কোনো কারণে পুলিশ যদি কখনো মামলা নিতে না চায়, তাহলে সরাসরি সংশ্লিষ্ট জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের (বিচারিক হাকিম) আদালতে নালিশি অভিযোগের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করা যায়। তবে সংঘটিত অপরাধ আমল-অযোগ্য হলেও থানায় না গিয়ে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশি মামলা করা যায়। আমল-অযোগ্য অপরাধ হলো সেসব অপরাধ, যেসব অপরাধ সংঘটনের কারণে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে না এবং ওইসব অপরাধের বিষয়ে তদন্ত করতেও সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়।
যেভাবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ করবেন : ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মৌখিকভাবে অভিযোগ করতে চাইলে ঘটনার আদ্যোপান্ত আদালতে স্পষ্ট করে বলে ঘটনার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে আবেদন করতে হবে। এরপর ওই অভিযোগের কোনো ভিত্তি আছে কি না, তা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগকারীকে এবং প্রয়োজন মনে করলে ঘটনার কোনো সাক্ষী থাকলে তাদের শপথের মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন। পরীক্ষার সার-সংক্ষেপ লিখে তিনি নিজে, অভিযোগকারী ব্যক্তির ও কোনো সাক্ষী থাকলে তাঁর স্বাক্ষর নেবেন। কেউ দরখাস্ত আকারে ঘটনার পূর্ণ বিবরণসহ লিখিত অভিযোগ করে প্রতিকার দাবি করলে এরূপ শপথ পরীক্ষাসহ এ ক্ষেত্রে জবানবন্দি নেবেন। এরকম অভিযোগে একটি কমপ্লেইন রেজিস্টার কেইস নম্বর বা কমপ্লেইন রেজিস্টার পিটিশন কেইস নম্বর দিয়ে নথিভুক্ত হয়। এজন্য একে সিআর মামলাও বলে। শপথ পরীক্ষার সময় এবং জবানবন্দি নেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট যদি অপরাধ সংঘটন বিষয়ে অভিযোগকারীর বক্তব্যে সন্তুষ্ট না হন অথবা অভিযোগকারী মামলার ভিত্তি (Prima facie) প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন, তবে ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি আমলে না নিয়ে আবেদনটি খারিজ করে দিতে পারেন। নালিশি পিটিশনটি খারিজ হলে অভিযোগকারী খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে দায়রা জজ আদালতে বা হাইকোর্ট বিভাগে ওই আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশনের আবেদন করতে পারেন।
অভিযোগ আমলে নেওয়ার ফলাফল ও তদন্তে পাঠানো : অভিযোগটি আমলে নিলে ম্যাজিস্ট্রেট বিবাদীপক্ষের বিরুদ্ধে সমন জারি করে (ক্ষেত্র বিশেষে ওয়ারেন্ট জারি করে) আদালতে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য উপস্থাপনের নির্দেশ দিতে পারেন অথবা আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে নিতে থানাকে নির্দেশ দিতে পারেন। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে আদেশপ্রাপ্ত হলে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগটি থানায় এজাহার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে মামলার জন্য প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নেবে। আবার আমল-অযোগ্য অপরাধের বেলায় বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত করতে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন। এক্ষেত্রেও আদিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অভিযোগটির বিষয়ে তদন্ত শুরু করবে এবং তদন্তকালীন আমলযোগ্য অপরাধ তদন্ত করার মতোই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে। তবে প্রয়োজন মনে করলে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অথবা অধিকতর তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি নিজে বা তাঁর অধস্তন অন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন। অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরও তদন্তকাজে সম্পৃক্ত করতে পারেন।
মনে রাখা জরুরি : নালিশি মামলার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্র প্রথম থেকেই পক্ষ হয়ে মামলা শুরু করে না। যেমনটা থানায় এজাহার রুজুর মাধ্যমে মামলা করলে রাষ্ট্র নিজে পক্ষভুক্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে মামলা পরিচালনা করে। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে নেওয়ার আদেশ দিলে রাষ্ট্র তখন মামলার পক্ষ হয়ে পরবর্তী সময়ে মামলা পরিচালনা করে। তাই নালিশি মামলার ক্ষেত্রে কেউ অভিযোগ করে পরবর্তী শুনানির দিন যদি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির না হয় বা ঘটনা তদন্ত শেষে যদি অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ না হয়, তবে ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি খারিজ করে দিতে পারেন। অভিযোগকারী চাইলে এ ধরনের খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতে বা হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন আবেদন করতে পারেন।
শেষ কথা : থানায় কখনো মামলা নিতে না চাইলে বিচলিত হয়ে নিজেকে অসহায় ভাবার কোনো কারণ নেই। আইন অনুযায়ী যে কেউই এরকম পরিস্থিতিতে সরাসরি বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গিয়ে নালিশি মামলা করে আইনের আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারেন। আমাদের দেশের বাস্তবতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসহায় ও দরিদ্র বিচারপ্রার্থীরা থানায় আইনের আশ্রয় না পেলে পুলিশকে টপকে অজ্ঞতা, দৈন্য ও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না। জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের আইনি সহায়তা প্রদান কর্মসূচিও ব্যাপক পরিসরে বাড়ানো উচিত।