ডিজিটাল- শব্দটার মধ্যেই কেমন যেন একটা আকর্ষণ কাজ করে। তবে এর অর্থটা বেশ সাদামাটা শোনাতে পারে- ডিজিট অর্থ অঙ্ক, ডিজিটাল অর্থ করা যায় অঙ্কভিত্তিক। তাহলে ডিজিটাল ডিভাইস কী? আক্ষরিক অর্থে বললে, ডিজিটাল ডিভাইস হলো এমন কোন ডিভাইস, যেটা অঙ্কভিত্তিক তথ্য বা সংকেত নিয়ে কাজ করে।
সাধারণভাবে আমাদের একটা ধারণা হয়ে থাকতে পারে, একটু পুরনো প্রযুক্তিগুলোকে এনালগ আর আধুনিক প্রযুক্তিকে ডিজিটাল বলা হয়। আসলে এরকম না ব্যাপারটা। ডিজিটাল ডিভাইসের উদাহরণ অনেক অতীতেও পাওয়া যাবে। যেমন- অ্যাবাকাসের নাম আমরা সবাই জানি। অ্যাবাকাস কিন্তু একটা ডিজিটাল ডিভাইস, কারণ এখানে গুটি দ্বারা সংখ্যাকে উপস্থাপন করা হয়- অর্থাৎ অঙ্কভিত্তিক তথ্য নিয়ে কাজ করা হয়।
ডিজিটাল ডিভাইসের বিপরীতে আরেক ধরণের ডিভাইস রয়েছে- এনালগ ডিভাইস। এনালগ ডিভাইস হলো এমন ডিভাইস যা এনালজি অর্থাৎ সাদৃশ্যতার ভিত্তিতে কাজ করে। এই ধরণের ডিভাইস ফিজিকাল কোন কিছুর তারতম্যের ভিত্তিতে কাজ করে। এই তারতম্য হতে পারে কোন ইলেক্ট্রিকাল বা মেকানিকাল (যান্ত্রিক) কোয়ান্টিটির। যেমন একটা চাকা ঘোরানো হলো, কতটুকু ঘোরানো হয়েছে এটা একটা মেকানিকাল কোয়ান্টিটি। ইলেক্ট্রিকাল কোয়ান্টিটি হতে পারে ভোল্টেজ বা কারেন্ট।
এনালগ এবং ডিজিটালের মধ্যে মূল তফাৎ হলো এনালগ সংকেত (সিগনাল) continuous (অবিচ্ছিন্ন), কিন্তু ডিজিটাল সংকেত discrete (বিচ্ছিন্ন)। যেমন ডিজিটাল একটি ডিভাইস, যেটি বাইনারি পদ্ধতিতে কাজ করে, সেখানে সংকেতগুলোর শুধু দুটি অবস্থা থাকতে পারে- যাদেরকে ০ ও ১ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। ০ ও ১ এই দুটি বিচ্ছিন্ন মানের মাঝামাঝি কোন অবস্থা এখানে সম্ভব না। কিন্তু এনালগ সিগনালের বেলায় তা যেকোন পর্যায়ে থাকতে পারে।
বিচ্ছিন্নতা ও অবিচ্ছিন্নতার ব্যপারটি সহজভাবে বুঝতে আমরা সিম্পল দুটি যন্ত্রের কথা চিন্তা করি।
প্রথম যন্ত্রটিতে মনে করা যাক তিনটি ডায়াল আছে। যন্ত্রটি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যেন প্রথম ডায়ালটি যতটুকু ঘোরানো হবে, তৃতীয় ডায়ালটি ততটুকু ঘুরবে, এরপর দ্বিতীয় ডায়াল যতটুকু ঘোরানো হবে, তৃতীয় ডায়ালটি আরো ততটুকু ঘুরবে। মানে কিনা এখানে দুটি ডায়ালের যোগফল পাওয়া যাচ্ছে তৃতীয় ডায়ালে। যোগ করার জন্য আমরা সরাসরি একটা যান্ত্রিক অবস্থা অর্থাৎ ডায়ালের ঘূর্ণন ব্যবহার করছি। এজন্য এটা একটা এনালগ ডিভাইস। এই ডিভাইসের একটি বৈশিষ্ট্য হলো ডায়ালগুলো যেকোন পরিমাণ ঘোরানো যেতে পারে, এটা কন্টিনিউয়াস- বিচ্ছিন্নতা নেই।।
এরপর আমরা আরেকটি যন্ত্রের কথা চিন্তা করি, ধরা যাক একটি অ্যাবাকাস, যেখানে গুটি ব্যবহার করে যোগ করা যায়। প্রথমে কিছু গুটি সরানো হবে, এরপর আরো কিছু গুটি সরানো হবে- তাহলে মোট যে কয়টি গুটি সরানো হলো তা হবে আগের দুবারে সরানো গুটির সংখ্যার যোগফল। এই যন্ত্রটিতে কিন্তু যেকোন পরিমাণ গুটি সরানো সম্ভব না, শুধু পূর্ণসংখ্যক গুটি সরানো সম্ভব। অর্থাৎ আমি ২টি অথবা ৩টি গুটি সরাতে পারবো, কিন্তু ২.৫ টি বা ৩.৩৩ টি গুটি সরাতে পারবো না। এই যন্ত্রটা এজন্য একটি ডিজিটাল ডিভাইস।
এই সময়ে ডিজিটাল ডিভাইস বললে অবশ্যই আমাদের চোখে এখন অ্যাবাকাসের মত কোন যন্ত্রের ছবি ভেসে ওঠে না, বেশ আধুনিক কোন যন্ত্রের কথা মনে হয়। পার্সোনাল কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, সার্ভার, ডিজিটাল ঘড়ি, স্মার্ট হোম ডিভাইস এবং এরকম যন্ত্রগুলো। বর্তমান সময়ে ডিজিটাল ডিভাইস বলতে আমরা আধুনিক কোন যন্ত্র বুঝি, যেটার নানাবিধ ব্যবহার থাকবে অথবা নির্দিষ্ট কোন কিছুর জন্য বিশেষায়িত হবে।
কিন্তু এই সব ডিজিটাল ডিভাইসের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে- এই ডিভাইসগুলো ডাটা প্রসেসিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু 0 এবং 1 এর সমন্বয়ে এনকোডেড ডাটা নিয়ে কাজ করে। অর্থাৎ একটু আগে যে বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারটা বলা হয়েছে, তা আধুনিক ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর জন্যও সত্য। এই 0 ও 1 দিয়ে ভোল্টেজের দুটি অবস্থা নির্দেশ করা হয়, যাকে বলা হয় লজিক স্টেট। যেমন 0 V থেকে 0.8 V পর্যন্ত ভোল্টেজকে বলা হতে পারে Logic 0 এবং 2 V থেকে 5 V পর্যন্ত ভোল্টেজকে বলা হতে পারে Logic 1।
ভোল্টেজ দিয়ে নির্দেশিত এনালগ সিগনালের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে যেকোন মান গ্রহণ করতে পারে। যেমন 4.5 V বা 2.33 V। কিন্তু ডিজিটাল সিগনালে আমরা শুধু দুটো লজিক অবস্থা বিবেচনা করব, Logic 0 আর 1 এর মাঝে কোন 0.5 নেই।
এতে সুবিধা কি? এনালগ ডিভাইস খুবই সূক্ষ্ম হতে হয়, একটা এনালগ সংকেত হুবহু পুনরুৎপাদন করা প্রায় অসম্ভব। যেমন একটা ডায়াল দু’বার ঘোরালে একদম সমান পরিমাণ ঘোরানো আসলে সম্ভব না, সামান্য হলেও কমবেশি হবেই। ডিজিটাল সিগনালে এই সমস্যা নেই। যেমন 4 V এর পরিবর্তে একটু কমবেশি যেমন 4.1 V হলেও সেটা Logic 1 এর সীমাতেই থাকবে। যদি অনেক কমবেশি হয়, যেমন 2 V থেকে 5 V এর সীমা ছাড়িয়ে যায়, সেক্ষেত্রে শুধু সমস্যা হবে, যার সম্ভাবনা খুবই কম।
এখানে প্রসঙ্গত, অধিকাংশ ডিজিটাল ডিভাইস বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতিতে কাজ করে। যেকারণে এখানে 0 ও 1 দুটি স্টেট আছে। তবে এর অধিক সংখ্যক স্টেট থাকতে পারবে না এমন না। প্রথমদিকের বেশকিছু কম্পিউটার ডেসিমাল সংখ্যা পদ্ধতিতে কাজ করতো, যেখানে ১০টি স্টেট ছিলো। তবে স্টেটের সংখ্যা অবশ্যই নির্দিষ্টসংখ্যক হবে। আবার সবক্ষেত্রে লজিক স্টেটগুলোকে একই ভোল্টেজ সীমা দিয়ে চিহ্নিত করা হবে এমনও না।
মাত্র ২টি স্টেট দিয়ে কীভাবে ডিজিটাল ডিভাইসগুলোতে এত কমপ্লিকেটেড ফাংশনগুলো কাজ করতে পারে, এই ব্যাপারটা খুবই ইন্টেরেস্টিং। বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি ও বুলিয়ান অ্যালজেবরা, কম্বিনেশনাল ও সিকুয়েন্সিয়াল লজিক এবং বিভিন্ন এনকোডিং ব্যবহার করে এটা সম্ভব হয়। যেমন, বিভিন্ন ক্যারেক্টার উপস্থাপনের জন্য আসকি বা ইউনিকোড এনকোডিং ব্যবহার হয়।
ক্ষেত্রবিশেষে এনালগ আর ডিজিটাল উভয়ের নিজ নিজ এডভান্টেজ আছে। এনালগ মানেই খারাপ, ডিজিটাল মানেই ভালো এরকম কোন ব্যাপার একেবারেই নেই। এই প্রসঙ্গে Veritasium এর এই ভিডিওটিতে চমৎকার কিছু জানা যাবে।
আরো দেখুন: সহজেই ফেসবুকের মত একটি সোশ্যাল মিডিয়া তৈরি করে নিন (ওয়ার্ডপ্রেস টিউটোরিয়াল)
একটি নিয়নবাতি পরিবেশনা