যখন কোন সমাজে বা দেশে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অন্যায়-অত্যাচার, অবৈধ যৌনকর্ম, সুদ-ঘুষ, হারাম খাবার প্রভৃতি পাপাচারে ভয়াবহ সয়লাব বয়ে যায় এবং আল্লাহর জমিনে তাঁর অবাধ্যতা মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পায় তখন আল্লাহর আযাব ও শাস্তি সেখানে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- “স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।” (সূরা রুম, আয়াত: ৪১) অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- “তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল।” (সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ৩০)
হাদীস শরীফে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- “যখন কোন জাতীর মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা তা প্রকাশ্যেও করতে শুরু করে, তবে তাদের মাঝে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী ব্যাপক আকার ধারন করে, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে ছিল না।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৪০১৯)
অপর হাদীসে বর্ণিত আছে, “মহামারী প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, যে গযব বা শাস্তি বনী ইসরাঈলের এক গোষ্ঠীর উপর এসেছিল, তার বাকি অংশই হচ্ছে মহামারী। ” (সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ১০৬৫)
তবে মহামারি ও দূরারোগ্যব্যাধি কাফের-মুশরিকদের জন্য আযাব হলেও মুসলমনদের ক্ষেত্রে রহমত এবং তাতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে তা শাহাদাত হিসেবে গণ্য হয়। যেমন- হাদীসে বর্ণিত আছে: “মহামারি আমার উম্মতের জন্য শাহাদাত এবং রহমতস্বরুপ। আর কাফেরদের জন্য হল আযাব। (মুসনদে আহমদ ৭/৩৩)
করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য করণীয়
১.ইস্তেগফার ও দোয়া করা: আল্লাহর কাছে সমস্ত অপরাধ ও পাপ থেকে ক্ষমা চাওয়া এবং করোনা ভাইরাসসহ সর্বপ্রকার রোগ থেকে পরিত্রাণ চাওয়া । কেননা, রাসূলুল্লাহ (সা.) কঠিন কঠিন রোগ থেকে মুক্তির জন্য নিম্মোক্ত দোয়াসমূহ বেশি বেশি করে পড়তেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ البَرَصِ، وَالْجُنُونِ، وَالْجُذَامِ، وَمِنْ سَيِّئِ الْأَسْقَامِ
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিনাল বারাছি ওয়াল জুনূনি ওয়াল জুযা-মি ওয়ামিন ছাইয়্যিইল আসক্বাম। অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে শ্বেত রোগ, মস্তিষ্ক বিকৃতি, কুষ্ঠ রোগ ও দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে আশ্রয় চাই। (সুনানে আবি দাউদ, হাদীস নং ১৫৫৪/ সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং ৫৪৯৩/ মুসনদে আহমদ, হাদীস নং ১৩০০৪/ সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ১০১৭)
اللهُمَّ جَنِّبْنِي مُنْكَرَاتِ الْأَخْلَاقِ، وَالْأَعْمَالِ، وَالْأَهْوَاءِ، وَالْأدْوَاءِ
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা জাননিবনী মুনকারা-তিল আখলা-কি ওয়াল আ’মা-লি ওয়াল আহওয়াই ওয়াল আদওয়া-ই। অর্থ: হে আল্লাহ! আমাকে খারাপ চরিত্র, অন্যায় কাজ ও কুপ্রবৃত্তি এবং রোগ-বালাই থেকে নিরাপদে রাখুন। ( তাবরানী, হাদীস নং ৩৬/ মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদীস নং ৩০২১০/ সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৯১/ মুসতাদরাকে হাকেম ১/৫৩২)
উসমান ইবনু আফফান (রা.) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ প্রতিদিন ভোরে ও সন্ধ্যায় যে কোন বান্দা এ দুয়াটি তিনবার পাঠ করবে, কোন কিছুই তার অনিষ্ট করতে পারবে না। দুয়াটি হলোঃ
بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
উচ্চারণ: বিসমিল্লাহিল লাযি লা- ইয়াদুররু মা’আসমিহি শাইয়্যুন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামায়ি ওয়াহুয়াস সামীউ’ল আলীম। অর্থ: ‘আল্লাহ তায়ালার নামে যাঁর নামের বারাকাতে আকাশ ও মাটির কোন কিছুই কোন অনিষ্ট করতে পারে না। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী’। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৯১/ সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৫০৬৮/ ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৩৮৬৮)
اللهمَّ إنِّي أعُوذُ بِكَ مِنْ جَهْدِ الْبَلَاءِ، وَدَرَكِ الشَّقَاءِ، وَسُوءِ الْقَضَاءِ، وَشَمَاتَةِ الْأَعْدَاءِ
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিন জাহদিল বালা-ই ওয়া দারাকিস সাক্বা-ই ওয়াসূইল কাযা-ই ওয়াশামা-তাহিল আ’দাই। অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে বালা মুসীবতের কঠোরতা, দুর্ভাগ্যে পতিত হওয়া, ভাগ্যের অশুভ পরিণতি এবং দুশমনের আনন্দিত হওয়া থেকে আশ্রয় চাই। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৬৩৪৭,৬৬১৬/ মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ২৭০৭/ সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ১০১৬)
দোয়া ইউনুস বেশি বেশি করে পাঠ করা: لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ উচ্চারণ: লা ইলা-হা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায যালিমীন। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭)
রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যে লোক সন্ধ্যায় উপনীত হয়ে তিনবার বলে, أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ উচ্চারণ: “আউযু বিকালিমাতিললা-হিত তা-ম্মাতি মিন সাররি মা খালাক্বা।” অর্থঃ “ আল্লাহ তায়ালার নিকট আমি তাঁর সম্পূর্ণ কালামের ওয়াসীলায় আশ্রয় প্রার্থনা করি, সে সকল অনিষ্ট হতে, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন ”। ঐ রাতে কোন বিষ তার অনিষ্ট করতে পারবে না। সুহাইল (রহ.) বলেন, আমার পরিবারের লোকেরা এই দুয়া শিখে তা প্রতি রাতে পড়ত। একদিন তাদের একটি মেয়ে দংশিত হয়, কিন্তু তাতে সে কোন যন্ত্রণা অনুভব করেনি। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৬০৪)
২. ধৈর্য ধারণ: রোগ-মহামারী কিংবা দুর্যোগ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে আসে। বান্দাদের পরীক্ষা করতে বিভিন্ন সময় আল্লাহ তায়ালা এমন করে থাকেন। যেমন, পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে, “অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি এবং ফল-ফসল বিনিষ্টের মাধ্যমে। তবে ধৈর্য ধারণকারীদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫) তাই বর্তমান সময়ে আমাদের উচিত হবে ধৈর্য ধারণ করা, আল্লাহ তায়ালার উপর বিশ্বাস আরোও সুদৃঢ় করা এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। রাসূল (সা.) আমাদেরকে এসব অবস্থায় সান্তনা দিয়েছেন।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) কে মহামারি সর্ম্পকে জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে তিনি বলেন, মহামারি আল্লাহ তালায়ার আযাব। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদের প্রতি ইচ্ছা প্রেরণ করেন। আল্লাহ তায়ালা তা মুসলমানদের জন্য রহমত করে দিয়েছেন। কোন ব্যক্তি মহামারিতে আক্রান্ত জায়গায় সওয়াবের আশায় ধৈর্য ধরে অবস্থান করে এবং তার অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, আল্লাহ তায়ালা তাকদীরে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে। তাহলে সে একজন শহীদের সমান সওয়াব পাবে। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৩৪৭৪)
৩. যাতায়াত: মহামারী কিংবা ভাইরাস নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী এমন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল। রাসূল (সা.) এর সময়েও এমন মহামারী রোগ ছড়িয়েছিল। মানবতার মুক্তির দূত রাসূল (সা.) এর সমাধানও দিয়ে গেছেন। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যদি তোমরা মহামারীর কোন সংবাদ শোন, তো সেখানে তোমরা প্রবেশ করিও না। আর যদি কোন শহরে বা নগরে কেউ সে মহামারীতে আক্রান্ত হয়, তো সেখান থেকে তোমরা বের হয়ো না। (বুখারী, হাদীস নং ৫৭২৮/ মুসনদে আহমদ, হাদীস নং ২১৭৯৮,২১৮১১/ তাবরানী, হাদীস নং ৪৮৯৭/ সুনানে বাইহাকী, হাদীস নং ৬৫৫৭)
তাই যেখানে মহামারী কিংবা সংক্রামক ব্যাধি দেখা দিলে সেখানে যাতায়াত থেকে বিরত থাকা। আর সেখানে যারা পূর্ব থেকে অবস্থান করছে, তারা সেখান থেকে অন্যত্রে না যাওয়া। তাই আমাদের হাদীসটির উপর আমল করে গমন ও প্রস্থান বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। প্রয়োজনে রাষ্ট্রী এ বিষয়ে আইনও করতে পারে।
৪. কুনূতে নাজেলা পড়া: মসজিদে মসজিদে ফজরের নামাযে কুনূতে নাজেলা পড়া। মুসলমানদের উপর কোন বিপদ আপদ, মহামারি, দুর্যোগ আসলে কুনূতে নাজেলা পড়ার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কাছে বিশেষ আর্জি পেশ করা।
৫. পবিত্র ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা: সর্বাবস্থায় পবিত্রতা ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি যতœবান হওয়া। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, পবিত্রতা ঈমানের অংশ। (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ২৩৩/ মুসনদে আহমদ, হাদীস নং ২২৯০২/ মু’জামুল কাবির, হাদীস নং ৩৪২৪) তাই নিজেকে জিবাণুমুক্ত রাখতে সব সময় অজু অবস্থায় থাকার চেষ্টা করা। কেননা, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা রোগ নিরাময়ের সহযোগী এবং একটি সুন্নাহসম্মত কাজ।
৬. শহীদি মর্যাদা লাভ: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, পাঁচ প্রকার মৃত শহীদ: মহামারীতে মৃত, পেটের পীড়ায় মৃত, পানিতে ডুবে মৃত, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে মৃত এবং যে আল্লাহর পথে শহীদ হলো। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং ২৮২৯/মুসলিম, হাদীস নং ১৯১৪) অপর হাদীসে আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, মহামারীতে মৃত্যু হওয়া প্রতিটি মুসলিমের জন্য শাহাদাত। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং ২৮৩০)
আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে করোনা ভাইরাসসহ যাবতীয় মহামারী থেকে হেফাযত করুন এবং সকল বিপদ-আপদে ইসলামের দিক-নির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমীন।
মুফতি: দারুল ইফতা ওয়াল ইরশাদ(মাদরাসা)