Site icon Trickbd.com

হিদায়াতের এক বাস্তব গল্প [কেউ মিস করবেন না]

 হিদায়াতের বাস্তব গল্প

যখন আমার স্ত্রী আমাদের প্রথম সন্তানের জন্ম দেয়,তখন আমার বয়স ৩০ এর বেশি নয়। সেই রাতটির কথা আজো আমার মনে আছে।

প্রতিদিনকার অভ্যাসমত, অই রাতটির পুরো সময় আমি বাইরেই কাটিয়েছি আমার বন্ধুদের নিয়ে। পুরো রাত কাটে গল্পে,আড্ডায় এবং লোকজনকে উপহাস করে। আমি ছিলাম তেমনই একজন, যারা মানুষকে হাসাতে পারতো। আমি অন্যদের নিয়ে উপহাস করতাম,ঠাট্টা করতাম,আর আমার বন্ধুরা এসব দেখে শুধুই হাসতো।

সেই রাতে আমি বুঝতে পারলাম, আমি তাদেরকে প্রচুর হাসাতে পারি। মানুষকে নকল করার অসাধারন এক ক্ষমতা আমার ছিলো। কারো স্বর নকল করে তাকে উত্যক্ত করতে পারতাম।

আমার এই ঠাট্টা – মশকারি থেকে কেউই রেহাই পাচ্ছিলোনা, এমনকি আমার বন্ধুরাও না।

আমার এসব ঠাট্টা থেকে বাঁচার জন্য তাদের কেউ কেউ আমাকে তখন এড়িয়ে চলছিলো।

আমি এখনও মনে করতে পারি, সে রাতে আমি একজন অন্ধ ভিক্ষুককে নিয়ে ঠাট্টা করেছিলাম যে মার্কেটের রাস্তার ধারে ভিক্ষা করছিলো। সেটা ছিল খুব শোচনীয়! সে যখন অন্ধকারে আসছিলো, আমি তখন তার সামনে আমার পা বসিয়ে দিলাম। সে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলো এবং চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখছিলো কে তাকে ল্যাঙ মেরে মাটিতে ফেলে দিলো।কিন্ত সে কিছুই বলতে পারছিলোনা।

.

আমি বাড়িতে ফিরলাম, যেরকম দেরি করে প্রত্যেকদিনই ফিরি, এবং দেখলাম আমার স্ত্রী আমার জন্য তখনও অপেক্ষা করছিলো।

তার অবস্থা ছিলো ভয়ানক রকম খারাপ।সে কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,- ‘রাশেদ, তুমি এতক্ষন কোথায় ছিলে?’

– ‘কোথায় থাকবো? মঙ্গলগ্রহে?’ – আমি ব্যাঙ্গাত্বকভাবে উত্তর দিলাম – ‘অবশ্যই বন্ধুদের সাথে ছিলাম।’

তাকে ক্লান্ত লাগছিলো। সে কান্না চাপা স্বরে বললো,- ‘রাশেদ, আমি খুবই ক্লান্ত। আমার মনে হয় একটু পরেই আমাদের সন্তান পৃথিবীতে আসতে যাচ্ছে।’

এইটুকু বলতেই এক ফোঁটা অশ্রু তার চোখ বেয়ে বুকে গড়িয়ে পড়ল।

আমি তখন বুঝতে পারলাম, আমি তাকে অবহেলা করছি। আমার উচিত ছিল তার যত্ন নেওয়া, অন্তত সে যতদিন গর্ভবতী আছে,ততদিন।

এই দিনগুলো বাইরে নষ্ট করা আমার একদম ঠিক হয়নি। দ্রুত তাকে আমি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।তাকে ডেলিভারি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। সে তখন ভয়ানক প্রসব বেদনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো।

আমি উদ্বিগ্নতা নিয়ে আমাদের সন্তান জন্ম নেওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। কিন্ত আমার স্ত্রীর ডেলিভারিটা কঠিন ছিল।

আমি ততক্ষন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম যতক্ষন না ক্লান্ত হচ্ছি।হাসপাতালে আমার স্ত্রীর সেবায় কর্তব্যরত নার্স মহিলাকে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে আমি বাসায় চলে এলাম,যাতে তারা আমাকে ফোনে সু-সংবাদটা দিতে পারে।এক ঘণ্টা পরে, তারা ফোন দিয়ে আমাকে আমার পুত্র সালেমের জন্মের অভিবাদন জানালো।আমি তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে চলে এলাম।যখনই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে দেখলো, তারা আমাকে আমার স্ত্রীর ডেলিভারিতে কর্তব্যরত চিকিৎসকের সাথে দেখা করতে বললো।

আমি চিৎকার করে বললাম,- ‘কিসের ডাক্তার? আমি এক্ষুনি আমার ছেলেকে দেখতে চাই।’

তারা বললো,- ‘প্লিজ, আগে ডাক্তারের সাথে দেখা করুন।’

আমি ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে আমার স্ত্রীর ভয়াবহ ডেলিভারির কথা বললেন।

এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে বললেন।

তারপর তিনি বললেন,- ‘আপনার সন্তানের চোখে সমস্যা আছে।সম্ভবত সে কখনোই চোখে দেখবেনা।’

আমি কোনরকমে কান্না চেপে ধরে মাথা নিচু করে ফেললাম। আমার মনে পড়লো সেই অন্ধ ভিক্ষুকের কথা, যাকে মার্কেটে আমি ল্যাঙ মেরে ফেলে দিয়েছিলাম অন্যদের হাসানোর জন্য।

সুবাহান-আল্লাহ! আপনি তাই পাবেন,যা আপনি দিবেন।

তখন আমি কি বলবো তাই ভেবে পাচ্ছিলাম না।হঠাৎ আমার স্ত্রী আর সদ্যজাত সন্তানের কথা মনে পড়ল। ডাক্তারকে তার দয়ার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে আমি আমার স্ত্রী আর সন্তানকে দেখতে গেলাম।

আমার স্ত্রীকে আমি মোটেই বিষন্ন দেখলাম না। আল্লাহর উপর তার বিশ্বাস ছিলো। সে ছিল সন্তুষ্ট।

সে কতোবারই না আমাকে বলতো,- ‘মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকারি করোনা।’

সে আমাকে বারবার এই কথা বলতো। আমি শুনতাম না।

.

পুত্র সালেম সহ আমরা হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে এলাম।

বাস্তবে, আমি সালেমের প্রতি উদাসীন ছিলাম।মনে করতাম, সালেম আমাদের পরিবারেই থাকেনা।সে আমাদের কেউ না,এরকম।

যখন সে জোরে জোরে কান্না করতো, তখন আমি ঘুমানোর জন্য অন্য কক্ষে চলে যেতাম।

কিন্ত আমার স্ত্রী তার খুব যত্ন করতো। তাকে অনেক ভালোবাসতো।

নিজের ক্ষেত্রে, আমি তাকে ঘৃণা করতাম না। কিন্ত এও ঠিক যে, আমি তাকে ভালোও বাসতে পারতাম না।

সালেম আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।হামাগুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে। যখন তার বয়স এক বছর, সে তখন হাঁটার চেষ্টা করছিলো। তখন আমরা লক্ষ্য করলাম, সে আসলে প্রতিবন্ধী।

আমি তখন তাকে আমার উপর বোঝা মনে করলাম।

.

সালেমের পর আমার স্ত্রী আরো দু’টি সন্তানের জন্ম দেয়।উমর এবং খালেদ।

বছর যেতে লাগলো। সালেম বড় হচ্ছিলো। সাথে উমর এবং খালেদও।বাসায় থাকতে আমার ভালো লাগতোনা। আমি আগের মতোই বেশিরভাগ সময় বন্ধুদের সাথে বাইরে বাইরে কাটাতাম।

আমার এরকম আচরনে আমার স্ত্রী কখনোই আশা ছেড়ে দেয়নি। সে সবসময় আমার হিদায়াতের জন্য দো’য়া করতো। আমার এহেন আচরনে সে কখনোই রাগ করতোনা। কিন্ত সে মনে মনে খুব কষ্ট পেতো, যখন সে দেখতো আমি পুত্র সালেমকে অবহেলা করে অন্য দু’জনকে আদর করছি। সালেম বড় হচ্ছিলো আর সাথে বাড়ছিলো আমার দুশ্চিন্তাও।

আমার স্ত্রী যখন তাকে একটি ভাল প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে বললো, আমি আপত্তি জানাইনি।

কতগুলো বছর যে চলে গেলো, আমি বুঝতেই পারলাম না। আমি দিনগুলো ছিল আগের মতই।

খাওয়া-কাজ-আড্ডা-ঘুম। এভাবেই।

এক শুক্রবার। আমি বেলা এগারোটা’য় ঘুম থেকে উঠলাম।বলা চলে,প্রতিদিনের তুলনায় সেদিন আমি অনেক ভোরেই জেগেছি। কারন, আমার এক জায়গায় দাওয়াত ছিলো। আমি কাপড় পরে,গায়ে পারফিউম মেখে বের হতে যাচ্ছিলাম।

যখনই আমি আমাদের বেডরুম অতিক্রম করছিলাম, আমি দেখলাম, সালেম একা একা কাঁদছে।

তার জন্মের পর এই প্রথমবার আমি তাকে নিজ চোখে কাঁদতে দেখছি। দশ বছর কেটে গেলো,কিন্ত এতদিন আমি তার দিকে একটু নজরও দিইনি। এবারও আমি তাকে ইগনোর করতে চেয়েছিলাম,কিন্ত কেন যেন পারলাম না।

আমি শুনলাম, সে কান্না করছে আর তার মা’কে ডাকছে।

আমি এই প্রথমবার তার কাছে গেলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম,- ‘সালেম, তুমি কাঁদছো কেনো?’

আমার কন্ঠ শোনামাত্র সে কান্না থামালো। আমাকে তার এত কাছে পেয়ে সে তার ছোট ছোট হাত দুটি হাতড়িয়ে আমাকে অনুভব করার চেষ্টা করতে লাগলো।সে তখনও বুঝতে পারছেনা তার সাথে কি হচ্ছে।

আমি খেয়াল করলাম, সে আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। যেন সে ঘৃণাভরে আমাকে বলতে চাচ্ছে,- ‘এতদিনে আমাকে তোমার মনে পড়লো? এই দশ বছর কোথায় ছিলে?’

আমি তাকে অনুসরন করলাম। দেখলাম, সে তার রুমের দিকে চলে গেলো।

প্রথমে সে তার কান্নার কারন আমাকে বলতে চায়নি।আমি তার সাথে শান্তভাবে কথা বলতে লাগলাম।এরপর সে আমাকে তার কান্নার কারন বললো। সে যখন আমাকে তার কান্নার কারন বলছিলো, আমি তা শুনছিলাম আর কাঁপছিলাম।

বলতে পারো কি সেই কারন?

তার ছোট ভাই উমর, যে তাকে ধরে ধরে প্রতিদিন মসজিদে নিয়ে যায়, সে এখনও তাকে নিতে আসেনি।সালেমের ভয় হচ্ছিলো, না জানি আবার মসজিদে যেতে দেরি হয়ে যায় আর সে মসজিদের সামনের কাতারে বসার জায়গা না পায়।

তাই সে উমর আর তার মা’কে চিৎকার করে ডাকছিল।কিন্ত তারা কেউই সাড়া দিচ্ছেনা দেখেই সে কাঁদছিলো।

আমি সালেমের পায়ের কাছে বসে গেলাম।দেখলাম,তখনও সালেমের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

তার পরের কথাগুলো আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি আমার হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিতে দিতে বললাম,- ‘এইজন্যেই কি তুমি কাঁদছিলে,সালেম?’

– ‘জ্বি’ – সে বললো।

আমি আমার বন্ধুদের কথা ভুলে গেলাম, দাওয়াতের কথা ভুলে গেলাম।

আমি বললাম,- ‘সালেম, কেঁদোনা।তুমি কি জানো আজ কে তোমাকে মসজিদে নিয়ে যাচ্ছে?’

সালেম বললো,- ‘উমরই নিয়ে যাবে।কিন্ত সে সবসময় দেরি করে ফেলে।’

— ‘না সালেম। আজ আমিই তোমাকে মসজিদে নিয়ে যাবো।’- আমি বললাম।

সালেম খুব অবাক হলো। সে কিছুতেই এটা বিশ্বাস করতে পারছিলোনা। সে ভেবেছে, আমি তার সাথে ঠাট্টা করছি।সে আবার কাঁদতে লাগলো।

আমি আমার হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিলাম, এবং আমার হাত তার হাতের উপর রাখলাম।আমি তাকে আমার গাড়িতে করে মসজিদে নিয়ে যেতে চাইলাম, কিন্ত সে আপত্তি জানালো।সে বললো,- ‘মসজিদ খুব কাছেই।আমাকে ধরে নিয়ে যান।’

.

শেষ কবে যে আমি মসজিদে ঢুকেছিলাম আমার মনে নেই। কিন্ত এতবছর ধরে যা পাপ আমি করেছি,তার জন্যে এই প্রথম আমার মনের ভেতর ভয় এবং অনুতাপ অনুভব করলাম।

পুরো মসজিদ মুসল্লিতে ভরপুর ছিল।কিন্ত তবুও আমি দেখলাম, একদম সামনের কাতারে সালেমের জন্য একটা খালি জায়গা রেখে দেওয়া আছে। আমরা একসাথে জুমার খুতবা শুনলাম। সালেম আমার পরে পরে রুকু-সিজদাতে যাচ্ছিলো, কিন্ত বাস্তবপক্ষে, মনে হচ্ছিলো, আমিই তার পরে পরে রুকু-সিজদা করছি।

নামাজের পর সে আমাকে একটি কোরআন এনে দিতে বললো।আমি অবাক হলাম। সে তো অন্ধ।সে কি করে কোরআন তেলাওয়াত করবে?

আমি তার অনুরোধ প্রায়ই প্রত্যাখ্যান করতে চাইলাম,কিন্ত তখন তার অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এরকম কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।আমি তাকে একটি কোরআন এনে দিলাম। সে আমাকে বললো কোরআনের সূরা কাহাফ খুলে দিতে। আমি কোরআনের পৃষ্টা উল্টাতে লাগলাম আর সূচিপত্র দেখে সূরা কাহাফ খুঁজতে লাগলাম।

সে আমার হাত থেকে কোরআন নিয়ে নিলো। সেটি তার সামনে ধরলো আর সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করতে লাগলো।

ইয়া আল্লাহ! পুরো সূরা কাহাফ তার মুখস্ত।।

আমি নিজেই নিজের প্রতি লজ্জিত হলাম।আমিও একটি কোরআন হাতে নিলাম। তখন আমার পুরো শরীর কাঁপছিলো। আমি কোরআন তিলাওয়াত করেই যাচ্ছি। আমি আল্লাহর কাছে বারবার মাফ চাইছিলাম আর বলছিলাম, – ‘হে আল্লাহ! আমাকে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ দেখাও।’

আমি এভাবে আর থাকতে পারলাম না।আমি মূহুর্তেই শিশুর মতো কান্না শুরু করলাম।

সেখানে তখনও কিছু মুসল্লি ছিল যারা সুন্নত আদায় করছিলো। আমি লজ্জিত হলাম। তাই আমি কোনরকমে আমার কান্না চেপে যেতে চাইলাম।আমার চাপা কান্না দীর্ঘায়িত হলো আর শরীর কাঁপছিলো। আমি তখন খেয়াল করলাম, একটি ছোট্ট হাত আমার মুখমন্ডল স্পর্শ করছে আর আমার চোখের জল মুছে দিচ্ছে। এটা ছিল আমার পুত্র সালেম। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম।বললাম, – ‘সালেম, তুমি অন্ধ নও।অন্ধ তো আমি, যে অসৎ সঙ্গীর পাল্লায় পড়েছি যারা আমাকে জাহান্নামের দোরগোড়ায় নিয়ে যাচ্ছে।’

আমরা বাড়ি চলে এলাম।ততক্ষনে আমার স্ত্রী সালেমের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। কিন্ত তার উদ্বিগ্নতা আনন্দ্রাশুতে পরিণত হল,যখন সে জানতে পারলো সালেমের সাথে আমিও জুমা’হ আদায় করেছি।

সেদিন থেকে, আমি আর এক ওয়াক্ত সালাতও ছাড়িনি। আমি আমার খারাপ বন্ধুগুলোকে ত্যাগ করলাম এবং মসজিদে নিয়মিত সালাত আদায় করে এরকম কিছু মানুষকে বন্ধু করে নিলাম।

তাদের সাথে মিশতে মিশতে আমি ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে লাগলাম। তাদের কাছ থেকে আমি এমন কিছু শিখছিলাম যা আমাকে এই দুনিয়া নয়,পরের দুনিয়া সম্পর্কে ভাবাতে লাগলো।

আমি কোন ধর্মীয় বক্তৃতা মিস করতাম না। প্রায়ই আমি পুরো কোরআন তিলাওয়াত করে ফেলতাম,অনেক সময় সেটা এক মাসের মধ্যেই।

আমি সবসময় আল্লাহর স্মরনে থাকতাম।ভাবতাম, তিনি অবশ্যই আমার পূর্বের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।আমি আমার পরিবারের দিকে মন দিলাম।আমার স্ত্রীর চোখে-মুখে সবসময় যে ভয়ের রেখা দেখা যেত, সেটি আর নেই। একটুকরো হাসি আমার ছেলে সালেমের মুখে লেগেই থাকতো। যে কেউ তার এই হাসি দেখতো, তারা বুঝতে পারতো, সে সম্ভবত দুনিয়ার সবকিছুই অর্জন করে ফেলেছে। আল্লাহর এই বিশেষ রহমতের জন্য আমি তার শুক’রিয়া করলাম।

.

একদিন আমার ঈমানী বন্ধুরা মানুষকে ঈমানের দাওয়াত দেওয়ার জন্য কিছু দূরে যাওয়ার প্ল্যান করলো। আমি যাবো কি যাবোনা, এটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলাম। আমি ইস্তিগফার করছিলাম আর আমার স্ত্রীর সাথে এই বিষয়ে পরামর্শ করছিলাম।

আমি ভেবেছিলাম সে আমায় যেতে নিষেধ করবে।কিন্ত হলো তার উল্টোটি। সে এটা শুনে খুবই খুশি হলো,এবং উপরন্তু আমাকে যেতে উৎসাহ দিলো।কারন, সে ইতিপূর্বে কখনো কোথাও যাওয়ার আগে আমাকে তার সাথে পরামর্শ করতে দেখেনি।

আমি সালেমের কাছে গেলাম,এবং বললাম যে আমাকে কিছু দিনের জন্য দাওয়াতি কাজে বেরোতে হবে।

সে অশ্রুসজল চোখে আমার দিকে তার দুই বাহু প্রসারিত করে দিলো।

আমি প্রায়ই সাড়ে তিন মাসের মত বাইরে ছিলাম।তখন আমি যখনি সুযোগ পেতাম,ফোনে আমার স্ত্রী আর সন্তানদের সাথে কথা বলতাম।

আমি তাদের অনেক মিস করতাম। বিশেষ করে সালেমকে। আমি তার কন্ঠ শোনার জন্য ব্যাকুল ছিলাম কিন্ত আমি চলে আসার পর সবার সাথে কথা হলেও,শুধু তার সাথে আমার কথা হয়নি।

আমি যখনই বাড়িতে ফোন করতাম,তখন হয় সে স্কুলে থাকতো,নয়তো মসজিদে। যখনই আমি আমার স্ত্রীকে বলতাম যে, সালেমকে আমি কতোটা মিস করছি, তখন সে আনন্দে,গর্বে হাসতো, শুধু শেষবার যখন ফোনে কথা বলি সেবার ছাড়া। তার কন্ঠস্বর পাল্টে গেলো।আমি বললাম,- ‘সালেমকে আমার সালাম দিও।’

সে শুধু বললো,- ‘ইনশাআল্লাহ! এরপর চুপ করে গেলো।’

আমি বাড়ি এলাম। দরজায় নক করলাম।আমি ভেবেছিলাম যে, সালেমই আমার জন্য দরজা খুলে দিবে।কিন্ত আমাকে অবাক করে দিয়ে খালেদই দরজা খুলে দিলো যার বয়স চার বছরের বেশি ছিলোনা।

সে যখন আমাকে ‘বাবা বাবা’ বলে ডাকছিলো,তখন আমি তাকে কোলে তুলে নিলাম। কেন জানিনা, যখন থেকে ঘরে ঢুকলাম,তখন থেকেই আমার মনের ভেতর একটা ভয় কাজ করছিলো।

আমি শয়তানের প্ররোচনা থেকে আল্লাহর পানা চাইলাম। আমি আমার স্ত্রীর কাছে গেলাম।তার চেহারা ছিলো ভিন্ন। যেন সে ভাল থাকার অভিনয় করছে এরকম।

আমি তাকে বললাম,- ‘কি হয়েছে তোমার?’

– ‘কিছুইনা।’- সে জবাব দিলো।

হঠাৎ, আমার সালেমের কথা মনে পড়লো।আমি বললাম,- ‘সালেম কোথায়?’

সে কিছুই বললনা। মাথা নিচু করে ফেললো। তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

আমি কান্না শুরু করলাম। চিৎকার করে বললাম,- ‘সালেম, কোথায় সালেম?’

তখন দেখলাম, আমার চার বছরের ছেলে খালেদ তার মতো করেই বলছে, – ‘বাববা! তালেম দান্নাতে তলে গেথে আল্লার তাতে।’

আমার স্ত্রী এটা সহ্য করতে পারলোনা। সে ফ্লোরে পড়ে গেলো আর দ্রুত রুম ছেড়ে চলে গেলো।

পরে আমি জানতে পারলাম, আমি যাওয়ার দুই সপ্তাহ পরে সালেম জ্বরে আক্রান্ত হয়।আমার স্ত্রী তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্ত সে আর সেরে উঠেনি।জ্বরের উসিলায় সে আল্লাহর সাক্ষাৎে চলে গেলো।

.

(এই লেখাটি পড়েছি একটি ইংরেজি ম্যাগাজিন পেপারে। যতবার পড়ি,ততবারই কাঁদি।)