পবিত্র কোরআন সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন, “এটি এমন একটি গ্রন্থ, যা আমি অবতীর্ণ করেছি, খুব মঙ্গলময়, অতএব, এর অনুসরণ কর এবং ভয় কর-যাতে তোমরা আল্লাহর করুণা বা রহমতপ্রাপ্ত হও। ” আল কোরআন মানুষের সৌভাগ্যের দিশারি পরিপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়সহ সৌভাগ্যময় এবং উন্নত জীবন যাপনের সমস্ত নির্দেশনা রয়েছে এ মহাগ্রন্থে। কোরআন ছাড়া অন্য কোনো গ্রন্থ মানুষের জীবনের সব দিকের নির্দেশনা দেয় না। কোরআনের বাণীর বাহ্যিক কাঠামো যেমন সৌন্দর্য্যে অনন্য তেমনি এর বিষয়বস্তুও গভীরতা ও গুরুত্বের দিক থেকে অনন্য। কোরআন যে মানুষের রচিত গ্রন্থ নয়, এটাই তার বড় প্রমাণ এবং এ মহাগ্রন্থের চিরন্তন অলৌকিকতার স্বাক্ষর।
মোজেজা বা অলৌকিকতা হল সাধারণ ঘটনা বা প্রচলিত নিয়মের বহির্ভূত কিছু ঘটনা। মহান আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ মোজেজা দেখাতে পারে না। নবী-রাসূলদের দেখানো যেসব মোজেজার সত্যতার প্রতি জ্ঞানী ব্যক্তিদের কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, তারা বুঝতেন যে আল্লাহর সাহায্য ছাড়া এ ধরনের অতি-প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটানো কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার বহু মানুষ নবী-রাসূলদের মোজেজাকে সত্য বলে বিশ্বাস করেনি।
নবী-রাসূলদের মোজেজা ছিল সমসাময়িক যুগের অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এটা মহান আল্লাহরই কৌশলগত বিধান। যাদুবিদ্যা বা সম্মোহন ও ছলনাপূর্ণ নানা কৌশলের মাধ্যমে দৃশ্যতঃ যেসব অস্বাভাবিক বিষয় দেখানো হয়, মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনা সেরকম কৃত্রিম কোনো বিষয় নয়। মোজেজা প্রচলিত জ্ঞান ও ছলা-কলার এত উর্দ্ধে যে তার স্বরূপ মানুষের সিমীত জ্ঞান দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। আর এ জন্যই মোজেজা ও যাদুর মত কৃত্রিম বিষয়ের পার্থক্য খুব সহজেই জ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন, ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত সুদক্ষ যাদুকররা হযরত মূসা (আঃ)’র মোজেজা দেখেই বুঝতে পেরেছিল যে তা যাদু নয়, বরং মানুষের সাধ্যাতীত কোনো ঘটনা। তাই ওই যাদুকররা ফেরাউনের হত্যার হুমকি অগ্রাহ্য করে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং সিজদাবনত হয়। হযরত মূসা (আঃ)’র যুগে যাদু বিদ্যার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল বলে আল্লাহ তাঁকে ঐসব অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছিলেন।
হযরত ঈসা (আঃ)’র যুগে চিকিৎসা বিদ্যায় ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছিল। সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের চিকিৎসকরা কোনো কোনো দূরারোগ্য রোগের চিকিৎসা করতেন। তাই এ যুগে মহাপ্রজ্ঞা ও কৌশলের অধিকারী মহান আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে এমন ক্ষমতা দিয়েছিলেন যে তিনি তার বলে জন্মান্ধকে দৃষ্টি শক্তি দান করতে এবং দূরারোগ্য রোগ সারাতে ও এমনকি মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতে পারতেন । জাহেলি যুগে আরবরা পদ্য-সাহিত্য, বাগ্মীতা ও অলংকার শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেছিল। তাই মহান আল্লাহ মানুষের জন্য তাঁর নেয়ামত পরিপূর্ণ করার লক্ষ্যে শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র কাছে নাজেল করেন মহাগ্রন্থ কোরআন, যা বাগ্মীতা, ভাষা-শৈলী, সাহিত্য-মান ও আলংকারিক সৌন্দর্য্যে অনন্য। আরবরা কোরানের ছন্দময় ভাষার অলৌকিক সৌন্দর্য্য ও সুললিত ধ্বনি- মাধুর্যের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়।
ইবনে হিশাম এক ঐতিহাসিক ঘটনায় লিখেছেন, “এক রাতে আবু সুফিয়ান, আবু জেহেল ও আখনাস পরস্পরকে না জানিয়ে রাসূল (সাঃ)’র ঘরের কাছে এসে কোরআনের মধুর তেলাওয়াত শুনছিল। ফেরার পথে তারা একে অপরকে দেখে ফেলে এবং কোরআন তেলাওয়াত শোনার জন্য সবাই নিজেকে তিরস্কার করে। তারা আর রাসূল (সাঃ)’র ঘরের কাছে আসবে না বলেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। কিন্তু কোরআনের বিস্ময়কর আয়াত ও অলৌকিক আকর্ষণে পরের রাতে তারা আবারও পৃথকভাবে রাসূল (সাঃ)’র ঘরের কাছে এসে গোপনে কোরআনের আয়াতের মধুর আবৃত্তি শোনে। ফেরার পথে আবারও পরস্পরের সাথে সাক্ষাত ও লজ্জিত হওয়ার পালা। তৃতীয় রাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে ওই তিন কাফের নেতা আবারও পরস্পর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে, কোরআনের আয়াতের আবৃত্তি শোনার জন্য তারা নবী(সাঃ)’র ঘরের পাশে জড় হবে না। ”
মিশরিয় চিন্তাবিদ ডক্টর তাহা ইয়াসিন বলেছেন,” কোরআনের অলৌকিকতা এমন এক বিষয় যে মন সেদিকেই যায় এবং তাকে মেনে নেয়। আর কলম ও ভাষা এর বর্ণনা দিতে অক্ষম।”
পবিত্র কোরআন ছাড়াও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)’র আরো অনেক মোজেজা ছিল। যেমন, চাঁদ দ্বিখন্ডিত করা এবং তাঁর নির্দেশে পাথর-কনার আল্লাহর প্রশংসা ইত্যাদি। কিন্তু বিশ্বনবী (সাঃ)’র সবচেয়ে বড় ও চিরস্থায়ী মোজেজা হল পবিত্র কোরআন। তাঁর অন্য মোজেজাগুলো ছিল বিশেষ উপলক্ষ-ভিত্তিক ও অস্থায়ী। ভবিষ্যতের মানুষ ওইসব অস্থায়ী মোজেজা নিজ চোখে দেখতে সক্ষম নয়। আর সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন উদ্ধৃতি ও উক্তির মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায় বা সন্দেহ সৃষ্টি হয়। তাই যারা কাছ থেকে মোজেজা দেখেনি তাদের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে যেতেই পারে। তাই আল্লাহ শেষ নবী (সাঃ)’র জন্য ব্যবস্থা করেছেন চিরন্তন বা শাশ্বত মোজেজার।
পবিত্র কোরআন অতীতেও যেমন ছিল রাসূল(সাঃ)’র নবুওতের প্রমাণ, তেমনি তা বর্তমানে ও ভবিষ্যতেও এ বিষয়ে সুস্পষ্টতম প্রমাণ হিসেবে টিকে থাকবে। যতই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকশিত হবে ততই পবিত্র কোরআনের অলৌকিকতা বেশি স্পষ্ট হবে। মুসলমান বিশেষজ্ঞ বা আলেমরা পবিত্র কোরআনের অলৌকিকত্বের অনেক দিকের কথা বলেছেন। জালালউদ্দিন সিয়ুতির মতে, মোজেজা দুই ধরনের। ইন্দ্রিয়গাহ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক। অতীতের নবী-রাসূলদের মোজেজা ছিল ইন্দ্রিয়গাহ্য। যেহেতু বিশ্বনবী (সাঃ)কে গোটা মানব জাতির জন্য পথ প্রদর্শক হিসেবে পাঠানো হয়েছে তাই তাঁর মোজেজা হল চিরস্থায়ী ও বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আর এ মোজেজাই হল পবিত্র কোরআন।
ইমাম ফখরে রাজির মতে, ” ভাষার বিশুদ্ধ রীতি, কাঠামো ও সব ধরনের ত্রুটিহীনতা কোরআনের অলৌকিকতা।” ইবনে আতিয়ার মতে, ” সুশৃঙ্ক্ষল শব্দ ও অর্থের বাস্তবতা কোরআনের অলৌকিকতা”।
কোরআন মানুষের পরিপূর্ণতা ও সৌভাগ্য নিশ্চিত করে। বিশ্বখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, ” কোরআন জ্যামিতি বা গণিতের বই নয়, বরং এটা এমন কিছু বিধি-বিধানের সংকলন যা মানুষকে সঠিক পথ দেখায়, যে পথ নির্ধারণ ও বর্ণনা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দার্শনিকের পক্ষেও অসম্ভব। ” এই আসমানি মহাগ্রন্থ খুব কম সময়ের মধ্যে রক্তপিপাসু, বল্গাহারা, অজ্ঞ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরবদেরকে মূর্তি পূজা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, কুসংস্কার এবং নৈতিক অনাচারগুলোর নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছিল।
কোরআনের শিক্ষায় উজ্জীবিত আরব মুসলমানরা পৃথিবীকে অতি উন্নত সভ্যতা উপহার দিয়েছিল। এ সভ্যতা শত শত বছর ধরে বিশ্বে উন্নত সংস্কৃতি ও উন্নত নৈতিক গুণাবলীর আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানদের বীরত্ব, মহানুভবতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা ছিল কোরআনের শিক্ষারই প্রভাব। এভাবে কোরআনই জ্ঞান ও একত্ববাদ-ভিত্তিক ইসলামের সোনালী সভ্যতার ভিত্তি রচনা করেছে।
কোরআন তার অলৌকিকতার প্রমাণ হিসেবে মুহাম্মাদ (সাঃ)’র নিরক্ষরতার কথা উল্লেখ করেছে। মহানবী (সাঃ) নিজেও তা বার বার বলেছেন। অথচ তিনি মানব জাতির জন্য যে মহাগ্রন্থ উপহার দিয়েছেন তা জ্ঞান, প্রজ্ঞা, উচ্চতর শিক্ষা ও নৈতিক দিক-নির্দেশনার মত নানা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদে এতটা ভরপুর যে, পন্ডিত ও চিন্তাবিদরা বিস্ময়ে অভিভুত হন।
মহানবী (সাঃ) ছিলেন একজন নিরক্ষর , ইয়াতিম, দরিদ্র। অথচ পবিত্র কোরআন নাজেল হয়েছিল তাঁর কাছে। কোরআনও তার অলৌকিকতার প্রমাণ হিসেবে মুহাম্মাদ (সাঃ)’র নিরক্ষরতার কথা উল্লেখ করেছে। মহানবী (সাঃ) নিজেও তা বার বার বলেছেন। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোরআনের আয়াতগুলোকে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ও ভুল-ভ্রান্তি ছাড়াই হুবহু মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন।
বিশ্বনবী (সাঃ) কোনো মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেননি। তিনি হচ্ছেন এমন এক ফুল যাকে শিক্ষা ও পরিপূর্ণতা দিয়ে গড়ে তুলেছেন স্বয়ং বিশ্ব জগতের মালিক। রাসূল (সাঃ) কাগজ, কলম ও কালির সাথে পরিচিত ছিলেন না, কিন্তু কোরআনে কলম ও লেখনির শপথ দেখা যায়। তাঁর ওপর মহান আল্লাহর প্রথম যে বাক্যটি ওহি বা প্রত্যাদেশ হিসেবে নাজেল হয়েছিল তা হল, পড়। তিনি মানুষের জন্য জ্ঞানকে সবচেয়ে বড় সম্পদ বা নেয়ামত বলে মনে করতেন। মদিনায় ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার পর তিনি সবাইকে জ্ঞান অর্জনের জোর আহ্বান জানান।
কোন মানব-শিক্ষক মহানবী (সাঃ)কে কিছু শেখায়নি এবং তিনি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যাননি, কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্বনবী (সাঃ) মানব জাতির শিক্ষকে পরিণত হয়েছেন এবং তিনি হয়েছেন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাকেন্দ্রের উৎস।
বিশ্বনবী (সাঃ)’র পবিত্র আহতে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আঃ) অন্য ঐশী ধর্মের আলেমদের সাথে এক বিতর্কে বলেছিলেন, মুহাম্মাদ (সাঃ)’র নবী হওয়ার অন্যতম প্রমাণ হল, তিনি ছিলেন ইয়াতিম, নিঃস্ব ও রাখাল। তিনি কোনো বই পড়েননি এবং কোনো শিক্ষকের কাছে যাননি । অথচ তিনি এমন এক বই এনেছেন যাতে রয়েছে অতীতের নবীদের ইতিহাস এবং অতীত ও ভবিষ্যতের অনেক তথ্য। ”
একজন নিরক্ষর ব্যক্তির মুখ দিয়ে উচ্চারিত কোরআনে সৃষ্টির উৎস, পরকাল, মানুষ, নৈতিকতা, বিধি-বিধান ও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অসাধারণ সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষার বর্ণনা রয়েছে। সুরা জুমআর দ্বিতীয় আয়াতে এসেছে, “তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ,তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত।”
সুরা ইউনুসের ১৬ নম্বর আয়াতেও বলা হয়েছে : “বলে দাও, যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে আমি এটি তোমাদের সামনে পড়তাম না, আর তিনি তোমাদেরেকে অবহিত করতেন না এ সম্পর্কে। কারণ আমি তোমাদের মাঝে ইতিপূর্বেও একটা বয়স অতিবাহিত করেছি। তারপরেও কি তোমরা চিন্তা করবে না?”
বাস্তবতা সম্পর্কে অনবহিত কেউ কেউ বিশ্বনবী (সাঃ)’র নিরক্ষরতার বিষয়টি অস্বীকার করেন। কিন্তু ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসূল (সাঃ) যদি নিরক্ষর না হতেন তাহলে জ্ঞান শেখার জন্য অন্যদের কাছে যেতেন । এভাবে তাঁর চিন্তাধারার ওপর সমসাময়িক যুগের চিন্তাবিদদের প্রভাব পড়ত। কিন্তু বিশ্বনবী (সাঃ) মানুষের কাছে যেসব চিন্তাধারা ও আদর্শ তুলে ধরেছেন সেসবের সাথে সেই জাহেলি যুগের মানুষের চিন্তাধারার কোনো মিল ছিল না, বরং সেসবই ছিল জাহেলি যুগের প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধারা বা রীতি-নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত।
মহানবী (সাঃ)’র যুগের বিপুল সংখ্যক মানুষ ছিল মূর্তি পূজারী ও কুসংস্কারে বিশ্বাসী। কেউ কেউ তাওরাত ও ইঞ্জিল থেকে জ্ঞান এবং বিধি-বিধান খুঁজত। বিশ্বনবী (সাঃ) যদি সমসাময়িক জ্ঞানীদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করতেন তাহলে প্রচলিত চিন্তাধারায় প্রভাবিত হতেন। ফলে বিকৃত হয়ে যাওয়া তাওরাত ও ইঞ্জিল এবং পবিত্র কোরআনের মধ্যে মোটামুটি মিল দেখা যেত। কিন্তু পবিত্র কোরআন অন্য ধর্মগুলোর কুসংস্কার ও হেঁয়ালী বা কাল্পনিক চিন্তাধারার কঠোর বিরোধিতা করেছে।
কোরআনের বিজ্ঞানসম্মত বক্তব্য, বুদ্ধিবৃত্তিক তথ্য ও ঐশী বাস্তবতাগুলো এ মহান গ্রন্থকে তৎকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করেছে।
মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ নবীকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখতে চেয়েছেন বলেই মহানবী (সাঃ) সব ধরণের মানব-রচিত মতাদর্শ বা তন্ত্র-মন্ত্রের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন। এমনকি তিনি বাবা মায়ের সাহচর্য ও তাদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। শৈশব থেকেই জাহেলি যুগের শিক্ষা-সংস্কৃতির ছোঁয়া বা স্পর্শ ছাড়াই অনেক দূরে মরুর বুকে বড় হয়েছেন বিশ্বনবী (সাঃ)। ফলে ওহি বা ঐশী প্রত্যাদেশ ধারণের ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর মধ্যে।
আর এ অবস্থায় একদিন হেরা পর্বতের গুহায় বিশ্বনবী (সাঃ)’র কাজে নাজেল হয় ঐশী প্রত্যাদেশ এবং তাঁর পবিত্র কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে সত্যের বাণী। এটা ছিল এক অলৌকিক বিপ্লব। তাঁর কাছে মহান আল্লাহর বাণী বা কোরআন ২৩ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে নাজেল হয়েছে ।
বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন বলেছেন, “বিশ্বনবী (সাঃ) ছিলেন নিরক্ষর। কিন্তু এই নিরক্ষরতা তাঁর জন্য পরিপূর্ণতা হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ, তিনি জ্ঞান অর্জন করেছেন মহান আল্লাহর প্রত্যাদেশ বা ওহির মাধ্যমে। অথচ আমাদের জন্য নিরক্ষর হওয়া এক ধরণের ত্রুটি। কারণ, আমাদের নিরক্ষরতা অজ্ঞতার সমতুল্য।”
প্রাচ্যবিদসহ গবেষকরা বিশ্বনবী (সাঃ)’র জীবনে পড়া-লেখার ক্ষুদ্রতম অভিজ্ঞতার আভাসও খুঁজে পাননি। তারা সবাইই স্বীকার করেছেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) নিরক্ষর ছিলেন এবং সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জাতির সদস্য হয়েও তিনি এমন এক বই এনেছেন যাতে রয়েছে সৃষ্টি জগতের, গ্রহ-নক্ষত্রের এবং আকাশ ও ভূ-মন্ডলের অনেক অজানা তথ্য ও নানা রহস্যের ভান্ডার।
ফরাসি প্রাচ্যবিদ “কুসিন ডি পার্সিভাল” বলেছেন, ” মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিগুলো হতচকিত হয়ে যায় এটা ভেবে যে কিভাবে একজন নিরক্ষর মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে এত প্রজ্ঞা ও জ্ঞানপূর্ণ স্পষ্ট বাক্য। ”
” সভ্যতার ইতিহাস” শীর্ষক বইয়ে উইল ডুরান্ট লিখেছেন, “সে যুগে আরবদের মধ্যে লেখা পড়ার কোনো গুরুত্ব ছিল না। তাই গোটা কোরাইশ গোত্রের মধ্যে লিখতে ও পড়তে সক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭ জন। নবী হওয়ার পর মুহাম্মদ (সাঃ) বিশেষ বইয়ের অধিকারী হন। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও আরবী ভাষার সবচেয়ে বিখ্যাত ও বাগ্মীতাপূর্ণ বই তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হল এবং তিনি যে কোনো জটিল বা সূক্ষ্ম বিষয়েও সমস্ত শিক্ষিত লোকদের চেয়েও বেশি জ্ঞান রাখতেন। ” রোমানিয়ার গবেষক কনস্টান ভার্জিল গিউরগিভ ” পয়গাম্বর মুহাম্মদ(সঃ)-কে আবারও নতুন করে জানতে হবে” শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, “নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও মুহাম্মদ(সঃ)’র ওপর প্রথম যে আয়াত নাজেল হয়েছিল তাতে কলম ও জ্ঞানের কথা রয়েছে। অর্থাৎ লেখা, জ্ঞান শেখা ও অন্যকে জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্য কোনো ধর্মেই জ্ঞানের ওপর এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমন কোনো ধর্ম পাওয়া যায় না যে ধর্মের সূচনাতেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মুহাম্মদ(সঃ) যদি একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হতেন তাহলে হেরা গুহায় তাঁর কাছে এই আয়াত নাজেল হওয়ার কারণে কেউই বিস্মিত হত না। কারণ, প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিই স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞানের গুরুত্ব বোঝেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নিরক্ষর এবং কোনো শিক্ষকের কাছেই তিনি পড়াশুনা করেননি। ইসলাম ধর্মে জ্ঞান অর্জনকে এত ব্যাপক গুরুত্ব দেয়ার কারণে আমি মুসলমানদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।”
মহানবী (সাঃ) ছিলেন একজন নিরক্ষর , ইয়াতিম ও দরিদ্র। অথচ পবিত্র কোরআন নাজেল হয়েছিল তাঁর কাছে। কোরআনও তার অলৌকিকতার প্রমাণ হিসেবে মুহাম্মাদ (সাঃ)’র নিরক্ষরতার কথা উল্লেখ করেছে। মহানবী (সাঃ) নিজেও তা বার বার বলেছেন। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোরআনের আয়াতগুলোকে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ও ভুল-ভ্রান্তি ছাড়াই হুবহু মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন।
বিশ্বনবী (সাঃ) কোনো মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেননি। তিনি হচ্ছেন এমন এক ফুল যাকে শিক্ষা ও পরিপূর্ণতা দিয়ে গড়ে তুলেছেন স্বয়ং বিশ্ব জগতের মালিক। রাসূল (সাঃ) কাগজ, কলম ও কালির সাথে পরিচিত ছিলেন না, কিন্তু কোরআনে কলম ও লেখনির শপথ দেখা যায়। তাঁর ওপর মহান আল্লাহর প্রথম যে বাক্যটি ওহি বা প্রত্যাদেশ হিসেবে নাজেল হয়েছিল তা হল, পড়। তিনি মানুষের জন্য জ্ঞানকে সবচেয়ে বড় সম্পদ বা নেয়ামত বলে মনে করতেন। মদিনায় ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার পর তিনি সবাইকে জ্ঞান অর্জনের জোর আহ্বান জানান।
কোন মানব-শিক্ষক মহানবী (সাঃ)কে কিছু শেখায়নি এবং তিনি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যাননি, কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্বনবী (সাঃ) মানব জাতির শিক্ষকে পরিণত হয়েছেন এবং তিনি হয়েছেন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাকেন্দ্রের উৎস।
বিশ্বনবী (সাঃ)’র পবিত্র আহতে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আঃ) অন্য ঐশী ধর্মের আলেমদের সাথে এক বিতর্কে বলেছিলেন, “মুহাম্মাদ (সাঃ)’র নবী হওয়ার অন্যতম প্রমাণ হল, তিনি ছিলেন ইয়াতিম, নিঃস্ব ও রাখাল। তিনি কোনো বই পড়েননি এবং কোনো শিক্ষকের কাছে যাননি । অথচ তিনি এমন এক বই এনেছেন যাতে রয়েছে অতীতের নবীদের ইতিহাস এবং অতীত ও ভবিষ্যতের অনেক তথ্য।”
একজন নিরক্ষর ব্যক্তির মুখ দিয়ে উচ্চারিত কোরআনে সৃষ্টির উৎস, পরকাল, মানুষ, নৈতিকতা, বিধি-বিধান ও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অসাধারণ সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষার বর্ণনা রয়েছে। সূরা জুমআর দ্বিতীয় আয়াতে এসেছে, “তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ,তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত।”
সূরা ইউনুসের ১৬ নম্বর আয়াতেও বলা হয়েছে : “বলে দাও, যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে আমি এটি তোমাদের সামনে পড়তাম না, আর তিনি তোমাদেরেকে অবহিত করতেন না এ সম্পর্কে। কারণ আমি তোমাদের মাঝে ইতিপূর্বেও একটা বয়স অতিবাহিত করেছি। তারপরেও কি তোমরা চিন্তা করবে না?”
বাস্তবতা সম্পর্কে অনবহিত কেউ কেউ বিশ্বনবী (সাঃ)’র নিরক্ষরতার বিষয়টি অস্বীকার করেন। কিন্তু ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসূল (সাঃ) যদি নিরক্ষর না হতেন তাহলে জ্ঞান শেখার জন্য অন্যদের কাছে যেতেন । এভাবে তাঁর চিন্তাধারার ওপর সমসাময়িক যুগের চিন্তাবিদদের প্রভাব পড়ত। কিন্তু বিশ্বনবী (সাঃ) মানুষের কাছে যেসব চিন্তাধারা ও আদর্শ তুলে ধরেছেন সেসবের সাথে সেই জাহেলি যুগের মানুষের চিন্তাধারার কোনো মিল ছিল না, বরং সেসবই ছিল জাহেলি যুগের প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধারা বা রীতি-নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। মহানবী (সাঃ)’র যুগের বিপুল সংখ্যক মানুষ ছিল মূর্তি পূজারী ও কুসংস্কারে বিশ্বাসী। কেউ কেউ তাওরাত ও ইঞ্জিল থেকে জ্ঞান এবং বিধি-বিধান খুঁজত। বিশ্বনবী (সাঃ) যদি সমসাময়িক জ্ঞানীদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করতেন তাহলে প্রচলিত চিন্তাধারায় প্রভাবিত হতেন। ফলে বিকৃত হয়ে যাওয়া তাওরাত ও ইঞ্জিল এবং পবিত্র কোরআনের মধ্যে মোটামুটি মিল দেখা যেত। কিন্তু পবিত্র কোরআন অন্য ধর্মগুলোর কুসংস্কার ও হেঁয়ালী বা কাল্পনিক চিন্তাধারার কঠোর বিরোধিতা করেছে।
কোরআনের বিজ্ঞানসম্মত বক্তব্য, বুদ্ধিবৃত্তিক তথ্য ও ঐশী বাস্তবতাগুলো এ মহান গ্রন্থকে তৎকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করেছে।
মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ নবীকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখতে চেয়েছেন বলেই মহানবী (সাঃ) সব ধরনের মানব-রচিত মতাদর্শ বা তন্ত্র-মন্ত্রের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন। এমনকি তিনি বাবা মায়ের সাহচর্য ও তাদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। শৈশব থেকেই জাহেলি যুগের শিক্ষা-সংস্কৃতির ছোঁয়া বা স্পর্শ ছাড়াই অনেক দূরে মরুর বুকে বড় হয়েছেন বিশ্বনবী (সাঃ)। ফলে ওহি বা ঐশী প্রত্যাদেশ ধারণের ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর মধ্যে।
আর এ অবস্থায় একদিন হেরা পর্বতের গুহায় বিশ্বনবী (সাঃ)’র কাজে নাজেল হয় ঐশী প্রত্যাদেশ এবং তাঁর পবিত্র কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে সত্যের বাণী। এটা ছিল এক অলৌকিক বিপ্লব। তাঁর কাছে মহান আল্লাহর বাণী বা কোরআন ২৩ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে নাজেল হয়েছে ।
বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন বলেছেন, “বিশ্বনবী (সাঃ) ছিলেন নিরক্ষর। কিন্তু এই নিরক্ষরতা তাঁর জন্য পরিপূর্ণতা হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ, তিনি জ্ঞান অর্জন করেছেন মহান আল্লাহর প্রত্যাদেশ বা ওহির মাধ্যমে। অথচ আমাদের জন্য নিরক্ষর হওয়া এক ধরনের ত্রুটি। কারণ, আমাদের নিরক্ষরতা অজ্ঞতার সমতুল্য।”
প্রাচ্যবিদসহ গবেষকরা বিশ্বনবী (সাঃ)’র জীবনে পড়া-লেখার ক্ষুদ্রতম অভিজ্ঞতার আভাসও খুঁজে পাননি। তারা সবাইই স্বীকার করেছেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) নিরক্ষর ছিলেন এবং সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জাতির সদস্য হয়েও তিনি এমন এক বই এনেছেন যাতে রয়েছে সৃষ্টি জগতের, গ্রহ-নক্ষত্রের এবং আকাশ ও ভূ-মন্ডলের অনেক অজানা তথ্য ও নানা রহস্যের ভাণ্ডার।
ফরাসি প্রাচ্যবিদ “কুসিন ডি পার্সিভাল” বলেছেন, ” মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিগুলো হতচকিত হয়ে যায় এটা ভেবে যে কিভাবে একজন নিরক্ষর মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে এত প্রজ্ঞা ও জ্ঞানপূর্ণ স্পষ্ট বাক্য। ”
” সভ্যতার ইতিহাস” শীর্ষক বইয়ে উইল ডুরান্ট লিখেছেন, “সে যুগে আরবদের মধ্যে লেখা পড়ার কোনো গুরুত্ব ছিল না। তাই গোটা কোরাইশ গোত্রের মধ্যে লিখতে ও পড়তে সক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭ জন। নবী হওয়ার পর মুহাম্মদ (সাঃ) বিশেষ বইয়ের অধিকারী হন। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও আরবী ভাষার সবচেয়ে বিখ্যাত ও বাগ্মীতাপূর্ণ বই তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হল এবং তিনি যে কোনো জটিল বা সূক্ষ্ম বিষয়েও সমস্ত শিক্ষিত লোকদের চেয়েও বেশি জ্ঞান রাখতেন। “
রোমানিয়ার গবেষক কনস্টান ভার্জিল গিউরগিভ “পয়গাম্বর মুহাম্মদ(সঃ)-কে আবারও নতুন করে জানতে হবে” শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, “নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও মুহাম্মদ(সঃ)’র ওপর প্রথম যে আয়াত নাজেল হয়েছিল তাতে কলম ও জ্ঞানের কথা রয়েছে। অর্থাৎ লেখা, জ্ঞান শেখা ও অন্যকে জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্য কোনো ধর্মেই জ্ঞানের ওপর এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমন কোনো ধর্ম পাওয়া যায় না যে ধর্মের সূচনাতেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মুহাম্মদ(সঃ) যদি একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হতেন তাহলে হেরা গুহায় তাঁর কাছে এই আয়াত নাজেল হওয়ার কারণে কেউই বিস্মিত হত না। কারণ, প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিই স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞানের গুরুত্ব বোঝেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নিরক্ষর এবং কোনো শিক্ষকের কাছেই তিনি পড়াশুনা করেননি। ইসলাম ধর্মে জ্ঞান অর্জনকে এত ব্যাপক গুরুত্ব দেয়ার কারণে আমি মুসলমানদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।”
মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও মানবতাকে বিকশিত করতে কোরআন নাজেল হয়েছিল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র পবিত্র অন্তরে। ইসলাম প কোরআনেরই উপহার। মানুষের চিরন্তন মুক্তি ও সৌভাগ্যের দিক-নির্দেশক মহাগ্রন্থ কোরআন সবচেয়ে মূল্যবান এবং দীর্ঘস্থায়ী আধ্যাত্মিক গ্রন্থ। ঐতিহাসিকরা একবাক্যে তা স্বীকার করে গেছেন। কোরআনের অন্যতম অলৌকিক দিক হল এর বক্তব্যগুলোর মধ্যে সঙ্গতি, সমন্বয়, ছন্দময়তা ও অলংকারসমৃদ্ধতা।
নতুন বিশ্বাস ও জ্ঞান বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের ধারণাকে বদলে দেয়ার পাশাপাশি অতীতের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দেখা দেয়। বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের চিন্তাধারা, লেখনি, ভাষণ ও বক্তব্য প্রায়ই বদলে যায় এবং অনেক সময় অতীতের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। তাই মানুষের কোনো রচনাই ত্রুটিমুক্ত নয়।
পবিত্র কোরআন বিজ্ঞান বা দর্শনের কোনো বই নয়। অথচ দর্শন ও বিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সত্য ও বাস্তব তথ্য রয়েছে এ মহাগ্রন্থে। মানুষের চিরন্তন মুক্তি ও সৌভাগ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ দিক-নির্দেশক হিসেবে কোরআন মানুষের জীবনের অনেক সূক্ষ্ম দিক ও বড় দিকের স্পষ্ট নীতিমালা তুলে ধরেছে। অথচ পরস্পর বিরোধী দুটি বাক্য বা সাংঘর্ষিক কোনো কথা এতে নেই। বিশ্বনবী (সাঃ)’র জীবনের নানা ঘটনা ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ২৩ বছরে পর্যায়ক্রমে নাজেল হয়েছে এ মহাগ্রন্থ। কখনও একটি প্রশ্নের জবাব কিংবা কখনও খোদায়ি কোনো বিধান ব্যাখ্যা করার জন্য, কখনওবা বিশেষ কোনো সমস্যার সমাধান অথবা কোনো সন্দেহ দূর করার জন্য বিশেষ সূরা বা আয়াত নাজেল হত। দীর্ঘ ২৩ বছরে ক্রমান্বয়ে ও বিচ্ছিন্নভাবে নাজেল হওয়া সত্ত্বেও পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলোর মধ্যে নেই সমন্বয়হীনতা বা সঙ্গতিহীনতা ও ছন্দ-পতন।
পবিত্র কোরআনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়েও দিক-নির্দেশনা রয়েছে। পরিবার, নারীর অধিকার, হিজাব বা পর্দা এবং চারিত্রিত পবিত্রতা সম্পর্ক বিধান দিয়েছে এ মহাগ্রন্থ। ঈমানদারদের পারস্পরিক আচরণ এবং নিজ সমাজের বাইরের অন্যদের সাথে আচরণ সম্পর্কেও পথের দিশা দেয় সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ আলকোরআন। এ মহাগ্রন্থ কখনও মানুষের সৌভাগ্যের ক্ষেত্রে নবী-রাসুলদের ভূমিকার কথা বলে, আবার কখনও শির্ক বা অংশীবাদিতার প্রভাব সম্পর্কে কথা বলে। বিশ্ব জগত, আকাশ ও তারকারাজি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা কোরআনে বিশেষভাবে গুরুত্ব বা ঔজ্জ্বল্য পেয়েছে। বৃষ্টি, বাতাস, মেঘ, সাগর, পশু-পাখি, উদ্ভিত, লতা-পাতা – এসবই মহান আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি ও আল্লাহর নেয়ামত। পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে সামাজিক ও রাজনৈতিক চুক্তি এবং যুদ্ধ ও সন্ধির নানা শর্ত সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা রয়েছে। কখনও বা কয়েকটি সূরার মধ্যে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা এসেছে। কোনো কোনো ঘটনার বর্ণনার পুনরাবৃত্তি থাকলেও সেসবের মধ্যে কোনো অসঙ্গতি বা বৈপরীত্য নেই। যেমন, হযরত মূসা (আঃ)’র ঘটনা কোরআনের বেশ কয়েকটি সূরায় এসেছে। ঘটনা এক হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যেক সূরায় রয়েছে স্বতন্ত্র বার্তা ও আলাদা গুণ।
কোরআন সব সময়ই প্রজ্ঞা ও চিন্তা-ভাবনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। চিন্তা-ভাবনা না করার পরিণতি সম্পর্কে বার বার সতর্ক করেছে কোরআনে।
কোরআনের নানা বৈশিষ্ট্য থেকে এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট, এ গ্রন্থ কোনো মানুষের রচনা নয়। কারণ, মানুষের রচনার মত এতে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য, অসঙ্গতি, সমন্বয়হীনতা ও কোনো মানবীয় ভুল-ত্রুটি নেই। কোরআনের এ অলৌকিকতা ও অনন্য বৈশিষ্ট্য যুগে যুগে প্রমাণিত হয়েছে। সূরা নিসার ৮২ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা কি কোরআন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা কর না? যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে নাজেল হত তাহলে অনেক মতপ্রার্থক্য দেখতে পেতে।”
কোরআনের অলৌকিকত্বের আরেকটি বড় দিক হল, এর বাক্য ও শব্দগুলোর শ্রুতিমধুর ছন্দময়তা এবং আলংকারিক সৌন্দর্য। আরব সাহিত্য-বিশারদ ও ভাষাবিদরা যুগে যুগে এটা স্বীকার করেছেন যে কোরআনের সাহিত্য মান, ছন্দশৈলী ও ভাষার সৌন্দর্য এবং মাধুর্য কোনো মানুষের কাজ নয়, বরং তা মানুষের সাধ্যাতীত। আবু জাহেল যখন সে যুগের শ্রেষ্ঠ আরব ভাষাবিদ ও বাগ্মী ওয়ালিদ বিন মুগিরা’র কাছে কোরআন সম্পর্কে তার মত জানতে চেয়েছিল তখন সে বলেছিল, “কোরআন সম্পর্কে আমি আর কী বলব? আল্লাহর শপথ করে বলছি, তোমাদের মধ্যে কেউ আরবী কবিতা ও কাসিদায় আমার মত জ্ঞান রাখ না। অলংকার শাস্ত্র, ছন্দ-বিদ্যা ও কবিতার ভাষা শৈলী বা কবিতার নানা শিল্প সম্পর্কে তোমরা কেউ আমার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারবে না। কিন্তু আল্লাহর শপথ করে বলছি, মুহাম্মদ যা বলছে, তার কোনো তুলনা নেই। কোরআনে ভাষা এমন সুমিষ্ট যে তা অন্য যে কোনো বাগ্মীতাপূর্ণ বক্তব্যের মিষ্টতাকে তুচ্ছ করে দেয়। কোরআনের বক্তব্য নতুন, দৃঢ়-ভিত্তিপূর্ণ, ব্যাপক ফলদায়ক ও নজিরবিহীন এবং তা সব বক্তব্যের চেয়ে উন্নত। কোরআনের চেয়ে উন্নত বক্তব্যের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না।” (তাফসিরে তাবারি )
পবিত্র কোরআনের শব্দ ও বাক্যের ছন্দময়তা এবং হৃদয় কেড়ে নেয়া ধ্বনি-মাধুর্য বা শ্রুতিমধুরতা মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত বা উদ্দীপ্ত করে। বৃটিশ চিন্তাবিদ কারবুলড (গ্যারিবাল্ড?) যখন প্রথম বার পবিত্র কোরআনের আবৃত্তি শোনেন তখন তার মধ্যে যে আবেগ বা প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল সে প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “রাতের প্রথম প্রহরে জেগে থাকা অবস্থায় হৃদয় নাড়া দেয়া মধুর ধ্বনি শুনলাম। এ ধ্বনি ছিল ইসলামের আহ্বান এবং সত্যে পরিপূর্ণ কোরআনের মধুর আয়াত। এ ধ্বনি আমাকে বাস্তবতার গভীরে নিয়ে গেল। চোখ দুটি বন্ধ করে নিজেকে মহান স্রষ্টার প্রাণ-সঞ্চারক ধ্বনির কাছে সমর্পণ করলাম- মনে মনে বললাম, এ ধ্বনি যেখানে খুশি নিয়ে যাক আমাকে।”
মহান আল্লাহ সূরা বনি ইসরাইলের ১০৬, থেকে ১০৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “তোমরা কোরআনকে মান্য কর অথবা অমান্য কর; যারা অতীতে জ্ঞান পেয়েছে, তাদের কাছে এর তেলাওয়াত করা হলে তারা নতমস্তকে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলেঃ আমাদের পালনকর্তা পবিত্র, মহান। নিঃসন্দেহে আমাদের পালকর্তার ওয়াদা অবশ্যই পূর্ণ হবে। তারা ক্রন্দন করতে করতে নতমস্তকে ভুমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয়ভাব আরো বৃদ্ধি পায়।” পবিত্র কোরআনের বাক্য, শব্দ ও অর্থের সঙ্গতি এবং সমন্বয় ব্রিটিশ চিন্তাবিদ কারবুলডকে অভিভুত করেছে। তিনি বলেছেন, “মহান আল্লাহর রহমত, সুসংবাদ ও দয়া সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতের ভাষা ও শব্দগুলো এমনই যে তা পাঠকের মধ্যে এসব বিষয়ের অকৃত্রিম ভাবই তুলে ধরে, ফলে পাঠকরা আত্মহারা হয়ে পড়েন। অন্যদিকে মানুষের বিচ্যুতি ও ভুলের পরিণতি সম্পর্কে এ মহাগ্রন্থের সতর্কবাণীতে ব্যবহৃত শব্দ ও ভাষা বেশ কঠিন এবং জোরালো। এভাবে কোরআনের বাহ্যিক কাঠামো ও অর্থের সমন্বয় এ মহাগ্রন্থকে করেছে অনন্য। এ ছাড়াও কোরআনের সুন্দর, মানানসই বাক্য ও শব্দ, অকাট্য যুক্তি, উপমার অভিনবত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্বের আরো হাজার হাজার দিক ঐশী এ গ্রন্থকে দান করেছে বাগ্মীতা ও সাহিত্যের শীর্ষ স্থান।”
পবিত্র কোরআন চিরন্তন অলৌকিকতার এবং ইসলাম ধর্মের সত্যতার নিদর্শন। মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে সব যুগের জ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা কোরআনের বিচিত্রময় তথ্য সম্ভার, ভবিষ্যদ্বাণী এবং এর বাগ্মীতা, ভাষাশৈলী বা সাহিত্যমানকে অলৌকিক বলে উল্লেখ করেছেন। আরবী শব্দ ও বাক্য প্রকরণ, ছন্দ প্রকরণ ও অর্থবিদ্যাসহ আরবী ব্যকরণের নানা দিক ব্যাপক মাত্রায় এ মহাগ্রন্থের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছে। কোরআনের ভাষা-শিল্প নিয়ে অনেক বই রচিত হয়েছে। তবে মানুষের জন্য কোরআনের সবচেয়ে বড় উপহার হল, মানুষের পথের দিশা ও তার চিন্তাগত পরিপক্কতার জন্য সহায়ক বাস্তবতাগুলোকে সবচেয়ে সুন্দর ভাষায় তুলে ধরেছে এ মহাগ্রন্থ। মহান আল্লাহ নিজেই কোরআনের সূরা জুমারের ২৩ নম্বর আয়াতে কোরআনের বক্তব্যকে “আহসানুল হাদীস”বা “সবচেয়ে সুন্দর ও উত্তম বাণী” বলে উল্লেখ করেছেন। ওই আয়াতের পুরো বাক্যটি এ রকম: “আল্লাহ সর্বোত্তম ( ও সবচেয়ে সুন্দর ) বাণী তথা কিতাব নাযিল করেছেন, যা (সূক্ষ্মতা, কোমলতা, সৌন্দর্য ও বিষয়বস্তুর মত বিভিন্ন দিকে) সামঞ্জস্যপূর্ণ, বার বার উচ্চারিত। এতে তাদের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে চামড়ার উপর, যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে, এরপর তাদের চামড়া ও অন্তর আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়।” মহান আল্লাহ সূরা ইসরা’র ১০৭ ও ১০৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “যারা এর পূর্ব থেকে জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছে, যখন তাদের কাছে এর তেলাওয়াত করা হয়,তখন তারা নতমস্তকে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে।… তারা কাঁদতে কাঁদতে নতমস্তকে ভুমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয়ভাব আরো বৃদ্ধি পায়।” পবিত্র কোরআনের সূরা মায়েদার ৮৩ নম্বর আয়াতে একদল খৃস্টান সম্পর্কে বলা হয়েছে, “আর তারা রসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা যখন শুনে, তখন আপনি তাদের চোখ অশ্রু সজল দেখতে পাবেন; এ কারণে যে, তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে।”
কোরআনের ভাষা খুবই প্রাঞ্জল, সাবলিল, মানানসই, কার্যকর, অলঙ্কারপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক। একইসঙ্গে পরিপূর্ণ ও স্পষ্ট ভাব প্রকাশেও এর জুড়ি নেই। ইসলামের আবির্ভাবের সমসাময়িক যুগে আরবরা ছিল বাগ্মীতা ও অলঙ্কারপূর্ণ বক্তব্যের অনুরাগী। তাই কোরআনের ভাষা তাদের কাছে ছিল অন্তহীন আকর্ষণ ও মহাবিস্ময়ের উৎস। গদ্য ও পদ্যের মাঝামাঝি বাকরীতি অথচ এ দুয়েরই নানা দূর্বলতা থেকে মুক্ত কোরআন যে ঐশী গ্রন্থ সে বিষয়ে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। জাহেলি যুগের আরবরা উন্নত ভাষাশৈলী ও সাহিত্যের সূক্ষ্ম দিক সম্পর্কে দক্ষ হলেও তারা বিজ্ঞান, নৈতিক জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানত না। কোরআন নৈতিক ও চিন্তাগত বিষয়ে অকাট্য যুক্তি ও চিত্তাকর্ষক বর্ণনা তুলে ধরে অজ্ঞতার যুগের অসার চিন্তাধারাগুলোকে চুরমার করে দিয়েছে। এ অবস্থায় কোরআনের ধারা অনুসরণ করে চিত্তাকর্ষক বক্তব্য রচনা করা সমসাময়িক যুগের আরব পন্ডিতদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু হিজরী তৃতীয় শতকে আরবী ” বালাগাত” বা অলংকার শাস্ত্র গড়ে ওঠায় জাহেজ, তাবারসি ও ফাখরে রাজির মত একদল মুসলিম মনিষী পবিত্র কোরআনের বাগ্মীতা ও প্রাঞ্জলতার মানদন্ডকে অন্য বাকরীতির ধারা থেকে আলাদাভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন। এভাবে কোরআনের সাহিত্য-মানের অলৌকিকত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সবার কাছে স্পষ্ট হয়।
ভাষাশৈলী, প্রাঞ্জলতা ও অর্থের গভীরতার দিক থেকে পবিত্র কোরআনের অলৌকিকত্ব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ইবনে আতিয়া বলেছেন, ” যখনই কোরআনের কোনো শব্দের পরিবর্তে অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করতে চেয়েছি এবং এ জন্য আরবী ভাষার পুরো শব্দ জগতে উপযুক্ত কোন শব্দের সন্ধান করেছি তখনই কোরআনের ওই শব্দের চেয়ে ভাল বা মানানসই কোনো শব্দ কখনও খুঁজে পাইনি।” পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদরাও পবিত্র কোরআনের এই বৈশিষ্ট্যের কথা স্বীকার করেছেন। বৃটিশ চিন্তাবিদ টমাস কার্লাইল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ” কোরআন যে ঐশী গ্রন্থ তা মনে না রেখেও বলা যায়, কোরআনের শব্দ চয়ন ও শব্দ বিন্যাস পরিপক্কতা বা পরিপূর্ণতার শীর্ষে রয়েছে। এ গ্রন্থ মূল মহাসত্য ও উচ্চতম এবং পবিত্র উৎসের সাথে যুক্ত। কোরআনের এ বৈশিষ্ট্যের বিষয়টি এমন যে পৃথিবীর সব বই এর কাছে তুচ্ছ এবং এ মহাগ্রন্থ অপছন্দনীয় সব মত বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত ও পবিত্র।”
ফরাসি চিন্তাবিদ ডারমিংহাম লিখেছেন, “কোরআন মোহাম্মদের অনন্য মোজেজা বা অলৌকিক নিদর্শন। এর উচ্চতর সাহিত্য মান ও সৌন্দর্য এবং আলোকোজ্জ্বল শক্তি আজো অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে বিরাজ করছে।”
পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলোর অর্থের সঙ্গতি এ মহাগ্রন্থের আরেকটি অনন্য সৌন্দর্য। কোরআনের সূরা ও আয়াতগুলো একই সময়ে ও একই স্থানে নাজেল হয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে নানা উপলক্ষ্যে ও ঘটনার প্রেক্ষাপটে মহানবী (সাঃ)’র ওপর নাজেল হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর সূরা ও আয়াতগুলোর অর্থ এবং লক্ষ্যের সঙ্গতি বিস্ময়কর। আধুনিক যুগের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোরআনের প্রত্যেক সূরার রয়েছে স্বতন্ত্র এবং কিছু অভিন্ন লক্ষ্য। সূরাগুলোর কাঠামোও ভিন্ন ধরনের। এসব সূরা চিত্তাকর্ষক ভূমিকার মাধ্যমে শুরু হয় এবং এরপর উচ্চতর লক্ষ্যগুলো তুলে ধরে। কখনওবা সেগুলো একটি সংক্ষিপ্ত উপসংহারের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। মিশরীয় গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেছেন, ” বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে কোরআনের আয়াতগুলো নাজেল হওয়া সত্ত্বেও পুরো গ্রন্থের যৌক্তিক ঐকতান ও ভাষাগত ঐক্য বজায় রয়েছে। আর এটাই কোরআনের মোজেজা বা অলৌকিকতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন।”
অভিনব নানা দিক ও সূক্ষ্ম ভাব তুলে ধরার ক্ষেত্রে কোরআনের ভাষাশৈলী খুবই যথাযথ এবং অনন্য। কোরআনের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত, তুলনা, উপমা বা রূপক প্রভৃতি অত্যন্ত অসাধারণ এবং আরবী সাহিত্যের দিক থেকে প্রচলিত রীতিসিদ্ধ। কিন্তু কোরআনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সেগুলোর প্রয়োগ বিস্ময়করভাবে নিখুঁত ও যথাযথ হয়েছে।
কোরআনের দৃষ্টান্ত, তুলনা ও রূপক বা চিত্রকল্পগুলোর শৈল্পিক মান আরবী সাহিত্যে নজিরবিহীন। প্রখ্যাত আরবী সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ ইবনে আসির এ প্রসঙ্গে সূরা নাবার দশ নম্বর আয়াতের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। এ আয়াতে রাতকে পোশাকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। ইবনে আসির বলেছেন, রাতের অন্ধকার মানুষকে অন্যদের দৃষ্টি থেকে ও শত্রুদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে এবং শত্রুর অনিষ্টতা থেকে বাঁচার জন্য মানুষ পালানোর সুযোগ পায়। পবিত্র কোরআন ছাড়া অন্য কোথাও এত সুন্দর ‘তুলনা’ পাওয়া যায় না বলে আসির মন্তব্য করেছেন। আরবী গদ্য ও পদ্যেও এমন সূক্ষ্ম তুলনার অস্তিত্ব নেই। আসির সূরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতের কথাও উল্লেখ করেছেন যেখানে স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের পোষাক হিসেবে তুলনা করা হয়েছে। আসির লিখেছেন, “পোশাক যেমন মানুষকে সুশ্রী করে, মানুষের অসুন্দর অংশকে গোপন রাখে এবং রোদ, বৃষ্টি ও ঠান্ডা আবহাওয়ার ক্ষতি থেকে তাকে রক্ষা করে তেমনি স্বামী-স্ত্রীও পরস্পরের জন্য সৌন্দর্য্যের মাধ্যম। তারা পরস্পরের অপছন্দনীয় স্বভাবগুলো ঢেকে রাখে এবং তাদেরকে পদস্খলন ও পাপাচার থেকে রক্ষা করে। তাই এটা খুবই চমৎকার তুলনা।”
কোরআনের অপূর্ব ভাষাশৈলী বিশ্ব সাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছে। যেমন, মহাকবি হাফেজ, সাদী ও মাওলানা রুমির কবিতা বা গজলগুলো কোরআনের ভাষাশৈলীর মধুর রসের ছোঁয়ায় সিক্ত হয়েছে বলেই সেগুলো এত মিষ্টি শোনায় এবং এত জনপ্রিয়।
পবিত্র কোরআনের অলৌকিকতা এত ব্যাপক যে এখন পর্যন্ত চিন্তাবিদ ও আলেমরা এসব অলৌকিকতার সব দিক উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন বলে কেউ দাবি করেননি। তবে জ্ঞান বিজ্ঞান যতই উন্নত হচ্ছে কোরআন পরিচিতির অশেষ রহস্যের কিছু কিছু দিকও স্পষ্ট হচ্ছে। অবশ্য পবিত্র কোরআন নিরেট বিজ্ঞান বা গণিত বিষয়ক বই নয় যে, এর মধ্যে কেবলই বিজ্ঞান ও গণিত সম্পর্কিত মতামত বা বিস্তারিত বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যাবে।
মহানবী (সাঃ)’র চিরন্তন মোজেজা পবিত্র কোরআন মানুষের পথ প্রদর্শক। এ মহাগ্রন্থ নিজেকে প্রজ্ঞা, জ্ঞান, আলো ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী বলে অভিহিত করেছে। যেমন, সূরা বনি ইসরাইল বা সূরা আসরার নয় নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “এই কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে,যা সবচেয়ে সরল এবং সৎকর্ম পরায়ণ মুমিনদেরকে এ সুসংবাদ দেয় যে,তাদের জন্যে মহা পুরস্কার রয়েছে।”
ইতিহাস তুলে ধরার ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআনের বর্ণনার রীতিও লক্ষনীয়। যেমন, এ মহাগ্রন্থে গুহায় আশ্রয় নেয়া কয়েকজন মুমিন যুবকের তথা আসহাবে কাহাফের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। তাগুতি ও কাফের শাসকের জুলুম থেকে আত্মরক্ষা এবং ঈমান রক্ষার জন্য তারা একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে ক্লান্ত অবস্থায় তারা ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ঘুম থেকে ওঠে তখন তিনশ বছর পেরিয়ে গেছে।
মহাগ্রন্থ কোরআন এ কাহিনী তুলে ধরেছে যাতে এর শিক্ষা সম্পর্কে সবাই সচেতন হয়। আল্লাহ যে মৃত্যুর পর আবারও মানুষকে জীবিত করতে পারেন- এই শিক্ষার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে অনেক মানুষ ওই ঘটনার অগুরুত্বপূর্ণ দিকের দিকে দৃষ্টি দেয়ায় কোরআন বিস্ময় প্রকাশ করেছে। যেমন, গুহাবাসীর সংখ্যা কয়জন ছিল তা নিয়ে বিতর্ক করার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। বরং মানুষের উচিত এ ঘটনার আলোকে মহান আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে চিন্তা করা।
পবিত্র কোরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার মাধ্যমে অনেক নতুন তথ্য বা জ্ঞান অর্জন সম্ভব। যেমন, পবিত্র কোরআনের সংখ্যাগত মোজেজা বা অলৌকিকতার নানা দিক গত এক শতকে গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ মহাগ্রন্থের সব বাক্য ও শব্দ বিশেষ গাণিতিক বা সংখ্যাগত নিয়মে বিন্যস্ত হয়েছে। এ বিষয়টি ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মত তুলে ধরেন মিশরের একজন চিন্তাবিদ। গবেষকরা তার এই আবিস্কারকে স্বাগত জানিয়েছেন। ওই মিশরিয় গবেষক এ নিয়ে তিন বছর গবেষণা করেন এবং কোরআনের সংখ্যাগত বিস্ময় তুলে ধরার মাধ্যমে এটা প্রমাণ করেছেন যে, এ মহাগ্রন্থ কোনো মানুষের রচনা নয়।
পবিত্র কোরআনের সংখ্যা বিষয়ক মোজেজা বা অলৌকিকতার প্রধান সংখ্যাটি উনিশ। “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বা “পরম করুণাময় ও অনন্ত দাতা আল্লাহর নামে” বাক্যটিতে রয়েছে ১৯ টি অক্ষর। কোরআনের প্রতিটি সূরার শুরুতে রয়েছে এই মহান আয়াত। এ আয়াতটি কোরআনে ১১৪ বার এসেছে, যা উনিশের ছয় গুণ। কোরআনের সূরার সংখ্যাও ১১৪টি। অবশ্য সূরা তওবার শুরুতে এ মহান বাক্যটি নেই। অন্যদিকে সূরা নামলে এ বাক্য দু’বার রয়েছে।
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম”-এর গভীর অর্থ ও গুরুত্বের কথা মুসলিম আলেম সমাজ যুগ যুগ ধরে উল্লেখ করে আসছেন। বিশ্বনবী (সাঃ)’র উপদেশ বা দিক নির্দেশনাতেও এ বাক্য তেলাওয়াতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলা না হলে বা এ বাক্যটি স্মরণ করা না হলে সে কাজটি বিফল হয়।
উল্লেখ্য, কোরআনের সর্বশেষ সূরা “সূরা আন নাস”-এর শব্দ সংখ্যা ১৯। এই সূরার প্রথম আয়াতের বর্ণ সংখ্যাও ১৯। কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ সূরা আল আলাকের প্রথম আয়াতের শব্দ সংখ্যাও ১৯। এ সূরা কোরআনের ৯৬ নম্বর সূরা। অন্য কথায় শেষের দিক থেকে এ সূরার অবস্থান ১৯ নম্বরে। এই সূরার মোট আয়াতের সংখ্যা ১৯। সূরা আত তওবা থেকে সূরা নামল পর্যন্ত সূরার মোট সংখ্যা ১৯। সূরা তওবায় ” বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” শীর্ষক সূচনা-বাক্য দিয়ে শুরু হয়নি। অন্যদিকে সূরা নামলে এ বাক্য দু’বার রয়েছে। কোরআনে ওয়াহেদ শব্দটি ১৯ বার এসেছে। রহমান শব্দটি কোরআনে ৫৭ বার এসেছে যা ১৯ এর তিন গুণ। রহিম শব্দটি এসেছে ১১৪ বার যা ১৯ এর ৬ গুণ। ১৯ দিয়ে মেলানো যায় এমন আরো অনেক বিষয় রয়েছে এ মহাগ্রন্থের।* কোরআনের বিভিন্ন অংশের এসব সংখ্যাগত মিল সত্যিই অলৌকিক।
অনেক গবেষক বিচ্ছিন্ন কিছু বর্ণ বা হরফ দিয়ে শুরু হওয়া সূরাগুলো নিয়ে গণনাগত গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, এসব বর্ণের সাথে সংশ্লিষ্ট বা মূল সূরাটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, আলিফ লাম মীম দিয়ে শুরু হয়েছে সূরা বাকারা। এই সূরার সাথে আলিফ, লাম ও মীম বর্ণগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা তাবাতাবায়ি তাফসির আল মিযানের ১৮ তম খণ্ডে লিখেছেন, বিচ্ছিন্ন অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়া যে সূরাগুলোর প্রথম অক্ষরটি অভিন্ন সেসব সূরার বিষয়বস্তুর মধ্যে মিল দেখা যায়। যেমন, সূরা আরাফের সাথে সূরা সোয়াদ এবং আলিফ লাম মীম দিয়ে শুরু হওয়া সূরাগুলোর বিষয়বস্তুর মধ্যে মিল লক্ষনীয়। “আলিফ লাম রা” দিয়ে শুরু হওয়া সূরা রাদের বিষয়বস্তুর সাথে আলিফ লাম মীম ও আলিফ লাম রা দিয়ে শুরু হওয়া সূরাগুলোর বিষয়বস্তুর মিলের কথাও এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্তমূলক।
গবেষকরা আরো দেখেছেন যে, অশেষ রহস্যে ভরা মহাগ্রন্থ কোরআনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু শব্দ ও বিষয়ের মধ্যেও সংখ্যাগত সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, কোরআনে মাস অর্থে ব্যবহৃত “শাহর” শব্দটি এসেছে ১২ বার। দিন অর্থে “ইয়াওম” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ৩৬৫ বার। ঘন্টা অর্থে “সয়াত” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ২৪ বার।
আল কোরআনে ঈমান বা এর সমার্ধক শব্দ এসেছে ৮১১ বার এবং জ্ঞান বা এর সমার্থক শব্দ এসেছে ৮১১ বার। আর এ থেকে মানুষের সৌভাগ্যের দুই প্রধান চাবিকাঠি হিসেবে ঈমান ও জ্ঞানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও গুরুত্ব ফুটে উঠে। মানবীয় মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য ঈমান যতটা জরুরি, মানুষের পূর্ণতার জন্য জ্ঞানও ততটা জরুরি।
কোরআনে আকল বা এর সমার্থক শব্দ এবং নূর বা আলো শব্দটি এসেছে ৪৯ বার। কোরআনে ইবলিস শব্দ এসেছে ১১ বার এবং আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার নির্দেশও এসেছে ১১ বার। কোরআনের সংখ্যাগত বা গাণিতিক বিষয় সংক্রান্ত নবীন গবেষকদের সব দাবিই গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। প্রখ্যাত মুফাসসির ও ফকিহ আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজির মনে করেন, কোরআনের সূরার সাথে সূরার অক্ষরের সংখ্যাগত সম্পর্ক নির্নয়ে কম্পিউটারের ব্যবহার জরুরি; কিন্তু এ সংক্রান্ত গবেষণা এখনও খুব বিকশিত না হওয়ায় তাতে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। তার মতে এ ধরনের গবেষণা কোরআন বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমেই হওয়া উচিত।