আসসালামুআলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। আশাকরি সবাই ভালো আছেন। আজকে আমরা আলোচনা করবো কবর জিয়ারতের দোয়া ও নিয়ম নিয়ে ইনশাআল্লাহ। আমরা জানবো, কবর কি? কবর ও মাজার এর মাধ্যে পার্থক্য কি। কবর জিয়ারতের নিয়ম ও কবর জিয়ারতের দোয়া, কবরে লাশ নামানোর নিয়ম সহ কবর রিলিটেড মোটামুটি সব কিছু জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
কবর কি? কবর কাকে বলে?
কোনো মুসলিমকে যেখানে দাফন করা হয় ওই জায়গাকে ‘কবর’ বলা হয়। হাদিস শরিফে আছে, ‘মানুষের কবরটি হয়তো জান্নাতের একটি বাগান হবে অথবা জাহান্নামের একটি গর্ত হবে।’ বাগানকে আরবিতে ‘রওজা’ বলা হয়। অতএব আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সাহাবিরা যেহেতু জান্নাতি, তদ্রূপ নেককার মুমিনরাও ইনশাআল্লাহ জান্নাতে যাবেন, তাই তাঁদের সম্মানার্থে কবরকে ‘রওজা’ও বলা যায়।
মাজার কী?
আর ‘মাজার’ও একটি আরবি শব্দ। বাংলায় এর অর্থ হচ্ছে জিয়ারতের স্থান। এই অর্থে শরিয়ত মতে সব মুমিনের কবরই ‘মাজার’, কেননা সব মুমিনের কবরই জিয়ারতের স্থান এবং কবরই জিয়ারত করা হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশের অলি-বুজুর্গদের কবরকে ‘মাজার’ বলা হয়, যেহেতু সেখানে মানুষ বেশি জিয়ারত করে থাকে।
“উল্লেখ্য, শরিয়তে আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.), সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ও অলি-নেককারসহ সব মুমিনের কবরেই জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে।”
তবে সিজদা করা, সাহায্য চাওয়া ও যাবতীয় কুসংস্কারের উদ্দেশ্যে কবর, মাজার ইত্যাদিতে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং কবর পাকা করা ও তার ওপর কোনো কিছু নির্মাণ করাও নিষিদ্ধ।
[সূত্র : তিরমিজি, হাদিস : ২৪৬০, বুখারি, হাদিস : ১৩৩০, মুসলিম, হাদিস : ১৯৭৭, ৯৭০, আবু দাউদ, হাদিস : ২০৪২]
কবর জিয়ারতের নিয়ম
কবর জিয়ারাত ইবাদত। পরকালের কথা স্মরণ রাখতেও কবর জিয়ারত করা জরুরি। আবার গোনাহমুক্ত জীবন গড়তেও কবর জিয়ারত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত ও কাজ। জিয়ারতকারীকেও ক্ষমা করা হবে মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্বনবি।
ইসলামের প্রথম যুগে কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করা হলেও পরে তা তুলে নেয়া হয়েছে। দেয়া হয়েছে কবর জিয়ারতের অনুমতি। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি আগে তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম; এখন থেকে তোমরা কবর জিয়ারত কর। কেননা তা দুনিয়া বিমুখতা এনে দেয় এবং আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ৷’ (ইবনে মাজাহ)
কবর জিয়ারতের দোয়া
কবরের পাশে গিয়ে দোয়া পড়া, কবরবাসীর মুক্তির জন্য দোয়া করা। নিজেদের জন্যও দোয়া করা উত্তম। কবর জিয়ারত করতে গিয়ে হাদিসে বর্ণিত এ দোয়া পড়া-
اَلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَ الْمُسْلِمِيْنَ وَ اِنَّا اِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لَلَاحِقُوْنَউচ্চারণ : ‘আসসালামু আলাইকুম দারা ক্বাওমিম মুমিনিনা ওয়া ইন্না ইনশাআল্লাহু বিকুম লাহিকুন।’ (মুসলিম)
– দরুদ শরিফ পড়া ।
–সুরা ফাতিহা পড়া ।
– সুরা ইখলাস পড়া ।
—সূরা ফালাক পড়া ৷
—সূরা নাস পড়া ৷
– আয়াতুল কুরসি পড়া।
—সূরা ইয়াসিন পড়া
—সূরা তাকাসুর পড়া
অতঃপর মৃত ব্যক্তির রুহের মাগফেরাত তথা ক্ষমা প্রার্থনা করা।
কবর জিয়ারতের জন্য জুমআর দিন উত্তম এবং সুন্নাত। জুমআর দিন কবর জিয়ারত করলে জিয়ারতকারীর জন্যও তা ক্ষমা লাভের কারণ। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতি জুমআয় তার মা-বাবা বা তাদের একজনের কবর জিয়ারত করবে, তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহারকারীদের মধ্যে গণ্য করা হবে।’ (আল মুজামুল আউসাত)
কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কান্না করাপ্রিয়জন তথা বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনের কবরের পাশে গেলে মনের অজান্তে চোখে পানি চলে আসা স্বাভাবিক।
কবরের কাছে গিয়ে হাহুতাশ কিংবা মাতম করা ঠিক নয়।তা সাধারণত নারীরাই বেশি করে বিধায় নারীদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করা হয়েছে।
হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আম্মাজানের কবর জিয়ারত করতে যান। সে সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাঁদলেন এবং তাঁর সঙ্গীরাও কাঁদল।
তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমি আমার রবের কাছে, আমার মায়ের কবর জিয়ারত করার অনুমতি চাইলে তিনি এর অনুমতি দিয়েছেন। কাজেই তোমরা কবর জিয়ারত করবে। কেননা তা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (আবু দাউদ)
মনে রাখতে হবে কবরের কাছে গিয়ে এমন কোনো কাজ করা যাবে না, শিরক কিংবা বিদাআতের পর্যায়ে চলে যায়। তাহলোঃ
⇒কোনোভাবেই কবরবাসীর কাছে কোনো কিছু কামনা করা যাবে না।
⇒কবরের মাটি ছুঁয়ে সালাম বা সেজদা করা যাবে না।
⇒এমনকি কবরে মানত বা দান-খয়রাত তথা গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ডিম দেয়া যাবে না।
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারী কবর জিয়ারতকারী ও তার ওপর মসজিদ নির্মাণকারীদের এবং তাতে বাতি জ্বালানো ব্যক্তিদের অভিশাপ দিয়েছেন।’ (আবু দাউদ)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কবর জিয়ারতে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মাইয়্যাতকে কবরে রাখার নিয়ম
মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা ফরজে কিফায়া। মাইয়্যেতের দাফন করা অনেক ছাওয়াবের কাজ। এ কাজে পারদর্শী লোক পাওয়া দুষ্কর। সংক্ষেপে মৃত ব্যক্তির দাফনের পদ্ধতি তুলে ধরা হলো-
১. কবরকে গভীর ও প্রশস্ত এবং সুন্দর করা ওয়াজিব।
২. কবরের দৈর্ঘ্য হবে মৃত ব্যক্তির উচ্চতা থেকে একটু বেশি।
৩. গভীরতা হবে মৃত ব্যক্তির দৈর্ঘ্যের অর্ধেক।
৪. কবর খননের শেষ পর্যায়ে মৃত ব্যক্তিকে রাখার মতো জায়গা ক্বিলার দিকে গর্ত করা। ইহাকে লাহাদ (বগলী) কবর বলা হয়। লাহাদ বা বগলী কবর সোজা কবরের চাইতে উত্তম।
৫. কবর খননের পর মাইয়্যেতকে কবরে রাখার সময় ‘বিসমিল্লাহি ওয়া আলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ’ দোয়া পাঠ করা। মিল্লাতির জায়গায় ‘সুন্নাতি’ বললেও চলবে।
৬. মাইয়্যেতকে কবরে রেখে ডান দিকে ক্বিবলামুখী করে দেয়া সুন্নাত।
৭. যারা মৃত ব্যক্তিকে কবরে নামাবে তাদের ক্বিবলামুখী হওয়া।
৮. মহিলা হলে পর্দার সঙ্গে নামানো মুস্তাহাব। শরীর প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকলে পর্দা করা ওয়াজিব।
৯. কবরে মাথার দিক থেকে মাটি দেয়া মুস্তাহাব। দুই হাতে মাটি কবরে রাখা। মাটি রাখার সময়; প্রথম বার বলবে- মিনহা খালাক্বনাকুম; দ্বিতীয় বার বলবে- ওয়া ফিহা নুঈদুকুম; তৃতীয় বার বলবে- ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা।
১০. উটের পিঠের মতো দুই দিক ঢালু করে মাঝখানে আধা হাত পরিমাণ উঁচু করা।
১১. মাটি দেয়ার পর পানি ছিটানো মুস্তাহাব।
১২. দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর কিছুক্ষণ কবরের পাশে থেকে মৃতের জন্য দোয়া করা মুস্তাহাব।
১৩. এক কবরে একজনকেই দাফন করা উত্তম। প্রয়োজনে একাধিক দাফনও করা যেতে পারে।
১৪. সমুদ্র ভ্রমণে কারো মৃত্যু হলে; সেখান থেকে স্থলভূমিতে নিয়ে আসতে দেরি হওয়ায় লাশ বিকৃত হওয়ার ভয় থাকলে, গোসল দিয়ে জানাযার পর সমুদ্রে ছেড়ে দিতে হবে। তবে স্থলভূমিতে কবরস্থ করা উত্তম।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মৃত ব্যক্তির দাফন কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার তাওফিক দান করুন।
আজ এ পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকবেন।খোদা হাফেজ।