যাযাবরের মতো যুক্তরাষ্ট্রের শহরে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। একটা করে বিয়ে করছেন। সংসার করছেন কিছুদিন। তারপর মনোমালিন্য, বিচ্ছেদ, শহর থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলেছেন আরেক শহরে। সেখানেও বিয়ে, সংসার, বিচ্ছেদ…তারপর আবার পথে। কিন্তু সবকিছু খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিলেও কাঠের একটা বাক্স হাতছাড়া করছেন না কখনো। ঘর-সংসারের মায়া যে লোক নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে পারেন, কী মোহে তিনি একটা সামান্য বাক্স আঁকড়ে ধরে চলেছেন বছরের পর বছর?
থমাস স্টোলত্জ হার্ভে। পেশায় চিকিত্সাবিদ। ১৯৫৫ সালের একটা মৃত্যু পাল্টে দেয় তাঁর জীবনধারা। স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েন। আসলে মৃত্যুটা যে-সে লোকের নয়। বিজ্ঞানের ইতিহাস ওলটপালট করে দেওয়া কিংবদন্তি বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের। তিনি দেহত্যাগ করেন সে বছরের ১৮ এপ্রিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন হাসপাতালে। অনেকে আইনস্টাইনের মৃত্যুকে স্বেচ্ছামৃত্যু বলে মনে করেন। চিকিত্সকেরা সার্জারি করিয়ে ভালো করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আইনস্টাইন রাজি হননি। যদিও তখনো সার্জারিবিদ্যাটা আজকের মতো আধুনিক ছিল না। তাই অপারেশনের পর আইনস্টাইন বাঁচতেন কি না, জোর দিয়ে বলার জো ছিল না। কিন্তু শেষ চেষ্টা তো করা যেত। আইনস্টাইনের বিরোধিতায় সেটাও হয়নি।
সেদিন লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছিল হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। ভক্ত, সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান ভিড় ঠেলে, তাঁদের অগোচরে আইনস্টাইনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মর্গে। পোস্টমর্টেমের ভার পড়েছিল ডা. থমাস হার্ভের ওপর। সেই পোস্টমর্টেমই কি কাল হয়েছিল হার্ভের জন্য? মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি? তবে সেদিন তাঁর মনে ছিল অন্য চিন্তা। আইনস্টাইনের শবদেহ ব্যবচ্ছেদের পর সরিয়ে রেখেছিলেন মহাবিজ্ঞানীর মগজ। কাজটা তিনি করেছিলেন গোপনে। জানাননি আইনস্টাইনের পরিবারকেও। তা ছাড়া আইনস্টাইন নিজেই চাননি তাঁর দেহের এতটুকু অংশ পৃথিবীতে টিকে থাকুক। এ জন্য পুড়িয়ে ছাই করে ফেলতে বলেছিলেন তাঁর মরদেহ। সেই ছাই কোথায় ফেলা হচ্ছে, সেটাও যেন কাকপক্ষীতে না জানে—এমনটাই নির্দেশ ছিল মহাবিজ্ঞানীর। কারণ স্পষ্ট। ব্যক্তিপুজো পছন্দ ছিল না আইনস্টাইনের। কেউ যাতে তাঁর সমাধিক্ষেত্র পবিত্র দর্শনীয় স্থান বানিয়ে ফেলতে না পারে, মৃত্যু কিংবা জন্মদিনে ফুলের স্তূপে যাতে চাপা না পড়ে তাঁর কবর, এ জন্যই দিয়েছিলেন পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ। কিন্তু সেই নির্দেশের তোয়াক্কা না করেই তাঁর মস্তিষ্ক সরিয়ে রাখা হলো। এ তো স্রেফ চুরি!
অতটা নোংরা উদ্দেশ্য বোধ হয় ছিল না ড. হার্ভের। কী এমন ছাঁচে গড়া আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক, যা তাঁকে শতকোটি মানুষের মধ্যে অনন্যসাধারণ করে তুলেছিল?—এটাই যাচাই করতে চেয়েছিলেন হার্ভে। তাই আধুনিক যুগের সবচেয়ে প্রতিভাধর মস্তিষ্কটা তিনি সরিয়ে রেখেছিলেন। এ খবর শুনে বেজায় চটেছিলেন আইনস্টাইনের ছেলে হানস আলবার্ট। তবে হার্ভে তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হন, তাঁর উদ্দেশ্য অসত্ নয়। তা ছাড়া আইনস্টাইন নিজেও একবার রাজি হয়েছিলেন তাঁর মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করতে দিতে। সেটা তাঁর জীবদ্দশায়। পদার্থবিজ্ঞানের জটিল সূত্রগুলো নিয়ে কাজ করার সময় একদিন তাঁর মস্তিষ্কের স্ক্যান করা হয়। স্ক্যানের ছবি নিয়ে চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। ডাক্তার বাড়তি কিছু খুঁজে পাননি আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে।
হার্ভে মস্তিষ্কটা খুলি থেকে বের করেন। তারপর সেটা চুবিয়ে রাখেন ফরমালিনের জারে। খুব বেশি দিন রাখা হয়নি প্রিন্সটন হাসপাতালে। হার্ভে বাড়ি নিয়ে আসেন মগজটা। মগজসহ জারটা বাক্সবন্দী করে তুলে রাখেন নিজের ঘরে। এরপরই শুরু হয় হার্ভের জীবনে উল্টোযাত্রা। প্রিন্সটন হাসপাতালের এক নার্সের সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্কের গুঞ্জন ওঠে। সেটা নিয়ে হইচই। চাকরি যায় হার্ভের। তারপর পাততাড়ি গুটিয়ে চষে ফেলেন গোটা যুক্তরাষ্ট্র। একের পর এক স্ত্রী ত্যাগ করেছেন, কিন্তু যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন মহামূল্য মগজটাকে।
১৯৭৮ সাল। কেটে গেছে দীর্ঘ ২৩ বছর। তত দিনে সাধারণ মানুষের মন থেকে হারিয়ে গেছেন হার্ভে। মানুষ ভুলে গেছে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের কথাও। ঠিক তখনই একটা পত্রিকার প্রতিবেদন সাড়া ফেলে দেয় গোটা দুনিয়ায়। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় নিউ জার্সি মান্থলি নামের এক অখ্যাত ম্যাগাজিনে। লেখক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক স্টিভেন লেভি। তাঁর দাবি, অনেক খোঁজাখুঁজি করে তিনি থমাস হার্ভের খোঁজ পেয়েছেন। পেয়েছেন আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের সন্ধানও। ওয়াইচিটা নামের একটা ছোট্ট শহরে প্যাথলজির ব্যবসা খুলে বসেছেন হার্ভে। জায়গাটা নিউ জার্সি থেকে ১২০০ কিলোমিটার দূরে। হার্ভের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তুলেছেন আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের প্রসঙ্গও। তখন হার্ভে তাঁকে ল্যাবরেটরির এক কোণে পড়ে থাকা নোংরা একটা বাক্স দেখিয়ে বলেন, এর ভেতরেই আছে আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক। বাক্সটা খুলে দেখেন ফরমালিনে ভরা সাধারণ একটা কাচের জারে ডোবানো সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে হতবাক হয়ে যান লেভি। বিজ্ঞানীমহলে তোলপাড় হয়ে যায় এ খবরে। অনেকেই বিজ্ঞানীর মগজ নিয়ে গবেষণার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যোগাযোগ করেন লেভির সঙ্গেও। কিন্তু তত দিনে আবার লাপাত্তা হার্ভে!
সাংবাদিকেরা কিন্তু পিছু ছাড়েননি হার্ভের। কখন কোথায় নিরুদ্দেশ হচ্ছেন, সেটার খবর রাখতে গোয়েন্দা বনে যান একেকজন। তুলে আনেন হার্ভের ব্যক্তিগত জীবনের সব রসাল খবর। আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের চেয়েও কোথাও কোথাও গুরুত্ব বেশি পায় হার্ভের নৈতিক অবক্ষয়ের গল্প। আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের সেই ভ্রমণ নিয়ে লেখা হয় দু-দুটো সাড়াজাগানো বই। আউটসাইড ম্যাগাজিনের সাবেক সম্পাদক লেখেন ড্রাইভিং মিস্টার আলবার্ট। পজেসিং জিনিয়াস নামের বইটি লেখেন দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেল পত্রিকার মেডিকেল রিপোর্টার ক্যারোলাইন আব্রাহাম।
দ্বিতীয় বইটি মূলত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। বহু মানুষের সাক্ষাত্কার যোগ করা হয়েছে বইটিতে। বিশেষ করে, আইনস্টাইনের কাছের মানুষদের কথা উঠে এসেছে। চেষ্টা করা হয়েছে আইনস্টাইনের ব্রেন অন্যদের চেয়ে আলাদা কেন, তার নিখুঁত বিশ্লেষণের।
সাংবাদিকেরা পিছু নিয়েছেন হার্ভের। তাঁরা জানতে চান আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে তিনি কী গবেষণা করলেন? নতুন কিছু বেরোল কি?
হার্ভে তাঁদের ধৈর্য ধরতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, সময় হলেই পৃথিবী জানবে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ক্যারিশমা। কিন্তু হার্ভে পারেননি নতুন কোনো তথ্য দিতে। চেষ্টা অবশ্য করেছিলেন। মাপ নিয়েছেন, ছবি তুলেছেন। কেটে টুকরো টুকরো করেছেন। সুগার কিউবের আকারে ২৪০টি টুকরো। বেশির ভাগই ডুবিয়ে রাখেন সেলয়ডিন দ্রবণে। কয়েকটা কাগজের মতো পাতলা করে স্লাইড বানিয়েছিলেন, মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। দীর্ঘ ৪৩ বছর আঁকড়ে ছিলেন আইনস্টাইনের মগজটাকে। তারপর হার মানেন বার্ধক্যের কাছে। ১৯৯৮ সালে মগজটাকে ফিরিয়ে দেন সেটার পুরোনো জায়গায়। প্রিন্সটন হাসপাতালের প্যাথলজিস্ট ডা. এলিয়ট ক্লাউসের কাছে হস্তান্তর করেন।
এরপর আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে অনেক গবেষণা হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম প্রকাশ একটি গবেষণাপত্র—এক্সিপেরিমেন্টাল নিউরোলজি পত্রিকায়। প্রধান গবেষক ড. মেরিয়ান সি ডায়মন্ড। সঙ্গে আরনল্ড বি স্কিবেল ও গ্রিয়ার এম মারফি। তাঁরা বলেন, আইনস্টাইনের মগজের ওজন ১ হাজার ২৩০ গ্রাম। মানুষের মস্তিষ্কের গড়পড়তা ওজনের চেয়ে ১২০ গ্রাম কম। ওজন কম হওয়াটাই নাকি শাপে বর হয়েছে আইনস্টাইনের জন্য। মস্তিষ্কে স্নায়ুকোষের ঘনত্ব অনেক বেশি। সেটার কারণেই আইনস্টাইন বুদ্ধিতে, চিন্তায় অনেক এগিয়ে ছিলেন। বিকল্প মতও আছে। দীর্ঘদিন ফরমালিনে ডুবিয়ে রাখলে টিস্যুতে যে সংকোচন ঘটে, সে জন্যই কি এই ওজন হ্রাস? নাকি তা এই ১২০ গ্রাম কমে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা নয়?
যা হোক, মানুষের মস্তিষ্কে দুই ধরনের কোষ আছে। একটা হলো নিউরন বা স্নায়ুকোষ। আরেকটা হলো গ্লিয়াকোষ। অন্তত পাঁচ ধরনের গ্লিয়াকোষ আছে। গ্লিয়াকোষ রোগজীবাণুর হাত থেকে নিউরনের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। নিউরনের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের সহায়ক হিসেবে বড় ভূমিকা রাখে এই কোষ। তা ছাড়া এরা নিজেদের মধ্যে সংকেত আদান-প্রদান করতে পারে।
ডায়মন্ড, স্কিবেল ও মারফির গবেষণায় উঠে এসেছে, আইনস্টাইনের মগজে একটি অংশে গ্লিয়াকোষের পরিমাণ বেশি। সেটা হলো সেরিব্রাল কর্টেক্স। গোটা মস্তিষ্কে নিউরনের তুলনায় নয় গুণ গ্লিয়াকোষ থাকে। কিন্তু সেরিব্রাল কর্টেক্সে গ্লিয়াকোষ নিউরনের মাত্র দ্বিগুণ। মস্তিষ্কে নিউরন আর গ্লিয়াকোষের অনুপাতকে বলে গ্লিয়া: নিউরন ইনডেক্স। অর্থাত্ সেরিব্রাল কর্টেক্সে গ্লিয়া: নিউরন ইনডেক্সের মান সবচেয়ে কম। মানুষের সঙ্গে অন্য প্রাণীর তুলনা করলে দেখা যায়, সেরিব্রাল কর্টেক্সে মানুষের গ্লিয়া: নিউরন ইনডেক্সের মান সবচেয়ে বেশি। ডায়মন্ড আর তাঁর সহকর্মীরা মনে করেন, এ কারণেই মানুষ বুদ্ধিতে অন্য প্রাণীর চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে।
ওই তিন গবেষক ১১ জন মৃত ব্যক্তির মগজ পর্যবেক্ষণ করে দেখেন। সেগুলোর সঙ্গে তুলনা করেন আইনস্টাইনের মগজের। দেখা যায়, সবার চেয়ে আইনস্টাইনের সেরিব্রাল কর্টেক্সে গ্লিয়া: নিউরন ইনডেক্সের মান সবচেয়ে বেশি। এ কারণেই আইনস্টাইনের বুদ্ধি, চিন্তা করার ক্ষমতা আর দশজনের চেয়ে বেশি ছিল—এই সিদ্ধান্তই ছিল ডায়মন্ড, স্কিবেল ও মারফির গবেষণাপত্রের মূল থিম। তবে রাইকেনবাখসহ (১৯৮৯) অন্য গবেষকদের মতে, কর্টেক্সের পুরুত্ব বেশি হলে গ্লিয়া: নিউরন ইনডেক্স বেশি হয়—এটা সঠিক হলেও এই ইনডেক্সের সঙ্গে বুদ্ধিমত্তা সরাসরি সম্পর্কিত না-ও হতে পারে।
আমস্টাইনের মস্তিষ্কের ওপর ছুরি চালিয়েছিলেন থমাস হার্ভে
১৯৯৬ সালে নিউরোসায়েন্স লেটারস নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত হয় আরেকটি গবেষণাপত্র। লেখক আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. ব্রিট অ্যান্ডারসন। তিনি দেখালেন, অন্যদের মস্তিষ্কের তুলনায় আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স এরিয়া বেশ সরু। কিন্তু নিউরনসংখ্যা অন্যদের সমান। তার মানে, আইনস্টাইনের সেরিব্রাল কর্টেক্সে নিউরনের ঘনত্ব বেশি। ঠিক এ কারণেই আইনস্টাইন অন্যদের চেয়ে প্রতিভায় এগিয়ে ছিলেন বলে মনে করেন অ্যান্ডারসন। কিন্তু এখানেও সন্দেহের অবকাশ আছে। দীর্ঘদিন ফরমালিনে থাকার ফল হিসেবে এমনটা হতে পারে।
সবচেয়ে সাড়াজাগানো প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। চিকিত্সাবিষয়ক ব্রিটিশ জার্নাল ল্যানসেট-এ। লেখক দুই কানাডিয়ান গবেষক ড. সান্ড্রা উইটেলসন ও ডেব্রা কিগার। তাঁরা ৩৫ জন সাধারণ মানুষের মস্তিষ্ক চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। সেগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন আইনস্টাইনের মগজ। ওই মগজগুলোর তুলনায় আইনস্টাইনের মগজের ওজন অনেক কম। কিন্তু এগিয়ে অন্য জায়গায়। ৩৫ জনের মগজেই দুটো আলাদা অংশের দেখা পেয়েছেন গবেষকদ্বয়। প্যারাইটাল ওপারকুলাম ও ইনফিরিয়র প্যারাইটাল লোব। আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে প্যারাইটাল ওপারকুলাম নেই! সুতরাং, বাড়তি ১৫ শতাংশ জায়গা পেয়ে গেছে ইনফিরিয়র প্যারাইটাল লোব। এই লোবের মধ্যে একটা ছোট্ট খাঁজ থাকে সবার মস্তিষ্কে। অন্যদের তুলনায় আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের সেই খাঁজটা ছোট। ফলে খাঁজের ভেতরের স্নায়ুকোষগুলো ঘন ও সন্নিবেশিত। তাই নাকি তাঁদের ভেতর পারস্পরিক যোগাযোগটাও অনেক সহজ। ঠিক এ কারণেই অন্যদের তুলনায় আইনস্টাইনের চিন্তাশক্তি অনেক প্রখর ছিল বলে ধারণা ওই গবেষকদ্বয়ের। অবশ্য আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে প্যারাইটাল অপারকুলাম না থাকা-সংক্রান্ত এ সিদ্ধান্তটি নিয়ে সাম্প্রতিককালের তিন গবেষক ফক, লেপোরে ও নোয়ি (২০১২) সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
বিজ্ঞানে শেষ কথা বলে কিছুই নেই। এসব গবেষণাও তাই শেষ কথা নয়। অনেকে মাত্র ১১ কিংবা ৩৫টি সাধারণ মস্তিষ্কের সঙ্গে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের তুলনা করাটা ঠিক মানতে পারেন না। বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ কার্ল ফ্রেডেরিক গাউসও কি কম প্রতিভাধর ছিলেন? মস্তিষ্কের আকারই যদি আইনস্টাইনকে মহাবিজ্ঞানী বানায়, তাহলে গাউস নিতান্তই নির্বোধ হতেন। তাঁর মস্তিষ্কের ওজন ছিল ১ হাজার ৪৯২ গ্রাম! আইনস্টাইনের চেয়ে ২৬২ গ্রাম বেশি। তা ছাড়া এক-দুটো অংশ বিশ্লেষণ করে গোটা মস্তিষ্ক সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক যুক্তিযুক্ত নয়। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের লেখক ডেভিড শেঙ্কের একটি বই সাড়া জাগায় গোটা বিশ্বে। দ্য জিনিয়াস ইন অল অফ আস নামের ওই বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন, প্রতিভা জন্মগত নয়; বরং মানুষ তার আগ্রহ, চেষ্টা, ধৈর্য আর পরিশ্রমের মাধ্যমেই নিজেকে অনন্য করে তোলে।
২০১৪ সালের ২৪ মে আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে আরেকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. হিনস। তিনি আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে ২৮ বার পরীক্ষা চালান। সেই পরীক্ষা থেকে সিদ্ধান্তে আসেন আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক অন্যদের থেকে আলাদা ছিল না। সর্বশেষ এই প্রবন্ধটা প্রকাশিত হয় ডিসকভার ম্যাগাজিনের নিউরোস্কেপটিক বিভাগে।
তাই আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষকেরা দ্বিধাবিভক্ত। কত হইচই, কত গবেষণা—এসবের মূল কৃতিত্ব কিন্তু থমাস হার্ভের। সেদিন যদি আইনস্টাইনের মস্তিষ্কটা বিনা অনুমতিতে সরিয়ে রাখার দুঃসাহস না দেখাতেন, তাহলে আজ কোথায় থাকত এত গবেষণা, এত আলোচনা? আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের দীর্ঘযাত্রার সঙ্গী হওয়া সেই প্যাথলজিস্ট ২০০৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। আর আইনস্টাইনের সেই মস্তিষ্ক? তার ঠিকানা এখন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব হেলথ অ্যান্ড মেডিসিনে। হার্ভে ছুরি চালানোর আগে অক্ষত অবস্থায় মস্তিষ্কের যে ছবিগুলো তুলেছিলেন, তা লুকিয়ে রেখেছিলেন নিজের কাছে। তাঁর মৃত্যুর পর সেগুলোও এখন ওই মিউজিয়ামে শোভা পাচ্ছে।
মস্তিষ্কের খুব সামান্য কিছু অংশ আছে ফিলাডেলফিয়ার মাটার মিউজিয়ামে। চিলড্রেন হসপিটাল অব ফিলাডেলফিয়ার নিউরো প্যাথলজিস্ট লুসি বোরকি কীভাবে জানি হার্ভের তখনকার স্ত্রীর কাছ থেকে সংগ্রহ করেন ৪৬টি স্লাইড। সেগুলো থেকে কয়েকটা নমুনা তিনি মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষকে দান করেন।
আইনস্টাইন পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন ৬১ বছর আগে। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর অক্ষয়কীর্তি। হার্ভের কারণে রয়ে গেছে তাঁর মস্তিষ্কও। পৃথিবীর বিজ্ঞান যে অবিশ্বাস্য গতিতে এগোচ্ছে, হয়তো মানবসভ্যতা ইতি টানার আগ পর্যন্ত সেটি টিকে থাকবে। ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে থাকা কোনো গবেষক একদিন হয়তো খুব জোরালোভাবেই ভেদ করবে আইনস্টাইনের মগজের রহস্য। আর সে জন্য মস্তিষ্ক নিয়ে যতই টালবাহানা করুন না কেন, হার্ভেকে অসংখ্য তিরস্কারের সঙ্গে সঙ্গে একটা ধন্যবাদ দিতেই হবে।
তথ্যসূত্র: ড্রাইভিং মস্টার আলবর্ট: মাইকেল পেটারনিটি, ডিসকভার ম্যাগাজিন ডটকম, ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিক,প্রথম আলো।