অনেকেই বলে থাকে মক্কায় তো অনেক আগে থেকেই মূর্তিপূজার প্রচলন ছিল। হঠাৎ করেই মুসলমানদের নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এসে নতুন করে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন করেছে। তারা এও বলে যে সনাতন ধর্ম এসেছে সবার আগে, এরপর বাকী ধর্মগুলির আবির্ভাব হয়েছে। শুধু তাই নয়, সোনামণিদের পাঠ্যপুস্তকেও বড় করে লেখা হয়েছে ‘ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মাদ’। অর্থাৎ এর আগে মূর্তিপূজা ছিল হঠাৎ করে মুসলমানদের নবী মুহাম্মাদ নতুন এক তাওহীদবাদী ধর্ম ‘ইসলাম’ নিয়ে হাজির হয়েছে।
কথাটি কতটুকু সত্য?
আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানী (রহ.) তার এক গ্রন্থে তথ্যবহুল চমৎকার সব আলোচনা এনেছেন। মূর্তিপূজা কীভাবে এল, কিভাবে প্রসার পেল, কীভাবে ভাইরাসের মত তা ছড়িয়ে গেল – তার আগাগোড়া লিপিবিদ্ধ করেছেন।
চলুন, আজ সেই গ্রন্থ থেকেই কিছু আলোচনা আনা যাক বি-ইযনিল্লাহ। ওয়ামা তাউফিকি ইল্লা বিল্লাহ,
তিনি (রহ.) বলেন, শারিয়াহ প্রতিষ্ঠিত হবার প্রাক্কালে – একদম শুরুর দিকে – জাতি ছিল মাত্র একটা। নির্ভেজাল তাওহীদ তথা একত্ববাদের উপরেই প্রতিষ্ঠিত ছিল তদ্বকালীন মানবজাতি। এরপর ধীরে ধীরে শিরক তাদেরকে ঘিরে ধরে। আর এর দালিলিক ভিত্তি হল আল্লাহ আযযা ওয়াযাল ইরশাদ করেন, “সকল মানুষ একই জাতি সত্তার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা পয়গম্বর পাঠালেন সু-সংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকরী হিসাবে।” [সূরাহ আল বাকারাহ, আয়াত : ২১৩]
❒ শিরক কী?
এই প্রশ্নের উত্তরে আল্লামা আলবানী (রহ.) বলেন, আল্লাহকে বাদ দিয়ে গাইরুল্লাহর ইবাদাত করা আল্লাহর যে কোন হক্বে কাউকে অংশীদার সাবস্ত্য করা। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, আদম (আ.) থেকে নূহ (আ.) পর্যন্ত ছিল দশ প্রজন্ম। তাদের সবাই ছিল শারিয়াহর সুপ্রতিষ্ঠিত তাওহীদের পথে। এরপর তারা বিচ্ছিন হয়ে যায়। এরপর আল্লাহ্ আম্বিয়া কিরামগণ (আলাইহিমুস সালাম)-কে প্রেরণ করেন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরুপে। [তাফসীরে ইবনে জারীর, ৪/২৭৫) ও আল হাকীম (২/৫৪৬)
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ্ বলেন, “আমি আমার সকল বান্দাদেরকে সত্য ধর্মের উপরে সৃষ্টি করেছি (শিরকমুক্ত তৌহিদের উপর)। অত:পর তাদের কাছে শাইত্বন এলো, সত্য ধর্ম থেকে তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দিল। আমি তাদের জন্য যা হালাল করেছি তারা লোকদের কাছে তা হারাম করে দিল এবং তাদেরকে আমার ইবাদতে অংশীদার স্থাপন করার নির্দেশ দিল, যার কোন দলিল আমি তাদের কাছে প্রেরণ করিনি।” (সহিহ মুসলিম, ৮/১৫৯ ও আহমাদ, ৪/১৬২)
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেন, “প্রতিটি নবজাতক ফিতরাতের উপর জম্মগ্রহণ করে। এরপর তার পিতামাতা তাকে ইয়াহুদী বানায়, খ্রীস্টান বানায় এবং অগ্নিপূজক বানায়, যেমন চতুষ্পদ জানোয়ার পূর্ণাঙ্গ চতুষ্পদ বাচ্চা প্রসব করে। তোমরা কি তাতে কোন কর্তিত অঙ্গ (বাচ্চা) দেখ?” (সহিহ মুসলিম, তাক্বদির অধ্যায়, হাদিস নং ৬৫১৪)
মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এটাই আল্লাহর প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ’র সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।” (সূরাহ রুম, আয়াত : ৩০)
❒ প্রথম জাতি যারা জমিনের উপর সবচাইতে বড় জুলুম (শিরক) শুরু করেছিল:
এই সুস্পষ্ট বিবরণীর পর, মুসলিমজাতির এটাও জানা অতীব জরূরী যে, মুউয়াহিদীন তথা তৌহিদের উপর অবিচল থাকা ক্বওম থাকার পরও কিভাবে তাদের মধ্যে শিরক ছড়িয়ে পড়েছিল। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা) সর্বপ্রথম প্রেরিত রাসূল নূহ (আ.)-এর জাতি সম্পর্কে যা জানিয়েছেন আমাদেরকে তা হল, তিনি তাকে প্রেরণ করেছিলেন শিরকের মত সবচাইতে গর্হিত গুনাহের কাজ বন্ধ করার, মানুষকে সত্যের দিকে আহবান ও তাওহীদের দিকে ফিরে আনার জন্য।
“তারা বলছে, তোমরা তোমাদের উপাস্যদেরকে ত্যাগ করো না এবং ত্যাগ করো না ওয়াদ্দ, সূয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নসরকে। (সূরাহ নূহ, আয়াত : ২৩)
[বিভিন্ন সহিহ বর্ণনায় সালাফদের অভিমত পাওয়া যায় যে, এই পাঁচ দেবতা তাদের জীবদ্দশায় সৎকর্মপরায়ণ মুত্তাক্বী বান্দা।ছিল। অত:পর যখন তারা মারা যায় তখন শাইত্বন লোকজনের মধ্যে গুজব ছড়ায় তাদের পশ্চাদপসরণ করার আর তাদের ক্ববরের পাশে বসে থাকার জন্য]
এরপর শাইত্বন পরবর্তী প্রজন্ম আসলে তাদের মধ্যে গুজব ছড়াল যে, তাদের উচিৎ মৃত সেই পাঁচজন ব্যক্তির ছবি আর মূর্তি বানানো। শাইত্বন তাদের সামনে এই ধ্যান ধারণা সুশোভিত করে তুলে ধরল, যাতে তারা মৃত ব্যক্তিদেরকে মনে রাখতে পারে আর তাদের সঠিক ও সুন্দরভাবে অনুসরণ করতে পারে।
অতঃপর আসল ৩য় প্রজন্ম।
শাইত্বন তাদেরকে ২য় প্রজন্মের রেখে যাওয়া ছবি-মূর্তিগুলিকে আল্লাহ – সর্বশক্তিমানের ইবাদাতের পাশপাশি পূজা করতে বলল। আর সে তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল যে, এই কাজ তাদের বাপ-দাদারাও করত। অত:পর আল্লাহ নূহ (আ.)-কে পাঠালেন, তিনি তাদেরকে নির্দেশ দিলেন, শুধুমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য। হাতে গোনা কয়েকজন লোক ছাড়া আর তার ডাকে কেউ সাড়া দিল না। মহান আল্লাহ সূরা নূহ-এর মধ্যে বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “নিঃসন্দেহে এই পাঁচজন ব্যক্তি ছিল নূহ (আ.)-এর ক্বওমের পরহেজগার ব্যক্তি। যখন তারা মৃত্যুবরণ করে শাইত্বন তাদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে দেয়। যাতে তারা তাদের মূর্তি বানায়। আর সেগুলি লোকালয়ে স্থাপন করার কুমন্ত্রণা দেয়। অতঃপর তারা শাইত্বনের অনুসরণ করে। তবে, তাদের মধ্যে থেকে তখনকার কেউই মূর্তিগুলির পূজা করা শুরু করল না। বরং তারা মারা যাবার পর কিছুদিন এই মুর্তিগুলির ব্যাপারে মানুষ ভুলেই ছিল। অতঃপর এর পরের প্রজন্ম মূর্তিপূজা শুরু করে।” (সহীহ বুখারী, ৮/৫৩৪)
ঠিক একইরকম বর্ণনা পাওয়া যায় ইবনে জারীর, আত-তাবারী, অন্যান্য সালাফগণের বর্ণনায়। (আদ-দাররুল মানছুর -৬/২৬৯)
❒ গায়রুল্লাহর ইবাদত হিসেবে প্রথম মুর্তিপূজা শুরু যেভাবেঃ
“ওয়াদ্দ ছিলেন সৎ, ধার্মিক, ঈমানদার আর একনিষ্ঠ আল্লাহর ইবাদতকারী ব্যক্তি। তাকে তার জাতির লোকজন খুব ভালবাসত। উনার ইন্তেকালের পর লোকেরা বাবেল শহরে উনার কবরের পাশে জমায়েত হতে লাগল। শোকের মাতম ও বিলাপ প্রকাশ করল। অতঃপর শাইত্বন যখন দেখল, লোকেরা কবর কেন্দ্রিক শোক ও বিলাপ প্রকাশ করছে তখন সে একজন মানুষের রুপে তাদের কাছে এসে বলল,
“আমি দেখলাম তোমরা তার কবরের পাশে শোকের মাতম করছ। তাহলে কেন তোমরা তার ছবি বানাচ্ছ না? (অর্থাৎ মূর্তি বানাচ্ছ না)। কেন তোমরা নিজেদের স্ব স্ব লোকালয়ে স্থাপন করছ না – এতে করে তোমারা তাকে স্মরণে রাখতে পার? তারা প্রলুব্ধ হয়ে শাইত্বনের এই ধোঁকায় “সায়” দিল। এরপর তারা তাদের স্মরণে মূর্তি বানিয়ে তাদের লোকালয়ে স্থাপন করল।
যখন শাইত্বন তাদেরকে দেখল যে, তারা ওয়াদ্দকে সকাল-বিকাল স্মরণ করছে, তখন সে বলল: আচ্ছা? কেন তোমরা সকলেই একটি করে মূর্তি তোমাদের নিজ নিজ ঘরের জন্য বানিয়ে নিচ্ছ না? এতে করে খুব সহজেই তাকে তোমরা স্মরণে রাখতে পারবে। অতঃপর তারা তাতেও “সায়” দিল। ফলে, প্রতিটি ঘরে তাদের মূর্তি তৈরী হল। এটাকে তারা যত্ম করত, শ্রদ্ধা করত। এই মূর্তি মৃতের স্মৃতি মনে করিয়ে দিত।
আবু জা’ফর (রহ.) বলেছেন, এর পরবর্তী প্রজন্ম যখন দেখল এটা তাদের বাপ-দাদারা করে গেছে, তখন এই প্রজন্ম এটাকে ইবাদতযোগ্য ইলাহ (দেবতা) ভাবতে শুরু করল। তিনি আরো বলেন, “এটাই হলো প্রথম আল্লাহর ইবাদত বাদ দিয়ে ১ম মূর্তি পূজা। তারা এই মূর্তির নাম দিয়েছিল “ওয়াদ্দ” (ইবনে আবু হাতিম)।
কার্যতঃ আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা)-এর প্রজ্ঞা প্রকাশিত হয়েছিল, যখন তিনি নাবী মুহম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে সর্বশেষ নবী হিসেবে এবং শারিয়াহর বিধানকে শাশ্বত বিধান হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যে বিধানের মাধ্যমে সুমহান রব নির্জলা শিরক এবং শিরকের উৎপত্তিস্থলজনিত সকল পথ ও ঘাটের উপর সম্পূর্ণরুপে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছেন। (কবরকেন্দ্রিক মাতম, ছবি, মূর্তি বানানো ইত্যাদি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে)। মানুষ যেন শিরকের মত গুরুতর গুনাহের ফাঁদে ফের জড়িয়ে না পড়ে তার সতর্কতা হিসেবে।
এই কারণে কবর পাকা করা, বিশেষ উদ্দেশ্যে সেখানে ভ্রমণ করা, মাজারকে উৎসবের প্রাণকেন্দ্র বানানো, সেখানে জমায়েত হওয়া, কবরবাসীর নামে মান্নত করা, তাদের কাছে কিছু চাওয়া – এসব কিছুই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এগুলি শিরকের দিকে ধাবিত করে, ধীরে ধীরে সুমহান রবকে ফেলে গাইরুল্লাহর ইবাদতের দিকে নিয়ে যায়।
ঘটনা এই বা এর চাইতে আরো ভয়াবহ যে, আমরা এমন এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যেখানে ইলমের বিলুপ্তি ঘটছে আর জাহালাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতি অল্প-সংখ্যক দিকনির্দেশনা দেবার মত আলিম (সত্যের দিকে আহবানে) পাওয়া যাচ্ছে। সেই সাথে শাইত্বন মানুষ আর জ্বিনের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট করার নিমিত্তে কাজ করে যাচ্ছে। আল্লাহর তায়ালার একক ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
❒ তথ্যসূত্রঃ
গ্রন্থকার: আল্লাম্মা মুহাম্মাদ নাসির-উদ-দীন আল-আলবানী (রহ.)
গ্রন্থ: তাহধিরুস-সাজিদ মিন ইত্তিখাদিল কুবুরি মাসাজিদ, পৃষ্ঠা: ১০১-১০৬, (ঈষৎ পরিমার্জিত)।