Site icon Trickbd.com

প্রামাণ্যচিত্রঃ কুরআনের সাথে বিজ্ঞানের কিছু ভিত্তিহীন সাংঘর্ষিকতা [পর্বঃ০৫] বিষয়ঃ দুই সমুদ্রের মিলন

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। আশা করি সবাই ভালো আছেন। মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে আমি এই ধারাবাহিকের চারটি পর্ব তৈরি করতে পেরেছি। তারই ধারাবাহিকতায় আজ এটা আমার পঞ্চম প্রামাণ্যচিত্র। তবে আজ একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করবো ইংশাল্লাহ। চলুন শুরু করি।

 

মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা ফুরক্বনের ৫৩ নম্বর আয়াতে বলেন-

وَهُوَ ٱلَّذِى مَرَجَ ٱلْبَحْرَيْنِ هَٰذَا عَذْبٌ فُرَاتٌ وَهَٰذَا مِلْحٌ أُجَاجٌ وَجَعَلَ بَيْنَهُمَا بَرْزَخًا وَحِجْرًا مَّحْجُورًا

অর্থঃ এবং তিনিই আল্লাহ যিনি দুই সমুদ্রকে [একসঙ্গে] মুক্তভাবে প্রবাহিত করেনঃ একটির পানি স্বাদু ও মিষ্ট, এবং অপরটির পানি নোনা ও তিক্ত। আর তিনি এদের মধ্যে এক পর্দা (দেয়াল) তৈরি করেছেন, একটি অংশ যা কখনোই অতিক্রম্য নয়। [২৫:৫৩]

(And It is He who has let free the two bodies of flowing water: One palatable and sweet, and the other salt and bitter; yet has He made a barrier between them, a partition that is forbidden to be passed.) [25:53]

 

এখানে মহান আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার এক অনন্য নিদর্শন তুলে ধরা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা দুই সাগরের সংযোগস্থলে এক অদৃশ্য পর্দা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এখানে কী বোঝানো হয়েছে তা অনেকেই ঠিক মতো জানে না জন্য কুরআনের ভুল ধরে। এই ব্যাপারে বিরোধী বিজ্ঞানীদের ভাষ্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

 

অর্থাৎ, তারা বলছে “যখন কোনো নদীর তাজা (মিষ্ট) পানি সাগরে বা মহাসাগরে গিয়ে পড়ে, তখন সাগরের পানি আর নদীর পানির মাঝে একটা পর্দা তৈরি হয় যাকে মোহনা বলে। তখন কিছু সময়ের জন্য নদীর পানি সাগরের নোনা পানি থেকে আলাদা থাকে। কিন্তু এই আলাদা থাকা সর্বদার জন্য নয় (সুতরাং এটাকে পর্দা তথা “Barrier” বলা যায় না), এটা স্থায়ী নয়, এবং এখানে দুই ভিন্ন লবণাক্ততার জলাশয়ের পানি অবশেষে একই সমান লবণাক্ত হয় (এবং মিশে যায়)। তাহলে কুরআন কীভাবে ভ্রান্তের মতো বলতে পারে যে দুই পানির মধ্যে বিভেদ সবসময়ের জন্য ও স্থায়ী?”

 

আমি এই বিষয়টা দেখার পর এটা নিয়ে গবেষণার জন্য প্রায় ১৫ ঘণ্টা অতিবাহিত করেছি। পরবর্তীতে আমি বুঝতে পারি যে যারা এ কথা বলেছে, তারা প্রথমত কুরআন কী বলেছে সেটাই জানে না আর দ্বিতীয়ত তারা বিজ্ঞান কী বলে সেটাও জানে না।

 

এবার একটু মনোযোগ দিয়ে দেখুন, মহান আল্লাহ কি নদীর সমুদ্রে মিশার কথা বলেছেন, নাকি দুই সমুদ্রের মিশার কথা বলেছেন? অর্থাৎ, তাদের যুক্তির প্রথমেই ভুল রয়েছে, তবে তা অতি নগণ্য। কেননা, নদীর সাগরে মিশা কিংবা দুই সমুদ্রের মিশার মাঝে একটাই বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে।

এই বিষয়টা স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য আমাদেরকে আল-কুরআনের আরেকটি আয়াত বুঝতে হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা রহমানে বলেনঃ

مَرَجَ ٱلۡبَحۡرَيۡنِ يَلۡتَقِيَانِ (١٩)

بَيۡنَہُمَا بَرۡزَخٌ۬ لَّا يَبۡغِيَانِ (٢٠)

অর্থঃ তিনি দুই সমুদ্রকে প্রবাহিত করেন, যাতে তারা মিলিত হয়। কিন্তু তাদের মাঝে রয়েছে এক (অদৃশ্য) দেয়াল, যা তারা অতিক্রম করতে পারে না। [৫৫:১৯-২০]

He has let free the two bodies of flowing water, meeting together. Between them is a Barrier which they do not transgress. [55:19-20]

 

কিছু সংঘাত সৃষ্টিকারী মানুষেরা এটা মনে করে যে পর্দা বা অন্তরায়কে স্থায়ী বলা হয়েছে, যার ফলে পানি মিশে না। কিন্তু আপনি খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন, আল্লাহ তায়ালা এই দুই স্থানের কোথাও বলেননি যে এই পর্দা স্থায়ী, আর এটাও বলেননি যে সমুদ্র সমুদ্রের সাথে মিশতে পারে না। বরং, মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন যে আল্লাহ তায়ালাই দুই সমুদ্রকে প্রবাহিত করেন, যাতে করে তারা মিশে যায় (আরবীতে ব্যবহৃত “মারজা” শব্দের অর্থ মিলিত হয় এবং মিশে যায়)। তিনি সমুদ্রের সমুদ্রকে অতিক্রমের কথা বলেননি, বলেছেন উভয় সমুদ্রের কোনোটাই সেই পর্দা বা দেয়ালকে অতিক্রম করতে পারে না। [কোনো কোনো কুরআনের অনুবাদে ভুল দেওয়া থাকে, যার থেকেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সেখানে লেখা থাকে যে সমুদ্র সমুদ্রকে অতিক্রম করতে পারে না। এটা অবশ্যই ভুল। কারণ, আরবীতে লেখা “বারযাখ” শব্দের অর্থ পর্দা বা অন্তরায় বা দেয়াল। “লা” অর্থ না আর “ইয়াবগিয়ান” অর্থ তারা দুইজন অতিক্রম করে। তাহলে শাব্দিক অর্থ থেকে দেখা যায় এখানে দেয়াল অতিক্রম করতে না পারার কথা বলা আছে, সমুদ্র অতিক্রমের কথা নয়।]

 

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ¹  ²

বিজ্ঞানও এটার সাথে একমত যে সমুদ্রের পানি পরস্পরের সাথে মিশে যায় কিন্তু কোনো সাগরের পানিই পর্দাকে অতিক্রম করতে পারে না।

কুরআনের প্রাচীন ভাষ্যকারগণ কুরআনের এই আয়াতের (সূরা রহমানের) ব্যাখ্যা তথা দুটি সমুদ্রের পানি একত্রে মিলিত হয় ও মিশে যায়, অথচ একই সময়ে তাদের মাঝে রয়েছে পর্দা-এর ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হননি।

দুটো ভিন্ন সমুদ্র যখন একত্রে মিলিত হয় তখন সেখানে একটা অন্তরায় থাকে। এই পর্দা দুটি সমুদ্রকে এমনভাবে ভাগ করে দেয়, যাতে প্রত্যেক সমুদ্রের পানিরই নিজস্ব তাপমাত্রা, ঘনত্ব ও লবণাক্ততা অক্ষুণ্ন থাকে। বর্তমান সময়ের বহু সমুদ্রবিশারদগণ এর ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছেন। দুটি সমুদ্রের মাঝে রয়েছে ঢালু পানির পর্দা, যার মধ্য দিয়ে দুই সমুদ্রের পানি পরস্পর মিলিত হয়। তবে এই মিলনের সময় উভয় সমুদ্রের পানিই তাদের সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হারায়। দুই ভিন্ন ঘনত্ব ও লবণাক্ততার পানি একত্রে মিলিত হয়ে সমসত্ব দ্রবণে পরিণত হয়। কিন্তু এই পানিকে তখন আর কোনো নির্দিষ্ট সমুদ্রের পানি বলা যাবে না। কারণ, এই পানির প্রকৃতি উভয় সাগরের পানির প্রকৃতি থেকেই আলাদা। এভাবে একদিকে দুই পাশের দুই সমুদ্রের সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রক্ষিত হচ্ছে, অন্যদিকে সমুদ্রের পানি পরস্পর মিলিতও হচ্ছে আর কোনো দিকের পানি পর্দা ভেদও করতে পারছে না।

এভাবে এই পর্দা উভয় সমুদ্রের পানির জন্য সমপ্রকৃতিকরণ অঞ্চল বা Homogenizing Area হিসেবে কাজ করে। কোনো সমুদ্রের পানিই তা অতিক্রম করতে পারছে না, যে পানিটা সেটা অতিক্রম করছে সেটাকে আবার কোনো একক সমুদ্রের পানি বলা সম্ভব নয়। কারণ সেটা কোনো সমুদ্রেরই বৈশিষ্ট্য ধারণ করে না। আর এর জন্যই একই স্থানে দুই ভিন্ন রঙের ভিন্ন সমুদ্রের পানি দেখা যায়।

 

তাহলে মহান আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই সঠিক বলেছেন, যা বুদ্ধিমানেরা ছাড়া বুঝতে পারবে না।

আমি হয়তো খুবই জটিলভাবে ব্যাখ্যা করলাম, যা বুঝতে আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মন লাগিয়ে আরেকবার পড়ে দেখুন আর চিন্তা করুন। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন ইংশাআল্লহ।

 

ধন্যবাদ। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আর অনুগ্রপূর্বক এই Post যত বেশি সম্ভব Share করবেন, যাতে সবাই জানতে পারে, তাতে আপনারও সাওয়াব হবে। আজ এখানেই বিদায় নিচ্ছি, আসসালামু আলাইকুম।

 

তথ্যসূত্রঃ [১] কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞানঃ

সঙ্গতিপূর্ণ নাকি সঙ্গতিহীন

পৃষ্ঠা ৩৪ (আংশিক)

[২] https://sogoodislam.wordpress.com/2013/05/03/barrier-between-sweet-and-salt-waters/amp/