মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন পাকে আসহাবে কাহাফ সম্পর্কে সূরা কাহাফের মধ্যে আলোচনা করেছেন। আসহাবে কাহাফ বলতে হযরত ঈসা (আ)-এর উম্মত সাত জন যুবককে বুঝানো হয়েছে। এ সাতজন যুবক ছিল ঈমানদার। তৎকালীন জর্ডানের বাদশাহ ছিল মূর্তিপূজারী । নাম দাকিয়ানুছ। বাদশাহ যখন এ আল্লাহওয়ালা যুবকদের সম্পর্কে জানতে পারল যে, তারা মূর্তিপূজা করেন না। বাদশাহ তখন তাদের ডেকে পাঠাল এবং তাদেরকে মূর্তিপূজা করার নির্দেশ প্রদান করল নচেৎ তাদেরকে কঠিন শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করল। বলল, তোমাদের ব্যাপারে আমি তাড়াহুড়া করব না, আগামীকাল পর্যন্ত তোমাদেরকে দ্বীন (ধর্ম) ছাড়ার অবকাশ দিচ্ছি।আগামীকাল তোমাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব। তখন এ সাতজন ইমানদার যুবক ইমান রক্ষার্থে জালিম বাদশার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা করলেন। তারা রাতের অন্ধকারে বেড়িয়ে পড়লেন। পাহাড়ি-জঙ্গলের দুর্গম পথ। কোথাও কারো কোন সাড়া-শব্দ নাই। যুবকরা চলছেন, উদ্দেশ্য রাতের আঁধারেই জালেমের রাজ্য ছেড়ে যাওয়া। অনেকখানি পথ পাড়ি দেবার পর তারা পেছনে কারো শব্দ শুনতে পেলেন, পেছনে তাকিয়ে দেখেন একটা কুকুর তাদের পিছু নিয়েছে। তারা ভয় পেয়ে গেলেন, ভাবলেন কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে আওয়াজ করবে , লোকেরা জেনে যাবে আমাদের পালানোর কথা। তারা কুকুরটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু না, সে কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। তারাও আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলেন, ফল হলো না। কুকুরটা তাদের মনোভাব বুঝতে পেরে আল্লাহর কাছে ফড়িয়াদ করলো, “ আয় আল্লাহ! তুমি আমাকে বাকশক্তি দাও, যাতে আমি তোমার ওলীদের সাথে কথা বলে তাদের অভয় দিতে পারি এবং তাদের সঙ্গি হতে পারি।” আল্লাহ তার ফড়িয়াদ শ্রবণ করলেন এবং তাকে বাকশক্তি প্রদান করলেন। কুকুরটা তাদের সাথে কথা বলা শুরু করল। তাদেরকে জানাল তার মনের আকুতি। মিনতির সুরে বলল, “হে আল্লাহর প্রিয়গণ! আমাকে ভয় পাবেন না, আমি আপনাদের কোন ক্ষতি করবো না। আমি পাহারাদার হয়ে বিভিন্ন প্রাণীর অনিষ্ট হতে আপনাদের রক্ষা করতে চাই।” তারা ভাবলেন যেহেতু কুকুরটা কথা বলছে, সুতরাং এ সাধারণ কোন কুকুর নয়, নিশ্চয়ই এ গায়েবি মদদ প্রাপ্ত কুকুর। তারা তাড়ানোর চেষ্টা থামালেন। অনেকদূর যাওয়ার পর পথের ক্লান্তি তাদেরকে পেয়ে বসল, তারা নিকটেই একটা গুহা দেখতে পেলেন। ভাবলেন এখানে কিছুক্ষন বিশ্রাম নেওয়া যাক, পরে আবার যাত্রা শুরু করা যাবে। বিশ্রাম নেওয়ার সময় তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। কুকুরও গুহার সম্মুখে ঘুমিয়ে পড়ল। যেমন আল্লাহর বাণীঃ
وَتَحْسَبُهُمْ أَيْقَاظًا وَهُمْ رُقُودٌ وَنُقَلِّبُهُمْ ذَاتَ الْيَمِينِ وَذَاتَ الشِّمَالِ وَكَلْبُهُم بَاسِطٌ ذِرَاعَيْهِ بِالْوَصِيدِ لَوِ اطَّلَعْتَ عَلَيْهِمْ لَوَلَّيْتَ مِنْهُمْ فِرَارًا وَلَمُلِئْتَ مِنْهُمْ رُعْبًا
“তুমি মনে করবে তারা জাগ্রত, অথচ তারা নিদ্রিত। আমি তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাই ডান দিকে ও বাম দিকে। তাদের কুকুর ছিল সামনের পা দুটি গুহাদ্বারে প্রসারিত করে। যদি তুমি উঁকি দিয়ে তাদেরকে দেখতে, তবে পেছন ফিরে পলায়ন করতে এবং তাদের ভয়ে আতংক গ্রস্ত হয়ে পড়তে।”
তারা একটানা তিনশ নয় বছর ঘুমিয়েছিলেন, ফলে তারা ক্ষুধা এবং ভয় থেকে মুক্ত ছিলেন। যদি তারা্ না ঘুমাতেন তবে তারা ক্ষুধার্ত হতেন এবং বাইরে খাবার আনতে গিয়ে জালিম বাদশার নিকট ধরা পড়তেন। সুতরাং, ঘুম তাদের জন্য মহান আল্লাহর মহানিয়ামত ছিল। তাদের ঘুম প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন_وَلَبِثُوا فِي كَهْفِهِمْ ثَلَاثَ مِائَةٍ سِنِينَ وَازْدَادُوا تِسْعًا
“তাদের উপর তাদের গুহায় তিনশ বছর, অতিরিক্ত আরও নয় বছর অতিবাহিত হয়েছে।”
সূর্যের তাপে যেন তাদের ঘুমের কোন সমস্যা না হয় সেজন্য উদিত হওয়ার সময় ডানদিকে আর অস্তমিত হওয়ার সময় বামদিকে ঘুরার জন্য আল্লাহ সূর্যকে নির্দেশ দেন। ফলে তাদের শরীরের উপর কখনো রোদ পড়ত না। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ
وَتَرَى الشَّمْسَ إِذَا طَلَعَت تَّزَاوَرُ عَن كَهْفِهِمْ ذَاتَ الْيَمِينِ وَإِذَا غَرَبَت تَّقْرِضُهُمْ ذَاتَ الشِّمَالِ وَهُمْ فِي فَجْوَةٍ مِّنْهُ ذَلِكَ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ مَن يَهْدِ اللَّهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِي وَمَن يُضْلِلْ فَلَن تَجِدَ لَهُ وَلِيًّا مُّرْشِدًا
“তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডান দিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বামদিকে চলে যায়, অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত। এটা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম। আল্লাহ যাকে সৎপথে চালান, সেই সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি কখনও তার জন্যে পথপ্রদর্শনকারী ও সাহায্যকারী পাবেন না।”
অতপর যখন তারা ঘুম হতে জাগ্রত হলেন তারা একে অন্যকে জিঙ্গাসা করলেন যে, আমরা কতক্ষণ ঘুমিয়েছি? কেউ বললেন একদিন, কেউ বললেন একদিনের কিছু কম। কিন্তু যখন তারা নিজেদের দাড়ি-গোফ, আঙ্গুলের দিকে তাকালেন তখন তারা বুঝতে পারলেন তারা অনেক সময় ঘুমিয়েছেন। সুদীর্ঘকাল পর ঘুম থেকে উঠার পর তারা প্রচন্ড ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লেন। কিছু মুদ্রা দিয়ে একজনকে খাবার আনার জন্য বাজারে পাঠিয়ে দিলেন। সবাই তাকে সাবধানে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। যেমন আল্লাহর বাণীঃ
وَكَذَلِكَ بَعَثْنَاهُمْ لِيَتَسَاءلُوا بَيْنَهُمْ قَالَ قَائِلٌ مِّنْهُمْ كَمْ لَبِثْتُمْ قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ قَالُوا رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثْتُمْ فَابْعَثُوا أَحَدَكُم بِوَرِقِكُمْ هَذِهِ إِلَى الْمَدِينَةِ فَلْيَنظُرْ أَيُّهَا أَزْكَى طَعَامًا فَلْيَأْتِكُم بِرِزْقٍ مِّنْهُ وَلْيَتَلَطَّفْ وَلَا يُشْعِرَنَّ بِكُمْ أَحَدًا
আমি এমনি ভাবে তাদেরকে জাগ্রত করলাম, যাতে তারা পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের একজন বললঃ তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ? তাদের কেউ বললঃ একদিন অথবা একদিনের কিছু অংশ অবস্থান করছি। কেউ কেউ বললঃ তোমাদের পালনকর্তাই ভাল জানেন তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ। এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ শহরে প্রেরণ কর; সে যেন দেখে কোন খাদ্য পবিত্র। অতঃপর তা থেকে যেন কিছু খাদ্য নিয়ে আসে তোমাদের জন্য; সে যেন নম্রতা সহকারে যায় ও কিছুতেই যেন তোমাদের খবর কাউকে না জানায়।
এদিকে তখন জালেম বাদশার পতন ঘটেছে, নতুন ধার্মিক বাদশার অভিষেক হয়েছে। তিনি বাজার থেকে খাবার নিয়ে যখন দোকানদারকে মুদ্রা দিলেন তখনই বাধল বিপত্তি। দোকানদার তাকে বলল এ মুদ্রা আপনি কোথায় পেলেন? এ তো অনেক পুরাতন মুদ্রা। পুরো বাজারে বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেল। খুব দ্রুত ব্যাপারটি বাদশার কানে চলে গেল। তাকে বাদশার দরবারে হাজির করা হলো। মুদ্রার উপরের তারিখ দেখে বাদশা বললেন, এ মুদ্রা আপনি কোথায় পেলেন? এতো তিনশ বছর আগের মুদ্রা। তখন তিনি বাদশাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। বাদশা তাকে অভয় দিলেন। তাদের সাথে দেখা করার জন্য গুহায় গেলেন। বাদশা তাদের সাথে আলোচনা শুরু করলেন। এক পর্যায়ে তারা আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। বাদশা তাদের গুহার উপর একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দিলেন।তাদের নামসমূহ নিম্নরূপঃ
১. ইয়ামলিকা
২. মাকসালমিনা
৩. কাশফুতাত
৪. আযরাফতিয়ুনাস
৫. কাশাফতিউয়ুনাস
৬. কিবিউআনাস
৭. ইউয়ুআনাস
ও