(১)
কিনদিলের বাবা হাজি সাহেব। পরহেজগার মানুষ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায় করেন। সেদিন ফজরের সময় নামাজের জন্য বের হবেন, দেখেন কিনদিলের ঘরের দরজা আধখোলা। কিনদিলের বুকের ওপর বই, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আহ! কত রাত জেগেই না পড়েছে। ওর ঘুম নষ্ট করতে ইচ্ছে করল না হাজি সাহেবের। তিনি একাই চলে গেলেন মসজিদে।
(২)
তিবার আজ বাংলা পরীক্ষা। সে বাংলায় দুর্বল। রাত বারোটা পর্যন্ত পড়ে ঘুমিয়েছে। তিবার মা একজন তাহাজ্জুদগুজার মহিলা। ফজরের আজানের সময় দেখেন, তিবা খুব আরাম করে ঘুমোচ্ছে। মেয়ে আমার অনেক রাত পর্যন্ত পড়েছে। থাক, আজ নাহয় ওর আরামের ঘুমটা নাইবা করলাম হারাম! তিনি একাই নামাজ পড়ে নিলেন।
এই দৃশ্যগুলো আমাদের অনেক ধার্মিক পরিবারে অহরহ দেখা যায়। বাবা-মা রীতিমতো নামাজি। কিন্তু সন্তানদের ভ্রুক্ষেপ নেই নামাজের প্রতি। বয়স কম, পড়াশোনা করে, আজ পরীক্ষা—ইত্যকার নানা অজুহাতে বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের নামাজ পড়ার তাগিদ দেন না। অথচ দেখুন, আমাদের মহান প্রতিপালক আমাদেরকে আদেশ করেছেন, “তুমি তোমার পরিবার-পরিজনকে নামাজ আদায়ের আদেশ দাও এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাক।” [সূরাহ ত্বহা: ১৩২]
নামাজের গুরুত্ব কমবেশি আমাদের সবারই জানা। নামাজ পরিত্যাগ করার ব্যাপারে একদল ‘উলামার বলিষ্ঠ মত হলো—এই কাজের কাজি কাফির হয়ে যাবে। চিন্তা করুন, কী ভয়াবহ অবস্থা! কারও কাফির হওয়া মানে—তার শার‘ঈ অভিভাবকত্ব বাতিল হয়ে যাবে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অটোমেটিক তালাক হয়ে যাবে, মুসলিমের ওয়ারিশ হওয়া থেকে বঞ্চিত হবে, এবং তওবা না করে মারা গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে! বিভীষিকাময় জাহান্নামের দগ্ধ অধীবাসীদের যখন জিজ্ঞাসা করা হবে, “কীসে তোমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে এলো?” তখন তারা বলবে, “আমরা দুনিয়াতে নামাজ পড়তাম না।” [সূরাহ মুদ্দাসসির: ৪২-৪৩]
হে মুসলিম পিতা, হে মুসলিম জননী, সন্তান তো আল্লাহপ্রদত্ত উপহার, আপনি এই উপহারকে হেলায় নষ্ট করবেন না। সন্তানসন্ততি মানুষের জীবনের সৌরভ, আপনি তাদেরকে আল্লাহ’র ইবাদতে অভ্যস্ত করে আপনার জীবনকে আরও সুকুমার ও সুরভিত করে তুলুন। এটাই ছিল নাবীগণের আদর্শ, এটাই ছিল যুগে যুগে আল্লাহওয়ালা মানুষদের আদর্শ। মহান আল্লাহ নাবী ইসমা‘ঈল (‘আলাইহিস সালাম) এর ব্যাপারে বলেছেন, “সে তার পরিবার-পরিজনকে নামাজ ও জাকাত আদায়ের নির্দেশ দিত; সে ছিল তার রবের সন্তোষপ্রাপ্ত বান্দা।” [সূরাহ মারইয়াম: ৫৫]
অনুরূপভাবে কুরআনে এসেছে, লুক্বমান (‘আলাইহিস সালাম) তাঁর সন্তানকে নসিহত করতে গিয়ে বলেছেন, “বেটা, তুমি নামাজ আদায় কোরো।” [সূরাহ লুক্বমান: ১৭]
সন্তানের উত্তম প্রতিপালন পিতামাতার দায়িত্ব। এটা সন্তানের অধিকার যে, পিতামাতা তাকে ইসলামের শিষ্টাচার শেখাবেন, তাকে আল্লাহ’র ইবাদতে অভ্যস্ত করবেন। নাবীজি ﷺ বলেছেন, “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। একজন পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। একজন নারী তাঁর স্বামী-গৃহের দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” [সাহীহ বুখারী, হা/৮৯৩]
নাবীজি ﷺ অন্যত্র বলেছেন, “আল্লাহ যাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, সে যদি উক্ত দায়িত্বের প্রতি খেয়ানতকারী হিসেবে মারা যায়, তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিবেন।” [সাহীহ মুসলিম, হা/১৪২; ইমান অধ্যায়; পরিচ্ছেদ- ৬৩]
এমনকি ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “অনেক ‘আলিম বলে থাকেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ সন্তানকে তার পিতার ব্যাপারে প্রশ্ন করার আগে পিতাকে তার সন্তান সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন। কারণ সন্তানের ওপর যেমন পিতার অধিকার আছে, তেমনি পিতার ওপর সন্তানেরও অধিকার আছে।” [তুহফাতুল মাওদূদ বি আহকামিল মাওলূদ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২২৯]
সুপ্রিয় পাঠক, সন্তানদেরকে নামাজে অভ্যস্ত করার কয়েকটি ধাপ আছে। পর্যায়ক্রমে ধাপগুলো অনুসরণ করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে, ইনশাআল্লাহ। তবে ধাপগুলো উল্লেখ করার আগে আরেকটি বিষয়ের কথা বলে নিই। সন্তানকে সৎ ও ধার্মিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে আগে পিতা-মাতাকে ভালো ও সচেতন হতে হবে। সন্তান যদি পিতা-মাতাকে ভুল কাজ করতে দেখে, তাহলে সে ভুল মেসেজ পাবে, পরবর্তীতে সে ওই ভুল কাজেই অভ্যস্ত হবে। তাইতো রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “প্রত্যেক নবজাতক ইসলামি প্রকৃতির ওপর জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তীতে তার পিতা-মাতাই তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান, কিংবা মূর্তিপূজক হিসেবে গড়ে তোলে।” [সাহীহ বুখারী, হা/১৩৫৮]
অনেক পিতামাতা তাদের সন্তানকে ঠিকমতো সময় দেন না, সন্তানের কাছে ধর্মীয় আলাপ করেন না, এবং সন্তানদের ধর্মপালনের ব্যাপারে খোঁজ নেন না। ফলে সন্তানরা ছোটোবেলায় ধার্মিকতার বার্তা পায় না, এবং পরবর্তীতে বড়ো হয়ে আল্লাহ’র অনুগ্রহবঞ্চিত অধার্মিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়। আরব কবি বলেছেন—
“প্রকৃত অনাথ তো সে নয়, যে তার বাবা-মাকে হারিয়েছে শৈশবে।
বরং সেই তো আসল অনাথ, যে তার বাবা-মাকে গাফেল পেয়েছে তার দেখভালে।” [আহমাদ শাওক্বীর কবিতা থেকে অনূদিত]
আরেক আরব কবি বলেছেন—
“মরুর লতিকা কখনো কি কভূ হইয়াছে বাগানের তৃণতুল্য?
তবে কীভাবে ভাবিলে তুমি, মূর্খ রমনীর কোলে যে লালিত, সে হইবে শিষ্ট? আর কীভাবে আশা করিলে তুমি, অধার্মিক নারীর দুগ্ধপায়ী হইবে কৃতকার্য?!” [মা‘রূফ আর-রুসাফীর কবিতা থেকে অনূদিত]
হে মুসলিম ভাই ও বোন, ছোটোদের কাছে ধর্মের আলোচনা করলে, আদর করে সালাফদের গল্প শোনালে, তাদের কোমল অন্তরে ধর্মের প্রতি অনুরাগ জন্মে, ইসলামের জন্য তৈরি হয় প্রগাঢ় ভালোবাসা। তাই তাদের কাছে ইসলামের আলোচনা করুন। একটি ছোট্ট ঘটনা বলি। আমার পিচ্চি বোন ‘আইশাহ ছোটোতেই আরবি খুতবা মুখস্থ করে ফেলেছে, অথচ ওকে পরিবারের কেউ সেটা শেখায়নি। অবাক কাণ্ড! কীভাবে শিখল?! জানা গেল, আব্বু আগে উস্তাযদের প্রচুর লেকচার শুনতেন। সে লেকচার শুনে শুনে আরবি খুতবা মুখস্থ করে ফেলেছে! আব্বু উস্তায হাশেম মাদানীর একটা লেকচার প্রায়ই শুনতেন। তো ‘আইশাহ লেকচার চলাকালীন সময়ে বলত, ‘এরপর শাইখ এটা বলবেন, এরপর এটা বলবেন।’ মানে ওর পুরো লেকচার মুখস্থ হয়ে গেছে!
আসলে বাচ্চাদের যে কাজের প্রতি অভ্যস্ত করবেন, সে সেই কাজেই অভ্যস্ত হবে। তাই তাকে নামাজে আদায়ে অভ্যাসী করুন। সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেছেন, “নামাজ আদায়ে অভ্যস্ত করার মাধ্যমে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হেফাজত করো। এরপর তোমরা তাদেরকে ভালো কাজে অভ্যস্ত করো। কেননা ভালো কাজ অভ্যাসের ওপর ভিত্তিশীল হয়।” [বাইহাক্বী, ৩/৮৪; মুসান্নাফে ‘আব্দুর রাযযাক্ব, হা/৭২৯৯]
এবার সন্তানদেরকে কয়টি ধাপে নামাজে অভ্যস্ত করবেন, সেটা বলি। সন্তানদেরকে নামাজে অভ্যস্ত করার জন্য আমরা তিনটি ধাপ অনুসরণ করতে পারি। যথা:
এক. একেবারে ছোটো থেকে, যেমন কেবল হাঁটতে শিখেছে, বা অল্প অল্প কথা বলতে পারে, তখন থেকেই তাকে সাথে নিয়ে নামাজে দাঁড়ান। বিশেষ করে মায়েরা এই কাজটি করতে পারেন। শুয়ে শুয়ে বাঘ-ভাল্লুকের গল্প না শুনিয়ে সূরাহ ফাতিহাহ শোনান। বারবার শুনিয়ে মুখস্থ করান। জান্নাতের কথা শোনান, ভালো বই থেকে সালাফদের গল্প শোনান। এ সময় বাচ্চাকে আদর করে বলবেন, নামাজ পড়লে আল্লাহ খুশি হন, নামাজ পড়লে আল্লাহ পুরস্কার দেন, নামাজ পড়লে আল্লাহ জান্নাত দেন, ইত্যাদি। বাচ্চা যদি খুবই দুষ্টুমি না করে, তাহলে তাকে নিয়ে মসজিদে যান। সালাফগণ—নারীপুরুষ সবাই—তাঁদের বাচ্চাদের নিয়ে মসজিদে যেতেন। তাই আপনারাও এই কাজটি করতে পারেন। এতে নামাজের প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হবে, ইনশাআল্লাহ।
দুই. সন্তানের বয়স যখন সাত বছর হয়, তখন এই ধাপটি শুরু হয়। দশ বছর না হওয়া পর্যন্ত এই ধাপের স্থায়িত্ব থাকে। এই সময় আপনি আপনার সন্তানকে নামাজের আদেশ দিবেন। তবে অবশ্যই কড়াকড়ি বা ধমকাধমকি করবেন না। খুবই মোলায়েমভাবে সন্তানকে নামাজের প্রতি উৎসাহিত করবেন। নাবী ﷺ সাত বছর বয়সে সন্তানকে নামাজ পড়ার নির্দেশ দিতে বলেছেন (আবূ দাঊদ, হা/৪৯৫)। এই সময় আপনি সন্তানদেরকে নামাজের জন্য গিফট দিতে পারেন।
সালাফগণ তাঁদের সন্তানদের ইবাদতে আগ্রহ বাড়ানোর জন্য উৎসাহোদ্দীপক উপহার দিতেন। ইমাম ইবরাহীম বিন আদহাম বলেছেন, “আমার পিতা আমাকে বলতেন, ‘বেটা, তুমি হাদীস শেখো। তুমি যখনই একটি হাদীস শুনে মুখস্থ করবে, তখনই তোমাকে এক দিরহাম পুরস্কার দেওয়া হবে।’ আমি এভাবেই হাদীস শিখেছি।” [ইতহাফুল খিয়ারাতিল মাহারাহ, পৃষ্ঠা: ৬৮]
তবে এখানে একটু সতর্ক থাকবেন। ‘আল্লামাহ সুলাইমান আর-রুহাইলী (হাফিযাহুল্লাহ) তাঁর এক লেকচারে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। আপনি ইবাদত করার জন্য যে পুরস্কার দিবেন, তা পুরোপুরি দুনিয়ানির্ভর করবেন না। এরকম বলবেন না যে, “তুমি যদি নামাজ পড়ো, তাহলে তোমাকে চকোলেট দিব, অথবা তোমার অমুক প্রিয় খাবার দিব।” বরং বলবেন, “তুমি যদি নামাজ পড়ো, তাহলে আল্লাহ আমাকে পুরস্কার দিবেন, আমি তোমাকে সেখান থেকে পুরস্কার দিব।” সে যদি নামাজ পড়ে, তাহলে আপনি তাকে পুরস্কার দিয়ে বলবেন, “এটা আল্লাহ দিয়েছেন।” এটা কিন্তু মিথ্যা না, আপনার সকল জীবিকা তো আল্লাহই দেন।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমাদের সন্তানদের জন্য আমরা এই কাজগুলো চাইলেই করতে পারি। তাই আপনার সন্তানকে সূরাহ ফাতিহাহ মুখস্থ করান, ছোটো ছোটো সূরাহ মুখস্থ করান। নামাজের নিয়মকানুন শেখান, তাশাহহুদ, দরুদ, দু‘আ মাসূরা শেখান। ইস্তেঞ্জার নিয়ম শেখান, ওজুর নিয়ম শেখান। আর এসব শিখলে তাকে পুরস্কৃত করুন। দেখবেন, সে ইবাদতের ব্যাপারে আরও আগ্রহী হবে, ইনশাআল্লাহ।
তিন. এটি সর্বশেষ ধাপ। দশ বছর বয়স থেকে এই ধাপ শুরু হয়। আপনার সন্তানের বয়স দশ বছর হয়ে গেলে, তাকে নামাজের ব্যাপারে জোর তাগিদ দিন। দশ বছর বয়সের পর সে যদি নামাজ না পড়ে, তাহলে তাকে হালকা প্রহার করুন। নাবী ﷺ বলেছেন, “তোমারা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দাও। আর দশ বছর বয়সে নামাজ না পড়ার কারণে প্রহার করো।” [আবূ দাঊদ, হা/৪৯৫; সনদ: হাসান (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]
‘উলামাগণ এই প্রহারের কিছু নিয়ম বর্ণনা করেছেন। রেগে যেয়ে প্রহার করবেন না। আর এত জোরে মারবেন না, যে সন্তান খুব ব্যথা পায়। সন্তানের মুখে, মাথায়, বুকে ও পেটে প্রহার করবেন না। আর তিনটার বেশি আঘাত করবেন না। তবে হ্যাঁ, যদি ধমক দিলেই কাজ হয়, তাহলে মারতে যাবেন না। অথবা আরেকটি কাজ করতে পারেন। এটি বেশ ফলপ্রসূ পদ্ধতি। এটি হলো বয়কট। সন্তান নামাজ না পড়লে তাকে বলুন, “তুমি যদি নামাজ না পড়ো, তাহলে তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই, আমি তোমার সাথে কথা বলব না।” সাহাবী ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) তাঁর ছেলেকে বয়কট করেছিলেন, একটি হাদীসের নির্দেশ না মানার কারণে। তিনি মৃত্যু অবধি তাঁর ছেলের সাথে কথা বলেননি। সুবহানাল্লাহ! ইসলামের প্রতি, রাসূলের সুন্নাহ’র প্রতি তাঁদের কত দরদ ছিল, চিন্তা করেন। রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম ওয়া আরদ্বাহুম।
এখানে সালাফদের একটি ঘটনা না বলে পারছি না। একবার ‘আব্দুল ‘আযীয বিন মারওয়ান (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ছেলে ‘উমার বিন ‘আব্দুল ‘আযীযকে শিষ্টাচার শেখার জন্য মদিনায় পাঠালেন। আর সালিহ বিন কায়সানের কাছে চিঠি লিখলেন, যেন তিনি তাঁর ছেলেকে দেখাশোনা করেন। তো সালিহ বিন কায়সান তাকে নামাজের জন্য জোর তাগিদ দিতেন। একদিন ছোটো ‘উমার নামাজে আসতে দেরি করে ফেলে।
সালিহ তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তোমাকে কীসে আটকে রেখেছিল যে, তোমার দেরি হলো?” ‘উমার বলে, “আরাম করে চুল আঁচড়াতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে।” সালিহ বললেন, “চুলের আরামের প্রতি তোমার এতো মহব্বত যে, তা তোমার নামাজে প্রভাব ফেলছে?!” এরপর তিনি এই কথা জানিয়ে ‘আব্দুল ‘আযীযকে চিঠি লিখলেন। বিষয়টি অবগত হয়ে ‘আব্দুল ‘আযীয একজন দূত প্রেরণ করলেন। সেই দূত এসে ‘উমারের মাথা মুণ্ডন করে দিল! [তারীখে দিমাশক্ব, খণ্ড: ৪৫; পৃষ্ঠা: ১৬৫]
চিন্তা করুন, সালাফগণ সন্তানদের ইসলামি তরবিয়তের (প্রতিপালন) ব্যাপারে কত খেয়াল রাখতেন। সন্তানরা যেন নামাজি হয়, সেজন্য কত চেষ্টা করতেন। এটাই নাবী ﷺ এর আদর্শ ছিল। সাহাবী ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, আমি রাতে আমার খালা মায়মূনার কাছে ঘুমোতাম। রাসূল ﷺ যখন রাতে খালার গৃহে আসতেন, তখন খোঁজ নিতেন, “ছেলে কি নামাজ পড়েছে?” [আবূ দাঊদ, হা/১৩৫৬; সনদ: বিশুদ্ধ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]
ব্যাপারটা খেয়াল করেন, রাসূল ﷺ প্রথমে বাড়িতে ঢুকেই খোঁজ নিলেন, ছেলে কি নামাজ পড়েছে?! এর নাম ইসলামি তরবিয়ত (প্রতিপালন)। আমাদেরও উচিত, আমাদের সন্তানদের প্রতি এরকম খেয়াল রাখা। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন।
শেষে আরও কিছু টিপস দিই। আপনি নিজের জন্য এবং আপনার সন্তানদের জন্য আল্লাহ’র কাছে দু‘আ করুন, যেন আপনাদেরকে আল্লাহ নামাজি বানিয়ে দেন। নাবী ইবরাহীম (‘আলাইহিস সালাম) এভাবে দু‘আ করতেন। তিনি বলতেন, “ইয়া আল্লাহ, আপনি আমাকে, আর আমার সন্তানসন্ততিকে নামাজিদের অন্তর্ভুক্ত করুন।” [সূরাহ ইবরাহীম: ৪০]
নামাজ ও পবিত্রতার ব্যাপারে ভালো অডিয়ো ক্লিপস পেলে তা আপনার সন্তানকে শোনান, ভিডিয়ো ক্লিপস পেলে দেখান। ভালো উস্তাযের, বা শাইখের লেকচার শোনাতে পারেন। নামাজের অথেনটিক ভিডিয়ো দেখাতে পারেন। তাহলে এর মাধ্যমে আপনার সন্তান নামাজের নিয়মকানুন সহজেই শিখে নিবে, ইনশাআল্লাহ।
আর সর্বদা তার নামাজের ব্যাপারে খোঁজ নিন। সে যদি আসরের নামাজের সময় বলে, “আম্মু, বাইরে খেলতে যাব।” তাহলে বলুন, “বেটা, নামাজ পড়ে খেলতে যাও।” হয়তো মাগরিবের সময় বলছে, “বাবা, অমুক রিলেটিভের বাসায় যাব।” আপনি বলুন, “এসো, আমরা নামাজ পড়ে নিই। তারপর একসাথে বের হবো।” কিংবা সে বলছে, “আব্বু, আমার কালকে কঠিন পরীক্ষা।” আপনি বলুন, “বেটা, এসো নামাজ পড়ি, আল্লাহ তোমার সময়ে বরকত দিবেন।” এই কাজগুলো যদি আমরা করি, তাহলে আমাদের সন্তানরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের প্রতি যত্নবান হবে, ইনশাআল্লাহ।
সর্বোপরি আমরা মহান আল্লাহ’র এই হুঁশিয়ারি স্মরণে রাখব। আল্লাহ বলেছেন, “হে ইমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর।” [সূরাহ তাহরীম: ৬]
আল্লাহ আমাদের সবাইকে যথাযথভাবে ইসলাম পালন করার তৌফিক দান করুন, আমাদের ভাবী প্রজন্মকে মানহাজে সালাফের দীপ্ত আলোয় আলোকিত করুন এবং আমাদের কর্মে সর্বোত্তম বরকত দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল ‘আলামীন।
❏ তথ্যসূত্র:
(১) ‘আল্লামাহ মুহাম্মাদ ‘আলী ফারকূস (হাফিযাহুল্লাহ), তারবিয়াতুল আওলাদ ওয়া উসুসু তা’হীলিহিম; দারুল মাওক্বি‘, আলজিয়ার্স কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪৩১ হি./২০১০ খ্রি. (২য় প্রকাশ)।
(২) ‘আল্লামাহ ফারকূস সম্পাদিত ও শাইখ নাজীব জালাওয়াহ বিরচিত “তারবিয়াতুল আওলাদ”; দারুল ফাদ্বীলাহ, আলজেরিয়া কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪৩২ হি./২০১১ খ্রি. (১ম প্রকাশ)।
(৩) শাইখ ফাওয়্যায আল-মাদখালী প্রণীত “ফাওয়াইদ ফী তারবিয়াতিল আবনা”– শীর্ষক নিবন্ধ; গৃহীত: আজুর্রি (ajurry) ডট কম।
(৪) “তারবিয়াতুল আওলাদি ‘আলাস সালাত”– শীর্ষক আরবি নিবন্ধ; গৃহীত: ইসলামওয়ে ডট নেট।
আমাদের সাইট: OurislamBD.Com