দ্যা পেগাসাস প্রজেক্ট : ভার্চুয়াল নিউক্লিয়ার বোম। পেগাসাস স্পাইওয়ার ও বিশ্ব গনতন্ত্রের উপর এর প্রভাব।
হ্যালো বন্ধুরা,
আশা করি সবাই ভালো আছেন। এই মহামারিতে যখন সারা বিশ্ব টালমাটাল। তখন ভার্চুয়াল জগত ইনফেক্টেড আরেকটি ভাইরাস দ্বারা। এটি হলো পেগাসাস। একটি স্পাইওয়ার, যা একজনের ফোনে প্রবেশ করতে পারে শুধু মাত্র একটি ফোন কলের মাধ্যমে। আপনাকে ফোন কলটি রিসিভও করতে হবে না৷ শুধু মোবাইলের ঘন্টা বাজবে আর বুম, আপনার মোবাইলে এখন অন্য কেউ ভাগ বসিয়েছে। হ্যা বন্ধুরা, এমনই কাহিনি শোনা যাচ্ছে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন জার্নালিস্ট, ডানপন্থি লোক, সরকার, জাজ, সোস্যাল এক্টিভিস্টদের কাছ থেকে। শুধু তাই নয়, ফ্রান্সের প্রাইমিনিস্টার নিজের ফোন বদলে ফেলেছে যখন থেকে তার নাম এই পেগাসাস স্ক্যান্ডাল লিস্টে এসেছে। আজকে আমরা জানার চেষ্টা করব পেগাসাস সম্পর্কে সকল খুটিনাটি,সারা বিশ্বে কি হচ্ছে এবং এর প্রভাব বিশ্বের গনতন্ত্র ও হিউম্যান রাইটস এর উপর কিভাবে পড়বে।
পেগাসাস কি করতে সক্ষম?
পেগাসাস একটি ম্যালওয়্যার; বলতে গেলে এখন পর্যন্ত তৈরি হওয়া সব থেকে শক্তিশালী এবং মারাত্মক একটি প্রোগ্রাম।
এটিসিক্রেটলি আপনার ফোনে প্রবেশ করে আপনার ফোনের যাবতীয় সকল তথ্য অন্যকে দিতে পারে,আপনার ফোনের ক্যামেরা একসেস করে ভিডিও করতে পারে,মাইক্রোফোন অন করে সব কিছু রেকোর্ড করতে পারে,আপনার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট, মেসেজ সব কিছু পড়তে এবং ট্রান্সফার করতে সক্ষম। আর এই সবই ঘটতে পারে আপনার সাথে কেবল একটি ফোন কল বা মেসেজ আসার মাধ্যমে। আগে তো লিংক এ ক্লিক করলে বা মেইল ওপেন করলে এসব স্পাইওয়ার আমাদের ডিভাইসে প্রবেশ করত। কিন্তু এখন আর এসবের দরকার নেই। এটাকে বলে Zero Click Attack।
পেগাসাস কে এবং কেন তৈরি করা হয়?
ইসরাইলের NSO নামের একটি সার্ভেলেন্স গ্রুপ এই পেগাসাসের নির্মাতা। তারা দাবি করে পেগাসাস তৈরি করা হয়েছে সরকারি এজেন্সি, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স এবং লো ইনফর্সম্যান্ট এজেন্সিগুলোর জন্য। যারা এটা ব্যাবহার করে বিভিন্ন টেরোরিস্ট গ্রুপ এবং ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে একশন নিতে পারে। এখন আপনি ভাবতে পারেন। তাইলে তো ঠিক আছে। ভালো কাজ করতেছে। কিন্তু বন্ধুগণ এটা হলে তো চলতই। ইদানীং বিভিন্ন নিউজ সামনে আসছে যা থেকে আপনারা ধারণা করতে পারবেন এই স্পাইওয়ারটি কতটুকু মারাত্মক। জামাল নামের একজন ইউএস বেসডস জার্নালিস্ট ২০১৮সালে সৌদি সরকার দ্বারা মার্ডার করা হয়। ইদানীং ইনভেস্টিগেশন রিপোর্টে সামনে আসে যে তার ওয়াইফের ফোনে প্রায় ৬মাস আগে এই স্পাইওয়ারটি ইন্সটল করা ছিল।
তাছাড়া একজন ম্যাক্সিক্যান জার্নালিস্টেরও মার্ডার হয়। এই ম্যাক্সিক্যান জার্নালিস্ট সরকারের কিছু দুর্নীতি এবং ক্রাইম সম্মুখে নিয়ে আসে। তার মার্ডার হয় এবং তার ফোনেও এই স্পাইওয়ারটি ইন্সটল ছিল। লিক অনুযায়ী ম্যাক্সিক্যান সরকার এই জার্নালিস্ট এর উপর স্পাইওয়ারটি দিয়ে স্পাই করছিল।
কোন কোন দেশ এই পেগাসাস লিস্টে রয়েছে? বাংলাদেশ কি রি লিস্টে রয়েছে?
রিসেন্টলি Amnesty ও Forbiden Stories সংস্থা দুটির যৌথ ইনভেস্টিগেশনে একটি লিকড লিস্ট রিভিল হয় ৫০০০০ হাজার ফোন নম্বরের যেগুলোতে পেগাসাস দারা আক্রমণ করা হয়।
তাছাড়া এই রিভিলের পিছনে আরো বড় বড় কিছু সংস্থার নামও রয়েছে। Amnesty International এর রিপোর্টে পাবলিকলি এই স্পাইওয়ারটির মেথলজিকেও রিভিল করে দেয়।আপনারা চাইলে চেক করে আসতে পারেন।
রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ১১টি দেশের মধ্যে এই স্পাইওয়ারটির ব্যাবহার হয় যার মধ্যে রয়েছে Azerbaijan, Bahrain, Hungary, India, Kazakhstan, Mexico, Morocco, Rwanda, Saudi Arabia and the United Arab Emirates। তবে ওয়াশিংটন পোস্ট এর মতে এর সংখ্যা প্রায় ৪৫ এবং যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
এই লিস্টে বাংলাদেশ থাকাটা কিছুটা রহস্য জনক। কেননা বাংলাদেশ ও ইজরাইলের মধ্যে কোনো কুটনৈতিক সম্পর্ক নেই। আর NSO এর মতে তারা কেবল সরকারের কাছেই এই স্পাইওয়ারটি বিক্রি করে। তাহলে কে বা কারা বাংলাদেশের ফোন নম্বরকে টার্গেট করলো তা অবশ্যই রহস্যের। অথবা এটি একটি ইন্টারন্যাশনাল গুজব আমাদের বিরুদ্ধে।
কানাডিয়ান রিসার্চ ল্যাবরেটরি The Citizen Lab ক্লেইম করে BTCL এর নেটওয়ার্কেও এই স্পাইওয়ারটিকে ডিটেক্ট করা হয়েছে।
তবে BTCL এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলেন এই ধরনের কোনো থ্রেট তাদের নেটওয়ার্কে নেই। থাকলে আরো আগেই তারা স্পট করে ফেলত।
যেই ৫০০০০ নম্বর রয়েছে তার মধ্যে ১০০০ফোনকে সনাক্ত করা হয়েছে। যেগুলোর ফরেনসিক টেস্ট করা হবে। এই ফোনগুলো বিভিন্ন জার্নালিস্ট, মানবাধিকার কর্মী, পলিটিসিয়ান্স, সরকারি অফিসিয়ালদের ফোন। এমনকি প্রাইম মিনিস্টারও লিস্টে রয়েছে।
উল্লেখ্য যে এই ৫০০০০ নম্বরের যেই লিস্ট সেখানে সব গুলো ফোনের উপর যে স্পাই করা হয়েছে তা কিন্তু হয়। এগুলো হতে পারে করা রয়েছে বা টার্গেট করেছে বা করতেছে এমন।
স্পাইওয়ারটি কতটা মারাত্মক এবং সারা বিশ্বের উপর এটি কেমন প্রভাব ফেলবে?
যারা নিরাপত্তার নামে এই ধরনের স্পাইওয়ার ব্যাবহার করছে তারা কাদের উপর ব্যাবহার করছে? যেই নম্বরের লিস্ট রিভিল হয় সেখানে ক্রিমিনালদের বদলে হিউম্যান রাইটস এক্টিভিস্ট, জার্নালিস্ট, লইয়ারস, সরকারি অফিসিয়ালস এবং রাজনৈতিক নেতা রয়েছে৷ তো একটু ভাবুন, এমন একটি স্পাইওয়ার যেটি বানানো হয় ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। সেটির ব্যাবহার হচ্ছে এখন অপজিশন পার্টি, জার্নালিস্ট, সোস্যাল এক্টিভিস্টদের উপর। এটা থেকেই ধারণা করতে পারেন এই স্পাইওয়ারটি কতটা ক্ষতিকর একটি দেশের গনতন্ত্রের জন্য। যেকোনো দেশের সরকার এটি ব্যাবহার করে যে কারো উপর স্পাই করতে পারবে এবং সকল তথ্যের বেনেফিট নিতে পারে। কোনো জার্নালিস্ট নিজেদের ইনভেস্টিগেশন করতে পারবে না কোনো দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সুপ্রিম কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট, ইলেকশন কমিশনার, মানবাধিকার কর্মী সহ এসব পর্যায়ের লোকজনের উপর যখন স্পাই হবে তখন সেই দেশের গনতন্ত্র দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা লাগবে। অনেক এক্সপার্টদের মতে এই ধরনের সফটওয়্যার বিশ্বের গনতান্ত্রর পিঠে ছুড়ি মারতে পারে। ইন্ডিয়ান ফ্রেস ক্লাব টুইট করেন যে, ইতিহাসে এই প্রথমবার আমাদের দেশের ডেনোক্রেসির সকল স্তম্ভের উপর স্পাই করা হয়। এখানে বলাই বাহুল্য ইন্ডিয়ার মত এত বড় একটি ডেমোক্রেটিক দেশের মধ্যে এই ধরনের স্পাইওয়ার ব্যাবহার অনেক জার্নালিস্ট, আপজিশন লিডার্স এমনকি সুপ্রিম কোর্টের স্টাফ মেম্বারের উপর স্পাই করা হয়েছে।
আমাদের করনীয় কি?
প্রথমত ব্যাক্তিগত পর্যায়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। কারণ এই স্পাইওয়ার থেকে বাচা ব্যাক্তিপর্যায়ে ইম্পসিবল। নিজের পাসওয়ার্ড গোপন রাখা যায় ফোন নম্বর গোপন কীভাবে রাখব ভাই?অবশ্য আমাদের ফোনে স্পাই করলেও পরিমনির লাইভ ভিডিও আর গ্রেপ্তারের ভিডিও ছাড়া কিছু পাওয়া যাবে না। তবুও সতর্ক থাকতে যেখানে সেখানে নিজেদের ফোন নম্বর দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে৷
আমাদের দেশের নাম যেহেতু এই লিস্টে রয়েছে, সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের সরকারের উচিৎ এই স্ক্যানড্যালটি ইনভেস্টিগেশন করা। বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই ইনভেস্টিগেশন শুরু করেছে। সুপ্রিম কোর্টের উচিৎ যত দ্রুত সম্ভব ইনভেস্টিগেশন চালু করে দেওয়া। আমাদের দেশের নাম এই লিস্টে কেন আসল, এটি কতটুকু সত্য এবং কে বা কারা এর পিছনে রয়েছে তা জানতে হবে। সর্বপরি পেগাসাস একটি নিউক্লিয়ার বোমের সমতুল্য ওয়েপন। এটির বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এই ধরনের স্পাইওয়ার ব্যাবহার ক্রয় বিক্রয়ের উপর রুলস এন্ড রেগুলেশন জারি করতে হবে ইন্টারন্যাশনাল সংস্থাগুলোর।
একরাম আহমেদ শিশির (৫ আগস্ট ২০২১)