ইভটিজিং মূলত প্রকাশ্যে যৌন হয়রানি। পথেঘাটে উত্ত্যক্ত করা বা পুরুষ দ্বারা নারী নির্যাতনের নির্দেশক একটি শব্দ। ‘ইভ’ শব্দটি বাইবেলের ‘ইভ’ (Eve) বা পবিত্র কোরআনের ‘হাওয়াকে’ বোঝায়। অন্যদিকে টিজিং শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘পরিহাস বা জ্বালাতন’। সুতরাং ‘ইভ’ বলতে বোঝায় নারী বা রমণী এবং টিজিং বলতে বোঝায় উত্ত্যক্ত বা বিরক্ত করা। একসময় সমাজের বখে যাওয়া একটি ক্ষুদ্র অংশ ইভটিজিং-এর সাথে জড়িত থাকলেও এখন উঠতি বয়সী তরুণ, কিশোর এবং অনেক মধ্য বয়সীরাও এর সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। আধুনিক সমাজে ‘ইভটিজিং’ শব্দটি ‘যৌন হয়রানি’ (Sexual Harassment) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ‘যৌন হয়রানি’ হচ্ছে সেই ধরনের কর্মকাণ্ড ও আচরণ, যা মানুষের যৌনতাকে উদ্দেশ্য করে মানসিক ও শারীরিকভাবে করা হয়।
যৌন হয়রানি বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছে নিুরূপ-
ক. অনাকাক্সিক্ষত যৌন আবেদনমূলক আচরণ (সরাসরি অথবা ইঙ্গিতে) যেমন- শারীরিক স্পর্শ বা এ ধরনের প্রচেষ্টা।
খ. প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারও সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা।
গ. যৌন হয়রানি বা নিপীড়নমূলক কথা বলা।
ঘ. যৌন সুযোগ লাভের জন্য অবৈধ আবেদন।
ঙ. পর্নোগ্রাফি দেখানো।
চ. যৌন আবেদনমূলক ভঙ্গি।
ছ. অশালীন ভঙ্গি, যৌন নির্যাতনমূলক ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা, কাউকে অনুসরণ করা বা পিছন পিছন যাওয়া, যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস করা।
ট. যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির কারণে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিক্ষাগত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হওয়া।
ঠ. প্রেম নিবেদনে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেওয়া বা চাপ প্রয়োগ করা।
ড. ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনে চেষ্টা করা।
এছাড়াও ভীড়ের মধ্যে অহেতুক নারীদের সাথে ধাক্কাধাক্কি ও শারীরিকভাবে নারীদের শ্লীলতাহানিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠা, ডিমোশন, চাকরিচ্যুতি ইত্যাদির ভয়-ভীতি দেখিয়ে যৌন সুবিধা নিতে চাওয়া- এ ধরনের আচরণের অন্তর্ভুক্ত। অফিসের পার্টিতে নাচার ছলে, লিফটে বা গাড়িতে পাশাপাশি গা ঘেঁষে বসে কেউ এই ধরনের কাজ করলেও তা হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।
যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কী?
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ২৯৪ ধারায় বলা হয়েছে ‘‘যে ব্যক্তি, অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করিয়া- (ক) কোনো প্রকাশ্য স্থানে কোনো অশ্লীল কার্য করে অথবা (খ) কোনো প্রকাশ্য স্থানে বা সন্নিকটে কোনো অশ্লীল গান গাঁথা, সঙ্গীত বা পদাবলি গায়, আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে; সেই ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনায় কারাদণ্ডে যাহার মেয়াদ ৩ মাস পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে”। এই আইন দ্বারা ছোট ছোট ঘটনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা সম্ভব। বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ৫০৯ ধারা অনুযায়ী, ‘‘যে ব্যক্তি কোনো নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার অভিপ্রায়ে এই উদ্দেশ্যে কোনো মন্তব্য করে, কোনো শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি করে বা কোনো বস্তুপ্রদর্শন করে যে উক্ত নারী অনুরূপ মন্তব্য বা শব্দ শুনতে পায় অথবা অনুরূপ অঙ্গভঙ্গি বা বস্তু দেখতে পায়, কিংবা উক্ত নারীর নির্জনবাসে অনধিকার প্রবেশ করে, সেই ব্যক্তি ১ বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন’’।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা : বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং কর্মস্থলে নারী ও শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধের দিকনির্দেশনা চেয়ে রিট (রিট পিটিশন নম্বর ৫৯১৬/২০০৮) দায়ের করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মাদ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকি কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সব সরকারি-বেসরকারি, আধা-সরকারি অফিস এবং সবধরনের প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি দিকনির্দেশনা প্রদান করেন, যা নিম্নরুপ-
১. অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত পরিচালনা এবং সুপারিশ করার জন্য সরকারি-বেসরকারি সব কর্মক্ষেত্র এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযোগ গ্রহণের জন্য কমিটি গঠন করবে।
২. কমপক্ষে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হবে, যার বেশির ভাগ সদস্য হবেন নারী এবং সম্ভব হলে কমিটির প্রধান হবেন নারী।
৩. কমিটির দু’জন সদস্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে নিতে হবে, যে প্রতিষ্ঠান জেন্ডার এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কাজ করে।
পরবর্তীতে সমিতি ২০১০ সালে আরও একটি রিট পিটিশন (রিট পিটিশন নম্বর ৮৭৬৯/২০১০) দায়ের করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১১ সালে নিম্নোক্ত নির্দেশনা প্রদান করে।
১. প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণের জন্য পৃথক সেল থাকবে।
৩. উপরিউক্ত সেল জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটিকে এ উদ্দেশ্যে রিপোর্ট পেশ করবে।