মেছতা দূর করার উপায় ২০২৪
মেছতা এমন একটি স্কিন কন্ডিশন যেটা আমার আশেপাশে ৩০ উর্ধ্ব বয়সের মানুষের মধ্যে আমি খুবই কমনলি দেখে থাকি। এই সমস্যাটি নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই অনেক বেশি দেখা দেয়। আজকে আমি এই মেছতা থেকে মুক্তি পাওয়ার বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত পদ্ধতি গুলো আপনাদের সাথে আলোচনা করবো। সবার আগে বলবো যাদের এখনও মেছতা দেখা দেয় নি তারা কি করলে ভবিষ্যতে মেছতা হওয়া রোধ করতে পারেন। তার পরই আলোচনা করব যাদের একটু একটু করে মেছতা দেখা দিয়েছে তারা কি করলে এটি থেকে মুক্তি পাবেন। এবং সবশেষে আলোচনা করব যারা দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়াস মেছতা সমস্যায় ভুগছেন তাদের মুক্তির উপায় কি হতে পারে।
মেছতা কি?
মেছতা এক ধরনের হাইপেরপিগমেন্টেশন যা তকে কালো চুপচুপে দাগ সৃষ্টি করে, তবে মেছতা সাধারণ হাইপেরপিগমেন্টেশন থেকে আলাদা। মেছতা একটি ক্রনিক অর্থাৎ অনেক বেশি সিরিয়াস এবং ত্বকের গভীরে লেয়ারে অবস্থান করা একটি হাইপেরপিগমেন্টেশন।
মেছতা প্রতিরোধ করার উপায়
সাধারণ হাইপেরপিগমেন্টেশন এর তুলনায় মেছতা দূর করা অনেক অনেক বেশি কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ। এই কারণ আমি সবার আগে আলোচনা করবো কি করলে মেছতা আপনারা সেটাকে প্রতিরোধ করতে পারেন।
১) অত্যাধিক তাপ এড়িয়ে চলা:
এ পরামর্শটি মূলত তাদের জন্য যাদের রান্নার জন্য দীর্ঘ সময় চুলার পাশে বা গরমের ভেতরে কাটাতে হয়। হিট মেছতা ট্রিগার করার অন্যতম একটি কারণ। যদি আপনার দীর্ঘ সময় ধরে চুলার পাশে কাজ করতেই হয়, তাহলে আপনার জন্য একটি টিপস আছে। আপনার হাতের কাছে একটি ভেজা কাপড় রাখুন এবং একটু পরপর কাপুরকে আলতো করে মুখে চেপে চেপে ধরুন। এর ফলে আপনার মুখে তাপমাত্রা খুব বেশি বৃদ্ধি পাবে না এবং মেছতার ঝুঁকি ও কমে আসবে। তখনই বদলে ফ্রিজে রাখার সুদিন জেল ও কিন্তু একটি অপশন হতে পারে। এর পাশাপাশি যদি আপনার ঠান্ডার সমস্যা না থেকে থাকে। মুখে ছোট্ট একটি বরফের টুকরা রাখলেও মুখে তাপমাত্রা কম রাখতে সাহায্য করবে।
২) শরীরে হরমোনাল লেবেল নিয়ন্ত্রিত রাখা:
যদি আপনাদের কারো থাইরয়েড সংক্রান্ত কোন হরমোনের সমস্যা থেকে থাকে তাহলে এটি অত্যন্ত গুরুত্বের সহকারে নিতে হবে। কারণ হরমোন মেছতা আবির্ভাব হওয়ার অন্যতম কারণ , এ কারণে প্রেগনেন্সি বা মেনোপোস পরবর্তী সময়ে অনেকেই হঠাৎ করে দেখা দেয়।
৩) জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল গ্রহণ না করা:
যদি আপনার পরিবারে কারও মেছতা থেকে থাকে তাহলে জেনেটিকলি আপনিও মেছতা হওয়ার অধিক ঝুঁকিতে থাকবেন। সে ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসেবে বার্থ কন্ট্রোল পিল গ্রহণ না করে অন্য কোন পদ্ধতি গ্রহণ করা। কারণ বার্থ কন্ট্রোল পিল শরীরে হরমোনের তারতম্য ঘটিয়ে থাকে এবং মেছতা হওয়ার ঝুঁকি ও বাড়িয়ে দেয়।
৪) ত্বক এ স্টিম নেয়া থেকে বিরত থাকুন:
আমি ইন্টারনেটে অনেককে ঘরোয়া পদ্ধতিতে skin-care অংশ হিসেবে স্টিম নেয়ার পরামর্শ দিতে দেখি। কিন্তু স্টিম আমাদের ত্বকের জন্য খুবই ক্ষতিকর, নিয়মিত স্ট্রিম গ্রহণ ত্বকের ব্যাকটেরিয়া ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি মেছতার আবির্ভাবে ও ভূমিকা রাখতে পারে। তাই ঘরে বসে হক বা পার্লারে ত্বকের স্টিম নেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৫) ত্বকে ট্রমা সৃষ্টি করে এমন প্রডাক্ট এড়িয়ে চলা:
খুব হ্রাস সাবান, হোয়াইটনিং প্রোডাক্ট এই গুলো থেকে ত্বকের ট্রমা সৃষ্টি করে। এবং তা থেকে দেখা দিতে পারে এই মেছতা। ইদানিং আমি ইন্টারনেটে বিপদজনক প্রচারণা দেখছি যে ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ বেশি থাকলে নাকি মেছতার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই হোয়াটনিং ট্রিটমেন্ট এর মাধ্যমে মেলানিন কমিয়ে ফেলে নাকি মেছতার আর হবেনা। কিন্তু এটা একদমই সত্য নয়। যেকোনো স্ক্রিন টন এর ব্যক্তিরই মেছতা দেখা দিতে পারে। শরীরের মেলানিন কম হলে মেছতা হবে না একথার কোন ভিত্তি নেই। এই ফাঁদে পড়ে হোয়াইটনিং ট্রিটমেন্ট নিতে গিয়ে বরং উল্টো আপনার ত্বক এবং শরীরে মেছতা সহ আরও নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এ বিষয়ে সাবধান।
৬) রোদ এড়িয়ে চলা:
আপনি মেছতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যা কিছুই করেন না কেন সব ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আপনি সানফ্লিকেশন না নেন। কারণ সূর্য থেকে নির্গত হওয়া ভিজিবল লাইট মেছতার সবথেকে বড় কারণগুলোর মধ্যে একটা বলে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। যদি সানস্ক্রিন কেনার বাজেট না থাকে তাহলে ছাতা হ্যান্ড এবং সানগ্লাস ব্যবহারের মাধ্যমে যতটা সম্ভব প্রটেকশন নেয়ার চেষ্টা করবেন।
মেছতা নিয়ন্ত্রণের উপায়
এবার আলোচনা করব যাদের হরমোনাল কারণে হালকা মেছতা দেখা দিয়েছে তারা কি করবেন?
১)হালকা মেছতা নিয়ন্ত্রণের উপায়:
এখানে আমি কিছু প্রোডাক্ট এবং উপাদানের কথা বলব যেগুলো ত্বকের উপরিভাগে লাগাতে হয় এবং এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রেসক্রিপশনের প্রয়োজন পড়ে না। এই অংশটি আজকের পোষ্টের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মন দিয়ে পড়বেন। কেন আমি কারণটি শেষে ব্যাখ্যা করব।
(হাইড্রোকুইনোন)
হাইড্রোকুইনোন মেছতা থেকে কার্যকরী উপাদান অসংখ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এর উপকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। তবে এটি অনেক বেশি শক্তিশালী একটি উপাদান হওয়ায় এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
যেমন:-
- ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া আপনারা ২% এর বেশি হাইড্রোকুইনোন যুক্ত প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে পারবেন না।
- একটানা এটা দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায় না। যেমন একটানা তিন মাস ব্যবহার করে এক মাসের একটি গ্যাপ দিলেন। এরপর আবার ব্যবহার করবেন।
- এছাড়া প্রেগনেন্সিতে এবং ব্রেস্ট ফিডিং মায়েরা এটা ব্যবহার করতে পারবেন না
২% হাইড্রোকুইনোন যুক্ত একটি প্রোডাক্ট আমাদের দেশে পাওয়া যায় সেটা হলো (Cos De Baha 2% hydrocortisone Brightening Serum) এটা ব্যবহারের পদ্ধতি বলে দিচ্ছি। মুখ ভালো করে ধুয়ে হাতে ২ বা ৩ ফুটা সিরাপ নিয়ে মুখে লাগিয়ে নেবেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মশারাইজার লাগিয়ে নেবেন। মনে রাখবেন এটা পুরো মুখে ব্যবহার করতে হয় কখনোই স্পট ট্রিটমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করবেন না।
২) এজলেয়িক এসিড:
এজলেয়িক এসিড আর একটি শক্তিশালী উপাদান যা মেছতা দূর করতে খুবই কার্যকর। এটির আরো একটি বড় গুণ হল এটি প্রেগনেন্সি বা বেস্ট ফিটিং সেফ। এছাড়া এটি আপনি একটানা সারা জীবন ব্যবহার করে যেতে পারবেন কোনো সাইড ইফেক্ট নেই। প্রেসক্রিপশন ছাড়া সর্বোচ্চ টেন পার্সেন্ট এজলেয়িক এসিড যুক্ত প্রোডাক্ট ব্যবহার করা যায়, এমন দুটি প্রোডাক্ট হলো:-
- 1) Cos de Baha 10% azelaic acid serum
- 2) Paula s choice 10% azelaic Acid booster
ব্যবহার পদ্ধতি একই হবে.
৩) রেটিনল:
রেটিনল শুধু মেছতা নয় ত্বকের এর যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য দারুন একটি উপাদান। প্রেগনেন্সি ছাড়া বাকি সারা জীবন এটি ব্যবহার করা যায়। এটি ব্রেস্ট ফিডিং সেফ বড় কোন সাইড ইফেক্ট নেই। তবে এর ব্যবহার ধীরে ধীরে বাড়াতে হয় যেমন প্রথম সপ্তাহে একবার দ্বিতীয় সপ্তাহে দুবার তৃতীয় সপ্তাহে তিনবার এভাবে।
৪) অন্যান্য ব্রাইটনিং উপাদান:
এছাড়াও ভাইটামিন সি হালকা মেছতা নিয়ন্ত্রণ বেশ উপকারি ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে একটি মেছতা একা নিয়ন্ত্রণ করার মত যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। আপনারা অবশ্যই আমি প্রথমে যে তিনটি উপাদানের কথা আলোচনা করেছি, তা যেকোনোর একটি থেকে সহযোগী উপাদান হিসাবে এই উপাদানটিও ব্যবহার করতে পারেন।
দীর্ঘ মিয়াদি মেছতা দূর করার উপায়
আপনার মেছতা যদি কয়েক বছরের পুরনো হয়ে থাকে, এবং মেছতা যদি মুখের বেশ কিছু অংশে ছড়িয়ে গিয়ে থাকে। এবং সেটি মার্কসের মতো দেখায় তাহলে আপনাকে প্রফেশনাল ট্রিটমেন্ট এর মধ্যে থেকে এটকে কমিয়ে আনতে হবে। তাই সবার আগে একজন ডক্টরের সাথে পরামর্শ নেন। কারণ এই অবস্থায় কোন স্কিন কেয়ার আপনার ক্ষেত্রে কাজ করবে না।
ডার্মালজিস্টরা এই ধরনের ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রে তিন ধরনের ট্রিটমেন্ট করে থাকেন:
১) প্রথম ট্রিটমেন্ট হল টপিকাল অর্থাৎ ত্বকের উপরে লাগাতে হয় এমন কোন ক্রিম। তবে যেকোন ক্রিম ব্যবহার করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
২) দ্বিতীয় ট্রিটমেন্ট হলো ওরাল বা ওষুধ খাওয়া, এক্ষেত্রে ডার্মালজিস্টরা আপনাকে পরামর্শ দিবে আপনার কোন ওষুধটি খাওয়া উচিত।
৩) তৃতীয় ট্রিটমেন্ট হল লেজার থেরাপি যা তেমন আইপিএল। কারো কারো ক্ষেত্রে এক ধরনের ট্রিটমেন্ট এ কাজ হয়। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে দুই বা তিন ধরনের ট্রিটমেন্টেরই প্রয়োজন হয়।
মেছতা ট্রিটমেন্ট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি তথ্য:
১) যাদের দীর্ঘদিনের অর্থাৎ কয়েক বছরের পুরনো ত্বকের গভীরের লেয়ারে মেছতা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে আলোচনা করা স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার টাকা ও সময়ের অপচয় মাত্র।
২) মেছতার কোন কিউরি নেই অর্থাৎ এটি চিরতরে দূর করা সম্ভব নয়। আপনি treatment বা স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট গুলোর মাধ্যমে এটি কমিয়ে আনার পরে যদি আবার রোদে যাওয়া শুরু করেন তবে এটি আবার ফিরে আসবে।
৩) মেছতার কোন শর্ট টাইম সমাধান নেই। এই যে বিভিন্ন প্রচারণা দেখেন যে এক সপ্তাহের মেছতা দূর করে দিন। এগুলো কিন্তু সবই প্রতারণা এবং আপনার দুর্বলতা ব্যবহার করে ব্যবসা করা মার্কেটিং কৌশল মাত্র। মেস্তা দূর করার সময় এর ব্যাপার কয়েক সপ্তাহ তো দূরের কথা কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে। তাই এই ধরনের মার্কেটিং দেখে অল্প সময়ের ফল আশা করবেন না।
সর্বশেষ কথা:-
ধৈর্য ধরে নিজের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে। হ্যাঁ মানসিক স্বাস্থ্য যেকোনো ত্বকের সমস্যা সমাধানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিজেকে যতটা টেনশন মুক্ত রাখার চেষ্টা করুন। আপনি যেমন সেভাবে নিজেকে ভালোবাসুন। আজকের মত এখানেই বিদায় নিচ্ছি দেখা হবে পরবর্তী কোনো আর্টিকেলে তা তখন পর্যন্ত খেয়াল রাখুন নিজের ধন্যবাদ।
One thought on "মেছতা দূর করার উপায়"