সংবাদপত্রের পাতা খুললে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে ধর্ষণ সংক্রান্ত খবর। এ সংক্রান্ত খবর পড়তে পড়তে দেশের জনগণ যেন আজ রীতিমতো বিষিয়ে উঠেছেন। এ দেশে ধর্ষণের হাত থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে, গৃহবধু, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের কোমলমতি শিশু পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। আর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়েও ধর্ষণ করার ঘটনাতো সমাজে অহরহই ঘটে চলেছে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে সমাজ ও মান-সম্মানের ভয়ে ধর্ষণের বিষয় কাউকে জানান না। তখন বিষয়টি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। আবার অনেক সময় এটাও দেখা যায় যে, ধর্ষণ করার ঘটনা ধর্ষক বা তার সহযোগী কর্তৃক ভিডিও আকারে ধারণ করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে কিংবা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয়-ভীতি দেখিয়ে ওই মেয়েকে ধর্ষণ করা হচ্ছে কিংবা তার কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেওয়া হচ্ছে। একজন মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তাঁর মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে, তা কি ভেবে দেখা উচিত নয়? পাশাপাশি ওই মেয়েটিকে বা ওই মেয়েটির পরিবারকে আমাদের সমাজ-ই বা কোন চোখে দেখে থাকে, তা কি আমরা ভেবে দেখি? আমরা কি ভেবে দেখেছি, একজন মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তাঁর সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন ভেঙে চুড়মার হয়ে যায়। ধর্ষণের ওই ঘটনা তাঁকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ানোর ফলে তাঁর মানসিক শান্তি থাকে না; থাকে না ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর আত্মবিশ্বাসটুকুও দিনে দিনে লোপ পেতে থাকে। সর্বোপরি ধর্ষণের শিকার মেয়েটি মানসিকভাবে এমন অশান্তি এবং যন্ত্রণাময় জীবন অতিবাহিত করে যে, সে যেন জীবিত থেকেও মৃত। আবার অনেক সময় অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে বাধ্য হয়। অনেক সময় দেখা যায়, ধর্ষণের মতো ফৌজদারি অপরাধ, ন্যাক্কারজনক ও জঘন্য ঘটনা ঘটলেও ধর্ষিতা কিংবা তার পরিবার ন্যায়বিচারটুকু পর্যন্ত পাচ্ছেন না। তখন এর চেয়ে বড় লজ্জার, দুঃখের ও আশ্চর্যের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ২০১৬ সালে এক হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তিনশ’র বেশি শিশু। ধর্ষণের ধারাবাহিক ঘটনা নিঃসন্দেহে দেশের সকলের জন্যই উদ্বেগজনক একটি বিষয়। ধর্ষণের ঘটনার ফলশ্র“তিতে বিশে^র দরবারেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যেকোনো সমাজে ধর্ষণ বিস্তৃত হলে এবং ধর্ষকদের সাজার ব্যবস্থা করা না হলে সেই সমাজে নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধ বলে কিছুই থাকে না। এ ধরনের ঘটনা সমগ্র সমাজ, দেশ ও জাতিকে বিশৃঙ্খলা ও পাপাচারের দিকে ধাবিত করে, যা কখনোই ভালো কোনো বিষয় হতে পারে না। 

ধর্ষণের কারণসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- ১. ধর্ষণকারীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ না থাকার কারণে নির্দ্বিধায় ধর্ষণ করতে উদ্যোগী হচ্ছে। ২. ধর্ষকদের মধ্যে কাম-প্রবৃত্তি থাকে, যা ধর্ষণের আরেকটি বড় কারণ। ৩. সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী লোকেরা ধর্ষণ করে থাকে বেশি। ৪. মাদকাসক্তি মানুষের স্বাভাবিক বিবেচনাবোধ লোপ করে এবং এটিও ধর্ষণের আরেকটি বড় কারণ। ৫. ধর্ষকদের মনে মেয়েদের প্রতি তীব্র ক্রোধ, আক্রমণাত্মক মনোভাব ও প্রতিহিংসা পরায়ণতা মনোভাব থাকে এবং এর ফলে ধর্ষণ করে। আর এসবের কারণ হতে পারে অতীতে কোনো মেয়ে দ্বারা প্রতারিত, অপমানিত ও প্রত্যাখ্যাত হওয়া। ৬. একাকিত্ব বোধ, অক্ষমতাবোধ, রাগ, অপমানজনক অনুভূতি, হতাশা, ব্যর্থতা বা ব্যক্তিজীবনে কষ্ট, অপ্রাপ্তি ইত্যাদি থাকলে মনের মধ্যে ধর্ষণের আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি পায়। ৭. যে সমাজে আইনের শাসন নেই কিংবা থাকলেও তা দুর্বল বা ভঙ্গুর, সেই সমাজের লোকেরা ধর্ষণ উপযোগী পরিবেশ পায় এবং ধর্ষণ করে। সুতরাং, সামাজিক প্রতিরোধ ও আইনের শাসনের অভাব ধর্ষণের জন্য দায়ী। ৮. যেসব পর্নোগ্রাফিতে মেয়েদের সঙ্গে জবরদস্তিমূলক যৌন সম্ভোগে মেয়েদের তা উপভোগ করতে দেখানো হয় বা মেয়েদের প্রতিবাদ করতে দেখানো হয় না, সেসব দেখে অনেক পুরুষ ধর্ষণে উৎসাহ বোধ করে। ৯. কোনো মেয়ে প্রেমে বা বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কে রাজি না হলে অনেক সময় মেয়েটির মুখ থেকে উচ্চারিত ‘না’ শব্দকে সহ্য করতে না পেরে ধর্ষণ করে। ১০. মেয়েদের ওপর আধিপত্য বিস্তার ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতাও ধর্ষণের অন্যতম কারণ। ১১. ক্ষমতাশীল ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে কোনো দুর্বল মেয়ে, শিশু বা ছেলের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় ধর্ষণের মাধ্যমে। ১২. অনেক সময় বন্ধুবান্ধবরা একসঙ্গে হয়ে বা শক্তিশালী হয়ে আকস্মিকভাবে কোনো অসহায় মেয়েকে একা পেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্যও ধর্ষণ করে। এছাড়াও বর্তমানে ইন্টারনেট, স্যাটেলাইটসহ নানা ধরনের তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াসহ পারিপাশির্^ক আরও অনেক কারণে ধর্ষণ হতে পারে। 
তবে যেভাবেই ধর্ষণ হোক না কেন, ধর্ষণ এক প্রকার যৌন অত্যাচার এবং তা একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ বটে। সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা অনুমতি ছাড়া যৌনাঙ্গের মিলন ঘটিয়ে বা না ঘটিয়ে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হওয়াকে ধর্ষণ বলা হয়ে থাকে। সাধারণ অর্থে একজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারীর সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসঙ্গমকে ধর্ষণ বলা হয়। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা মোতাবেক, যদি কোনো ব্যক্তি নিম্নক্ত পাঁচ প্রকারের যেকোনো অবস্থায় কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সহবাস করে, তবে উক্ত ব্যক্তি ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে। প্রথমত : তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে; দ্বিতীয়ত : তার সম্মতি ব্যতিরেকে; তৃতীয়ত : তার সম্মতিক্রমে, যেক্ষেত্রে তাকে মৃত্যু বা আঘাতের ভয় প্রদর্শন করে তাঁর সম্মতি আদায় করা হয়;চতুর্থত : তাঁর সম্মতিক্রমে, যেক্ষেত্রে লোকটি জানে যে, সে তার স্বামী নয় এবং নারীটি এ বিশ্বাসে সম্মতিদান করে যে, পুরুষটির সঙ্গে সে আইনানুগভাবে বিবাহিত অথবা সে নিজেকে আইনানুগভাবে বিবাহিত বলে বিশ্বাস করে এবং পঞ্চমত :তার সম্মতিক্রমে বা ব্যতিরেকে, যে ক্ষেত্রে সে ১৪ বছরের কম বয়স্ক হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা অনুযায়ী, ধর্ষণের অপরাধের যে সকল শাস্তির বিধান রয়েছে তা হচ্ছে; ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত কমপক্ষে এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড। একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে উক্ত দলের সকলের জন্যই এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ দশ বছর এবং সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে। কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলে ধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। বিচারক সাধারণত শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করেন। মামলার বিষয়বস্তু (ধর্ষণের শিকার নারীর জবানবন্দি, ডাক্তারি পরীক্ষার ফলাফল এবং অন্যান্য সাক্ষ্য) পর্যালোচনা করে নিজস্ব বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে বিচারক রায় দেন এবং অপরাধীর শাস্তি নির্ধারণ করেন। তবে ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষিত নারীর উচিত হবে ধর্ষণের ঘটনাটি দ্রুত কাছের কাউকে জানানো। ধর্ষণ প্রমাণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীর শরীর। এজন্য ধর্ষণের ঘটনার পর যে অবস্থায় আছে, তেমনি থাকা প্রয়োজন। নিজেকে পরিষ্কার বা গোসল করানো এক্ষেত্রে কোনোভাবেই ঠিক হবে না। কারণ, ধর্ষণকারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর শরীরে কিছু প্রমাণ-চিহ্ন রেখে যায়। ডাক্তারি পরীক্ষার দ্বারা নারীর শরীর থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য-প্রমাণাদি এবং আলামত সংগ্রহ করা যায়, যা ধর্ষণের ঘটনাকে প্রমাণ ও ধর্ষণকারীকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। ঘটনার সময় যে কাপড় শরীরে ছিল তা অবশ্যই সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। কাপড়ে রক্ত, বীর্য ইত্যাদি লেগে থাকলে তা যদি ধর্ষণকারীর রক্ত বা বীর্যের সাথে মিলে যায়, তাহলে মামলায় এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। আর এক্ষেত্রে দ্রুত থানায় অভিযোগ দায়ের কিংবা আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। যত দ্রুত অভিযোগ দায়ের করা যায়, ততই মঙ্গল। কারণ, ধর্ষণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তারি পরীক্ষা না করালে ধর্ষণের প্রমাণ তেমন একটা পাওয়া যায় না। 
তবে থানায় অভিযোগ দায়ের করে কিংবা আদালতে মামলা করে বিচার পাওয়ার চেয়ে সমাজে যেন ধর্ষণের ঘটনা না ঘটে সেই ব্যবস্থা করা অধিকতর মঙ্গলজনক। কারণ, ‘Prevention is better than cure’ বা প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিবাদ হওয়াটা খুবই জরুরি। ধর্ষকরা অনেক সময় শাস্তি পায় না বলে পরবর্তীতে তারা স্পর্ধা পেয়ে যায় এবং বীরদর্পে ধর্ষণ করে। তাকে দেখে অন্যরাও ধর্ষণ করতে উৎসাহিত হয়। এভাবে চলতে থাকলে সমাজ, দেশ ও জাতি কলুষিত হয়। দেশ পরিণত হয় মগের মল্লুকে। ধর্ষণ রোধে প্রতিটি পরিবার থেকে প্রতিটি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা প্রয়োজন। কারণ, পরিবারই তার আচরণ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরি করে দেয়। সর্বোপরি, ধর্ষণ প্রতিরোধে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজসহ সকলের একযোগে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন ধর্ষণকে যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করা। এক্ষেত্রে সকলকে মনে রাখতে হবে, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ষণ যেমন একটি বড় ধরনের ফৌজদারি অপরাধ, তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তা বড় ধরনের পাপ। আবার সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ধর্ষণকে অত্যন্ত ঘৃণ্য, নিন্দনীয় ও খারাপ প্রকৃতির কাজ হিসেবে দেখা হয়। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, যে সমাজে নারীরা বেশি মাত্রায় ধর্ষণের শিকার হয়, সেই সমাজে নারীরা দেশ-জাতির উন্নয়নে স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে না। অথচ, নারীদেরকে পিছিয়ে রেখে বা তাঁদেরকে ধর্ষণ করে কোনো সমাজের ঠিকমতো উন্নয়ন, অগ্রগতি সাধিত হতে পারে না। তাই সমাজ, দেশ ও জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি ঘটানোসহ সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে এবং একটি সুখী, সুন্দর ও সাফল্যময় দেশ-জাতি গঠনে ধর্ষণকে কঠোরহস্তে দমন করা অপরিহার্যÑ যেন ভবিষ্যতে এ পথে আর কেউ পা বাড়াতে না পারে।

One thought on "আইন জানুন আইন মানুন পর্ব ২১: ধর্ষণ, ধর্ষিতা এবং আইন"

Leave a Reply