ইসলাম ইনসাফপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিধান নিশ্চিত করেছে। ন্যায়বিচার কায়েম করার বিধান শুধু ইসলামই সমাজে উপহার দিয়েছে। গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী, মার্কসবাদী, নাস্তিক্যবাদী, লেলিনবাদী অথবা স্যাকুলারিজম এসব ব্যবস্থা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এসব ধাঁচে পরিচালিত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা সবসময় অন্যায়কে পুঁজি করে অথবা দুর্নীতিকে অবলম্বন করে মতার মসনদ পাকাপোক্ত করার কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে টিকে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়েছে। অন্যায়, অবিচার ও জুলুম ইসলামি অনুশাসনের যে পরিপন্থী, এ কথা তারা মনেই করে না।
কুরআন এবং সুন্নাহর শাসনব্যবস্থা অর্থাৎ, সৎ ও নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন নেতৃত্বের শাসনব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনো শাসকের পে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কেবল যে শাসক ইসলামি বিধান মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনা করে এবং যে শাসক শুধু মহান আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে, সেই শাসকের পইে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর নাম আমরা অনেকেই হয়তো শুনে থাকব। ইতিহাসে খুব প্রসিদ্ধ এ টাইগ্রিস নদী। এ নদীর একেবারে উত্তর প্রান্তে অবস্থিত সিরিয়ার একটি বিখ্যাত শহর। এ শহরের নাম ‘আর রাকাহ’। খলিফা হারুন-অর-রশিদের শাসনামলের একটি ঘটনা এ শহরকে আবর্তন করে ঘটেছিল। একসময় সেখান থেকে খলিফা হারুন-অর-রশিদের রাজ দরবারে একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি এসেছিল। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল, এ শহরের প্রধান বিচারপতি এক মাস যাবৎ গুরুতর অসুস্থ আছেন। তাই বিচারকার্য প্রায় স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে খুব তাড়াতাড়ি সমাধানের ব্যবস্থা নিতে মহামান্য খলিফাকে অনুরোধ করা হলো। খলিফার হাতে চিঠিটা পৌঁছা মাত্র বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। কী করা যায় না যায় তা নিয়ে পেরেশান হয়ে গেলেন খলিফা। চিন্তা করলেন, বিষয়টি তো অতীব জরুরি। খলিফা সিদ্ধান্ত নিলেন নতুন বিচারপতি নিয়োগের জন্য। সবকিছু ঠিকঠাক করে নতুন বিচারপতি নিয়োগের ব্যবস্থা নিলেন খলিফা। তারপর একটি ফেরত চিঠি পাঠালেন আর রাকাহ শহরে। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এ শহরে একজন নতুন বিচারক আসছেন। আশা করা যায়, বিচারব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। প্রজাদের বিচারের জন্য আর কষ্ট পেতে হবে না’। সুতরাং প্রজাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। যে কথা সেই কাজ। ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যেই আর রাকাহ শহরে নতুন বিচারক এসে কাজে যোগ দিলেন। বিচারকাজ যথারীতি শুরু হয়ে গেল। শুরুতেই শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা একজন অশীতিপর বৃদ্ধাকে আদালতে নিয়ে এলো। কারণ বৃদ্ধ মহিলাটি একটি অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল।
অপরাধী মহিলা আদালতের কাঠগড়ায় : অপরাধের অভিযোগে বৃদ্ধ মহিলাকে বিচারের জন্য খলিফার আদালতের কাঠগড়ায় আনা হয়েছিল। জানা যায়, আর রাকাহ শহরের একটি খাবারের হোটেল থেকে বৃদ্ধ মহিলা কিছু রুটি আর এক বোতল মধু চুরি করতে গিয়ে একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়। শুধু ওই বুড়ি নয়, রাজ্যের সব নাগরিক খুব ভালো করেই জানতেন, খলিফা হারুন-অর-রশিদের রাজ্যে চুরি করা কত বড় অপরাধ। যত সৎ লোকই হোক না কেন, চুরির দায়ে আইনগতভাবে অপরাধীর হাত কাটা যাবে অথবা জেল-জরিমানা হবে। এটাই ছিল রাষ্ট্রীয় আইনব্যবস্থা। এটা জেনেও মহিলা চুরি করেছে।
মহিলার জবানবন্দী গ্রহণ : বিচারক মহিলার জবানবন্দী গ্রহণ করলেন। বললেন, আপনি কি চুরি করেছেন? মহিলা বললেন, জ্বি আমি চুরি করেছি। অতপর বিচারপতি বললেন, আপনি কি জানেন চুরি করা কত বড় অপরাধ ও অন্যায়? তখন তিনি বললেন, জ্বি আমি জানি, চুরি করা অনেক বড় অপরাধ। মার অযোগ্য পাপ। বিচারপতি পুনরায় বললেন, আপনি কি জানেন, এ অপরাধের জন্য আপনার কি পরিমাণ শাস্তি হতে পারে? বৃদ্ধা বললেন, জ্বি, আমি জানি চুরির দায়ে আমার কি পরিমাণ শাস্তি হতে পারে। বললেন, আর্থিক দণ্ড হতে পারে, জেল হতে পারে, এমনকি আমার হাতও কাটা যেতে পারে।
পুনরায় জবানবন্দী : বিচারপতি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে এসব জেনেশুনে আপনি কেন চুরি করেছেন? মহিলা তখন অবলীলাক্রমে উত্তর দিলেন, মহারাজ আমি গত সাত দিন ধরে কিছুই খাইনি। পুরোপুরি অভুক্ত। শুধু আমি নই, আমার সাথে আমার এতিম দুই নাতিও না খেয়ে আছে। তাদের পেটে কোনো দানাপানি নেই। তাই পেটের ধার যন্ত্রণা সইতে না পেরে বাধ্য হয়ে খাবার চুরি করেছি। আসলে আমি কোনো চোর নই। আমার আর কোনো উপায় ছিল না বিধায় চুরির মতো জঘন্য কাজ করেছি।
বিচারকের বিস্ময় ও রায় প্রদান : বিচারক বিস্ময়াভিভূত হয়ে বললেন, আগামীকাল নগর প্রধান, খাদ্যগুদাম প্রধান, শরিয়াহ প্রধান, পুলিশ বাহিনীর প্রধানসহ সব সমাজহিতৈষী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আদালতে উপস্থিত থাকতে বলা হলো। সবার সামনে যথাসময়ে বিচারের রায় দেয়া হবে। বিচারকের নির্দেশ পেয়ে পরদিন সকালে সবাই আদালতে উপস্থিত হলো। বিচারকও যথাসময়ে উপস্থিত হলেন। রায় শোনার অপোয় সবাই অপেমাণ। বিচারক রীতি অনুযায়ী পিনপতন নীরবতার মধ্যে রায় ঘোষণা করলেন। ঘোষণা হলো, চুরি করার অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় মোট ৫০টি চাবুক, ১০০ দিনার রৌপ্যমুদ্রা জরিমানা আর অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড ধার্য করা হলো। কিন্তু কার বিরুদ্ধে বিচারক রায় দিলেন সে ব্যাপারে প্রশ্ন রয়ে গেল।
সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী : যুগে যুগে সত্যের জয় হয়েছে সবসময়। চুরি করা বৃদ্ধা কোনো প্রতারণা ও মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে অকপটে সত্য কথা স্বীকার করেছিলেন। সত্যের শিখায় উদ্ভাসিত হওয়াই তার জন্য হাত কাটার মতো আদালতের কঠিন শাস্তির রায় হলো। রায়ে মহিলার অপরাধ মওকুফ করা হলো এবং ৫০টি চাবুক মারার নির্দেশ দেয়া হলো। কিন্তু এ ৫০টি চাবুক কাকে মারা হবে তা কিন্তু তখনো কেউ বুঝতে পারেনি! বিচারপতি রায় দেয়ার পর সেন্ট্রিকে ডেকে পাঠালেন। তাকে চাবুক আনতে নির্দেশ দিলেন। বিচারপতির আসন থেকে তিনি নিচে নেমে এলেন। অতপর বৃদ্ধ মহিলার পাশে এসে দাঁড়ালেন। সেন্ট্রিকে বললেন, ‘যে নগরে একজন ুধাতুর বৃদ্ধ মহিলা সাত দিন অনশনে থেকে ুধার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে হোটেল থেকে খাবার চুরি করতে বাধ্য হন, সেখানে সবচেয়ে বড় অপরাধী সে দেশের খলিফা বা সে দেশের শাসনকর্তা।’
বিচারক নিজেই নিজের বিচার করলেন : বিচারক বললেন, ‘খলিফার প্রতিনিধি হয়ে যেহেতু আমি বিচার করতে এসেছি, তাই এর সম্পূর্ণ দায়ভার আমার ওপর বর্তায়। আমার ব্যর্থতাই এর জন্য প্রধানত দায়ী। তাই বিচারের রায়ে দেয়া ৫০টি চাবুকের ২০টি আগে আমার হাতে মারা হোক’। আর এটাই আদালতের নির্দেশ। আদেশ যেন সঠিকভাবে পালন করা হয়। বিচারক হিসেবে চাবুক মারতে আমার ওপর যেন বিন্দুমাত্র করুণা প্রদর্শন অথবা দয়া না দেখানো হয়। বিচারক নির্দ্বিধায় নিজের হস্ত দুটি সামনে প্রসারিত করে দিলেন। দু’হাতে পরপর ৫০টি চাবুক মারা হলো। চাবুকের কঠিন আঘাতে বিচারকের হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগল। অনন্যোপায় হয়ে বিচারক পকেট থেকে একটি রুমাল বের করলেন। বিচারকের এ অবস্থা দেখে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একজন সেই রুমাল দিয়ে বিচারকের হাতে ব্যান্ডেজ করার জন্য উদ্যত হলে বিচারক তাকে বারণ করলেন। তারপর যা হলো: বিচারক বললেন, ‘যে শহরে নগরপ্রধান খাদ্যগুদাম প্রধানসহ অন্যান্য সমাজহিতৈষী একজন অভাবগ্রস্ত মহিলার ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে পারে না, তারাও এ চুরির জন্য অপরাধী। তাই বাকি ৩০টি চাবুকের আঘাত সমানভাবে তাদের মারা হোক’। এভাবে একে একে সবাইকে সমানভাবে ৩০টি চাবুক মারা হলো।
ইনসাফপূর্ণ বিচার ও মা প্রার্থনা : তারপর বিচারক নিজ পকেট থেকে বের করা রুমালের ওপর ৫০টি রোপ্যমুদ্রা রাখলেন। তারপর উপস্থিত সবাইকে ডেকে বললেন, যে সমাজ একজন বয়স্ক অশীতিপর বৃদ্ধ মহিলাকে ুধার তাড়নায় চোর বানিয়ে দেয়, যে ঘরে পিতৃ-মাতৃহীন এতিম শিশু দিনের পর দিন উপবাস থাকে, সে সমাজে বসবাসকারী সব নাগরিক অপরাধী। সুতরাং এখানে যারা উপস্থিত আছেন সবাইকে ১০ দিনার করে রোপ্যমুদ্রা জরিমানা করা হলো। জরিমানার অর্থের পরিমাণ হলো মোট ৫০০ দিনার। এ ৫০০ দিনার রোপ্যমুদ্রা থেকে ১০০ রোপ্যমুদ্রা জরিমানা বাবদ রেখে দেয়া হলো। বাকি ৪০০ রোপ্যমুদ্রা থেকে ২০টি চুরি হয়ে যাওয়া দোকানের মালিককে দেয়া হলো। আর বাকি ৩৮০টি মুদ্রা বৃদ্ধ মহিলাকে দিয়ে দেয়া হলো। তাকে বিচারক বললেন, এগুলো আপনার ভরণপোষণের জন্য দেয়া হলো। এতিম শিশুদের নিয়ে আপনি সংসার চালাবেন। আর আগামী মাসে আপনি বাগদাদে খলিফা হারুন-অর-রশিদের রাজদরবারে আসবেন। খলিফা আপনার কাছে মা প্রার্থনা করেছেন।
খলিফার দরবারে বৃদ্ধ মহিলা : বিচারকের কথামতো ঠিক এক মাস পর বৃদ্ধ মহিলা খলিফার রাজদরবারে গিয়ে হাজির হলেন। দেখলেন, খলিফার আসনে বসা লোকটিকে যেন খুব পরিচিত মনে হয়। তারপর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে খলিফার আসনের দিকে এগিয়ে গেলেন। খুব কাছে গিয়ে মহিলা বুঝতে পারলেন লোকটি অন্য কেউ নন, উনি তো সে দিনের সেই বিচারক, যিনি তার চুরির অভিযোগে বিচারের রায় দিয়েছিলেন। খলিফা খিলাফতের আসন থেকে নেমে এসে বললেন, আপনাকে আর আপনার এতিম দুই নাতিকে উপোস রাখার জন্য সে দিন বিচারক হিসেবে আমি খলিফা নিজেই মা চেয়েছিলাম। আজ রাজদরবারে ডেকে এনেছি প্রজা অধিকার সমুন্নত করতে না পারা একজন অধম খলিফাকে মা করে দেয়ার জন্য। আপনি আমাকে মাফ করে দেবেন এটাই আমার প্রত্যাশা। আমি একজন মুসলিম শাসক আর আপনি আমার রাজ্যের একজন নাগরিক। আমি নিজেই খলিফা হিসেবে সে দিন বিচারকের ভূমিকা পালন করেছি। আপনি আমাকে মার্জনা করুন মা।
ন্যায়পরায়ণ শাসক : ইসলামের এ মহানুভব খলিফা বাগদাদের খলিফা থাকাকালীন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। প্রজাদের প্রিয়পাত্র হিসেবে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। খলিফা হারুন-অর-রশিদ মাত্র ৪৭ বছর বয়সে ৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের খোরাশান প্রদেশের তোস নগরে ইন্তেকাল করেন। ইসলামের ইতিহাসে ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবেই পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। এভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খলিফা হারুন-অর-রশিদ তার রাজ্যে সম্পূর্ণরূপে শান্তিশৃঙ্খলা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার সংরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
যদি পোস্টটি ভালো লাগে তাহলে আমার সাইটটি ঘুরে দেখুন একবার ? hmvai.com
ধন্যবাদ
তথ্যসূত্রঃ মুসলিম শাসনের ন্যায়বিচার ৷