশ করেন। যেমন আল্লাহর ভাষায়-
ﻗَﺎﻝَ ﺍﺟْﻌَﻠْﻨِﻲْ ﻋَﻠَﻰ ﺧَﺰَﺁﺋِﻦِ ﺍﻷَﺭْﺽِ ﺇِﻧِّﻲْ ﺣَﻔِﻴْﻆٌ ﻋَﻠِﻴْﻢٌ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৫৫)-
‘ইউসুফ বলল, আপনি আমাকে দেশের ধন-ভান্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত করুন। আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও (এ বিষয়ে) বিজ্ঞ’ (ইউসুফ ১২/৫৫) ।
তাঁর এই পদ প্রার্থনা ও নিজের যোগ্যতা নিজ মুখে প্রকাশ করার উদ্দেশ্য নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও অহংকার প্রকাশের জন্য ছিল না। বরং কুফরী হুকূমতের অবিশ্বস্ত ও অনভিজ্ঞ মন্ত্রী ও আমলাদের হাত থেকে আসন্ন দুর্ভিক্ষ পীড়িত সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য ও তাদের প্রতি দয়ার্দ্র চিত্ততার কারণে ছিল। ইবনু কাছীর বলেন, এর মধ্যে নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়ার দলীল রয়েছে ঐ ব্যক্তির জন্য, যিনি কোন বিষয়ে নিজেকে আমানতদার ও যোগ্য বলে নিশ্চিতভাবে মনে করেন’। [23] কুরতুবী বলেন, যখন কেউ নিশ্চিতভাবে মনে করবেন যে, এ ব্যাপারে তিনি ব্যতীত যোগ্য আর কেউ নেই, তখন তাকে ঐ পদ বা দায়িত্ব চেয়ে নেওয়া ওয়াজিব হবে। পক্ষান্তরে যদি অন্য কেউ যোগ্য থাকে, তবে চেয়ে নেওয়া যাবে না। মিসরে ঐ সময় ইউসুফের চাইতে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় যোগ্য ও আমানতদার কেউ ছিল না বিধায় ইউসুফ উক্ত দায়িত্ব চেয়ে নিয়ে ছিলেন’। [24] আত্মস্বার্থ হাছিল বা পাপকাজে সাহায্য করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না।
আহলে কিতাবগণের বর্ণনা মতে এই সময় বাদশাহ তাঁকে কেবল খাদ্য মন্ত্রণালয় নয়, বরং পুরা মিসরের শাসন ক্ষমতা অর্পণ করেন এবং বলেন, আমি আপনার চাইতে বড় নই, কেবল সিংহাসন ব্যতীত’। ইবনু ইসহাকের বর্ণনা মতে এ সময় বাদশাহ তাঁর হাতে মুসলমান হন। একথাও বলা হয়েছে যে, এই সময় ‘আযীযে মিছর’ ক্বিৎফীর মারা যান। ফলে ইউসুফকে উক্ত পদে বসানো হয় এবং তার বিধবা স্ত্রী যুলায়খাকে বাদশাহ ইউসুফের সাথে বিবাহ দেন। [25] জ্ঞান ও যুক্তি একথা মেনে নিলেও কুরআন এ বিষয়ে কিছু বলেনি। যেমন রাণী বিলক্বীসের মুসলমান হওয়া সম্পর্কে কুরআন স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে (নমল ২৭/৪৪) । যেহেতু কুরআন ও হাদীছ এ বিষয়ে কিছু বলেনি, অতএব আমাদের চুপ থাকা উত্তম। আর আহলে কিতাবগণের বর্ণনা বিষয়ে রাসূলের দেওয়া মূলনীতি অনুসরণ করা উচিত যে, তাওরাত ও ইনজীল বিষয়ে আমরা তাদের কথা সত্যও বলব না, মিথ্যাও বলব না বরং আমাদের নিকটে শেষনবীর মাধ্যমে যে বিধান এসেছে, কেবল তারই অনুসরণ করব।। [26]
নবী হিসাবে সুলায়মান (আঃ)-এর যেমন উদ্দেশ্য ছিল বিলক্বীসের মুসলমান হওয়া ও তার রাজ্য থেকে শিরক উৎখাত হওয়া। অনুরূপভাবে নবী হিসাবে ইউসুফ (আঃ)-এরও উদ্দেশ্য থাকতে পারে বাদশাহর মুসলমান হওয়া এবং মিসর থেকে শিরক উৎখাত হওয়া ও সর্বত্র আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়া। বাদশাহ যখন তার ভক্ত ও অনুরক্ত ছিলেন এবং নিজের বাদশাহী তাকে সোপর্দ করেছিলেন, তখন ধরে নেওয়া যায় যে, তিনি শিরকী ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগ করে তাওহীদের অনুসারী হয়েছিলেন এবং ইউসুফকে নবী হিসাবে স্বীকার করে তাঁর শরী‘আতের অনুসারী হয়ে বাকী জীবন কাটিয়েছিলেন। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
এভাবে আল্লাহর ইচ্ছায় ইউসুফ (আঃ) মিসরের সর্বোচ্চ পদে সসম্মানে বরিত হ’লেন এবং অন্ধকূপে হারিয়ে যাওয়া ইউসুফ পুনরায় দীপ্ত সূর্যের ন্যায় পৃথিবীতে বিকশিত হয়ে উঠলেন। আল্লাহ বলেন,
ﻭَﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻣَﻜَّﻨَّﺎ ﻟِﻴُﻮﺳُﻒَ ﻓِﻲ ﺍﻷَﺭْﺽِ ﻳَﺘَﺒَﻮَّﺃُ ﻣِﻨْﻬَﺎ ﺣَﻴْﺚُ ﻳَﺸَﺂﺀُ ﻧُﺼِﻴْﺐُ ﺑِﺮَﺣْﻤَﺘِﻨَﺎ ﻣَﻦْ ﻧَﺸَﺂﺀُ ﻭَﻻَ ﻧُﻀِﻴﻊُ ﺃَﺟْﺮَ ﺍﻟْﻤُﺤْﺴِﻨِﻴْﻦَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৫৬)-
‘এমনিভাবে আমরা ইউসুফকে সেদেশে প্রতিষ্ঠা দান করি। সে তথায় যেখানে ইচ্ছা স্থান করে নিতে পারত। আমরা আমাদের রহমত যাকে ইচ্ছা তাকে পৌঁছে দিয়ে থাকি এবং আমরা সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করি না’ (ইউসুফ ১২/৫৬) । উপরোক্ত আয়াতে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে ইউসুফের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার এবং মিসরের সর্বত্র বিধান জারি করার। ইবনু কাছীর বলেন, এই সময় তিনি দ্বীনী ও দুনিয়াবী উভয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন’। [27]
ইউসুফের দক্ষ শাসন ও দুর্ভিক্ষ মুকাবিলায় অপূর্ব ব্যবস্থাপনা:
সুদ্দী, ইবনু ইসহাক্ব, ইবনু কাছীর প্রমুখ বিদ্বানগণ ইসরাঈলী রেওয়ায়াত সমূহের ভিত্তিতে যে বিবরণ দিয়েছেন, তার সারকথা এই যে, ইউসুফ (আঃ)-এর হাতে মিসরের শাসনভার অর্পিত হওয়ার পর স্বপ্নের ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রথম সাত বছর সমগ্র দেশে ব্যাপক ফসল উৎপন্ন হয়। ইউসুফ (আঃ)-এর নির্দেশক্রমে উদ্বৃত্ত ফসলের বৃহদাংশ সঞ্চিত রাখা হয়। এতে বুঝা যায় যে, আধুনিক কালের এলএসডি, সিএসডি খাদ্য গুদামের অভিযাত্রা বিগত দিনে ইউসুফ (আঃ)-এর মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল।
এরপর স্বপ্নের দ্বিতীয় অংশের বাস্তবতা শুরু হয় এবং দেশে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তিনি জানতেন যে, এ দুর্ভিক্ষ সাত বছর স্থায়ী হবে এবং আশপাশের রাজ্যসমূহে বিস্তৃত হবে। তাই সংরক্ষিত খাদ্যশস্য খুব সতর্কতার সাথে ব্যয় করা শুরু করলেন। তিনি ফ্রি বিতরণ না করে স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণের সিদ্ধান্ত নেন। সেই সাথে মাথাপ্রতি খাদ্য বিতরণের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন। তাঁর আগাম হুঁশিয়ারি মোতাবেক মিসরীয় জনগণের অধিকাংশের বাড়ীতে সঞ্চিত খাদ্যশস্য মওজূদ ছিল। ফলে পার্শ্ববর্তী দুর্ভিক্ষপীড়িত রাজ্যসমূহ থেকে দলে দলে লোকেরা মিসরে আসতে শুরু করে। ইউসুফ (আঃ) তাদের প্রত্যেককে বছরে এক উট বোঝাই খাদ্য-শস্য স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে প্রদানের নির্দেশ দেন। [28] অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়ার কারণে খাদ্য বিতরণের তদারকি ইউসুফ (আঃ) নিজেই করতেন। এতে ধরে নেওয়া যায় যে, খাদ্য-শস্যের সরকারী রেশনের প্রথা বিশ্বে প্রথম ইউসুফ (আঃ)-এর হাতেই শুরু হয়।
ভাইদের মিসরে আগমন:
মিসরের দুর্ভিক্ষ সে দেশের সীমানা পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দূর-দূরান্ত এলাকা সমূহে বিস্তৃত হয়। ইবরাহীম, ইসহাক্ব ও ইয়াকূবের আবাসভূমি কেন‘আনও দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে পতিত হয়। ফলে ইয়াকূবের পরিবারেও অনটন দেখা দেয়। এ সময় ইয়াকূব (আঃ)-এর কানে এ খবর পৌঁছে যায় যে, মিসরের নতুন বাদশাহ অত্যন্ত সৎ ও দয়ালু। তিনি স্বল্পমূল্যে এক উট পরিমাণ খাদ্যশস্য অভাবী ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করছেন। এ খবর শুনে তিনি পুত্রদের বললেন, তোমরাও মিসরে গিয়ে খাদ্যশস্য নিয়ে এসো। সেমতে দশ ভাই দশটি উট নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল। বৃদ্ধ পিতার খিদমত ও বাড়ী দেখাশুনার জন্য ছোট ভাই বেনিয়ামীন একাকী রয়ে গেল। কেন‘আন থেকে মিসরের রাজধানী প্রায় ২৫০ মাইলের ব্যবধান।
যথাসময়ে দশভাই কেন‘আন থেকে মিসরে উপস্থিত হ’ল। ইউসুফ (আঃ) তাদেরকে চিনে ফেললেন। কিন্তু তারা তাঁকে চিনতে পারেনি। যেমন আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺟَﺎﺀ ﺇِﺧْﻮَﺓُ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ﻓَﺪَﺧَﻠُﻮْﺍ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻓَﻌَﺮَﻓَﻬُﻢْ ﻭَﻫُﻢْ ﻟَﻪُ ﻣُﻨْﻜِﺮُﻭْﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৫৮)-
‘ইউসুফের ভাইয়েরা আগমন করল এবং তার কাছে উপস্থিত হ’ল। ইউসুফ তাদেরকে চিনতে পারল। কিন্তু তারা তাকে চিনতে পারেনি’ (ইউসুফ ১২/৫৮) ।
ইউসুফের কৌশল অবলম্বন ও বেনিয়ামীনের মিসর আগমন :
সুদ্দী ও অন্যান্যদের বরাতে কুরতুবী ও ইবনু কাছীর বর্ণনা করেন যে, দশ ভাই দরবারে পৌঁছলে ইউসুফ (আঃ) তাদেরকে দোভাষীর মাধ্যমে এমনভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, যেমন অচেনা লোকদের করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল তাদের সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং পিতা ইয়াকূব ও ছোটভাই বেনিয়ামীনের বর্তমান অবস্থা জেনে নেওয়া। যেমন তিনি জিজ্ঞেস করেন, তোমরা ভিন্নভাষী এবং ভিনদেশী। আমরা কিভাবে বুঝব যে, তোমরা শত্রুর গুপ্তচর নও? তারা বলল, আল্লাহর কসম! আমরা গুপ্তচর নই। আমরা আল্লাহর নবী ইয়াকূব (আঃ)-এর সন্তান। তিনি কেন‘আনে বসবাস করেন। অভাবের তাড়নায় তাঁর নির্দেশে সুদূর পথ অতিক্রম করে আপনার কাছে এসেছি আপনার সুনাম-সুখ্যাতি শুনে। যদি আপনি আমাদের সন্দেহ বশে গ্রেফতার করেন অথবা শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন, তাহ’লে আমাদের অতিবৃদ্ধ পিতা-মাতা ও আমাদের দশ ভাইয়ের পরিবার না খেয়ে মারা পড়বে। [29]
একথা শুনে ইউসুফের হৃদয় উথলে উঠল। কিন্তু অতি কষ্টে বুকে পাষাণ চেপে রেখে বললেন, তোমাদের পিতার আরও কোন সন্তান আছে কি?
তারা বলল, আমরা বারো ভাই ছিলাম। তন্মধ্যে এক ভাই ইউসুফ ছোট বেলায় জঙ্গলে হারিয়ে গেছে। আমাদের পিতা তাকেই সর্বাধিক স্নেহ করতেন। অতঃপর তার সহোদর সবার ছোট ভাই বেনিয়ামীন এখন বাড়ীতে আছে পিতাকে দেখাশুনার জন্য। সবকথা শুনে নিশ্চিত হবার পর ইউসুফ (আঃ) তাদেরকে রাজকীয় মেহমানের মর্যাদায় রাখার এবং যথারীতি খাদ্য-শস্য প্রদানের নির্দেশ দিলেন। অতঃপর বিদায়ের সময় তাদের বললেন, পুনরায় আসার সময় তোমরা তোমাদের ছোট ভাইটিকে সাথে নিয়ে এসো। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ-
ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﺟَﻬَّﺰَﻫُﻢْ ﺑِﺠَﻬَﺎﺯِﻫِﻢْ ﻗَﺎﻝَ ﺍﺋْﺘُﻮﻧِﻲْ ﺑِﺄَﺥٍ ﻟَّﻜُﻢ ﻣِّﻦْ ﺃَﺑِﻴْﻜُﻢْ ﺃَﻻَ ﺗَﺮَﻭْﻥَ ﺃَﻧِّﻲْ ﺃُﻭْﻓِﻲ ﺍﻟْﻜَﻴْﻞَ ﻭَﺃَﻧَﺎ ﺧَﻴْﺮُ ﺍﻟْﻤُﻨْﺰِﻟِﻴْﻦَ – ﻓَﺈِﻥ ﻟَّﻢْ ﺗَﺄْﺗُﻮﻧِﻲْ ﺑِﻪِ ﻓَﻼَ ﻛَﻴْﻞَ ﻟَﻜُﻢْ ﻋِﻨْﺪِﻱ ﻭَﻻَ ﺗَﻘْﺮَﺑُﻮﻥِ – ﻗَﺎﻟُﻮﺍْ ﺳَﻨُﺮَﺍﻭِﺩُ ﻋَﻨْﻪُ ﺃَﺑَﺎﻩُ ﻭَﺇِﻧَّﺎ ﻟَﻔَﺎﻋِﻠُﻮﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৫৯-৬১ ‏) –
‘অতঃপর ইউসুফ যখন তাদের রসদ সমূহ প্রস্ত্তত করে দিল, তখন বলল, তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাইকে আমার কাছে নিয়ে এসো। তোমরা কি দেখছ না যে, আমি মাপ পূর্ণভাবে দিয়ে থাকি এবং মেহমানদের উত্তম সমাদর করে থাকি’? (৫৯) । ‘কিন্তু যদি তোমরা তাকে আমার কাছে না আনো, তবে আমার কাছে তোমাদের কোন বরাদ্দ নেই এবং তোমরা আমার নিকটে পৌঁছতে পারবে না’ (৬০) । ‘ভাইয়েরা বলল, আমরা তার সম্পর্কে তার পিতাকে রাযী করার চেষ্টা করব এবং আমরা একাজ অবশ্যই করব’ (ইউসুফ ১২/৫৯-৬১) ।
এরপর ইউসুফ (আঃ) কৌশল অবলম্বন করলেন। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, দশটি উটের সমপরিমাণ খাদ্যমূল্য সংগ্রহ করতে ভাইদের সামর্থ্য নাও হ’তে পারে। অথচ ছোট ভাইকে আনা প্রয়োজন। সেকারণ তিনি কর্মচারীদের বলে দিলেন, খাদ্যমূল্য বাবদ তাদের দেওয়া অর্থ তাদের কোন একটি বস্তার মধ্যে ভরে দিতে। যাতে বাড়ী গিয়ে উক্ত টাকা নিয়ে আবার তারা চলে আসতে পারে। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ-
ﻭَﻗَﺎﻝَ ﻟِﻔِﺘْﻴَﺎﻧِﻪِ ﺍﺟْﻌَﻠُﻮْﺍ ﺑِﻀَﺎﻋَﺘَﻬُﻢْ ﻓِﻲ ﺭِﺣَﺎﻟِﻬِﻢْ ﻟَﻌَﻠَّﻬُﻢْ ﻳَﻌْﺮِﻓُﻮْﻧَﻬَﺎ ﺇِﺫَﺍ ﺍﻧْﻘَﻠَﺒُﻮْﺍ ﺇِﻟَﻰ ﺃَﻫْﻠِﻬِﻢْ ﻟَﻌَﻠَّﻬُﻢْ ﻳَﺮْﺟِﻌُﻮْﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৬২)-
‘ইউসুফ তার কর্মচারীদের বলল, তাদের পণ্যমূল্য তাদের রসদ-পত্রের মধ্যে রেখে দাও, যাতে গৃহে পৌঁছে তারা তা বুঝতে পারে। সম্ভবতঃ তারা পুনরায় আসবে’ (ইউসুফ ১২/৬২) ।
ইউসুফের ভাইয়েরা যথাসময়ে বাড়ী ফিরে এল। বস্তা খুলে পণ্যমূল্য ফেরত পেয়ে তারা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। তারা এটাকে তাদের প্রতি আযীযে মিছরের বিশেষ অনুগ্রহ বলে ধারণা করল। এক্ষণে তারা পিতাকে বলল, আববা! আমরা যখন পণ্যমূল্য পেয়ে গেছি, তখন আমরা সত্বর পুনরায় মিসরে যাব। তবে মিসররাজ আমাদেরকে একটি শর্ত দিয়েছেন যে, এবারে যাওয়ার সময় ছোট ভাই বেনিয়ামীনকে নিয়ে যেতে হবে। তাকে ছেড়ে গেলে খাদ্যশস্য দিবেন না বলে তিনি স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। অতএব আপনি তাকে আমাদের সাথে যাবার অনুমতি দিন। জবাবে পিতা ইয়াকূব (আঃ) বললেন, তার সম্পর্কে তোমাদের কিভাবে বিশ্বাস করব? ইতিপূর্বে তোমরা তার ভাই ইউসুফ সম্পর্কে বিশ্বাসভঙ্গ করেছ’। অতঃপর পরিবারের অভাব-অনটনের কথা ভেবে তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়ে তিনি বেনিয়ামীনকে তাদের সাথে যাবার অনুমতি দিলেন। ঘটনাটি কুরআনের ভাষায় নিম্নরূপ-
ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺭَﺟَﻌُﻮْﺍ ﺇِﻟَﻰ ﺃَﺑِﻴْﻬِﻢْ ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﻣُﻨِﻊَ ﻣِﻨَّﺎ ﺍﻟْﻜَﻴْﻞُ ﻓَﺄَﺭْﺳِﻞْ ﻣَﻌَﻨَﺎ ﺃَﺧَﺎﻧَﺎ ﻧَﻜْﺘَﻞْ ﻭَﺇِﻧَّﺎ ﻟَﻪُ ﻟَﺤَﺎﻓِﻈُﻮْﻥَ – ﻗَﺎﻝَ ﻫَﻞْ ﺁﻣَﻨُﻜُﻢْ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﺇِﻻَّ ﻛَﻤَﺎ ﺃَﻣِﻨﺘُﻜُﻢْ ﻋَﻠَﻰ ﺃَﺧِﻴْﻪِ ﻣِﻦ ﻗَﺒْﻞُ ﻓَﺎﻟﻠﻪُ ﺧَﻴْﺮٌ ﺣَﺎﻓِﻈﺎً ﻭَﻫُﻮَ ﺃَﺭْﺣَﻢُ ﺍﻟﺮَّﺍﺣِﻤِﻴْﻦَ – ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﻓَﺘَﺤُﻮْﺍ ﻣَﺘَﺎﻋَﻬُﻢْ ﻭَﺟَﺪُﻭْﺍ ﺑِﻀَﺎﻋَﺘَﻬُﻢْ ﺭُﺩَّﺕْ ﺇِﻟَﻴْﻬِﻢْ ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﻣَﺎ ﻧَﺒْﻐِﻲ ﻫَـﺬِﻩِ ﺑِﻀَﺎﻋَﺘُﻨَﺎ ﺭُﺩَّﺕْ ﺇِﻟَﻴْﻨَﺎ ﻭَﻧَﻤِﻴْﺮُ ﺃَﻫْﻠَﻨَﺎ ﻭَﻧَﺤْﻔَﻆُ ﺃَﺧَﺎﻧَﺎ ﻭَﻧَﺰْﺩَﺍﺩُ ﻛَﻴْﻞَ ﺑَﻌِﻴْﺮٍ ﺫَﻟِﻚَ ﻛَﻴْﻞٌ ﻳَﺴِﻴْﺮٌ – ﻗَﺎﻝَ ﻟَﻦْ ﺃُﺭْﺳِﻠَﻪُ ﻣَﻌَﻜُﻢْ ﺣَﺘَّﻰ ﺗُﺆْﺗُﻮْﻥِ ﻣَﻮْﺛِﻘﺎً ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻟَﺘَﺄْﺗُﻨَّﻨِﻲْ ﺑِﻪِ ﺇِﻻَّ ﺃَﻥ ﻳُّﺤَﺎﻁَ ﺑِﻜُﻢْ ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺁﺗَﻮْﻩُ ﻣَﻮْﺛِﻘَﻬُﻢْ ﻗَﺎﻝَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻰ ﻣَﺎ ﻧَﻘُﻮْﻝُ ﻭَﻛِﻴْﻞٌ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৬৩-৬৬)-
‘অতঃপর তারা যখন তাদের পিতার কাছে ফিরে এল, তখন বলল, হে আমাদের পিতা! আমাদের জন্য খাদ্যশস্যের বরাদ্দ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অতএব আপনি আমাদের সাথে আমাদের ভাইকে প্রেরণ করুন, যাতে আমরা খাদ্যশস্যের বরাদ্দ আনতে পারি। আমরা অবশ্যই তার পুরোপুরি হেফাযত করব’ (৬৩) । ‘পিতা বললেন, আমি কি তার সম্পর্কে তোমাদের সেইরূপ বিশ্বাস করব, যেরূপ বিশ্বাস ইতিপূর্বে তার ভাই সম্পর্কে করেছিলাম? অতএব আল্লাহ উত্তম হেফাযতকারী এবং তিনিই সর্বাধিক দয়ালু’ (৬৪) । ‘অতঃপর যখন তারা পণ্য সম্ভার খুলল, তখন দেখতে পেল যে, তাদেরকে তাদের পণ্যমূল্য ফেরত দেওয়া হয়েছে। তারা (আনন্দে) বলে উঠলো, হে আমাদের পিতা! আমরা আর কি চাইতে পারি? এইতো আমাদের দেওয়া পণ্যমূল্য আমাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা আবার আমাদের পরিবারের জন্য খাদ্যশস্য আনব। আমরা আমাদের ভাইয়ের হেফাযত করব এবং এক উট খাদ্যশস্য বেশী আনতে পারব এবং ঐ বরাদ্দটা খুবই সহজ’ (৬৫) । ‘পিতা বললেন, তাকে তোমাদের সাথে পাঠাব না, যতক্ষণ না তোমরা আমার নিকটে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার কর যে, তাকে অবশ্যই আমার কাছে পৌঁছে দেবে। অবশ্য যদি তোমরা একান্তভাবেই অসহায় হয়ে পড় (তবে সেকথা স্বতন্ত্র)। অতঃপর যখন সবাই তাঁকে অঙ্গীকার দিল, তখন তিনি বললেন, আমাদের মধ্যে যে কথা হ’ল, সে ব্যাপারে আল্লাহ মধ্যস্থ রইলেন’ (ইউসুফ ১২/৬৩-৬৬) ।
উপরের আলোচনায় মনে হচ্ছে যে, দশভাই বাড়ী এসেই প্রথমে তাদের পিতার কাছে বেনিয়ামীনকে নিয়ে যাবার ব্যাপারে দরবার করেছে। অথচ তারা ভাল করেই জানত যে, এ প্রস্তাবে পিতা কখনোই রাযী হবেন না। দীর্ঘদিন পরে বাড়ী ফিরে অভাবের সংসারে প্রথমে খাদ্যশস্যের বস্তা না খুলে বৃদ্ধ পিতার অসন্তুষ্টি উদ্রেককারী বিষয় নিয়ে কথা বলবে, এটা ভাবা যায় না। পণ্যমূল্য ফেরত পাওয়ায় খুশীর মুহূর্তেই বরং এরূপ প্রস্তাব দেওয়াটা যুক্তিসম্মত।
উল্লেখ্য যে, কুরআনী বর্ণনায় আগপিছ হওয়াতে ঘটনার আগপিছ হওয়া যরূরী নয়। যেমন মূসা (আঃ)-এর কওমের গাভী কুরবানীর ঘটনা বর্ণনা (বাক্বারাহ ৬৭-৭১) শেষে ঘটনার কারণ ও সূত্র বর্ণনা করা হয়েছে (বাক্বারাহ ৭২-৭৩) । এমন বিবরণ কুরআনের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়। এখানেও সেটা হয়েছে বলে অনুমিত হয়।
ছেলেদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়ে বেনিয়ামীনকে তাদের সাথে পাঠাবার ব্যাপারে সম্মত হওয়ার পর পিতা ইয়াকূব (আঃ) পরিষ্কারভাবে বলেন, ﻓَﺎﻟﻠﻪُ ﺧَﻴْﺮٌ ﺣَﺎﻓِﻈﺎً ‘আল্লাহ্ই উত্তম হেফাযতকারী’ (ইউসুফ ১২/৬৪) । অর্থাৎ তিনি বেনিয়ামীনকে আল্লাহর হাতেই সোপর্দ করলেন। আল্লাহ তার বান্দার এই আকুতি শুনলেন। অতঃপর ইয়াকূব (আঃ) ছেলেদেরকে কিছু উপদেশ দেন, যার মধ্যে তাঁর বাস্তববুদ্ধি ও দূরদর্শিতার প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি তাদেরকে একসাথে একই প্রবেশদ্বার দিয়ে মিসরের রাজধানীতে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন। বরং তাদেরকে পৃথক পৃথক ভাবে বিভিন্ন দরজা দিয়ে শহরে প্রবেশ করতে বলেন। কেননা তিনি ভেবেছিলেন যে, একই পিতার সন্তান সুন্দর ও সুঠামদেহী ১১ জন ভিনদেশীকে একত্রে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেখলে অনেকে মন্দ কিছু সন্দেহ করবে। দ্বিতীয়তঃ
প্রথমবার সফরে মিসররাজ তাদের প্রতি যে রাজকীয় মেহমানদারী প্রদর্শন করেছেন, তাতে অনেকের মনে হিংসা জেগে থাকতে পারে এবং তারা তাদের ক্ষতি করতে পারে। তৃতীয়তঃ তাদের প্রতি অন্যদের কুদৃষ্টি লাগতে পারে। বিষয়টি আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবে,
ﻭَﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﺑَﻨِﻲَّ ﻻَ ﺗَﺪْﺧُﻠُﻮﺍْ ﻣِﻦْ ﺑَﺎﺏٍ ﻭَﺍﺣِﺪٍ ﻭَﺍﺩْﺧُﻠُﻮﺍْ ﻣِﻦْ ﺃَﺑْﻮَﺍﺏٍ ﻣُّﺘَﻔَﺮِّﻗَﺔٍ ﻭَﻣَﺎ ﺃُﻏْﻨِﻲْ ﻋَﻨﻜُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻣِﻦْ ﺷَﻲْﺀٍ ﺇِﻥِ ﺍﻟْﺤُﻜْﻢُ ﺇِﻻَّ ِﻟﻠﻪِ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﺗَﻮَﻛَّﻠْﺖُ ﻭَﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻓَﻠْﻴَﺘَﻮَﻛَّﻞِ ﺍﻟْﻤُﺘَﻮَﻛِّﻠُﻮْﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৬৭)-
‘ইয়াকূব বললেন, হে আমার সন্তানেরা! তোমরা সবাই একই দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না। বরং পৃথক পৃথক দরজা দিয়ে প্রবেশ কর। তবে আল্লাহ থেকে আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারি না। আল্লাহ ব্যতীত কারু হুকুম চলে না। তাঁর উপরেই আমি ভরসা করি এবং তাঁর উপরেই ভরসা করা উচিত সকল ভরসাকারীর’ (ইউসুফ ১২/৬৭) ।
অতঃপর পিতার নিকট থেকে বিদায় নিয়ে বেনিয়ামীন সহ ১১ ভাই ১১টি উট নিয়ে মিসরের পথে যাত্রা করল। পথিমধ্যে তাদের কোনরূপ বাধা-বিঘ্ন ঘটেনি। মিসরে পৌঁছে তারা পিতার উপদেশ মতে বিভিন্ন দরজা দিয়ে পৃথক পৃথকভাবে শহরে প্রবেশ করল। ইয়াকূবের এ পরামর্শ ছিল পিতৃসূলভ স্নেহ-মমতা হ’তে উৎসারিত। যার ফল সন্তানেরা পেয়েছে। তারা কারু হিংসার শিকার হয়নি কিংবা কারু বদনযরে পড়েনি। কিন্তু এর পরেও আল্লাহর পূর্ব নির্ধারিত তাক্বদীর কার্যকর হয়েছে। বেনিয়ামীন চুরির মিথ্যা অপবাদে গ্রেফতার হয়ে যায়। যা ছিল ইয়াকূবের জন্য দ্বিতীয়বার সবচেয়ে বড় আঘাত। কিন্তু এটা ইয়াকূবের দো‘আর পরিপন্থী ছিল না। কেননা তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ থেকে আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারি না। আল্লাহ ব্যতীত কারু হুকুম চলে না’ (ইউসুফ ১২/৬৭) । অতএব পিতার নির্দেশ পালনকরলেও তারা আল্লাহর পূর্বনির্ধারণ বা তাক্বদীরকে এড়াতে পারেনি। আর সেই তাক্বদীরের ফলেই ইয়াকূব (আঃ) তার হারানো দু’সন্তানকে একত্রে ফিরে পান। ইয়াকূবের গভীর জ্ঞানের প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন, ﻭَﺇِﻧَّﻪُ ﻟَﺬُﻭْ ﻋِﻠْﻢٍ ﻟِّﻤَﺎ ﻋَﻠَّﻤْﻨَﺎﻩُ ﻭَﻟَـﻜِﻦَّ ﺃَﻛْﺜَﺮَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻻَ ﻳَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ، ‘ইয়াকূব বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। যা আমরা তাকে দান করেছিলাম। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না’ (ইউসুফ ১২/৬৮) ।
বলা বাহুল্য, ইয়াকূবের সেই ইল্ম ছিল আল্লাহর সত্তা ও তাঁর গুণাবলীর ইল্ম, আল্লাহর অতুলনীয় ক্ষমতার ইল্ম। আর এটাই হ’ল মা‘রেফাত বা দিব্যজ্ঞান, যা সূক্ষ্মদর্শী মুত্তাক্বী আলেমগণ লাভ করে থাকেন। সেজন্যেই তিনি নিজের দেওয়া কৌশলের উপরে নির্ভর না করে আল্লাহর উপরে ভরসা করেন ও তাঁর উপরেই ছেলেদের ন্যস্ত করেন। সেকারণেই আল্লাহ তাঁর নিজস্ব কৌশল প্রয়োগ করে ছেলেদেরকে সসম্মানে পিতার কোলে ফিরিয়ে দেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ ।
উক্ত বিষয়গুলি কুরআনে বর্ণিত হয়েছে নিম্নরূপে:
ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﺩَﺧَﻠُﻮْﺍ ﻣِﻦْ ﺣَﻴْﺚُ ﺃَﻣَﺮَﻫُﻢْ ﺃَﺑُﻮْﻫُﻢْ ﻣَّﺎ ﻛَﺎﻥَ ﻳُﻐْﻨِﻲْ ﻋَﻨْﻬُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻣِﻦْ ﺷَﻲْﺀٍ ﺇِﻻَّ ﺣَﺎﺟَﺔً ﻓِﻲْ ﻧَﻔْﺲِ ﻳَﻌْﻘُﻮْﺏَ ﻗَﻀَﺎﻫَﺎ ﻭَﺇِﻧَّﻪُ ﻟَﺬُﻭْ ﻋِﻠْﻢٍ ﻟِّﻤَﺎ ﻋَﻠَّﻤْﻨَﺎﻩُ ﻭَﻟَـﻜِﻦَّ ﺃَﻛْﺜَﺮَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻻَ ﻳَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ – ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﺩَﺧَﻠُﻮﺍْ ﻋَﻠَﻰ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ﺁﻭَﻯ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﺃَﺧَﺎﻩُ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﻧِّﻲ ﺃَﻧَﺎْ ﺃَﺧُﻮْﻙَ ﻓَﻼَ ﺗَﺒْﺘَﺌِﺲْ ﺑِﻤَﺎ ﻛَﺎﻧُﻮْﺍ ﻳَﻌْﻤَﻠُﻮْﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৬৮-৬৯)-
‘তারা যখন তাদের পিতার নির্দেশনা মতে শহরে প্রবেশ করল, তখন আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে তা তাদের বাঁচাতে পারল না (অর্থাৎ তাদের সে কৌশল কাজে আসল না এবং বেনিয়ামীন গ্রেফতার হ’ল)। কেবল ইয়াকূবের একটি প্রয়োজন (অর্থাৎ ছেলেদের দেওয়া পরামর্শে) যা তার মনের মধ্যে (অর্থাৎ, স্নেহ মিশ্রিত তাকীদ) ছিল, যা তিনি পূর্ণ করেছিলেন বস্ত্ততঃ তিনি তো ছিলেন একজন জ্ঞানী, যে জ্ঞান আমরা তাকে শিক্ষা দিয়েছিলাম (অর্থাৎ আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান)। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’। ‘অতঃপর যখন তারা ইউসুফের নিকটে উপস্থিত হ’ল, তখন সে তার ভাই (বেনিয়ামীন)-কে নিজের কাছে রেখে দিল এবং (গোপনে তাকে) বলল, নিশ্চয়ই আমি তোমার সহোদর ভাই (ইউসুফ)। অতএব তাদের (অর্থাৎ সৎ ভাইদের) কৃতকর্মের জন্য দুঃখ করো না’ (ইউসুফ ১২/৬৮-৬৯) ।
বেনিয়ামীনকে আটকে রাখা হ’ল:
সহোদর ছোট ভাই বেনিয়ামীনকে রেখে দেবার জন্য ইউসুফ (আঃ) আল্লাহর হুকুমে একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করলেন। যখন সকল ভাইকে নিয়ম মাফিক খাদ্য-শস্য প্রদান করা হ’ল এবং পৃথক পৃথক বস্তায় পৃথক নামে পৃথক উটের পিঠে চাপানো হ’ল, তখন গোপনে বেনিয়ামীনের বস্তার মধ্যে বাদশাহর নিজস্ব ব্যবহৃত স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত ওযন পাত্র, যা ছিল অতীব মূল্যবান, সেটিকে ভরে দেওয়া হ’ল। অতঃপর কাফেলা বের হয়ে কিছু দূর গেলে পিছন থেকে জনৈক রাজকর্মচারী ছুটে গিয়ে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করল, হে কাফেলার লোকেরা! তোমরা চোর। দাঁড়াও তোমাদের তল্লাশি করা হবে। ঘটনাটির বর্ণনা কুরআনের ভাষায় নিম্নরূপ:
ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺟَﻬَّﺰَﻫُﻢْ ﺑِﺠَﻬَﺎﺯِﻫِﻢْ ﺟَﻌَﻞَ ﺍﻟﺴِّﻘَﺎﻳَﺔَ ﻓِﻲْ ﺭَﺣْﻞِ ﺃَﺧِﻴْﻪِ ﺛُﻢَّ ﺃَﺫَّﻥَ ﻣُﺆَﺫِّﻥٌ ﺃَﻳَّﺘُﻬَﺎ ﺍﻟْﻌِﻴْﺮُ ﺇِﻧَّﻜُﻢْ ﻟَﺴَﺎﺭِﻗُﻮْﻥَ – ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻭَﺃَﻗْﺒَﻠُﻮْﺍ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﻣَﺎﺫَﺍ ﺗَﻔْﻘِﺪُﻭْﻥَ – ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻧَﻔْﻘِﺪُ ﺻُﻮَﺍﻉَ ﺍﻟْﻤَﻠِﻚِ ﻭَﻟِﻤَﻦْ ﺟَﺎﺀ ﺑِﻪِ ﺣِﻤْﻞُ ﺑَﻌِﻴْﺮٍ ﻭَﺃَﻧَﺎ ﺑِﻪِ ﺯَﻋِﻴْﻢٌ – ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺗَﺎﻟﻠﻪِ ﻟَﻘَﺪْ ﻋَﻠِﻤْﺘُﻢْ ﻣَﺎ ﺟِﺌْﻨَﺎ ﻟِﻨُﻔْﺴِﺪَ ﻓِﻲ ﺍﻷَﺭْﺽِ ﻭَﻣَﺎ ﻛُﻨَّﺎ ﺳَﺎﺭِﻗِﻴْﻦَ – ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻓَﻤَﺎ ﺟَﺰَﺁﺅُﻩُ ﺇِﻥْ ﻛُﻨﺘُﻢْ ﻛَﺎﺫِﺑِﻴْﻦَ – ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺟَﺰَﺁﺅُﻩُ ﻣَﻦْ ﻭُﺟِﺪَ ﻓِﻲْ ﺭَﺣْﻠِﻪِ ﻓَﻬُﻮَ ﺟَﺰَﺍﺅُﻩُ ﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻧَﺠْﺰِﻱ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤِﻴْﻦَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৮০-৮৫)-
‘অতঃপর যখন ইউসুফ তাদের জন্য খাদ্যশস্য প্রস্ত্তত করে দিচ্ছিল, তখন একটি পাত্র তার (সহোদর) ভাইয়ের বরাদ্দ খাদ্যশস্যের মধ্যে রেখে দিল। অতঃপর একজন ঘোষক ডেকে বলল, হে কাফেলার লোকজন! তোমরা অবশ্যই চোর’ (৭০) । ‘একথা শুনে তারা ওদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, তোমাদের কি হারিয়েছে’? (৭১) । ‘তারা বলল, আমরা বাদশাহর ওযনপাত্র হারিয়েছি। যে কেউ এটা এনে দেবে, সে এক উটের বোঝা পরিমাণ মাল পাবে এবং আমি এটার যামিন রইলাম’
(৭২) । ‘তারা বলল, আল্লাহর কসম! তোমরা তো জানো যে, আমরা এদেশে কোনরূপ অনর্থ ঘটাতে আসিনি এবং আমরা কখনোই চোর নই’ (৭৩) । বাদশাহর লোকেরা বলল, ‘যদি তোমরা মিথ্যাবাদী হও তবে যে চুরি করেছে, তার শাস্তি কি হবে’? (৭৪) । ‘তারা বলল, (আমাদের নবী ইয়াকূবের শরী‘আত অনুযায়ী) এর শাস্তি এই যে, যার খাদ্যশস্যের বস্তা থেকে এটা পাওয়া যাবে, তার শাস্তি স্বরূপ সে (মালিকের) গোলাম হবে। আমরা যালেমদেরকে এভাবেই শাস্তি দিয়ে থাকি’ (ইউসুফ ১২/৭০-৭৫) ।
এভাবে ইউসুফ তার ভাইদের মুখ দিয়েই তাদের শরী‘আতের বিধান জেনে নিলেন এবং সভাসদগণ সবাই তা জানলো। যদিও ইউসুফ তার পিতার শরী‘আতের বিধান জানতেন এবং নিজেও নবী ছিলেন। আল্লাহ বলেন,
ﻓَﺒَﺪَﺃَ ﺑِﺄَﻭْﻋِﻴَﺘِﻬِﻢْ ﻗَﺒْﻞَ ﻭِﻋَﺎﺀِ ﺃَﺧِﻴْﻪِ ﺛُﻢَّ ﺍﺳْﺘَﺨْﺮَﺟَﻬَﺎ ﻣِﻦْ ﻭِﻋَﺎﺀِ ﺃَﺧِﻴْﻪِ ﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻛِﺪْﻧَﺎ ﻟِﻴُﻮْﺳُﻒَ ﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﻟِﻴَﺄْﺧُﺬَ ﺃَﺧَﺎﻩُ ﻓِﻲْ ﺩِﻳْﻦِ ﺍﻟْﻤَﻠِﻚِ ﺇِﻻَّ ﺃَﻥ ﻳَّﺸَﺂﺀَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻧَﺮْﻓَﻊُ ﺩَﺭَﺟَﺎﺕٍ ﻣَّﻦْ ﻧَﺸَﺂﺀُ ﻭَﻓَﻮْﻕَ ﻛُﻞِّ ﺫِﻱ ﻋِﻠْﻢٍ ﻋَﻠِﻴْﻢٌ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৭৬)-
‘অতঃপর (ইউসুফের নির্দেশ মোতাবেক) তার ভাইয়ের বস্তার পূর্বে (ঘোষক) অন্য ভাইদের বস্তা তল্লাশি শুরু করল। অবশেষে সেই পাত্রটি তার (সহোদর) ভাইয়ের বস্তা থেকে বের করল। এমনিভাবে আমরা ইউসুফকে কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলাম। সে বাদশাহর (প্রচলিত) আইনে আপন ভাইকে কখনো নিজ অধিকারে নিতে পারত না আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত। আমরা যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় উন্নীত করি এবং (সত্য কথা এই যে,) প্রত্যেক জ্ঞানীর উপরে জ্ঞানী আছেন
(ইউসুফ ১২/৭৬) ।
শিক্ষণীয় বিষয় :
(১) আল্লাহর উপরোক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে একথা বুঝানো হয়েছে যে, ভাইদের মর্যাদার চেয়ে ইউসুফের মর্যাদা আল্লাহ অধিক উন্নীত করেছেন (২) এতদ্ব্যতীত এ বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ইয়াকূব (আঃ) নিজ জ্ঞান মোতাবেক বেনিয়ামীনকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে আনার জন্য ছেলেদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেওয়ার মাধ্যমে যে কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, তার চাইতে ইউসুফের মাধ্যমে আল্লাহ যে জ্ঞানের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তা ছিল অনেক ঊর্ধ্বের এবং অনেক সুদূর প্রসারী। কেননা এর ফলেই পরবর্তীতে ইয়াকূব (আঃ) সব ছেলেদের নিয়ে সপরিবারে মিসরে উচ্চ সম্মান নিয়ে আগমনের সুযোগ পান।
প্রশ্ন হ’তে পারে যে, ইউসুফ (আঃ) বেনিয়ামীনকে চোর বানিয়ে নিজের কাছে রেখে দেবার মত নিষ্ঠুর পন্থা বেছে নিলেন কেন? তাছাড়া এর দ্বারা তার বৃদ্ধ পিতা ইয়াকূব (আঃ) যে আরও বেশী মনোকষ্ট পাবেন, তাতো তিনি জানতেন। তিনি এটাও জানতেন যে, তাকে হারিয়ে শোকে-দুঃখে তার পিতা কাতর হয়ে আছেন। এ প্রশ্নের জবাব আল্লাহ নিজেই দিয়েছেন যে, ‘আমরাই ইউসুফকে এ কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলাম। নইলে বাদশাহর (প্রচলিত) আইনে আপন ভাইকে সে কখনো নিজ অধিকারে নিতে পারত না’ (ইউসুফ ১২/৭৬) । অতএব আল্লাহর হুকুমে ইউসুফ এ কাজ করেছিলেন। এখানে তার নিজের কিছুই করার ছিল না।
(৩) একটি সাধারণ নীতি এখানে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, প্রত্যেক জ্ঞানীর উপরে জ্ঞানী আছেন। অতএব মানুষ যেন তার জ্ঞানের বড়াই না করে। ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, এখানে আল্লাহকেই সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী বলে বুঝানো হয়েছে (কুরতুবী) ।
বেনিয়ামীনকে ফিরিয়ে নেবার জন্য ভাইদের প্রচেষ্টা :
চোর হিসাবে বিদেশে গ্রেফতার হওয়া ও গোলামীর শৃংখলে আবদ্ধ হওয়ার মত লজ্জাষ্কর ঘটনায় প্রত্যেক ভাই-ই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। স্বয়ং বেনিয়ামীনও এজন্য প্রস্ত্তত ছিল না। তবে তার মনে এতটুকু সান্ত্বনা ছিল যে, সে তার ভাইয়ের কাছে থাকবে। কিন্তু চুরির মত অপবাদ সহ্য করা নিঃসন্দেহে কষ্টদায়ক ছিল। কিন্তু বিদেশ-বিভূঁইয়ে ভিন রাজ্যে তাদের কিছু করারও ছিল না। অবশেষে সকলে মিলে বাদশাহর কাছে গিয়ে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নিল। তারা গিয়ে বাদশাহ্কে বলল, আমাদের যিনি বৃদ্ধ পিতা আছেন, ছোট ছেলেটি তাঁর অতীব প্রিয়। এর বিচ্ছেদের বেদনা তিনি সইতে পারবেন না। তাই আমাদের অনুরোধ, আপনি তার বদলে আমাদের একজনকে রেখে দিন’। কিন্তু বাদশাহ (ইউসুফ) তাতে রাযী হলেন না। তিনি বললেন, যার কাছে মাল পাওয়া গেছে, তাকে বাদ দিয়ে অন্যকে গ্রেফতার করা আইনসিদ্ধ নয়।
শত অনুনয়-বিনয়ে কাজ না হওয়ায় অবশেষে মনের ক্ষেদ প্রকাশ করে তাদের কেউ বলে ফেলল, সে যদি চুরি করে থাকে, তবে এতে আর আশ্চর্যের কি আছে। ওর ভাইও ইতিপূর্বে চুরি করেছিল। এর দ্বারা তারা বুঝাতে চেয়েছিল যে, আমরা দশভাই ঠিক আছি, ওরা দুই সহোদর ভাই-ই চোর
(নাঊযুবিল্লাহ) । ইউসুফকে কাছে রাখার জন্য শৈশবে তার স্নেহপরায়ণ ফুফু যে চুরির ঘটনা সাজিয়েছিল, সে ঘটনার দিকেই তারা ইঙ্গিত করেছিল, যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। যদিও তারা ভালভাবে জানত যে, সেটা ছিল একেবারেই মিথ্যা এবং সাজানো বিষয়। কিন্তু সেটাকেই সত্যিকার চুরি বলে আখ্যায়িত করল বেনিয়ামীনের প্রতি আক্রোশ বশতঃ। ইউসুফ শুনে ধৈর্য ধারণ করলেন ও মনের দুঃখ মনে চেপে রাখলেন।
এভাবে বাদশাহর কাছ থেকে নিরাশ হয়ে বেনিয়ামীনকে ছেড়ে যখন তারা বেরিয়ে এল, তখন তাদের বড় ভাই ইয়াহূদা অন্য ভাইদের বলল, তোমরা পিতার কাছে ফেরত যাও এবং তাঁকে সব খুলে বল। আমি এখান থেকে ফেরত যাব না, যতক্ষণ না পিতা আমাকে আদেশ দেন কিংবা আল্লাহ আমার জন্য কোন ফায়ছালা করেন। উল্লেখ্য, এই বড় ভাইয়ের হাতেই তার পিতা বেনিয়ামীনকে সোপর্দ করেছিলেন এবং ইতিপূর্বে এই বড় ভাই-ই ইউসুফকে হত্যা না করার জন্য অন্য ভাইদের পরামর্শ দিয়েছিল এবং সেই-ই গোপনে জঙ্গলের সেই অন্ধকূপে ইউসুফের জন্য খাদ্য সরবরাহ করেছিল ও সারাক্ষণ তার তদারকি করত, যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।
উপরোক্ত ঘটনাটি কুরআনে আগপিছ করে বর্ণিত হয়েছে। যেমন সেখানে ইউসুফের সামনে আগেই ইউসুফের চুরির ঘটনা বলা হয়েছে। অথচ শুরুতেই এটা বলা অযৌক্তিক এবং অসমীচীন। কেননা তাতে বেনিয়ামীন যে আসলেই চোর, সেকথা পরোক্ষভাবে স্বীকার করা হয়। অথচ তারা প্রথমে সেটা অস্বীকার করেছিল এবং সেটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:
ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺇِﻥ ﻳَّﺴْﺮِﻕْ ﻓَﻘَﺪْ ﺳَﺮَﻕَ ﺃَﺥٌ ﻟَّﻪُ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻞُ ﻓَﺄَﺳَﺮَّﻫَﺎ ﻳُﻮْﺳُﻒُ ﻓِﻲْ ﻧَﻔْﺴِﻪِ ﻭَﻟَﻢْ ﻳُﺒْﺪِﻫَﺎ ﻟَﻬُﻢْ ﻗَﺎﻝَ ﺃَﻧﺘُﻢْ ﺷَﺮٌّ ﻣَّﻜَﺎﻧﺎً ﻭَﺍﻟﻠﻪ ُ ﺃَﻋْﻠَﻢُ ﺑِﻤَﺎ ﺗَﺼِﻔُﻮْﻥَ – ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟْﻌَﺰِﻳْﺰُ ﺇِﻥَّ ﻟَﻪُ ﺃَﺑﺎً ﺷَﻴْﺨﺎً ﻛَﺒِﻴْﺮﺍً ﻓَﺨُﺬْ ﺃَﺣَﺪَﻧَﺎ ﻣَﻜَﺎﻧَﻪُ ﺇِﻧَّﺎ ﻧَﺮَﺍﻙَ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﺤْﺴِﻨِﻴْﻦَ – ﻗَﺎﻝَ ﻣَﻌَﺎﺫَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺃَﻥْ ﻧَﺄْﺧُﺬَ ﺇِﻻَّ ﻣَﻦْ ﻭَﺟَﺪْﻧَﺎ ﻣَﺘَﺎﻋَﻨَﺎ ﻋِﻨْﺪَﻩُ ﺇِﻧَّـﺎ ﺇِﺫﺍً ﻟَّﻈَﺎﻟِﻤُﻮْﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৭৭-৭৯)-
‘তারা বলতে লাগল, যদি সে চুরি করে থাকে, তবে তার এক ভাইও ইতিপূর্বে চুরি করেছিল। তখন ইউসুফ প্রকৃত ব্যাপার নিজের মনের মধ্যে রাখল, তাদেরকে প্রকাশ করল না। (মনে মনে) বললেন, তোমরা লোক হিসাবে খুবই মন্দ এবং আল্লাহ সে বিষয়ে ভালভাবে জ্ঞাত, যা তোমরা বলছ’
(৭৭) । ‘তারা বলতে লাগল, হে আযীয (অর্থাৎ ইউসুফ)! তার পিতা আছেন অতিশয় বৃদ্ধ। অতএব আপনি আমাদের একজনকে তার বদলে রেখে দিন। আমরা আপনাকে অনুগ্রহশীলদের মধ্যকার একজন বলে দেখতে পাচ্ছি’
(৭৮) । ‘সে বলল, যার কাছে আমরা আমাদের মাল পেয়েছি, তাকে ছেড়ে অন্যকে গ্রেফতার করা থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। এমনটি করলে তো আমরা নিশ্চিতভাবে যুলুমকারী হয়ে যাব’ (ইউসুফ ১২/৭৭-৭৯) ।
বেনিয়ামীনকে রেখেই মিসর থেকে ফিরল ভাইয়েরা :
অতঃপর তারা যখন বাদশাহর কাছ থেকে নিরাশ হয়ে গেল, তখন পরামর্শের জন্য সকলে একান্তে বসল। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,
ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺍﺳْﺘَﻴْﺄَﺳُﻮﺍْ ﻣِﻨْﻪُ ﺧَﻠَﺼُﻮﺍْ ﻧَﺠِﻴّﺎً ﻗَﺎﻝَ ﻛَﺒِﻴْﺮُﻫُﻢْ ﺃَﻟَﻢْ ﺗَﻌْﻠَﻤُﻮﺍْ ﺃَﻥَّ ﺃَﺑَﺎﻛُﻢْ ﻗَﺪْ ﺃَﺧَﺬَ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢ ﻣَّﻮْﺛِﻘﺎً ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻠّﻪِ ﻭَﻣِﻦ ﻗَﺒْﻞُ ﻣَﺎ ﻓَﺮَّﻃﺘُﻢْ ﻓِﻲ ﻳُﻮﺳُﻒَ ﻓَﻠَﻦْ ﺃَﺑْﺮَﺡَ ﺍﻷَﺭْﺽَ ﺣَﺘَّﻰَ ﻳَﺄْﺫَﻥَ ﻟِﻲ ﺃَﺑِﻲ ﺃَﻭْ ﻳَﺤْﻜُﻢَ ﺍﻟﻠﻪ ُﻟِﻲ ﻭَﻫُﻮَ ﺧَﻴْﺮُ ﺍﻟْﺤَﺎﻛِﻤِﻴﻦَ، ﺍﺭْﺟِﻌُﻮﺍْ ﺇِﻟَﻰ ﺃَﺑِﻴﻜُﻢْ ﻓَﻘُﻮﻟُﻮﺍْ ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﺇِﻥَّ ﺍﺑْﻨَﻚَ ﺳَﺮَﻕَ ﻭَﻣَﺎ ﺷَﻬِﺪْﻧَﺎ ﺇِﻻَّ ﺑِﻤَﺎ ﻋَﻠِﻤْﻨَﺎ ﻭَﻣَﺎ ﻛُﻨَّﺎ ﻟِﻠْﻐَﻴْﺐِ ﺣَﺎﻓِﻈِﻴْﻦَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৮০ -৮১ ‏) –
‘অতঃপর যখন তারা তার (বাদশাহর) কাছ থেকে নিরাশ হয়ে গেল, তখন তারা একান্তে পরামর্শে বসল। তখন তাদের বড় ভাই বলল, তোমরা কি জানো না যে, পিতা তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার নিয়েছেন এবং ইতিপূর্বে ইউসুফের ব্যাপারেও তোমরা অন্যায় করেছ? অতএব আমি কিছুতেই এদেশ ত্যাগ করব না, যে পর্যন্ত না পিতা আমাকে আদেশ দেনঅথবা আল্লাহ আমার কোন ফায়ছালা করেন। তিনিই সর্বোত্তম ফায়ছালাকারী’। ‘তোমরা তোমাদের পিতার কাছে ফিরে যাও এবং বল, হে পিতা! আপনার ছেলে চুরি করেছে। আমরা যা জানি, কেবল তারই সাক্ষ্য দিলাম এবং কোন অদৃশ্য বিষয়ে আমরা হেফাযতকারী ছিলাম না’ (ইউসুফ ১২/৮০-৮১) ।
অর্থাৎ বেনিয়ামীনকে হেফাযতের অঙ্গীকার বাহ্যিক অবস্থা পর্যন্ত সম্ভবপর ছিল। কিন্তু আমাদের দৃষ্টির আড়ালে সে কিছু করে থাকলে তাতে আমাদের কিছুই করার ছিল না। অতঃপর তারা কেন‘আনে ফিরে এল এবং পিতাকে সব কথা খুলে বলল।
পিতার নিকটে ছেলেদের কৈফিয়ত :
কেন‘আনে ফিরে এসে পিতার নিকটে তারা বেনিয়ামীনকে রেখে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে এবং সেই সাথে তারা নিজেদের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য মিসর প্রত্যাগত অন্যান্য কেন‘আনী কাফেলাকে সাক্ষী মানল এবং পিতাকে বলল,
ﻭَﺍﺳْﺄَﻝِ ﺍﻟْﻘَﺮْﻳَﺔَ ﺍﻟَّﺘِﻲ ﻛُﻨَّﺎ ﻓِﻴﻬَﺎ ﻭَﺍﻟْﻌِﻴﺮَ ﺍﻟَّﺘِﻲ ﺃَﻗْﺒَﻠْﻨَﺎ ﻓِﻴﻬَﺎ ﻭَﺇِﻧَّﺎ ﻟَﺼَﺎﺩِﻗُﻮﻥَ ‘(হে পিতা!) আপনি জিজ্ঞেস করুন ঐ জনপদের লোকদের, যেখানে আমরা ছিলাম এবং (জিজ্ঞেস করুন) ঐসব কাফেলাকে যাদের সাথে আমরা এসেছি। আমরা নিশ্চিতভাবেই (আপনাকে) সত্য ঘটনা বলছি’ ( ইউসুফ ৮২) । (কিন্তু ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত পিতা তাদের কথায় কর্ণপাত না করে বললেন),
ﺑَﻞْ ﺳَﻮَّﻟَﺖْ ﻟَﻜُﻢْ ﺃَﻧﻔُﺴُﻜُﻢْ ﺃَﻣْﺮﺍً ﻓَﺼَﺒْﺮٌ ﺟَﻤِﻴْﻞٌ ﻋَﺴَﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﺃَﻥ ﻳَّﺄْﺗِﻴَﻨِﻲْ ﺑِﻬِﻢْ ﺟَﻤِﻴْﻌﺎً ﺇِﻧَّﻪُ ﻫُﻮَ ﺍﻟْﻌَﻠِﻴْﻢُ ﺍﻟْﺤَﻜِﻴْﻢُ ‘বরং তোমরা মনগড়া একটা কথা নিয়েই এসেছ। এখন ধৈর্যধারণই উত্তম। সম্ভবতঃ আল্লাহ তাদের সবাইকে (ইউসুফ ও বেনিয়ামীনকে) একসঙ্গে আমার কাছে নিয়ে আসবেন। তিনি বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (৮৩) । ‘অতঃপর তিনি তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন, হায় আফসোস ইউসুফের জন্য! (আল্লাহ বলেন,) এভাবে দুঃখে তাঁর চক্ষুদ্বয় সাদা হয়ে গেল এবং অসহনীয় মনস্তাপে তিনি ছিলেন ক্লিষ্ট’ (৮৪) । ছেলেরা তখন তাঁকে বলতে লাগল, ‘আল্লাহর কসম! আপনি তো ইউসুফের স্মরণ থেকে নিবৃত্ত হবেন না, যে পর্যন্ত না মরণাপন্ন হন কিংবা মৃত্যুবরণ করেন’ (৮৫) । ইয়াকূব বললেন,
ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﺃَﺷْﻜُﻮْ ﺑَﺜِّﻲ ﻭَﺣُﺰْﻧِﻲ ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﺃَﻋْﻠَﻢُ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻣَﺎ ﻻَ ﺗَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ، ﻳَﺎ ﺑَﻨِﻲَّ ﺍﺫْﻫَﺒُﻮْﺍ ﻓَﺘَﺤَﺴَّﺴُﻮْﺍ ﻣِﻦْ ﻳُﻮﺳُﻒَ ﻭَﺃَﺧِﻴْﻪِ ﻭَﻻَ ﺗَﻴْﺄَﺳُﻮْﺍ ﻣِﻦْ ﺭَّﻭْﺡِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺇِﻧَّﻪُ ﻻَ ﻳَﻴْﺄَﺱُ ﻣِﻦْ ﺭَّﻭْﺡِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺇِﻻَّ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡُ ﺍﻟْﻜَﺎﻓِﺮُﻭْﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৮৬-৮৭ ‏) –
‘আমি তো আমার অস্থিরতা ও দুঃখ আল্লাহর কাছেই পেশ করছি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না’ (৮৬) । ‘হে বৎসগণ! যাও ইউসুফ ও তার ভাইকে তালাশ কর এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকে কাফের সম্প্রদায় ব্যতীত কেউ নিরাশ হয় না’ (ইউসুফ ১২/৮২-৮৭) ।
উপরোক্ত ৮৬ ও ৮৭ আয়াতে বর্ণিত ইয়াকূব (আঃ)-এর বক্তব্যে ইউসুফ ও বেনিয়ামীনকে ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। হ’তে পারে ইউসুফকে হারানোর দীর্ঘ বিরহ-বেদনা এবং নতুনভাবে পাওয়া বেনিয়ামীন হারানোর কঠিন মানসিক ধাক্কা সামাল দেওয়ার জন্য আল্লাহ পাক তাঁকে অহী মারফত ইঙ্গিত দিয়ে থাকবেন অথবা আল্লাহ তাকে উক্ত মর্মে ওয়াদা দিয়ে থাকবেন। ইয়াকূব (আঃ)-এর বক্তব্য ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﺃَﺷْﻜُﻮ ﺑَﺜِّﻲ ﻭَﺣُﺰْﻧِﻲ ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟﻠﻪِ
‘আমি আমার অস্থিরতা ও দুঃখ আল্লাহর কাছে পেশ করছি’ (ইউসুফ ১২/৮৬) , একথার মধ্যে তাঁর কঠিন ধৈর্যগুণের প্রকাশ ঘটেছে।
পিতার নির্দেশে ছেলেদের পুনরায় মিসরে গমন :
ইউসুফ ও বেনিয়ামীনকে খুঁজে বের করার জন্য ইয়াকূব (আঃ) ছেলেদেরকে এরূপ কঠোর নির্দেশ ইতিপূর্বে কখনো দেননি। তাঁর দৃঢ়তায় ছেলেদের মধ্যেও আশার সঞ্চার হ’ল। বেনিয়ামীন মিসরে থাকা নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু ইউসুফের ব্যাপারে কোন আশা ছিল না।
বলা হয়ে থাকে যে, ﺇﺫﺍ ﺃﺭﺍﺩ ﺍﻟﻠﻪ ﺃﻣﺮًﺍ ﻫﻴﺄ ﻟﻪ ﺍﻷﺳﺒﺎﺏ ‘আল্লাহ যখন কোন কাজের ইচ্ছা করেন, তখন তার কার্যকারণ সমূহ প্রস্ত্তত করে দেন’। বেনিয়ামীনের উদ্দেশ্যে মিসর যাত্রার মধ্যেই ইউসুফ উদ্ধারের বিষয়টি লুকিয়েছিল, যেটা কারু জানা ছিল না। তাই আল্লাহর ইচ্ছায় ভাইয়েরা সবাই মিসরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’ল।
ইউসুফের সৎ ভাইয়েরা পিতার নির্দেশক্রমে মিসর পৌঁছল এবং ‘আযীযে মিছর’-এর সাথে সাক্ষাৎ করল। তারা তাঁর কাছে নিজেদের সাংসারিক অভাব-অনটনের কথা পেশ করল। এমনকি পণ্যমূল্য আনার মত সঙ্গতিও তাদের নেই বলে জানাল। তদুপরি পরপর দুই পুত্রকে হারিয়ে অতিবৃদ্ধ পিতার করুণ অবস্থার কথাও জানালো।
যেমন আল্লাহ বলেন,
ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺩَﺧَﻠُﻮْﺍ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟْﻌَﺰِﻳْﺰُ ﻣَﺴَّﻨَﺎ ﻭَﺃَﻫْﻠَﻨَﺎ ﺍﻟﻀُّﺮُّ ﻭَﺟِﺌْﻨَﺎ ﺑِﺒِﻀَﺎﻋَﺔٍ ﻣُّﺰْﺟَﺎﺓٍ ﻓَﺄَﻭْﻑِ ﻟَﻨَﺎ ﺍﻟْﻜَﻴْﻞَ ﻭَﺗَﺼَﺪَّﻕْ ﻋَﻠَﻴْﻨَﺎ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻳَﺠْﺰِﻱ ﺍﻟْﻤُﺘَﺼَﺪِّﻗِﻴْﻦَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৮৮)-
‘অতঃপর যখন তারা ইউসুফের কাছে পৌঁছল, তখন বলল, হে আযীয! আমরা ও আমাদের পরিবার বর্গ কষ্টের সম্মুখীন হয়েছি এবং আমরা অপর্যাপ্ত পুঁজি নিয়ে এসেছি। আপনি আমাদেরকে পুরোপুরি বরাদ্দ দিন এবং আমাদেরকে অনুদান দিন। আল্লাহ দানকারীদের প্রতিদান দিয়ে থাকেন’ (ইউসুফ ১২/৮৮) । উল্লেখ্য যে, এখানে ছাদাক্বার অর্থ অনুদান এবং স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে পুরোপুরি দান করা।
ইউসুফের আত্মপ্রকাশ এবং ভাইদের ক্ষমা প্রার্থনা :
পরিবারের অনটনের কথা শুনে এবং পিতার অন্ধত্ব ও অসহায় অবস্থার কথা শুনে ইউসুফ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি আল্লাহর হুকুমে নিজেকে প্রকাশ করে দিলেন এবং বললেন, ﻗَﺎﻝَ ﻫَﻞْ ﻋَﻠِﻤْﺘُﻢْ ﻣَﺎ ﻓَﻌَﻠْﺘُﻢ ﺑِﻴُﻮﺳُﻒَ ﻭَﺃَﺧِﻴﻪِ ﺇِﺫْ ﺃَﻧﺘُﻢْ ﺟَﺎﻫِﻠُﻮﻥَ – ‘তোমাদের কি জানা আছে যা তোমরা করেছিলে ইউসুফ ও তার ভাইয়ের সাথে? যখন তোমরা (পরিণাম সম্পর্কে) অজ্ঞ ছিলে’ (৮৯) । ‘তারা বলল, ﺇِﻧَّﻚَ ﻟَﺄَﻧﺖَ ﻳُﻮﺳُﻒُ؟
তবে কি তুমিই ইউসুফ? তিনি বললেন, ﺃَﻧَﺎ ﻳُﻮﺳُﻒُ ﻭَﻫَـﺬَﺍ ﺃَﺧِﻲْ ﻗَﺪْ ﻣَﻦَّ ﺍﻟﻠﻪ ُﻋَﻠَﻴْﻨَﺎ، আমিই ইউসুফ, আর এ হ’ল আমার (সহোদর) ভাই। আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি তাক্বওয়া অবলম্বন করে ও ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ এহেন সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না’ (৯০) । ‘তারা বলল, ﺗَﺎﻟﻠﻪِ ﻟَﻘَﺪْ ﺁﺛَﺮَﻙَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻨَﺎ ﻭَﺇِﻥْ ﻛُﻨَّﺎ ﻟَﺨَﺎﻃِﺌِﻴْﻦَ – ‘আল্লাহর কসম! আমাদের উপরে আল্লাহ তোমাকে পসন্দ করেছেন এবং আমরা অবশ্যই অপরাধী ছিলাম’
(৯১) । ‘ইউসুফ বললেন, ﻻَ ﺗَﺜْﺮَﻳﺐَ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢُ ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﻳَﻐْﻔِﺮُ ﺍﻟﻠﻪُ ﻟَﻜُﻢْ ﻭَﻫُﻮَ ﺃَﺭْﺣَﻢُ ﺍﻟﺮَّﺍﺣِﻤِﻴْﻦَ – ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সকল দয়ালুর চাইতে অধিক দয়ালু’ (ইউসুফ ১২/৮৯-৯২) ।
ইউসুফের ব্যবহৃত জামা প্রেরণ :
ভাইদেরকে মাফ করে দেওয়ার পর ইউসুফ তাঁর ব্যবহৃত জামাটি বড় ভাইদের হাতে দিয়ে বললেন, এই জামাটি নিয়ে পিতার চেহারার উপরে রেখো। তাতেই তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। অতঃপর তাঁকে সহ তোমাদের সকলের পরিবারবর্গকে নিয়ে এখানে চলে এসো। একটি বর্ণনায় এসেছে যে, এই সময় ইয়াহূদা বলেছিল, বড় ভাই হিসাবে পিতা সেদিন আমার হাতেই তোমাকে সোপর্দ করেছিলেন। কিন্তু আমি ভাইদের চাপের মুখে তোমার জামায় মিথ্যা রক্ত মাখিয়ে পিতাকে দেখিয়েছিলাম। আজ আমি তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। তোমার এ জামাটি আমিই স্বহস্তে পিতার মুখের উপরে রাখব। এর বিনিময়ে তিনি যদি আমাকে ক্ষমা করে দেন। ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, এই বড় ভাই-ই সে সময় তিনদিন ধরে গোপনে ইউসুফকে কূয়ায় দেখাশুনা করতেন। এরই পরামর্শে ভাইয়েরা তাকে হত্যা করেনি। বেনিয়ামীনকে হারিয়ে মনের দুঃখে এই বড় ভাই-ই মিসর থেকে আর কেন‘আনে ফিরে যায়নি। তাই আজকে ইউসুফকে ফিরে পাওয়ার সুসংবাদ এবং তার জামা নিয়ে পিতার চেহারার উপরে রাখার এ মহান দায়িত্ব পালনের অধিকার স্বভাবতঃ তার উপরেই বর্তায়। অতঃপর ইউসুফের জামা নিয়ে ভাইদের কাফেলা মিসর ত্যাগ করে কেন‘আনের পথে রওয়ানা হ’ল। ওদিকে আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থাপনায় প্রায় ২৫০ মাইল দূরে ইয়াকূবের নিকটে উক্ত জামার গন্ধ পৌঁছে গেল। তিনি আনন্দের আতিশয্যে সবাইকে বলে ফেললেন যে, ﺇِﻧِّﻲ ﻟَﺄَﺟِﺪُ ﺭِﻳﺢَ ﻳُﻮﺳُﻒَ ওগো তোমরা শুনো! আমি ইউসুফের গন্ধ পাচ্ছি’ (১২/৯৪) । নিঃসন্দেহে এটি ছিল মু‘জেযা, যা আল্লাহ যথাসময়ে ইয়াকূবকে প্রদর্শন করেছেন। কেননা মু‘জেযা নবীগণের ইচ্ছাধীন নয়। এটা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি সময় ও প্রয়োজন মাফিক নবীগণের মাধ্যমে তা প্রদর্শন করে থাকেন। যদি এটা নবীগণের ইচ্ছাধীন হ’ত, তাহ’লে বাড়ীর অদূরে জঙ্গলের এক পরিত্যক্ত কূয়ায় ইউসুফ তিনদিন পড়ে রইলেন, তার রক্তমাখা জামা পিতার কাছে দেওয়া হ’ল তখন তো তিনি ইউসুফের খবর জানতে পারেননি। তাই নবীদের মু‘জেযা হৌক বা দ্বীনদার মুমিনদের কারামত হৌক, কোনটাই ব্যক্তির ইচ্ছাধীন নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছাধীন।
ভাইদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের তাৎপর্য :
ইউসুফ ভাইদের উপরে কোনরূপ প্রতিশোধ নিতে চাননি। বরং তিনি চেয়েছিলেন তাদের তওবা ও অনুতাপ। সেটা তিনি যথাযথভাবেই পেয়েছিলেন। কেননা এই দশ ভাইও নবীপুত্র এবং তাদেরই একজন ‘লাভী’
‏( ﻻﻭﻯ ‏) -এর বংশের অধঃস্তন চতুর্থ পুরুষ হয়ে জন্ম নেন অন্যতম যুগশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মূসা (আঃ)।
বস্ত্ততঃ ইয়াকূব (আঃ)-এর উক্ত বারোজন পুত্রের বংশধারা হিসাবে বনু ইস্রাঈলের বারোটি গোত্র সৃষ্টি হয় এবং তাদের থেকেই যুগে যুগে জন্ম গ্রহণ করেন লক্ষাধিক নবী ও রাসূল। যাঁদের মধ্যে ছিলেন দাঊদ ও সুলায়মানের মত শক্তিধর রাষ্ট্রনায়ক, রাসূল ও নবী এবং বনু ইস্রাঈলের সর্বশেষ রাসূল হযরত ঈসা (আঃ)। অতএব বৈমাত্রেয় হিংসায় পদস্খলিত হ’লেও নবী রক্তের অন্যান্য গুণাবলী তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। ইউসুফ (আঃ) তাই তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে নিঃসন্দেহে বিরাট মহত্ত্ব ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে অর্থাৎ এই ঘটনার প্রায় আড়াই হাযার বছর পরে বনু ইসমাঈলের একমাত্র ও সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবী বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের দিন তাঁর জানী দুশমন মক্কার কাফেরদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তিনিও সেদিন ইউসুফের ন্যায় একই ভাষায় বলেছিলেন, ﻻﺗﺜﺮﻳﺐَ ﻋﻠﻴﻜﻢُ ﺍﻟﻴﻮﻡ ﻓﺎﺫﻫﺒﻮﺍ ﻭﺃَﻧﺘﻢُ ﺍﻟﻄُّﻠَﻘﺎﺀُ ‘তোমাদের প্রতি আজ কোন অভিযোগ নেই। যাও! তোমরা মুক্ত’। শুধু তাই নয়, কাফের নেতা আবু সুফিয়ানের গৃহে যে ব্যক্তি আশ্রয় নিবে, তাকেও তিনি ক্ষমা ঘোষণা করে বলেন, ﻣَﻦْ ﺩَﺧَﻞَ ﺩَﺍﺭَ ﺃَﺑﻰ ﺳُﻔﻴﺎﻥَ ﻓﻬﻮ ﺁﻣِﻦٌ
‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে আশ্রয় নিবে, সে নিরাপদ থাকবে’। [30] তাতে ফল হয়েছিল এই যে, যারা ছিল এতদিন তাঁর রক্ত পিয়াসী, তারাই হ’ল এখন তাঁর দেহরক্ষী। মক্কা বিজয়ের মাত্র ১৯ দিন পরে হুনায়েন যুদ্ধে নওমুসলিম কুরায়েশদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং দু’বছর পরে আবুবকরের খেলাফতকালে ইয়ারমূকের যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের ও তার পুত্র ইয়াযীদের এবং আবু জাহ্ল-পুত্র ইকরিমার কালজয়ী ভূমিকা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তাই বিদ্বেষী সৎ ভাইদের ক্ষমা করে দিয়ে ইউসুফ (আঃ) নবীসুলভ মহানুভবতা এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
ঘটনাটির কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:
ﺍﺫْﻫَﺒُﻮﺍ ﺑِﻘَﻤِﻴﺼِﻲ ﻫَـﺬَﺍ ﻓَﺄَﻟْﻘُﻮﻩُ ﻋَﻠَﻰ ﻭَﺟْﻪِ ﺃَﺑِﻲ ﻳَﺄْﺕِ ﺑَﺼِﻴﺮﺍً ﻭَﺃْﺗُﻮﻧِﻲ ﺑِﺄَﻫْﻠِﻜُﻢْ ﺃَﺟْﻤَﻌِﻴﻦَ – ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﻓَﺼَﻠَﺖِ ﺍﻟْﻌِﻴﺮُ ﻗَﺎﻝَ ﺃَﺑُﻮﻫُﻢْ ﺇِﻧِّﻲ ﻟَﺄَﺟِﺪُ ﺭِﻳﺢَ ﻳُﻮﺳُﻒَ ﻟَﻮْﻻَ ﺃَﻥ ﺗُﻔَﻨِّﺪُﻭﻥِ – ﻗَﺎﻟُﻮﺍ ﺗَﺎﻟﻠﻪِ ﺇِﻧَّﻚَ ﻟَﻔِﻲ ﺿَﻼَﻟِﻚَ ﺍﻟْﻘَﺪِﻳﻢِ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৯৩-৯৫ ‏) –
ইউসুফ তার ভাইদের বললেন, ‘তোমরা আমার এ জামাটি নিয়ে যাও। এটি আমার পিতার চেহারার উপরে রেখো। এতে তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসবে। আর তোমাদের পরিবারবর্গের সবাইকে আমার কাছে নিয়ে আস’। ‘অতঃপর কাফেলা যখন রওয়ানা হ’ল, তখন (কেন‘আনে) তাদের পিতা বললেন, যদি তোমরা আমাকে অপ্রকৃতিস্থ না ভাবো, তবে বলি যে, আমি নিশ্চিতভাবেই ইউসুফের গন্ধ পাচ্ছি’। ‘লোকেরা বলল, আল্লাহর কসম! আপনি তো আপনার সেই পুরানো ভ্রান্তিতেই পড়ে আছেন’ (ইউসুফ ১২/৯৩-৯৫) ।
ইয়াকূব (আঃ) দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন :
যথাসময়ে কাফেলা দীর্ঘ সফর শেষে বাড়ীতে পৌঁছল এবং বড়ভাই ইয়াহূদা ছুটে গিয়ে পিতাকে ইউসুফের সুসংবাদ দিলেন। অতঃপর ইউসুফের প্রদত্ত জামা পিতার মুখের উপরে রাখলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় সাথে সাথে তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরে এল। খুশীতে উদ্বেলিত ও আনন্দে উৎফুল্ল বৃদ্ধ পিতা বলে উঠলেন, ‘আমি কি বলিনি যে, আল্লাহর নিকট থেকে আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না’। অর্থাৎ ইউসুফ জীবিত আছে এবং তার সাথে আমার সাক্ষাত হবে, এ খবর আল্লাহ আমাকে আগেই দিয়েছিলেন। বিষয়টির কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:
ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺃَﻥْ ﺟَﺎﺀَ ﺍﻟْﺒَﺸِﻴْﺮُ ﺃَﻟْﻘَﺎﻩُ ﻋَﻠَﻰ ﻭَﺟْﻬِﻪِ ﻓَﺎﺭْﺗَﺪَّ ﺑَﺼِﻴْﺮﺍً ﻗَﺎﻝَ ﺃَﻟَﻢْ ﺃَﻗُﻞ ﻟَّﻜُﻢْ ﺇِﻧِّﻲْ ﺃَﻋْﻠَﻢُ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻣَﺎ ﻻَ ﺗَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৯৬)-
‘অতঃপর যখন সুসংবাদ দাতা (ইয়াহূদা) পৌঁছল, সে জামাটি তার (ইয়াকূবের) চেহারার উপরে রাখল। অমনি সে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল এবং বলল, আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে যা জানি, তোমরা তা জানো না’? (ইউসুফ ১২/৯৬) ।
ঘামের গন্ধে দৃষ্টিশক্তি ফেরা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য :
ইউসুফ (আঃ)-এর ব্যবহৃত জামা প্রেরণ ও তা মুখের উপরে রাখার মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার এ বিষয়টির উপর বর্তমানে গবেষণা হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে, মানবদেহের ঘামের মধ্যে এমন উপাদান আছে যার প্রতিক্রিয়ায় দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসা সম্ভব। উক্ত গবেষণার মূল সূত্র ছিল ইউসুফ (আঃ)-এর ব্যবহৃত জামা মুখের উপরে রাখার মাধ্যমে ইয়াকূব (আঃ)-এর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার কুরআনী বর্ণনা। [31]
পিতার নিকটে ছেলেদের ক্ষমা প্রার্থনা :
প্রকৃত ঘটনা সবার নিকটে পরিষ্কার হয়ে গেলে লজ্জিত ও অনুতপ্ত বিমাতা ভাইয়েরা সবাই এসে পিতার কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং আল্লাহর নিকটে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুরোধ করল। যেমন আল্লাহ বলেন,
ﻗَﺎﻟُﻮﺍْ ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﺍﺳْﺘَﻐْﻔِﺮْ ﻟَﻨَﺎ ﺫُﻧُﻮْﺑَﻨَﺎ ﺇِﻧَّﺎ ﻛُﻨَّﺎ ﺧَﺎﻃِﺌِﻴْﻦَ – ﻗَﺎﻝَ ﺳَﻮْﻑَ ﺃَﺳْﺘَﻐْﻔِﺮُ ﻟَﻜُﻢْ ﺭَﺑِّﻲ ﺇِﻧَّﻪُ ﻫُﻮَ ﺍﻟْﻐَﻔُﻮﺭُ ﺍﻟﺮَّﺣِﻴﻢُ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৯৭-৯৮)-
‘তারা বলল, হে আমাদের পিতা! আমাদের অপরাধ মার্জনার জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই আমরা গোনাহগার ছিলাম’। ‘পিতা বললেন, সত্বর আমি আমার পালনকর্তার নিকটে তোমাদের জন্য ক্ষমা চাইব। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইউসুফ ১২/৯৭-৯৮) ।
ইয়াকূব-পরিবারের মিসর উপস্থিতি ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন :
৯৩ আয়াতে বলা হয়েছে যে, ইউসুফ তার ভাইদেরকে তাদের পরিবারবর্গসহ মিসরে আসতে বলেছিলেন। মিসরে তাদের এই যাওয়াটাই ছিল কেন‘আন থেকে স্থায়ীভাবে তাদের মিসরে হিজরত। আরবের ইহুদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করেছিল, ইয়াকূব পরিবারের মিসরে হিজরতের কারণ কি? তার জবাব এটাই যে, ইউসুফের আহবানে ইয়াকূব পরিবার স্থায়ীভাবে মিসরে হিজরত করেছিল এবং প্রায় চারশ’ বছর পরে সেখানে মূসা (আঃ)-এর আবির্ভাবকালে তাদের সংখ্যা ছিল মিসরের মোট জনসংখ্যার ১০ হ’তে ২০ শতাংশের মত। [32]
মিসর থেকে ভাইদের কেন‘আনে ফেরৎ পাঠানোর সময় কোন কোন বর্ণনা মোতাবেক ইউসুফ (আঃ) দু’শো উট বোঝাই খাদ্য-শস্য ও মালামাল উপঢৌকন স্বরূপ পাঠিয়েছিলেন, যাতে তারা যাবতীয় দায়-দেনা চুকিয়ে ভালভাবে প্রস্ত্ততি নিয়ে মিসরে স্থায়ীভাবে ফিরে আসতে পারে। ইয়াকূব পরিবার সেভাবেই প্রস্ত্ততি নিলেন। অতঃপর গোটা পরিবার বিরাট কাফেলা নিয়ে কেন‘আন ছেড়ে মিসর অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। এই সময় তাদের সংখ্যা নারী-পুরুষ সব মিলে ৭০ জন অথবা তার অধিক ছিল বলে বিভিন্ন রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে।[33]
অপর দিকে মিসর পৌঁছার সময় নিকটবর্তী হ’লে ইউসুফ (আঃ) ও নগরীর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তাঁদের অভ্যর্থনার জন্য বিশাল আয়োজন করেন। অতঃপর পিতা-মাতা ও ভাইদের নিয়ে তিনি শাহী মহলে প্রবেশ করেন। ইউসুফের শৈশবকালে তার মা মৃত্যুবরণ করার কারণে তার আপন খালাকে পিতা বিবাহ করেন, ফলে তিনিই মা হিসাবে পিতার সাথে আগমন করেন। তবে কেউ বলেছেন, তাঁর নিজের মা এসেছিলেন। [34] অতঃপর তিনি পিতা-মাতাকে তাঁর সিংহাসনে বসালেন। এর পরবর্তী ঘটনা হ’ল শৈশবে দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়নের অনন্য দৃশ্য। এ বিষয়ে বর্ণিত কুরআনী ভাষ্য নিম্নরূপ:
ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺩَﺧَﻠُﻮْﺍ ﻋَﻠَﻰ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ﺁﻭَﻯ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﺃَﺑَﻮَﻳْﻪِ ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺍﺩْﺧُﻠُﻮْﺍ ﻣِﺼْﺮَ ﺇِﻥْ ﺷَﺂﺀ ﺍﻟﻠﻪُ ﺁﻣِﻨِﻴْﻦَ – ﻭَﺭَﻓَﻊَ ﺃَﺑَﻮَﻳْﻪِ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻌَﺮْﺵِ ﻭَﺧَﺮُّﻭْﺍ ﻟَﻪُ ﺳُﺠَّﺪﺍً ﻭَﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺖِ ﻫَـﺬَﺍ ﺗَﺄْﻭِﻳْﻞُ ﺭُﺅْﻳَﺎﻱَ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻞُ ﻗَﺪْ ﺟَﻌَﻠَﻬَﺎ ﺭَﺑِّﻲْ ﺣَﻘّﺎً ﻭَﻗَﺪْ ﺃَﺣْﺴَﻦَ ﺑِﻲْ ﺇِﺫْ ﺃَﺧْﺮَﺟَﻨِﻲْ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦِ ﻭَﺟَﺎﺀَ ﺑِﻜُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟْﺒَﺪْﻭِ ﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِ ﺃَﻥ ﻧَّﺰَﻍَ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥُ ﺑَﻴْﻨِﻲْ ﻭَﺑَﻴْﻦَ ﺇِﺧْﻮَﺗِﻲْ ﺇِﻥَّ ﺭَﺑِّﻲْ ﻟَﻄِﻴﻒٌ ﻟِّﻤَﺎ ﻳَﺸَﺂﺀُ، ﺇِﻧَّﻪُ ﻫُﻮَ ﺍﻟْﻌَﻠِﻴْﻢُ ﺍﻟْﺤَﻜِﻴْﻢُ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ৯৯-১০০)-
‘অতঃপর যখন তারা ইউসুফের কাছে পৌঁছল, তখন ইউসুফ পিতা-মাতাকে নিজের কাছে নিল এবং বলল, আল্লাহ চাহেন তো নিঃশংকচিত্তে মিসরে প্রবেশ করুন’। ‘অতঃপর সে তাঁর পিতা-মাতাকে সিংহাসনে বসালো এবং তারা সবাই তার সম্মুখে সিজদাবনত হ’ল। সে বলল, হে পিতা! এটিই হচ্ছে আমার ইতিপূর্বে দেখা স্বপ্নের ব্যাখ্যা। আমার পালনকর্তা একে বাস্তবে রূপায়িত করেছেন। তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আমাকে জেল থেকে বের করেছেন এবং আপনাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন, শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়ার পর। আমার পালনকর্তা যা চান, সুক্ষ্ম কৌশলে তা সম্পন্ন করেন। নিশ্চয়ই তিনি বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’
(ইউসুফ ১২/৯৯-১০০) ।
দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর পিতা-পুত্রের মিলনের সময় ইউসুফের কথাগুলি লক্ষণীয়। তিনি এখানে ভাইদের দ্বারা অন্ধকূপে নিক্ষেপের কথা এবং পরবর্তীতে যোলায়খার চক্রান্তে কারাগারে নিক্ষেপের কথা চেপে গিয়ে কেবল কারামুক্তি থেকে বক্তব্য শুরু করেছেন। তারপর পিতাকে গ্রাম থেকে শহরে এনে মিলনের কথা ও উন্নত জীবনে পদার্পণের কথা বলেছেন। অতঃপর ভাইদের হিংসা ও চক্রান্তের দোষটি শয়তানের উপরে চাপিয়ে দিয়ে ভাইদেরকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। সবকিছুতে আল্লাহর অনুগ্রহের স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি উচ্চাঙ্গের বর্ণনা এবং এতে মহানুভব ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ইয়াকূবী শরী‘আতে সম্মানের সিজদা বা সিজদায়ে তা‘যীমী জায়েয ছিল। কিন্তু মুহাম্মাদী শরী‘আতে এটা হারাম করা হয়েছে। এমনকি সালাম করার সময় মাথা নত করা বা মাথা ঝুঁকানোও হারাম। এর মাধ্যমে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের প্রতি সিজদা করার দূরতম সম্ভাবনাকেও নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।
ইউসুফের দো‘আ :
এভাবে ইউসুফের শৈশবকালীন স্বপ্ন যখন স্বার্থক হ’ল, তখন তিনি কৃতজ্ঞ চিত্তে আল্লাহর নিকটে প্রাণভরে দো‘আ করেন নিম্নোক্ত ভাষায়-
ﺭَﺏِّ ﻗَﺪْ ﺁﺗَﻴْﺘَﻨِﻲْ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﻠْﻚِ ﻭَﻋَﻠَّﻤْﺘَﻨِﻲْ ﻣِﻦْ ﺗَﺄْﻭِﻳْﻞِ ﺍﻷَﺣَﺎﺩِﻳْﺚِ ﻓَﺎﻃِﺮَ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﻭَﺍﺕِ ﻭَﺍﻷَﺭْﺽِ ﺃَﻧْﺖَ ﻭَﻟِﻴِّﻲْ ﻓِﻲ ﺍﻟﺪُّﻧُﻴَﺎ ﻭَﺍﻵﺧِﺮَﺓِ ﺗَﻮَﻓَّﻨِﻲْ ﻣُﺴْﻠِﻤﺎً ﻭَّﺃَﻟْﺤِﻘْﻨِﻲْ ﺑِﺎﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴْﻦَ – ‏( ﻳﻮﺳﻒ ১০১)-
‘হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছেন এবং আমাকে (স্বপ্নব্যাখ্যা সহ) বাণীসমূহের নিগুঢ় তত্ত্ব ব্যাখ্যা দানের শিক্ষা প্রদান করেছেন। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের হে সৃষ্টিকর্তা! আপনিই আমার কার্যনির্বাহী দুনিয়া ও আখেরাতে। আপনি আমাকে ‘মুসলিম’ হিসাবে মৃত্যু দান করুন এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের সাথে মিলিত করুন’ (ইউসুফ ১২/১০১) ।
ইউসুফের উক্ত দো‘আর মধ্যে যুগে যুগে সকল আল্লাহভীরু মযলূমের হৃদয় উৎসারিত প্রার্থনা ফুটে বেরিয়েছে। সকল অবস্থায় আল্লাহর উপরে ভরসাকারী ও সমর্পিত চিত্ত ব্যক্তির জন্য ইউসুফ (আঃ)-এর জীবনী নিঃসন্দেহে একটি অনন্য সাধারণ প্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্ত।
ইউসুফের প্রশংসায় আল্লাহ তা‘আলা :
সূরা আল-আন‘আমের ৮৩ হ’তে ৮৬ আয়াতে আল্লাহ পাক একই স্থানে পরপর ১৮ জন নবীর নাম উল্লেখ পূর্বক তাঁদের প্রশংসা করে বলেন, আমি তাদের প্রত্যেককে সুপথ প্রদর্শন করেছি, সৎকর্মশীল হিসাবে তাদের প্রতিদান দিয়েছি এবং তাদের প্রত্যেককে আমরা সারা বিশ্বের উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি ‏( ﻭَﻛُﻼًّ ﻓﻀَّﻠْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴﻦَ ‏) -(৮৬) । তারা প্রত্যেকে ছিল পুণ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত ‏( ﻛُﻞٌّ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴﻦَ ‏) –
(৮৫) । বস্ত্ততঃ ঐ ১৮ জন প্রশংসিত নবীর মধ্যে হযরত ইউসুফও রয়েছেন
(আন‘আম ৬/৮৪) ।
ইউসুফকে আল্লাহ সম্ভবতঃ ছহীফা সমূহ প্রদান করেছিলেন, যেমন ইতিপূর্বে ইবরাহীম (আঃ)-কে প্রদান করা হয়েছিল (আ‘লা ৮৭/১৯) । আল্লাহ তাঁকে নবুঅত ও হুকূমত উভয় মর্যাদায় ভূষিত করেছিলেন। মানুষ তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকলেও মিসরবাসী সকলে তাঁর দ্বীন কবুল করেনি। উক্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ ইউসুফের প্রশংসা করেন এবং মানুষের সন্দেহবাদের নিন্দা করে বলেন,
ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﺟَﺎﺀَﻛُﻢْ ﻳُﻮْﺳُﻒُ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻞُ ﺑِﺎﻟْﺒَﻴِّﻨَﺎﺕِ ﻓَﻤَﺎ ﺯِﻟْﺘُﻢْ ﻓِﻲْ ﺷَﻚٍّ ﻣِّﻤَّﺎ ﺟَﺎﺀَﻛُﻢْ ﺑِﻪِ ﺣَﺘَّﻰ ﺇِﺫَﺍ ﻫَﻠَﻚَ ﻗُﻠْﺘُﻢْ ﻟَﻦْ ﻳَّﺒْﻌَﺚَ ﺍﻟﻠﻪ ُﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِﻩِ ﺭَﺳُﻮْﻻً ﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻳُﻀِﻞُّ ﺍﻟﻠﻪ ُﻣَﻦْ ﻫُﻮَ ﻣُﺴْﺮِﻑٌ ﻣُّﺮْﺗَﺎﺏٌ –
‘ইতিপূর্বে তোমাদের কাছে ইউসুফ সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ আগমন করেছিল। অতঃপর তোমরা তার আনীত বিষয়ে সর্বদা সন্দেহ পোষণ করতে থাক। অবশেষে যখন সে মারা গেল, তখন তোমরা বললে, আল্লাহ ইউসুফের পরে কখনো আর কাউকে রাসূল রূপে পাঠাবেন না… (অথচ রিসালাতের ধারা অব্যাহত ছিল)। আল্লাহ এমনিভাবে সীমালংঘনকারী ও সন্দেহবাদীদের পথভ্রষ্ট করে থাকেন’
(মুমিন ৪০/৩৪) ।
শেষনবীর প্রতি আল্লাহর সম্বোধন ও সান্ত্বনা প্রদান :
৩ থেকে ১০১ পর্যন্ত ৯৯টি আয়াতে ইউসুফের কাহিনী বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করার পর আল্লাহ পাক শেষনবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বলেন, ﺫَﻟِﻚَ ﻣِﻦْ ﺃَﻧﺒَﺎﺀِ ﺍﻟْﻐَﻴْﺐِ ﻧُﻮْﺣِﻴْﻪِ ﺇِﻟَﻴْﻚَ ﻭَﻣَﺎ ﻛُﻨْﺖَ ﻟَﺪَﻳْﻬِﻢْ ﺇِﺫْ ﺃَﺟْﻤَﻌُﻮﺍ ﺃَﻣْﺮَﻫُﻢْ ﻭَﻫُﻢْ ﻳَﻤْﻜُﺮُﻭْﻥَ – ‘এগুলি হ’ল গায়েবী খবর, যা আমরা তোমার কাছে প্রত্যাদেশ করলাম। তুমি তাদের নিকটে (অর্থাৎ ইউসুফ ভ্রাতাদের নিকটে) ছিলে না, যখন তারা তাদের পরিকল্পনা অাঁটছিল এবং ষড়যন্ত্র করছিল’ (ইউসুফ ১২/১০২) ।
এর দ্বারা আল্লাহ একথা বুঝাতে চেয়েছেন যে, প্রায় আড়াই হাযার বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া ইউসুফ ও ইয়াকূব পরিবারের এই অলৌকিক ঘটনা ও অশ্রুতপূর্ব কাহিনী সবিস্তারে ও সঠিকভাবে বর্ণনা করা নবুঅতে মুহাম্মাদীর এক অকাট্য দলীল। কুরআন অবতরণের পূর্বে এ ঘটনা মক্কাবাসী মোটেই জানত না। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ﺗِﻠْﻚَ ﻣِﻦْ ﺃَﻧﺒَﺎﺀِ ﺍﻟْﻐَﻴْﺐِ ﻧُﻮْﺣِﻴْﻬَﺎ ﺇِﻟَﻴْﻚَ ﻣَﺎ ﻛُﻨْﺖَ ﺗَﻌْﻠَﻤُﻬَﺎ ﺃَﻧْﺖَ ﻭَﻻَ ﻗَﻮْﻣُﻚَ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻞِ ﻫَـﺬَﺍ،
‘ইতিপূর্বে (নবীদের) এ সকল ঘটনা না তুমি জানতে, না তোমার স্বজাতি জানত’ (হূদ ১১/৪৯) । ইমাম বাগাভী (রহঃ) বলেন, (মদীনা থেকে প্রেরিত) ইহুদী প্রতিনিধি এবং কুরায়েশ নেতারা একত্রিতভাবে রাসূলকে ইউসুফ ও ইয়াকূব-পরিবারের ঘটনাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল। তাদের প্রশ্নের জবাবে অহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত উপরোক্ত ঘটনাবলী সুন্দরভাবে বলে দেওয়া সত্ত্বেও এবং তা তাওরাতের অনুকূলে হওয়া সত্ত্বেও যখন তারা অবিশ্বাস ও কুফরীতে অটল রইল, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্তরে দারুন আঘাত পেলেন। এ সময় আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে পরবর্তী আয়াত নাযিল করে বলেন, ﻭَﻣَﺎ ﺃَﻛْﺜَﺮُ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻭَﻟَﻮْ ﺣَﺮَﺻْﺖَ ﺑِﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ – ‘তুমি যতই আকাংখা কর, অধিকাংশ লোক বিশ্বাস স্থাপনকারী নয়’ (ইউসুফ ১২/১০৩; তাফসীরে বাগাভী) । অর্থাৎ নবী হিসাবে একমাত্র কাজ হ’ল প্রচার করা ও সাধ্যমত সংশোধনের চেষ্টা করা। চেষ্টাকে সফল করার দায়িত্ব বা ক্ষমতা কোনটাই নবীর এখতিয়ারাধীন নয়। কাজেই লোকদের অবিশ্বাস বা অস্বীকারে দুঃখ করার কিছুই নেই। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
ﻧَﺤْﻦُ ﺃَﻋْﻠَﻢُ ﺑِﻤَﺎ ﻳَﻘُﻮْﻟُﻮْﻥَ ﻭَﻣَﺎ ﺃَﻧْﺖَ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﺑِﺠَﺒَّﺎﺭٍ ﻓَﺬَﻛِّﺮْ ﺑِﺎﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ ﻣَﻦ ﻳَّﺨَﺎﻑُ ﻭَﻋِﻴْﺪِ –
‘তারা যা বলে আমরা তা সম্যক অবগত আছি। তুমি তাদের উপরে যবরদস্তিকারী নও। অতএব, যে আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে কুরআনের মাধ্যমে উপদেশ দাও’ (ক্বাফ ৫০/৪৫) ।
ইউসুফের কাহিনী এক নযরে :
(১) জন্মের বৎসরাধিক কাল পরেই মায়ের মৃত্যু (২) অতঃপর ফুফুর কাছে লালন-পালন (৩) ফুফু ও পিতার স্নেহের দ্বন্দ্বে ফুফু কর্তৃক চুরির অপবাদ প্রদান। অতঃপর চুরির শাস্তি স্বরূপ ফুফুর দাসত্ব বরণ (৪) শৈশবে স্বপ্ন দর্শন ও পিতার নিকটে বর্ণনা (৫) পিতৃস্নেহের আধিক্যের কারণে ভ্রাতৃ হিংসায় পতিত হন এবং তাকে হত্যার চক্রান্ত হয় (৬) পরে জঙ্গলে নিয়ে হত্যার বদলে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করা হয় (৭) সেখান থেকে প্রসিদ্ধ মতে তিন দিন পরে একটি পথহারা ব্যবসায়ী কাফেলার নিক্ষিপ্ত বালতিতে করে উপরে উঠে আসেন (৮) অতঃপর ভাইদের মাধ্যমে ব্যবসায়ী কাফেলার নিকটে ক্রীতদাস হিসাবে স্বল্পমূল্যে বিক্রি হয়ে যান (৯) অতঃপর ‘আযীযে মিছর’ ক্বিৎফীরের গৃহে ক্রীতদাস হিসাবে পদার্পণ করেন ও পুত্রস্নেহে লালিত-পালিত হন (১০) যৌবনে গৃহস্বামীর স্ত্রী যোলায়খার কু-নযরে পড়েন (১১) অতঃপর সেখান থেকে ব্যভিচার চেষ্টার মিথ্যা অপবাদে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন (১২) প্রসিদ্ধ মতে সাত বছর কারাগারে থাকার পর বাদশাহর স্বপ্ন ব্যাখ্যা দানের অসীলায় বেকসূর খালাস পান এবং তার পূর্বে সম্ভবতঃ জেলখানাতেই তাঁর নবুঅত লাভ হয় (১৩) অতঃপর বাদশাহর নৈকট্যশীল হিসাবে বরিত হন (১৪) এ সময় ক্বিৎফীরের মৃত্যু এবং বাদশাহর উদ্যোগে যুলায়খার সাথে ইউসুফের বিবাহ হয় বলে ইস্রাঈলী বর্ণনায় প্রতিভাত হয়। তবে এতে মতভেদ রয়েছে। (১৫) বাদশাহ ইসলাম কবুল করেন বলে বর্ণিত হয়েছে এবং ইউসুফকে অর্থ মন্ত্রণালয় সহ দেশের পুরা শাসনভার অর্পণ করে তিনি নির্জনবাসী হন (১৬) দুর্ভিক্ষের সাত বছরের শুরুতে কেন‘আন থেকে ইউসুফের সৎ ভাইয়েরা খাদ্যের সন্ধানে মিসরে আসেন এবং তিনি তাদের চিনতে পারেন। দ্বিতীয়বার আসার সময় তিনি বেনিয়ামীনকে সাথে আনতে বলেন (১৭) বেনিয়ামীনকে আনার পর বিদায়ের সময় তার খাদ্য-শস্যের বস্তার মধ্যে ওযনপাত্র রেখে দিয়ে কৌশলে ‘চোর’(?) বানিয়ে তাকে নিজের কাছে আটকে রাখেন (১৮) বেনিয়ামীনকে হারানোর মনোকষ্টে বেদনাহত পিতা ইয়াকূব স্বীয় পুত্র ইউসুফ ও বেনিয়ামীনকে একত্রে পাওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট থেকে বিশেষ জ্ঞান অথবা গোপন অহী লাভ করেন (১৯) ইউসুফ ও বেনিয়ামীনকে খুঁজে আনার জন্য ছেলেদের প্রতি তিনি কড়া নির্দেশ দেন এবং সেমতে তারা পুনরায় মিসর গমন করেন (২০) এই সময় আযীযে মিছরের সঙ্গে সাক্ষাৎ কালে ভাইদের মুখে বৃদ্ধ পিতার ও দুস্থ পরিবারের দুরবস্থার কথা শুনে ব্যথিত ইউসুফ নিজেকে প্রকাশ করে দেন। (২১) তখন ভাইয়েরা তার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেন (২২) ইউসুফের নির্দেশে ভাইয়েরা কেন‘আনে ফিরে যান এবং ইউসুফের দেওয়া তার ব্যবহৃত জামা তার পরামর্শমতে অন্ধ পিতার চেহারার উপরে রাখার সাথে সাথে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান (২৩) অতঃপর ইউসুফের আবেদনক্রমে গোটা ইয়াকূব-পরিবার মিসরে স্থায়ীভাবে হিজরত করে (২৪) মিসরে তাদেরকে রাজকীয় সন্বর্ধনা প্রদান করা হয় এবং প্রসিদ্ধ মতে চল্লিশ বছর পর পিতা ও পুত্রের মিলন হয়। (২৫) অতঃপর পিতা-মাতা ও ১১ ভাই ইউসুফকে সম্মানের সিজদা করেন। (২৬) এভাবে শৈশবে দেখা ইউসুফের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় এবং একটি করুণ কাহিনীর আনন্দময় সমাপ্তি ঘটে।
ইয়াকূব (আঃ)-এর মৃত্যু :
ইয়াকূব (আঃ) মিসরে ১৭ বছর বসবাস করার পর ১৪৭ বছর বয়সে সেখানে মৃত্যুবরণ করেন এবং অছিয়ত অনুযায়ী তাঁকে কেন‘আনে পিতা ইসহাক ও দাদা ইবরাহীম (আঃ)-এর কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।[35]
ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যু:
ইউসুফ (আঃ) ১২০ বছর বয়সে মিসরে ইন্তেকাল করেন। তিনিও কেন‘আনে সমাধিস্থ হওয়ার জন্য অছিয়ত করে যান। তাঁর দুই ছেলে ছিল ইফরাঈম ও মানশা।[36] কেন‘আনের উক্ত স্থানটি এখন ফিলিস্তীনের হেবরন এলাকায় ‘আল-খলীল’ নামে পরিচিত। আল্লাহ বলেন, ﻟَﻘَﺪْ ﻛَﺎﻥَ ﻓِﻲ ﻗَﺼَﺼِﻬِﻢْ ﻋِﺒْﺮَﺓٌ ﻟِّﺄُﻭْﻟِﻲ ﺍﻷَﻟْﺒَﺎﺏِ،
‘নিশ্চয়ই নবীগণের কাহিনীতে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ রয়েছে’ (ইউসুফ ১২/১১১) ।
ঐতিহাসিক মানছূরপুরী (মৃ: ১৩৪৯/১৯৩০ খৃ:) বলেন, ইউসুফ (আঃ)-এর অবস্থার সাথে আমাদের নবী (ছাঃ)-এর অবস্থার পুরোপুরি মিল ছিল। দু’জনেই সৌন্দর্য ও পূর্ণতার অধিকারী ছিলেন। দু’জনকেই নানাবিধ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’তে হয়েছে। দু’জনের মধ্যে ক্ষমা ও দয়াগুণের প্রাচুর্য ছিল। দু’জনেই স্ব স্ব অত্যাচারী ভাইদের উদ্দেশ্যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বলেছিলেন, ﻻَﺗَﺜْﺮِﻳْﺐَ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢُ ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই’। দু’জনেই আদেশ দানের ও শাসন ক্ষমতার মালিক ছিলেন এবং পূর্ণ কামিয়াবী ও প্রতিপত্তি থাকা অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছেন’। [37]
পূর্বে বর্ণিত ঐতিহাসিক বর্ণনা সমূহের সাথে মানছূরপুরীর বর্ণনার মধ্যে কিছু গরমিল রয়েছে। ঐতিহাসিকগণের মধ্যে এরূপ মতপার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য এই যে, কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বাইরে সকল বক্তব্যের উৎস হ’ল ইস্রাঈলী বর্ণনা সমূহ। সেখানে বক্তব্যের ভিন্নতার কারণেই মুসলিম ঐতিহাসিকদের বক্তব্যে ভিন্নতা এসেছে। এই সঙ্গে এটাও জানা আবশ্যক যে, ইহুদীরা ছিল আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকারকারী, অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যাকারী, আল্লাহর কিতাবসমূহকে বিকৃতকারী ও তার মাধ্যমে দুনিয়া উপার্জনকারী এবং নবীগণের চরিত্র হননকারী। বিশেষ করে ইউসুফ, দাঊদ, সুলায়মান, ঈসা ও তাঁর মায়ের উপরে যে ধরনের জঘন্য অপবাদ সমূহ তারা রটনা করেছে, ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। অতএব ইউসুফ (আঃ) সম্পর্কে তাদের বর্ণিত অভব্য ও আপত্তিকর বিষয়াবলী থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
সংশয় নিরসন :
সূরা ইউসুফের মোট ৯ (নয়)টি আয়াতের ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আয়াতগুলি হ’ল যথাক্রমে ৪, ৬, ৮, ১৫, ২৪, ২৬, ২৮, ৪২ ও ৫২ আমরা এখানে সেগুলি সংক্ষেপে তুলে ধরব এবং গৃহীত ব্যাখ্যাটি পেশ করব।-
১. আয়াত সংখ্যা ৪ : ( ﺃَﺣَﺪَ ﻋَﺸَﺮَ ﻛَﻮْﻛَﺒﺎً ) ‘এগারোটি নক্ষত্র’। জনৈক ইহুদীর প্রশ্নের উত্তরে রাসূলের বরাত দিয়ে উক্ত ১১টি নক্ষত্রের নাম সহ হাদীছ বর্ণনা করা হয়েছে।[38] যাদেরকে ইউসুফ আকাশে তাকে সিজদা করতে দেখেন। অথচ হাদীছটি ভিত্তিহীন।
এখানে গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল , ইউসুফের বাকী ১১ ভাই হ’লেন ১১টি নক্ষত্র এবং তাঁর পিতা-মাতা হ’লেন সূর্য ও চন্দ্র, যারা একত্রে ইউসুফকে সম্মানের সিজদা করেন। যা বর্ণিত হয়েছে সূরা ইউসুফ ১০০ নম্বর আয়াতে।
২. আয়াত সংখ্যা ৬ : ( ﻭَﻳُﻌَﻠِّﻤُﻚَ ﻣِﻦ ﺗَﺄْﻭِﻳﻞِ ﺍﻷَﺣَﺎﺩِﻳﺚِ ) ‘এবং তোমাকে বাণী সমূহের নিগুঢ় তত্ত্ব শিক্ষা দেবেন’। এখানে একদল বিদ্বান বলেছেন, ‘বাণী সমূহের নিগুঢ় তত্ত্ব’ অর্থ আল্লাহর কিতাব ও নবীগণের সুন্নাত সমূহের অর্থ উপলব্ধি করা। এখানে গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল : স্বপ্ন ব্যাখ্যা দানের ক্ষমতা, যা বিশেষভাবে হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহর বাণী সমূহ, যা তাঁর কিতাব সমূহে এবং নবীগণের সুন্নাত সমূহে বিধৃত হয়েছে, সেসবের ব্যাখ্যাও এর মধ্যে শামিল রয়েছে।
৩. আয়াত সংখ্যা ৮ : ( ﺇِﻥَّ ﺃَﺑَﺎﻧَﺎ ﻟَﻔِﻲ ﺿَﻼَﻝٍ ﻣُّﺒِﻴﻦٍ ) ‘নিশ্চয়ই আমাদের পিতা স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন’। ইউসুফের বিমাতা দশ ভাই তাদের পিতা হযরত ইয়াকূব (আঃ)-কে একথা বলেছিল শিশুপুত্র ইউসুফ ও তার ছোট ভাই বেনিয়ামীনের প্রতি তাঁর স্নেহাধিক্যের অভিযোগ এনে। একই কথা তাঁকে পরিবারের অন্যেরা কিংবা প্রতিবেশীরাও বলেছিল, যখন ইউসুফের সাথে সাক্ষাতের পর তার ব্যবহৃত জামা নিয়ে ভাইদের কাফেলা কেন‘আনের উদ্দেশ্যে মিসর ত্যাগ করছিল। পিতা ইয়াকূব তখন বলেছিলেন, ﺇِﻧِّﻲ ﻟَﺄَﺟِﺪُ ﺭِﻳْﺢَ ﻳُﻮْﺳُﻒَ ‘আমি ইউসুফের গন্ধ পাচ্ছি’ (ইউসুফ ৯৪) । জবাবে লোকেরা বলেছিল, ﺗَﺎﻟﻠﻪِ ﺇِﻧَّﻚَ ﻟَﻔِﻲْ ﺿَﻼَﻟِﻚَ ﺍﻟْﻘَﺪِﻳْﻢِ ‘আল্লাহর কসম! আপনি তো সেই পুরানো ভ্রান্তিতেই পড়ে আছেন’
(ইউসুফ ৯৫) ।
এখানে ‘ভ্রান্তি’ ( ﺿﻠﻞ ) অর্থ ‘প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে না জানা’। যেমন শেষনবী (ছাঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ﻭَﻭَﺟَﺪَﻙَ ﺿَﺎﻻًّ ﻓَﻬَﺪَﻯ ‘তিনি তোমাকে পেয়েছিলেন পথহারা। অতঃপর তিনি পথ দেখিয়েছেন’ (আয-যোহা ৭) । অতএব গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল এই যে, এখানে ﺿﻼﻝবা ভ্রান্তি কথাটি আভিধানিক অর্থে এসেছে পারিভাষিক অর্থে নয়। কেননা পারিভাষিক অর্থে ﺿﻼﻝবা ভ্রষ্টতার অর্থ ﺿﻼﻝ ﻓﻲ ﺍﻟﺪﻳﻦ ‘ধর্মচ্যুত হওয়া’। নবীপুত্র হিসাবে ইউসুফের ভাইয়েরা তাদের পিতা নবী ইয়াকূবকে নিশ্চয়ই ধর্মচ্যুত কাফের বলেনি।
৪. আয়াত সংখ্যা ১৫ : ‏( ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺫَﻫَﺒُﻮﺍ ﺑِﻪِ ﻭَﺃَﺟْﻤَﻌُﻮﺍْ ﺃَﻥ ﻳَّﺠْﻌَﻠُﻮْﻩُ ﻓِﻲ ﻏَﻴَﺎﺑَﺔِ ﺍﻟْﺠُﺐِّ ﻭَﺃَﻭْﺣَﻴْﻨَﺎ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﻟَﺘُﻨَﺒِّﺌَﻨَّﻬُﻢْ ﺑِﺄَﻣْﺮِﻫِﻢْ ﻫَـﺬَﺍ ﻭَﻫُﻢْ ﻻَ ﻳَﺸْﻌُﺮُﻭْﻥَ ‏) ‘অতঃপর তারা যখন তাকে নিয়ে যাত্রা করল এবং অন্ধকূপে নিক্ষেপ করতে একমত হ’ল, তখন আমরা তাকে অহী (ইলহাম) করলাম যে, (এমন একটা দিন আসবে, যখন) অবশ্যই তুমি তাদেরকে তাদের এ কুকর্মের কথা অবহিত করবে। অথচ তারা তোমাকে চিনতে পারবে না’।
এখানে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন ‘যখন তারা তাকে নিয়ে যাত্রা করল’-এর ﻟَﻤَّﺎ অর্থাৎ ‘যখন’-এর জওয়াব নিয়ে। অর্থাৎ কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বে না পরে এই ইলহাম হয়েছিল। কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর ভাইয়েরা যখন রক্ত মাখা জামা নিয়ে পিতার নিকটে এসে কৈফিয়ত পেশ করে
(ইউসুফ ১৭) , তখন ইউসুফকে সান্ত্বনা দিয়ে এ ইলহাম করা হয়।
এক্ষেত্রে গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল : ( ﻭَﺃَﻭْﺣَﻴْﻨَﺎ ﺇِﻟَﻴْﻪِ)-এর ﻭﺍﻭ এসেছে ( ﻟَﻤَّﺎ)-এর জওয়াব হিসাবে এবং তা বাক্যে ﺻﻠﺔ হয়েছে। ফলে ব্যাখ্যা দাঁড়াবে এই যে, কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বেই এ ইলহাম করা হয়েছিল। আর এটি বাস্তবায়িত হয়েছিল বহু বৎসর পরে যখন ইউসুফের সঙ্গে তার ভাইদের সাক্ষাৎ হয়। অথচ তারা তাঁকে চিনতে পারেনি (ইউসুফ ৫৮) । ইউসুফ তার ভাইদের সেদিন বলেছিলেন, ‘তোমাদের কি জানা আছে যা তোমরা করেছিলে ইউসুফ ও তার ভাইয়ের সাথে? যখন তোমরা (পরিণাম সম্পর্কে) অজ্ঞ ছিলে’? ‘তারা বলল, তবে কি তুমিই ইউসুফ? তিনি বললেন, আমিই ইউসুফ, আর এ হ’ল আমার (সহোদর) ভাই। আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন…
(ইউসুফ ৮৯-৯০) ।
৫. আয়াত সংখ্যা ২৪ : ‏( ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﻫَﻤَّﺖْ ﺑِﻪِ ﻭَﻫَﻢَّ ﺑِﻬَﺎ ﻟَﻮْﻻَ ﺃَﻥ ﺭَّﺁ ﺑُﺮْﻫَﺎﻥَ ﺭَﺑِّﻪِ ‏) ‘উক্ত মহিলা তার বিষয়ে কুচিন্তা করেছিল। আর সেও তার প্রতি কল্পনা করত, যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করত..’।
এখানে প্রথম প্রশ্ন হ’লঃ ইউসুফ উক্ত মহিলার প্রতি কোনরূপ অন্যায় কল্পনা করেছিলেন কি-না। দ্বিতীয় প্রশ্ন হ’ল, তিনি যে আল্লাহর পক্ষ হ’তে ‘প্রমাণ’ ( ﺑﺮﻫﺎﻥ ) অবলোকন করেছিলেন সেটা কি?
প্রথম প্রশ্নের জওয়াব হ’ল দ্বিবিধ: (১) অনিচ্ছাকৃতভাবে কল্পনা এসে থাকতে পারে। যা বেগানা নারী-পুরুষের মধ্যে হ’তে পারে। কিন্তু বুদ্বুদের ন্যায় উবে যাওয়া চকিতের এই কল্পনা কোন পাপের কারণ নয়। কেননা তিনি নিজেকে সংযত রেখেছিলেন এবং ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ভবিষ্যৎ নবী হিসাবে যেটা তাঁর জন্য স্বাভাবিক ছিল। আল্লাহ বলেন, ﻭَﺃَﻣَّﺎ ﻣَﻦْ ﺧَﺎﻑَ ﻣَﻘَﺎﻡَ ﺭَﺑِّﻪِ ﻭَﻧَﻬَﻰ ﺍﻟﻨَّﻔْﺲَ ﻋَﻦِ ﺍﻟْﻬَﻮَﻯ، ﻓَﺈِﻥَّ ﺍﻟْﺠَﻨَّﺔَ ﻫِﻲَ ﺍﻟْﻤَﺄْﻭَﻯ – ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সত্তাকে ভয় করে এবং নিজেকে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বিরত রাখে’, ‘নিশ্চয়ই জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৪০-৪১) । মুনাফিকদের কুপরামর্শে ওহোদের যুদ্ধ থেকে বনু হারেছাহ ও বনু সালামাহ পালিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু পালায়নি। যে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ﺇِﺫْ ﻫَﻤَّﺖْ ﻃَّﺂﺋِﻔَﺘَﺎﻥِ ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﺃَﻥ ﺗَﻔْﺸَﻼَ ﻭَﺍﻟﻠﻪ ُﻭَﻟِﻴُّﻬُﻤَﺎ ﻭَﻋَﻠَﻰ ﺍﻟﻠﻪِ ﻓَﻠْﻴَﺘَﻮَﻛَّﻞِ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨُﻮْﻥَ ‘যখন তোমাদের দু’টি দল সাহস হারাবার উপক্রম করেছিল, অথচ আল্লাহ তাদের অভিভাবক ছিলেন, আর আল্লাহর উপরেই বিশ্বাসীদের ভরসা করা উচিত’ (আলে ইমরান ১২২) ।
এখানে একই ﻫَﻤَّﺖْ(কল্পনা করছিল) ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন এবং নিজেকে তাদের অভিভাবক বলে বরং তাদের প্রশংসা করেছেন। উল্লেখ্য যে, ﻫَﻢٌّ বা কল্পনা দু’ধরনের হয়ে থাকে। এক- ﻫﻢ ﺛﺎﺑﺖ বা দৃঢ় কল্পনা, যা আযীয-পত্নী করেছিল ইউসুফের প্রতি। দুই- ﻫﻢ ﻋﺎﺭﺽ অনিচ্ছাকৃত কল্পনা, যাতে কোন দৃঢ় সংকল্প থাকে না। ইউসুফের মধ্যে যদি এটা এসে থাকে বলে মনে করা হয়, তবে তাতে তিনি দোষী হবেন না। কেননা তিনি ঐ কল্পনার কথা মুখে বলেননি বা কাজে করেননি। বরং তার বিরুদ্ধে বলেছেন ও করেছেন।
দ্বিতীয় জওয়াব হ’ল এই যে, ইউসুফের মনে আদৌ কোন অন্যায় কল্পনা আসেনি। প্রমাণ মওজুদ থাকার কারণে এটা তাঁর চরিত্রে নিষিদ্ধ ছিল। মুফাসসির আবু হাইয়ান স্বীয় তাফসীর ‘বাহরুল মুহীত্বে’ একথা বলেন। তিনি বলেন, এমতাবস্থায় আয়াতটির বর্ণনা হবে, ﻟﻮﻻ ﺃﻥ ﺭَّﺁ ﺑﺮﻫﺎﻥ ﺭﺑﻪ ﻟﻬﻢَّ ﺑﻬﺎ ‘যদি তিনি তার পালনকর্তার প্রমাণ না দেখতেন, তাহ’লে তার (অর্থাৎ উক্ত মহিলার) ব্যাপারে কল্পনা করতেন’। আলোচ্য আয়াতে ﻟﻮﻻ (যদি) শর্তের জওয়াব আগেই উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ বলা হয়েছে ﻭَﻫَﻢَّ ﺑِﻬَﺎ ﻟَﻮْﻻ ﺃَﻥ ﺭَّﺁ ﺑُﺮْﻫَﺎﻥَ ﺭَﺑِّﻪِ ‘আর সেও তার প্রতি কল্পনা করত, যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করত’। আর সেই ‘বুরহান’ বা প্রমাণ ছিল আল্লাহ নির্ধারিত ‘নফসে লাউয়ামাহ’ অর্থাৎ শাণিত বিবেক, যা তাকে কঠোরভাবে বাধা দিয়েছিল।
আরবী সাহিত্যে ও কুরআনে এ ধরনের বাক্যের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন জান্নাতীগণ বলবেন, ﻭَﻣَﺎ ﻛُﻨَّﺎ ﻟِﻨَﻬْﺘَﺪِﻱَ ﻟَﻮْﻻَ ﺃَﻥْ ﻫَﺪَﺍﻧَﺎ ﺍﻟﻠﻪُ ‘আমরা কখনো সুপথ পেতাম না, যদি না আল্লাহ আমাদের পথ প্রদর্শন করতেন’ (আ‘রাফ ৪৩) । অর্থাৎ ﻟﻮﻻ ﺃﻥ ﻫﺪﺍﻧﺎ ﺍﻟﻠﻪُ ﻣﺎ ﻛﻨﺎ ﻟِﻨﻬﺘﺪﻱَ ‘যদি আল্লাহ আমাদের হেদায়াত না করতেন, তাহ’লে আমরা হেদায়াত পেতাম না’।
ইউসুফের নিষ্পাপত্ব :
ইউসুফ যে এ ব্যাপারে শতভাগ নিষ্পাপ ছিলেন, সে বিষয়ে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি দ্রষ্টব্য:
(১) ইউসুফ দৃঢ়ভাবে নিজের নির্দোষিতা ঘোষণা করেন। যেমন গৃহস্বামীর কাছে তিনি বলেন, ﻫِﻲَ ﺭَﺍﻭَﺩَﺗْﻨِﻲْ ﻋَﻦْ ﻧَﻔْﺴِﻲْ ‘উক্ত মহিলাই আমাকে প্ররোচিত করেছিল’ (ইউসুফ ২৬) । তার আগে তিনি মহিলার কুপ্রস্তাবের জওয়াবে বলেছিলেন, ﻣَﻌَﺎﺫَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺇِﻧَّﻪُ ﺭَﺑِّﻲْ ﺃَﺣْﺴَﻦَ ﻣَﺜْﻮَﺍﻱَ ﺇِﻧَّﻪُ ﻻَ ﻳُﻔْﻠِﺢُ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤُﻮْﻥَ ‘আল্লাহ আমাকে রক্ষা করুন! তিনি (অর্থাৎ গৃহস্বামী) আমার মনিব। তিনি আমার উত্তম বসবাসের ব্যবস্থা করেছেন। নিশ্চয়ই সীমা লংঘনকারীগণ সফলকাম হয় না’ (ইউসুফ ২৩) । নগরীর মহিলাদের সমাবেশে গৃহকত্রী যখন ইউসুফকে তার কুপ্রস্তাবে রাযী না হ’লে জেলে পাঠানোর হুমকি দেন, তখন ইউসুফ তার জওয়াবে বলেছিলেন, ﺭَﺏِّ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦُ ﺃَﺣَﺐُّ ﺇِﻟَﻲَّ ﻣِﻤَّﺎ ﻳَﺪْﻋُﻮﻧَﻨِﻲْ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ‘হে আমার পালনকর্তা! এরা আমাকে যে কাজের দিকে আহবান জানাচ্ছে, তার চাইতে কারাগারই আমার নিকটে অধিক পসন্দনীয়’ (ইউসুফ ৩৩) । এখানে তিনি তাদের চক্রান্ত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আশ্রয় ভিক্ষা করেন।
(২) উক্ত মহিলা নিজেই ইউসুফের নির্দোষিতার সাক্ষ্য দেন। যেমন নগরীর মহিলাদের সমাবেশে তিনি বলেন, ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﺭَﺍﻭَﺩﺗُّﻪُ ﻋَﻦْ ﻧَّﻔْﺴِﻪِ ﻓَﺎﺳَﺘَﻌْﺼَﻢَ ‘আমি তাকে প্ররোচিত করেছিলাম, কিন্তু সে নিজেকে সংযত রেখেছিল’ (ইউসুফ ৩২) । পরবর্তীতে যখন ঘটনা পরিষ্কার হয়ে যায়, তখনও উক্ত মহিলা বলেন, ﺍﻵﻥَ ﺣَﺼْﺤَﺺَ ﺍﻟْﺤَﻖُّ ﺃَﻧَﺎ ﺭَﺍﻭَﺩﺗُّﻪُ ﻋَﻦْ ﻧَّﻔْﺴِﻪِ ﻭَﺇِﻧَّﻪُ ﻟَﻤِﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴْﻦَ ‘এখন সত্য প্রকাশিত হ’ল। আমিই তাকে ফুসলিয়েছিলাম এবং সে ছিল সত্যবাদী’ (ইউসুফ ৫১) ।
(৩) তদন্তকালে নগরীর সকল মহিলা ইউসুফ সম্পর্কে সত্য সাক্ষ্য দেন। তারা বলেন, ﺣَﺎﺵَ ِﻟﻠﻪِ ﻣَﺎ ﻋَﻠِﻤْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻣِﻦْ ﺳُﻮْﺀٍ
‘আল্লাহ পবিত্র। আমরা ইউসুফ সম্পর্কে মন্দ কিছুই জানি না’ (ইউসুফ ৫১) ।
(৪) গৃহকর্তা আযীযে মিছর তার নির্দোষিতার সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, ﺇِﻧَّﻪُ ﻣِﻦْ ﻛَﻴْﺪِﻛُﻦَّ ﺇِﻥَّ ﻛَﻴْﺪَﻛُﻦَّ ﻋَﻈِﻴْﻢٌ ‘(হে স্ত্রী!) এটা তোমাদের ছলনা মাত্র। নিঃসন্দেহে তোমাদের ছলনা খুবই মারাত্মক’
(ইউসুফ ২৮) । ‘ইউসুফ! এ প্রসঙ্গ ছাড়। আর হে মহিলা! এ পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চিতভাবে তুমিই পাপাচারিনী’ (ঐ, ২৯) ।
(৫) গৃহকর্তার উপদেষ্টা ও সাক্ষী একইভাবে সাক্ষ্য দেন ও বলেন, ﻭَﺇِﻥْ ﻛَﺎﻥَ ﻗَﻤِﻴْﺼُﻪُ ﻗُﺪَّ ﻣِﻦْ ﺩُﺑُﺮٍ ﻓَﻜَﺬَﺑَﺖْ ﻭَﻫُﻮَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴْﻦَ ‘যদি ইউসুফের জামা পিছন দিকে ছেঁড়া হয়, তবে মহিলা মিথ্যা বলেছে এবং ইউসুফ সত্যবাদী’ (ঐ, ২৭) ।
(৬) আল্লাহ স্বয়ং ইউসুফের নির্দোষিতার সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন, ﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻟِﻨَﺼْﺮِﻑَ ﻋَﻨْﻪُ ﺍﻟﺴُّﻮْﺀَ ﻭَﺍﻟْﻔَﺤْﺸَﺎﺀَ ﺇِﻧَّﻪُ ﻣِﻦْ ﻋِﺒَﺎﺩِﻧَﺎ ﺍﻟْﻤُﺨْﻠَﺼِﻴْﻦَ ‘এভাবেই এটা এজন্য হয়েছে, যাতে আমরা তার থেকে যাবতীয় মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয়ই সে আমাদের মনোনীত বান্দাগণের অন্যতম’ (ঐ, ২৪) ।
(৭) এমনকি অভিশপ্ত ইবলীসও প্রকারান্তরে ইউসুফের নির্দোষিতার সাক্ষ্য দিয়েছে। যেমন সে অভিশপ্ত হওয়ার পর আল্লাহ্কে বলেছিল,
ﻝَﺃُﻏْﻮِﻳَﻨَّﻬُﻢْ ﺃَﺟْﻤَﻌِﻴْﻦَ، ﺇِﻻَّ ﻋِﺒَﺎﺩَﻙَ ﻣِﻨْﻬُﻢُ ﺍﻟْﻤُﺨْﻠَﺼِﻴْﻦَ –
‘আমি অবশ্যই তাদের (বনু আদমের) সবাইকে পথভ্রষ্ট করব’। ‘তবে তাদের মধ্য হ’তে তোমার মনোনীত বান্দাগণ ব্যতীত (হিজর ৩৯-৪০; ছোয়াদ ৮২) । এখানে একই শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহ ইউসুফকে তাঁর ‘মনোনীত বান্দাগণের অন্যতম’ (ইউসুফ ২৪) বলে ঘোষণা করেছেন।
অত্র ২৪ আয়াতে বর্ণিত ‏( ﺍﻟﺴُّﻮﺀَ ﻭَﺍﻟْﻔَﺤْﺸَﺎﺀ ‏)
‘মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয়সমূহ’ অর্থ কি? এ বিষয়ে বিদ্বানগণ বলেন, মুখের বা হাতের দ্বারা স্পর্শ করার পাপ এবং প্রকৃত যেনার পাপ। অর্থাৎ উভয় প্রকার পাপ থেকে আল্লাহ ইউসুফকে ফিরিয়ে নেন।
নিকৃষ্ট মনের অধিকারী ইহুদীরা ও তাদের অনুসারীরা, যারা ইউসুফের চরিত্রে কালিমা লেপন করে নানাবিধ কল্পনার ফানুস উড়িয়ে শত শত পৃষ্ঠা মসীলিপ্ত করেছে, তাদের উদ্দেশ্যে ইমাম রাযী (রহঃ) বলেন, ‘যেসব মূর্খরা ইউসুফের চরিত্রে কলংক লেপনের চেষ্টা করে, তারা যদি আল্লাহর দ্বীনের অনুসারী হবার দাবীদার হয়, তাহ’লে তারা এ ব্যাপারে আল্লাহর সাক্ষ্য কবুল করুক। অথবা যদি তারা শয়তানের তাবেদার হয়, তবে ইবলীসের সাক্ষ্য কবুল করুক’। আসল কথা এই যে, ইবলীস এখন এদের শিষ্যে পরিণত হয়েছে।
এক্ষণে আয়াতের গৃহীত ব্যাখ্যা দু’টির সারমর্ম হ’ল (১) আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রমাণ মওজুদ থাকার কারণে ইউসুফের অন্তরে আদৌ বাজে কল্পনার উদয় হয়নি (২) প্রমাণ দেখার কারণে কল্পনার বুদ্বুদ সাথে সাথে মিলে যায় এবং তিনি আল্লাহর আশ্রয় কামনা করেন ও দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল: ঐ ‘বুরহান’ বা প্রমাণটি কি ছিল, যা তিনি দেখেছিলেন? এ বিষয়ে ইবনু আববাস, আলী, ইকরিমা, মুজাহিদ, সুদ্দী, সাঈদ ইবনু জুবায়ের, ইবনু সীরীন, ক্বাতাদাহ, হাসান বাছরী, যুহরী, আওযাঈ, কা‘ব আল-আহবার, ওহাব বিন মুনাবিবহ এবং অন্যান্য প্রসিদ্ধ বিদ্বান মন্ডলীর নামে এমন সব উদ্ভট ও নোংরা কাল্পনিক চিত্রসমূহ তাফসীরের কেতাব সমূহে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যা পড়তেও ঘৃণাবোধ হয় ও লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। শুরু থেকে এ যাবত কালের কোন তাফসীরের কেতাবই সম্ভবতঃ এইসব ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক গল্প থেকে মুক্ত নয়। উক্ত মুফাসসিরগণের তাক্বওয়া ও বিদ্যাবত্তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলতে বাধ্য হব যে, ইউসুফের প্রতি সুধারণা রাখা সত্ত্বেও তাঁরা প্রাচীন কালের ইহুদী যিন্দীক্বদের বানোয়াট কাহিনী সমূহের কিছু কিছু স্ব স্ব কিতাবে স্থান দিয়ে দুধের মধ্যে বিষ মিশ্রিত করেছেন। যা এ যুগের নাস্তিক ও যিন্দীক্বদের জন্য নবীগণের নিষ্পাপত্বের বিরুদ্ধে প্রচারের মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে তা ধর্মভীরু মানুষের ধর্মচ্যুতির কারণ হয়েছে। সাথে সাথে এগুলি কিছু পেট পূজারী কাহিনীকারের রসালো গল্পের খোরাক হয়েছে। তাফসীরের নামে যা শুনে মানুষ ক্রমেই ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অতএব ঈমানদারগণ সাবধান!!
‘বুরহান’ কি?
ﻟَﻮْﻻ ﺃَﻥ ﺭَّﺁﻯ ﺑُﺮْﻫَﺎﻥَ ﺭَﺑِّﻪِ ‘যদি সে তার পালনকর্তার প্রমাণ না দেখত’ এ কথার মধ্যে কোন্ প্রমাণ ইউসুফকে দেখানো হয়েছিল, সেটা বলা হয়নি। তবে কুরআনে মানুষের তিনটি নফসের কথা বলা হয়েছে। (১) নফসে আম্মারাহ। যা মানুষকে অন্যায় কাজে প্ররোচিত করে (২) নফসে লাউয়ামাহ। যা মানুষকে ন্যায় কাজে উদ্বুদ্ধ করে ও অন্যায় কাজে বাধা দেয় এবং (৩) নফসে মুত্বমাইন্নাহ, যা মানুষকে ন্যায়ের উপর দৃঢ় রাখে, আর তাতে দেহমনে প্রশান্তি আসে। নবীগণের মধ্যে শেষের দু’টি নফস সর্বাধিক জোরালোভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। আর নফসে লাউয়ামাহ বা বিবেকের তীব্র কষাঘাতকেই এখানে ‘বুরহান’ বা ‘আল্লাহর প্রমাণ’ হিসাবে বলা হয়ে থাকতে পারে। যেমন হাদীছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছিরাতে মুস্তাক্বীমের উদাহরণ বর্ণনা করে তার মাথায় একজন আহবানকারীর কথা বলেছেন, যিনি সর্বদা মানুষকে ধমক দেন যখনই সে অন্যায়ের কল্পনা করে। তিনি বলেন, খবরদার! নিষিদ্ধ পর্দা উত্তোলন করো না। করলেই তুমি তাতে প্রবেশ করবে। এই ধমকদানকারীকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ﻭﺍﻋﻆُ ﺍﻟﻠﻪِ ﻓﻲ ﻗﻠﺐِ ﻛﻞِّ ﻣﺆﻣﻦٍ ‘প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ে আল্লাহর উপদেশদাতা’ হিসাবে অভিহিত করেছেন’। [39] ইউসুফের হৃদয়ে নিশ্চয়ই ঐ ধমকদাতা উপদেশ দানকারী মওজুদ ছিলেন যাকে ‏( ﺑُﺮْﻫَﺎﻥَ ﺭَﺑِّﻪِ ‏) বা ‘আল্লাহর প্রমাণ’ বলা হয়েছে।
অতএব এখানে ‘বুরহান’ বা প্রমাণ বলতে যেনার মত জঘন্য অপকর্মের বিরুদ্ধে বিবেকের তীব্র কষাঘাতকেই বুঝানো হয়েছে। যা নবীগণের হৃদয়ে আল্লাহ প্রোথিত রাখেন। ইমাম জা‘ফর ছাদিক্ব বলেন, ‘বুরহান’ অর্থ নবুঅত, যাকে আল্লাহ নবীগণের হৃদয়ে গ্রথিত রাখেন। যা তার মধ্যে এবং আল্লাহর ক্রোধপূর্ণ কাজের মধ্যে প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে। অতএব ‘বুরহান’ অর্থ নবুঅতের নিষ্পাপত্ব, যা ইউসুফকে উক্ত পাপ থেকে বিরত রাখে।
৬. আয়াত সংখ্যা ২৬ : ‏( ﻭَﺷَﻬِﺪَ ﺷَﺎﻫِﺪٌ ﻣِّﻦْ ﺃَﻫْﻠِﻬَﺎ ‏) ‘আর মহিলার পরিবারের জনৈক ব্যক্তি সাক্ষ্য দিল’। কিন্তু কে সেই সাক্ষী? এ নিয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে প্রচুর মতভেদ রয়েছে। যেমন কেউ বলেছেন এটি ছিল দোলনার শিশু, কেউ বলেছেন, মহিলার এক দূরদর্শী চাচাতো ভাই, কেউ বলেছেন, তিনি মানুষ বা জিন ছিলেন না, বরং আল্লাহর অন্য এক সৃষ্টি ছিলেন। ছাহাবী ও তাবেঈগণের নামেই উক্ত মতভেদগুলি বর্ণিত হয়েছে। অথচ কুরআন স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে যে, ‘ঐ ব্যক্তি ছিলেন মহিলার পরিবারের সদস্য’ (ইউসুফ ২৬) । এটা বুঝতে মোটেই কষ্ট হয় না যে, লোকটি ছিলেন নিরপেক্ষ ও অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি এবং তিনি ছিলেন আযীযে মিছরের নিকটতম লোক। নইলে তিনি তার সঙ্গে অন্দরমহলে আসতে পারতেন না।
দুর্ভাগ্য যে, এ প্রসঙ্গে একটি হাদীছও বলা হয়ে থাকে। সেখানে বলা হয়েছে যে, চার জন শিশু দোলনায় থাকতে কথা বলেছে, তার মধ্যে ইউসুফের সাক্ষী একজন। চারজনের মধ্যে তিন জনের বিষয়টি সঠিক। কিন্তু ইউসুফের সাক্ষী কথাটি মিথ্যা। যার কারণে হাদীছটি যঈফ। [40] ঐ তিন জন হ’লেন, ঈসা (আঃ), ২- জুরায়েজ নামক বনু ইস্রাঈলের জনৈক সৎ ব্যক্তি, যাকে এক দুষ্টু মহিলা যেনার অপবাদ দেয়। পরে তার বাচ্চা স্বয়ং জুরায়েজ-এর নির্দোষিতার সাক্ষ্য দেয় ও প্রকৃত যেনাকারীর নাম বলে দেয়
(মুত্তাফাক্ব আলাইহ) । ৩- শেষনবীর জন্মগ্রহণের প্রায় ৪০ বছর পূর্বে সংঘটিত আছহাবুল উখদূদের ঘটনা, যেখানে এক যালেম শাসক বহু গর্ত খুঁড়ে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে একদিনে প্রায় বিশ হাযার মতান্তরে সত্তুর হাযার ঈমানদার নর-নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। সে সময় একজন মহিলা তার কোলে থাকা দুধের বাচ্চাকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতস্তত করায় শিশু পুত্রটি বলে উঠেছিল ﺇﺻﺒِﺮﻯ ﻳﺎﺍُﻣَّﻪْ ﻓﺈﻧﻚِ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺤﻖ ‘ছবর কর মা! কেননা তুমি সত্যের উপরে আছ’।
[41] এইসব ছহীহ হাদীছের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ইউসুফের সাক্ষীর নাম। অথচ কুরআন স্পষ্টভাবেই বলে দিয়েছে যে, সাক্ষী ছিলেন মহিলাটির পরিবারের একজন ব্যক্তি। তাছাড়া আরও বলে দিয়েছে উক্ত ব্যক্তির দূরদর্শিতাপূর্ণ পরামর্শ যে, যদি ইউসুফের জামা পিছন দিকে ছেঁড়া হয়, তাহ’লে সে সত্যবাদী’ (ইউসুফ ২৭) । এক্ষণে কীভাবে একথা বলা যায় যে, ঐ সাক্ষী ছিল দোলনার শিশু বা আল্লাহর অন্য এক সৃষ্টি? যদি তাই হবে, তাহ’লে সেটাই তো যথেষ্ট ছিল। অন্য কোন তদন্তের দরকার ছিল না বা ইউসুফকে হয়ত জেলও খাটতে হ’ত না।
৭. আয়াত সংখ্যা ২৮ : ‏( ﺇِﻥَّ ﻛَﻴْﺪَﻛُﻦَّ ﻋَﻈِﻴﻢٌ ‏)
‘নিশ্চয়ই তোমাদের ছলনা খুবই মারাত্মক’। এই আয়াতের সঙ্গে যদি অন্য একটি আয়াত মিলানো হয়, যেখানে বলা হয়েছে যে, ﺇِﻥَّ ﻛَﻴْﺪَ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥِ ﻛَﺎﻥَ ﺿَﻌِﻴْﻔﺎً ‘নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল সর্বদা দুর্বল’ (নিসা ৭৬) । তাহ’লে ফলাফল দাঁড়াবে এই যে, মহিলারা শয়তানের চাইতে মারাত্মক। ইমাম কুরতুবী এর পক্ষে একটি মরফূ হাদীছ এনেছেন, যেখানে বলা হয়েছে যে, ﺇﻥَّ ﻛَﻴْﺪَ ﺍﻟﻨِّﺴَﺎﺀِ ﺃَﻋْﻈَﻢُ ﻣِﻦْ ﻛَﻴْﺪِ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥِ ‘নিশ্চয়ই নারীদের ছলনা শয়তানের ছলনার চাইতে বড়’। অথচ হাদীছটি যঈফ ও জাল।[42] অথচ শয়তানকে আল্লাহ ক্ষমতা দিয়েছেন মানুষকে পথভ্রষ্ট করার। আর এটা করেছেন মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য, কে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আর কে না পড়ে। পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যে ভাল ও মন্দ রয়েছে। উভয়ে শয়তানের খপ্পরে পড়তে পারে। কিন্তু কেউই শয়তানের চাইতে বড় নয়। আলোচ্য আয়াতে দুষ্টু নারীদের ছলনার ভয়ংকরতা বুঝানো হয়েছে। যেকথা একটি ছহীহ হাদীছে আল্লাহর রাসূলও বলেছেন যে, ‘জ্ঞানী পুরুষকে হতবুদ্ধি করার মোক্ষম হাতিয়ার হ’ল নারী’। [43] কেননা সাধারণ নীতি এই যে, নারীর প্রতি পুরুষ সহজে দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু তাই বলে এর অর্থ এটা নয় যে, নারীদের ছলনা শয়তানের চাইতে বড়। এ ধরনের ব্যাখ্যা নারী জাতিকে অপমান করার শামিল।
৮. আয়াত সংখ্যা ৪২ : ‏( ﺍﺫْﻛُﺮْﻧِﻲْ ﻋِﻨْﺪَ ﺭَﺑِّﻚَ ﻓَﺄَﻧﺴَﺎﻩُ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥُ ﺫِﻛْﺮَ ﺭَﺑِّﻪِ ﻓَﻠَﺒِﺚَ ﻓِﻲ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦِ ﺑِﻀْﻊَ ﺳِﻨِﻴْﻦَ ‏)
‘যে কারাবন্দী সম্পর্কে ইউসুফের ধারণা ছিল যে, সে মুক্তি পাবে, তাকে সে বলে দিল যে, তুমি তোমার মনিবের কাছে আমার কথা আলোচনা করো। কিন্তু শয়তান তাকে তা ভুলিয়ে দেয় ফলে তাঁকে কয়েক বছর কারাগারে থাকতে হয়’।
মালেক ইবনে দীনার, হাসান বাছরী, কা‘ব আল-আহবার, ওহাব বিন মুনাবিবহ ও অন্যান্য বিদ্বানগণের নামে এখানে বিষ্ময়কর সব তাফসীর বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন আইয়ূব রোগভোগ করেন সাত বছর, ইউসুফ কারাভোগ করেন সাত বছর, বুখতানছর আকৃতি পরিবর্তনের শাস্তি ভোগ করেন সাত বছর’ (কুরতুবী) । আমরা বুঝতে পারি না আল্লাহর নবীগণের সাথে ফিলিস্তীনে ইহুদী নির্যাতনকারী নিষ্ঠুর রাজা বুখতানছরের তুলনা করার মধ্যে কি সামঞ্জস্য রয়েছে?
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, ইউসুফ যখন কারাবন্দী সাক্ষীকে উক্ত কথা বলেন, তখন তাকে বলা হয়, হে ইউসুফ! তুমি আমাকে ছেড়ে অন্যকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করলে? অতএব শাস্তি স্বরূপ আমি তোমার কারাভোগের মেয়াদ বাড়িয়ে দিলাম। তখন ইউসুফ কেঁদে উঠে বললেন, হে আমার পালনকর্তা! বিপদ সমূহের বোঝা আমার অন্তরকে ভুলিয়ে দিয়েছে। সেজন্য আমি একটি কথা বলে ফেলেছি। আর কখনো এরূপ বলব না’।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, জিবরীল কারাগারে প্রবেশ করলেন এবং ইউসুফকে বললেন, বিশ্বপালক তোমাকে সালাম দিয়েছেন এবং তোমাকে বলেছেন যে, ইউসুফ! তোমার কি লজ্জা হয়নি যে, তুমি আমাকে ছেড়ে মানুষের কাছে সুফারিশ করলে? অতএব আমার সম্মান ও উচ্চ মর্যাদার কসম! অবশ্যই আমি তোমাকে কয়েক বছর জেলে রাখব। ইউসুফ বললেন, এর পরেও কি তিনি আমার উপর সন্তুষ্ট আছেন? জিব্রীল বললেন, হ্যাঁ আছেন। তখন ইউসুফ বললেন, তাহ’লে আমি কিছুরই পরোয়া করি না’।
অন্য একজন মুফাসসির বলেছেন, পাঁচ বছর জেল খাটার পরে এই ঘটনা ঘটে। ফলে শাস্তি স্বরূপ তাঁকে আরো সাত বছর জেল খাটতে হয়। এরপর তাঁর মুক্তির অনুমতি হয় এবং বাদশাহ স্বপ্ন দেখেন ও সেই অসীলায় তাঁর মুক্তি হয়’। এভাবে কেউ বলেছেন ১২ বছর, কেউ বলেছেন ১৪ বছর জেল খেটেছেন
(ইবনু কাছীর) । তবে অধিকাংশের মতে ৭ বছর। আর কুরআনে রয়েছে কেবল ﺑﻀﻊ ﺳﻨﻴﻦযার অর্থ হ’ল কয়েক বছর, যা ৩ থেকে ৯ অথবা ১০ বছরের মধ্যে
(কুরতুবী) ।
মূলতঃ ইহুদী লেখকরা ইউসুফ (আঃ)-এর কারাভোগকে তাঁর অপরাধের শাস্তি হিসাবে প্রমাণ করার জন্য এরূপ গল্প বানিয়েছে। অথচ এটা আদৌ কোন অপরাধ নয়। কেননা ছহীহ হাদীছে এসেছে, ‘আল্লাহ মানুষের সাহায্যে অতক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ মানুষ মানুষের সাহায্যে থাকে’। [44] অতএব একজন মানুষ আরেকজন মানুষের কাছে সাহায্য চাইবে এবং পরস্পরকে সাহায্য করবে, এটাই স্বাভাবিক এবং এতে অশেষ নেকী রয়েছে। কিন্তু অপরাধ হ’ল সেটাই যখন জীবিত ব্যক্তি কোন মৃত ব্যক্তি বা কোন বস্ত্তর কাছে সাহায্য চায়, অথচ তার কোন ক্ষমতা নেই। মুসলিম তাফসীরকারগণও এক্ষেত্রে ধোঁকায় পড়েছেন। এমনকি উক্ত মর্মে ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে রাসূলের নামে একটি হাদীছও বর্ণিত হয়েছে যে, ﺭﺣﻢ ﺍﻟﻠﻪ ﻳﻮﺳﻒ ﻟﻮﻟﻢ ﻳﻘﻞ ﺍﻟﻜﻠﻤﺔ ﺍﻟﺘﻲ ﻗﺎﻟﻬﺎ ﻣﺎ ﻟﺒﺚ ﻓﻲ ﺍﻟﺴﺠﻦ ﻃﻮﻝ ﻣﺎ ﻟﺒﺚ، ﺣﻴﺚ ﻳﺒﺘﻐﻲ ﺍﻟﻔﺮﺝ ﻣﻦ ﻋﻨﺪ ﻏﻴﺮ ﺍﻟﻠﻪ – ‘ইউসুফের উপর আল্লাহ রহম করুন! যদি তিনি ঐ কথা না বলতেন যা তিনি কারা সাথীকে বলেছিলেন, তাহ’লে এত দীর্ঘ সময় তাঁকে কারাগারে থাকতে হতো না। কেননা তিনি কারামুক্তির জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্যের সাহায্য কামনা করেছিলেন’। [45] অথচ হাদীছটি মুনকার ও যঈফ এবং অত্যন্ত দুর্বল। যা থেকে কোন দলীল গ্রহণ করা যায় না (হাশিয়া কুরতুবী; ইবনু কাছীর) । এর বিপরীত ছহীহ হাদীছে আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
ﻝﻭﻟَﺒِﺜْﺖَ ﻓﻰ ﺍﻟﺴِّﺠْﻦِ ﻣﺎ ﻟَﺒِﺚَ ﻳﻮﺳﻒُ ﻷَﺟَﺒْﺖُ ﺍﻟﺪﺍﻋِﻲَ
‘ইউসুফ যতদিন জেল খেটেছেন, অতদিন যদি আমি জেল খাটতাম, তাহ’লে আমি বাদশাহর দূতের ডাকে সাড়া দিতাম’। [46] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ﻟﻮ ﻛﻨﺖ ﺃﻧﺎ ﻷﺳﺮﻋﺖُ ﺍﻹﺟﺎﺑﺔَ ﻭﻣﺎ ﺍﺑﺘﻐﻴﺖُ ﺍﻟﻌﺬﺭَ ‘যদি আমি হ’তাম, তাহ’লে দ্রুত সাড়া দিতাম এবং কোনরূপ ওযর করতাম না’।
[47]
বস্ত্ততঃ এটি ছিল নবী হিসাবে ইউসুফ (আঃ)-এর পরীক্ষা। আর নবীগণই দুনিয়াতে বেশী পরীক্ষিত হন, যা বহু ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।[48]
৯. আয়াত সংখ্যা ৫২ : ‏( ﺫَﻟِﻚَ ﻟِﻴَﻌْﻠَﻢَ ﺃَﻧِّﻲ ﻟَﻢْ ﺃَﺧُﻨْﻪُ ﺑِﺎﻟْﻐَﻴْﺐِ ‏) ‘এটা এজন্য যাতে গৃহস্বামী জানতে পারেন যে, আমি তার অগোচরে তার সাথে কোন বিশ্বাসঘাতকতা করিনি’।
এখানে ‘আমি’ কে? গৃহকত্রী না ইউসুফ? বড় বড় মুফাসসিরগণ লিখেছেন, ইউসুফ। এজন্য ইবনু আববাস (রাঃ)-এর নামে একটি হাদীছ বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, বাদশাহ নগরীর মহিলাদের জমা করে তাদের কাছে ইউসুফ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সবাই বলে যে, আমরা তার ব্যাপারে মন্দ কিছু জানি না। তখন আযীয-পত্নী বলেন, এখন সত্য প্রকাশিত হ’ল। আমিই তাকে প্ররোচিত করেছিলাম এবং সে ছিল সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত। তখন ইউসুফ বলল, এটা এজন্য যাতে গৃহকর্তা জানতে পারেন যে, আমি তার অসাক্ষাতে তার সাথে কোন বিশ্বাসঘাতকতা করিনি’। তখন জিবরীল ইউসুফকে গুঁতা মেরে বলেন, যখন ঐ নারীর প্রতি তুমি কুচিন্তা করেছিলে তখনও কি নয়? অর্থাৎ তখন কি তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করো নি? জবাবে ইউসুফ বলেন, আমি নিজেকে নির্দোষ বলি না। নিশ্চয়ই মানুষের অন্তর মন্দ প্রবণ’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, জিবরীল ইউসুফকে বলেন, যখন তুমি পায়জামা খুলেছিলে, তখনও কি বিশ্বাসঘাতকতা করোনি? ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলি যে স্রেফ বাজে কথা, তা যেকোন পাঠকই বুঝতে পারেন। অথচ এগুলি এমন এমন তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, যা সব সময় আমরা মাথায় রাখি। [49]
বস্ত্ততঃ ৫০, ৫১, ৫২ ও ৫৩ চারটি আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক বিচার করলে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, ৫২ ও ৫৩ আয়াতের বক্তব্য হ’ল আযীযে মিছরের স্ত্রীর। কেননা ঐ সময় ইউসুফ ছিলেন জেলখানায়। তিনি কিভাবে মহিলাদের ঐ মজলিসে হাযির থাকলেন এবং উক্ত মন্তব্য করলেন? নগরীর মহিলাদের ও আযীয-পত্নীর স্পষ্ট স্বীকৃতির মাধ্যমে সত্য উদঘাটনের পরেই তো ইউসুফের মুক্তির পথ খুলে গেল এবং বাদশাহ বললেন, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে আমার একান্ত সহচর করে নেব
(ইউসুফ ৫৪) । কুরআনের প্রকাশ্য অর্থকে পাস কাটিয়ে দূরতম অর্থ গ্রহণের পিছনে নবী বিদ্বেষী ইহুদী লেখকদের অপপ্রচারের ফাঁদে পা দেওয়া ছাড়া এগুলি আর কীইবা হ’তে পারে?
প্রাচীনতম মুফাসসির হিসাবে ইবনু জারীর ত্বাবারী (মৃঃ ৩১০ হিঃ) তাঁর বিখ্যাত তাফসীরে এমন অনেক দুর্বল বর্ণনা জমা করেছেন, যা নবীগণের মর্যাদার খেলাফ। রাসূল (ছাঃ), ছাহাবী, তাবেঈ ও অন্যান্য বিদ্বানগণের নামে সেখানে অসংখ্য যঈফ ও ভিত্তিহীন বর্ণনা জমা করা হয়েছে।
যেমন ২৪ আয়াতাংশ ‏( ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﻫَﻤَّﺖْ ﺑﻪ ﻭَﻫَﻢَّ ﺑِﻬَﺎ ‏)
-এর তাফসীরে ইবনু আববাসের ৮টি সহ ছয়জন বিদ্বানের মোট ১৪টি উক্তি উদ্ধৃত করার পর তিনি বলেছেন, ﻩﺫﺍ ﻗﻮﻝ ﺟﻤﻴﻊ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﺑﺘﺄﻭﻳﻞ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﺍﻟﺬﻳﻦ ﻋﻨﻬﻢ ﻳﺆﺧﺬ ﺗﺄﻭﻳﻠﻪ ‘এগুলি হ’ল কুরআন ব্যাখ্যায় অভিজ্ঞ সেই সকল বিদ্বানের ব্যাখ্যা সমূহ, যাঁদের থেকে কুরআনের ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়ে থাকে’। [50] অথচ এসব বিদ্বানগণের নামে উদ্ধৃত বক্তব্যগুলি বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত বলে পরবর্তী বিদ্বানগণ স্বীকার করেননি।
এভাবে প্রধানতঃ ইবনু জারীরের তাফসীরের উপরে ভিত্তি করেই পরবর্তী বহু খ্যাতনামা মুফাসসির ঐসব ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনা অথবা এ সবের মর্ম সমূহ স্ব স্ব তাফসীরে স্থান দিয়েছেন। যেমন ওয়াহেদী, বাগাভী, কুরতুবী, ইবনু কাছীর, জালালায়েন, বায়যাভী, কাশশাফ, আলূসী, আবুস সঊদ, শাওকানী প্রমুখ বিদ্বানগণ। যদিও তাঁদের অনেকেই এসবের সমর্থক ছিলেন না। তবুও তাঁদের তাফসীরে এসব বর্ণনা স্থান পাওয়ায় লোকেরা তাঁদের নামে সেগুলি অন্যদের নিকট বর্ণনা করে এবং জনগণ বিভ্রান্ত হয়। অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই যে, নবীগণের শত্রু হিব্রুভাষী ইহুদী যিন্দীক্বদের কপট লেখনীগুলো আরবী ভাষী মুসলিম বিদ্বানগণের মাধ্যমে বিশ্বের সর্বত্র প্রচারিত হয়েছে। বিদ্বানগণের সরলতা এভাবেই অনেক সময় অন্যদের পথভ্রষ্টতার কারণ হয়।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,
ﻭﺃﻣﺎ ﻣﺎ ﻳﻨﻘﻞ ﺃﻧﻪ ﺣﻞ ﺳﺮﺍﻭﻳﻠﻪ ﻭﺟﻠﺲ ﻣﺠﻠﺲ ﺍﻟﺮﺟﻞ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﺮﺃﺓ ﻭﺃﻧﻪ ﺭﺃﻯ ﺻﻮﺭﺓ ﻳﻌﻘﻮﺏ ﻋﺎﺿﺎً ﻋﻠﻰ ﻳﺪﻩ ﻭﺃﻣﺜﺎﻝ ﺫﻟﻚ ﻓﻜﻠﻪ ﻣﻤﺎ ﻟﻢ ﻳﺨﺒﺮ ﺍﻟﻠﻪ ﺑﻪ ﻭﻻ ﺭﺳﻮﻟﻪ ﻭ ﻣﺎﻟﻢ ﻳﻜﻦ ﻛﺬﻟﻚ ﻓﻬﻮ ﻣﺄﺧﻮﺫ ﻋﻦ ﺍﻟﻴﻬﻮﺩ ﺍﻟﺬﻳﻦ ﻫﻢ ﺃﻋﻈﻢ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﻛﺬﺑًﺎ ﻋﻠﻰ ﺍﻷﻧﺒﻴﺎﺀ ﻭﻗﺪﺣﺎً ﻓﻴﻬﻢ، ﻭﻛﻞ ﻣﻦ ﻧﻘﻠﻪ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﺴﻠﻤﻴﻦ ﻓﻌﻨﻬﻢ ﻧﻘﻠﻪ، ﻟﻢ ﻳﻨﻘﻞ ﻣﻦ ﺫﻟﻚ ﺃﺣﺪ ﻋﻦ ﻧﺒﻴﻨﺎ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺣﺮﻓﺎً ﻭﺍﺣﺪﺍً –
‘অতঃপর যেসব কথা বর্ণিত হয়েছে যে, ইউসুফ তার পাজামা খুলে ফেলেছিলেন ও উক্ত নারীর উপর উদ্যত হয়েছিলেন এবং এ সময় তিনি তার পিতাকে দাঁতে নিজ আঙ্গুল কামড়ে ধরা অবস্থায় দেখেছিলেন- এধরনের কাহিনী সমূহের সবটাই ঐসমস্ত কথার অন্তর্ভুক্ত, যে বিষয়ে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল কোন খবর দেননি। আর তা আদৌ ঐরূপ নয়। বরং এগুলি ইহুদীদের কাছ থেকে গৃহীত, যারা নবীগণের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও অপবাদ দেওয়ার ব্যাপারে মানবজাতির মধ্যে সেরা। মুসলমানদের মধ্যে যারা এসব বিষয়ে বলে, তারা তাদের থেকে নকল করে বলে। অথচ তাদের কেউ এ বিষয়ে আমাদের নবী (ছাঃ) থেকে একটি হরফও বর্ণনা করেনি’। [51] তিনি আরও বলেন, ﻭﻗﺪ ﺍﺗﻔﻖ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﻋﻠﻰ ﺃﻧﻪ ﻟﻢ ﺗﻘﻊ ﻣﻨﻪ ﺍﻟﻔﺎﺣﺸﺔ ﻭﻟﻜﻦ ﺑﻌﺾ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﻳﺬﻛﺮ ﺃﻧﻪ ﻭﻗﻊ ﻣﻨﻪ ﺑﻌﺾ ﻣﻘﺪﻣﺎﺗﻬﺎ –
‘বিদ্বানগণ এ বিষয়ে একমত যে, ইউসুফ থেকে কোন ফাহেশা কাজ হয়নি। তবে কিছু লোক বর্ণনা করে যে, তাঁর থেকে উক্ত কাজের প্রারম্ভিক কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছিল। যেমন তারা এ বিষয়ে কিছু বর্ণনা করে থাকে। যার কোনটাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে নয়। বরং কিছু ইহুদী থেকে তারা এগুলি বর্ণনা করে থাকে মাত্র’। [52]
উল্লেখ্য যে, সূরা ইউসুফ-এর ৪২ আয়াতটিকে লুফে নিয়ে একদল কাহিনীকার কল্পনার ঘোড়া দৌড়িয়ে এমনকি মহাকাব্য পর্যন্ত রচনা করেছেন। এ ব্যাপারে ফারসী ভাষায় কবি ফেরদৌসীর (মৃঃ ৪১৬ হিঃ/১০২৫ খৃঃ) ‘মাছনাবী ইউসুফ-যোলেখা’ ‏( ﻣﺜﻨﻮﻯ ﻳﻮﺳﻒ ﺯﻟﻴﺨﺎ ‏) কাব্য প্রসিদ্ধ। যদিও এটি তাঁর সময়কার অজ্ঞাত কোন কবির লেখনী বলে অনেকে ধারণা করেন। তারপর তা তুর্কী ভাষায় অনুদিত হয়। অতঃপর ফারসী ও তুর্কী ভাষা হ’তে তা এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত ও রূপান্তরিত হয়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। দিল্লীর সুলতান গিয়াছুদ্দীন আযম শাহের সময়
(১৩৮৯-১৪১০ খৃঃ) পনের শতকের প্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহাম্মাদ ছগীর সম্ভবতঃ সর্বপ্রথম বাংলায় ‘ইউসুফ-জুলেখা’ কাব্য রচনা করেন। বর্তমানে নামধারী কিছু মুফাসসিরে কুরআন গ্রামে ও শহরে তাফসীর মাহফিলের নামে কয়েকদিন ব্যাপী ইউসুফ-যুলায়খার রসালো কাহিনী শুনিয়ে থাকেন। অথচ ‘যুলায়খা’ নামটিরও কোন সঠিক ভিত্তি নেই। কুরআনে কেবল ﺍﻣﺮﺃﺓ ﺍﻟﻌﺰﻳﺰ বা ‘আযীয-পত্নী’ বলা হয়েছে। নবী বিদ্বেষী ইহুদী গল্পকারদের খপপরে পড়ে মুসলমান গল্পকারগণ আজকাল রীতিমত মুফাসসিরে কুরআন বনে গেছেন।
অতএব জান্নাত পিয়াসী পাঠক, গবেষক, লেখক, আলেম, মুফতী ও বক্তাগণকে অবশ্যই সাবধান হ’তে হবে এবং মন্দটা বাদ দিয়ে ভালটা বাছাই করে নিতে হবে। নইলে ক্বিয়ামতের মাঠে জওয়াবদিহিতার সম্মুখীন হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!
[আলোচনা দ্রষ্টব্যঃ ইবনু তায়মিয়াহ, মজমূ‘ ফাতাওয়া ‘তাফসীর’ অধ্যায়; মুহাম্মাদ আল-আমীন শানক্বীত্বী, তাফসীর আযওয়াউল বায়ান (বৈরুত: ‘আলামুল কুতুব, তাবি); ডঃ মুহাম্মাদ আবু শাহবাহ, আল-ইস্রাঈলিয়াত (কায়রোঃ মাকতাবাতুস সুন্নাহ ৪র্থ সংস্করণ ১৪০৮); ডঃ তাহের মাহমূদ, আসবাবুল খাত্বা ফিত তাফসীর (দাম্মাম, সঊদী আরব, দার ইবনুল জাওযী ১ম সংস্করণ ১৪২৫ হিঃ) প্রভৃতি]
ইউসুফের কাহিনীতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ:
(১) ইউসুফের কাহিনীতে একথা পূর্ণভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকেই পরিণামে বিজয়ী করেন। এই বিজয় তো আখেরাতে অবশ্যই। তবে দুনিয়াতেও হ’তে পারে।
(২) আল্লাহর কৌশল বান্দা বুঝতে পারে না। যদিও অবশেষে আল্লাহর কৌশলই বিজয়ী হয়। যেমন অন্ধকূপে নিক্ষেপ করে অতঃপর বিদেশী কাফেলার কাছে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করে দিয়ে ইউসুফের ভাইয়েরা নিশ্চিন্ত হয়ে ভেবেছিল যে, আপদ গেল। কিন্তু আল্লাহ তাঁর নিজস্ব কৌশলে ইউসুফকে দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন করলেন এবং ভাইদেরকে ইউসুফের কাছে আনিয়ে অপরাধ স্বীকারে বাধ্য করলেন’ (ইউসুফ ৯১) । যেটা ইউসুফ নিজে কখনোই পারতেন না।
(৩) সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপরে ভরসা করা ও সুন্দরভাবে ধৈর্য ধারণ করাই হ’ল আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। সেজন্যেই দেখা গেছে যে, ইউসুফ (আঃ) জেলে গিয়েও সর্বদা আল্লাহর উপরে ভরসা করেছেন ও সুন্দরভাবে ধৈর্য ধারণ করেছেন। অন্যদিকে পিতা ইয়াকূব (আঃ) সন্তান হারিয়ে পাগলপরা হ’লেও তাঁর যাবতীয় দুঃখ ও অস্থিরতা আল্লাহর নিকটে পেশ করে ধৈর্য ধারণ করেছেন’ (ইউসুফ ৮৬) ।
(৪) নবীগণ মানুষ ছিলেন। তাই মনুষ্যসূলভ প্রবণতা ইয়াকূব ও ইউসুফের মধ্যেও ছিল। ইউসুফের শোকে ইয়াকূবের বিরহ-বেদনা এবং আযীযের গৃহে চরিত্র বাঁচানো কঠিন হবে বিবেচনায় ইউসুফের কারাগারকে বেছে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশের মধ্যে উপরোক্ত দুর্বলতার প্রমাণ ফুটে ওঠে। কিন্তু তাঁরা সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি নিবিষ্টচিত্ত থাকার কারণে আল্লাহর অনুগ্রহে নিষ্পাপ থাকেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তাঁর প্রত্যেক তাক্বওয়াশীল বান্দার প্রতি একইরূপ অনুগ্রহ করে থাকেন।
(৫) ইউসুফের কাহিনী কেবল তিক্ত বাস্তবতার এক অনন্য জীবন কাহিনী নয়। বরং বিপদে ও সম্পদে সর্বাবস্থায় আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা ও তাঁর উপরে একান্ত নির্ভরতার এক বাস্তব দলীল।
(৬) ইউসুফের কাহিনীর সার-নির্যাস হ’ল ‘তাওহীদ’ অর্থাৎ ‘তাওহীদে ইবাদত’। কারণ এখানে বাস্তব ঘটনাবলী দিয়ে প্রমাণ করে দেওয়া হয়েছে যে, কেবল আল্লাহর স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয়, বরং জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর দাসত্ব করা ও তাঁর বিধান মেনে চলার মধ্যেই বান্দার প্রকৃত মঙ্গল ও সার্বিক কল্যাণ নির্ভর করে। যেমন ইউসুফের সৎ ভাইয়েরা আল্লাহকে মানতো। কিন্তু তাঁর বিধান মানেনি বলেই তারা চূড়ান্তভাবে পরাজিত ও লজ্জিত হয়েছিল। অথচ ইউসুফ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও আল্লাহর দাসত্বে ও তাঁর বিধান মানায় অটল থাকায় আল্লাহ তাঁকে অনন্য পুরস্কারে ভূষিত করেন ও মহা সম্মানে সম্মানিত করেন।
[1] . বুখারী, মিশকাত হা/৪৮৯৪ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ১৩।
[2] . কুরতুবী, ইউসুফ ৭; ইবনু জারীর হা/১৮৭৮৬ ইবনু আববাস হ’তে।
[3] . উল্লেখ্য যে, ইউসুফ (আঃ)-এর চরিত্র বাইবেলে অত্যন্ত বিকৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে (দ্রঃ সুলায়মান মানছূরপুরী, রহমাতুললিল আলামীন ২/২৪৪-২৪৬।
[4] . ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়াল নিহায়াহ ১/১৯০।
[5] . আল-বিদায়াহ ১/১৯৬-১৯৭। তবে মানছূরপুরী বলেন, তাঁর বিবাহ ‘আসনাথ’ নাম্নী এক মহিলার সাথে হয়েছিল। -রাহমাতুললিল আলামীন ৩/১০৭। হ’তে পারে দু’জনেই তাঁর স্ত্রী ছিলেন।
[6] . আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/২০৪ পৃঃ।
[7] . মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৬৩ ‘মি‘রাজ’ অধ্যায়।
[8] . বুখারী হা/৩৩৮০ ‘নবীর গুণাবলী’ অনুচ্ছেদ।
[9] . ইবনু কাছীর, ইউসুফ ৫৬-৫৭।
[10] . ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/১৯৬-১৯৭ পৃঃ।
[11] . তারীখুল আম্বিয়া পৃঃ ১/১২৪ পৃঃ।
[12] . আল-বিদায়াহ ১/১৮৪ পৃঃ।
[13] . তাফসীর ইবনে কাছীর, ইউসুফ ৭৭।
[14] . কুরতুবী, ইউসুফ ৪, ১০০ আয়াত।
[15] . কুরতুবী, ইউসুফ ১৯; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ১/১৮৯।
[16] . তাফসীর ইবনে কাছীর, ইউসুফ ১৯।
[17] . ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ১/১৮৮।
[18] . ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/১৮৯; হাকেম ২/৩৭৬ হা/৩৩২০, হাকেম একে ‘ছহীহ’ বলেছেন এবং যাহাবী তা সমর্থন করেছেন।
[19] . বুখারী হা/৬১২৬ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায় ৩১ অনুচ্ছেদ; মুসলিম হা/১৩১ ‘ঈমান’ অধ্যায় ৬১ অনুচ্ছেদ; মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৬৩ ‘মি‘রাজ’ অনুচ্ছেদ।
[20] . যঈফুল জামে‘ হা/৪৭৬২, ৪৭৭৫।
[21] . তাফসীর কুরতুবী, ইউসুফ ২৬-২৮।
[22] ( ,
( . তিরমিযী হা/৩৩৩২ ‘তাফসীর’ অধ্যায় ১৩ অনুচ্ছেদ ‘সূরা ইউসুফ’; ছহীহ তিরমিযী হা/২৪৯০ সনদ হাসান; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৭০৫ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়, ‘সৃষ্টির সূচনা ও নবীগণের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ।
[23] . আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/১৯৬।
[24] . তাফসীরে কুরতুবী, ইউসুফ ৫৫।
[25] . ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/১৯৬-১৯৭।
[26] . বুখারী, মিশকাত হা/১৫৫ ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ; মির‘আত ১/২৫২।
[27] . আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/১৯৭।
[28] . তাফসীর ইবনু কাছীর, ইউসুফ ৫৮-৬২।
[29] . তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর, ইউসুফ ৫৮-৫৯।
[30] . আর-রাহীকুল মাখতূম (কুয়েতঃ ১৪১৪/১৯৯৪), পৃঃ ৪০৫, ৪০১।
[31] . সূরা ইউসুফ ৮৪ এবং ৯৩-৯৬ আয়াতগুলি গবেষণা করে মিসরের সরকারী ‘ন্যাশনাল সেন্টার অফ রিসার্চেস ইন ইজিপ্ট’-এর মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. আবদুল বাসিত মুহাম্মাদ মানুষের দেহের ঘাম থেকে একটি ‘আইড্রপ’ আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে ২৫০ জন রোগীর উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, কোনরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই ৯০%-এর বেশী চোখের ছানি রোগ সেরে যায় ও তারা দৃষ্টি ফিরে পায়। ইতিমধ্যে এই ঔষধটি ‘ইউরোপিয়ান ইন্টারন্যাশনাল প্যাটেন্ট ১৯৯১’ এবং ‘আমেরিকান প্যাটেন্ট ১৯৯৩’ লাভ করেছে। এছাড়া একটি সুইস ঔষধ কোম্পানীর সাথে তাঁর চুক্তি হয়েছে এই মর্মে যে, তারা তাদের ঔষধের প্যাকেটের উপর ‘মেডিসিন অফ কুরআন’ লিখে তা বাজারে ছাড়বে।- সূত্র: ইন্টারনেট।
[32] . মাওলানা মওদূদী, রাসায়েল ও মাসায়েল (ঢাকাঃ ১৯৯৬), ৫/২৫০ পৃঃ।
[33] . ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/২০৪।
[34] . ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ, ১/১৮৪, ২০৪।
[35] . ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/২০৫।
[36] . ঐ, পৃঃ ১/২০৬, ১৯৬।
[37] . সুলায়মান বিন সালমান মানছূরপুরী, রহমাতুল লিল আলামীন (সুইওয়ালাঁ দিল্লী-২ : ই‘তিক্বাদ পাবলিশিং হাউস, ১ম সংস্করণ ১৯৮০ খৃঃ), ৩/১৩৩ পৃঃ।
[38] . আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/১৮৬।
[39] . রাযীন, আহমাদ, মিশকাত হা/১৯১ সনদ ছহীহ, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[40] . আলবানী, যঈফুল জামে‘ হা/৪৭৬২, ৪৭৭৫।
[41] . আহমাদ, সনদ ছহীহ, রাবী ছোহায়েব (রাঃ), সিলসিলা যঈফাহ হা/৮৮০।
[42] . মারাসীলু ইবনে আবী হাতেম হা/৪২৯; কুরতুবী, ঐ, ২৮ আয়াত, ৯/১৫০ পৃঃ।
[43] . মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৯ ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[44] . মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪ ‘ইল্ম’ অধ্যায়।
[45] . কুরতুবী হা/৩৬৭০-৭১; ইবনু জারীর, ইবনু কাছীর, ত্বাবারাণী, ইবনু হিববান প্রভৃতি।
[46] . বুখারী হা/৩৩৭২, ৩৩৮৭, ৪৬৯৪, ৬৯৯২; মুসলিম, নাসাঈ, আহমাদ; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৭০৫ ‘কিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায় ‘সৃষ্টির সূচনা ও নবীগণের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ।
[47] . আহমাদ হা/৯২৯৮ রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ), হাদীছ হাসান।
[48] . সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২৬৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৯৯৪-৯৬।
[49] . যেমন ১-সঊদী সরকার প্রকাশিত ও মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অনূদিত করাচীর মুফতী মুহাম্মাদ শফী কৃত তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআনে বক্তব্যটি ইউসুফের বলে লেখা হয়েছে (পৃঃ ৬৬৯)। ২-ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বঙ্গানুবাদে ১৩১ নং টীকাতে বলা হয়েছে যে, অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে ৫২ ও ৫৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত কথাগুলি হযরত য়ূসুফের উক্তি (ঐ, পৃঃ ৩৬৭)। ৩- তাফসীর ইবনে কাছীরের অনুবাদে ডঃ মুজীবুর রহমান ব্রাকেটে লিখেছেন, ‘ইউসুফ বললেন’ (ঐ, দারুস সালাম, রিয়াদ পৃঃ ৪৫৫)। ৪- মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী অনূদিত ঐ উর্দূ তাফসীরে একই অনুবাদ করা হয়েছে, যা সঊদী সরকার কর্তৃক পাকিস্তানের ছালাহুদ্দীন ইউসুফের তাফসীর সহ প্রকাশিত হয়েছে (ঐ, পৃঃ ৬৫৬)। ৫- সঊদী সরকার প্রকাশিত ইংরেজী অনুবাদেও (পৃঃ ৩১০) একই কথা লেখা হয়েছে। ৬- অথচ আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী তাঁর ইংরেজী তাফসীরে সঠিক অর্থ করেছেন (ঐ, পৃঃ ৫৭০)। ৭- অন্যদিকে মাওলানা মওদূদী কেবল এটি ইউসুফের উক্তি বলে সমর্থনই করেননি, উল্টা এর বিরোধিতা করার কারণে ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনু কাছীর প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত বিদ্বানগণকে কটাক্ষ করে তাফসীর লিখেছেন (ঐ, বঙ্গানুবাদ ৬/১০৪ পৃঃ)। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
[50] . দ্রঃ তাফসীর ত্বাবারী (বৈরুতঃ ১৪০৭/১৯৮৭) ১২/১০৮-১১০ পৃঃ।
[51] . দাক্বায়েকুত তাফসীর ৩/২৭৩ পৃঃ।
[52] . মাজমূ‘ ফাতাওয়া ‘তাফসীর’ অধ্যায় (কায়রোঃ ১৪০৪ হিঃ) ১৫/১৪৮-৪৯ পৃঃ

Leave a Reply