জটাধারী ‘মুচকি হাসি’ বাবার দরবারে আশেকানের ভিড়। তিন দিন পর বাবা আজ পানাহারের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এ কয় দিন ধ্যানে এতটাই মগ্ন ছিলেন যে যৌগিক খানাখাদ্যের দিকে নজর দিতে পারেননি। ‘যার হাত থেকে বাবা খানাখাদ্য খান, দুনিয়াবি জিন্দেগিতে তিনি কামিয়াব’—আশেকানের মাঝে এমন ধারণা প্রচলিত থাকায় সবাই খাবার নিয়ে এসেছেন। যাঁর যাঁর খাবার বাড়িয়ে ধরে বিচলিত নয়নে তাকিয়ে আছেন বাবার দিকে। ধ্যান ভাঙার পর থেকেই জটাধারী ‘মুচকি হাসি’ বাবা সমানে মুচকি হাসি দিয়ে যাচ্ছেন। হাস্যরত অবস্থায় বাবা খানা স্পর্শ করেন না। আশেকানরা বাবার হাসি থামার অপেক্ষা করছেন। বরিশাল সরকারি কলেজের ছাত্র জানে আলম এক বছর আগে জটাধারী ‘মুচকি হাসি’ বাবার মুরিদ হয়েছেন। এর আগে প্রতিবেশী আমেনা খাতুনকে বশে আনার জন্য বাবাকে আমিত্তি খাইয়ে হাতে হাতে ফলপ্রাপ্ত হন। আমেনা এখন জানে আলমের আপন বউ। তার পর থেকে বাবার কেরামতিতে আস্থা রাখেন। আজও জানে আলম এক হাঁড়ি আমিত্তি নিয়ে এসেছেন বাবার দরবারে। দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর সামনে। গত এক ঘণ্টা যাবৎ বাবা হেসেই যাচ্ছেন। এই জিনিস কখন থামবে তা নিয়ে জানে আলম বেজায় চিন্তিত। হাসির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, কিন্তু একেবারে থেমে যায়নি। এই মুহূর্তে বাবা চোখ বন্ধ রেখে বিড়বিড় করে কী যেন জপ করছেন। ১০ মিনিট পরের কথা। বাবার চোখ এখনো বন্ধ, তবে হাসি থেমেছে। জানে আলম আমিত্তির হাঁড়ি এগিয়ে ধরে আছেন। আচমকাই তার মনের আশা পূরণ হলো। বাবা চোখ মেলে তাকালেন। মুখের সামনে আমিত্তির হাঁড়ি দেখে হাত বাড়িয়ে এক পিস তুলে নিলেন। কামড় বসিয়ে জানে আলমকে জিজ্ঞেস করলেন—কী চাস? —বাবা, আপনি তো সবই জানেন। —ইদানীং মনের কথা বুঝতে পারি না রে পাগলা। অগ্নাদি রাশ্যাশ্রিত হয়ে গ্রহবৃন্দ ভিন্ন ভিন্ন নক্ষত্রাশয় তান্ত্রিকায়িত হয়ে পরশ্রীকাতরতায় মুগ্ধ করতঃ যোগ, দৃষ্টি, প্রেক্ষা ও গোচরজনিত আবেশি ফলদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ। নির্জল রাশি ধনুস দহন নাড়িগত রুদ্র সজল রাশি কর্কটস্থ অমৃতা নাড়িগত কেতু, নীরা নাড়ির অধিপতি সজল গ্রহ, শুক্র ও বায়ু নাড়ির অধিপতি শুষ্ক গ্রহ শনি এবং সজল রাশি তুলাস্থ চণ্ডা নাড়িগত জলা নাড়ির অধিপতি সাম্যগ্রহ বুধসহ দৃষ্টি সম্পর্কে আবদ্ধ। সজল রাশি মকরস্থ অমৃতা নাড়িগত রাহু যুক্ত হার্সেল থাকার ফলে দেশের জনগণ সর্বদাই অস্থির। এই অস্থির জনগণের মনের কথা জানা আমার পক্ষে সম্ভব না। —আপনার বচনের কিছুই তো অন্তরে নিতে পারলাম না বাবা। —তুই এসব নিতে পারবি না রে বাছা। তার চেয়ে বরং আমি আরেকটা আমিত্তি নেই। তুই সমস্যা বল। জানে আলম জটাধারী ‘মুচকি হাসি’ বাবার সামনে তার সমস্যা তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিলেন—বাবা, বাংলাদেশ এশিয়া কাপ টুর্নামেন্টে খেলছে। প্রথম ম্যাচটা হারলেও পরেরটা জিতেছে। এ পর্যায়ে আপনি যদি আপনার তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে বাংলাদেশের প্লেয়ারদের একটু পাওয়ার বাড়িয়ে দিতেন, তাহলে ওরা বাকি ম্যাচগুলো জিতে ফিরত। জটাধারী ‘মুচকি হাসি’ বাবা এশিয়া কাপের কথা শুনে যেন খুশি হলেন। এশিয়া কাপে বাংলাদেশ খেলছে নাকি? আমিও তো বাংলাদেশি পোলা, আশি টাকা তোলা। ধ্যানের কারণে এই সব দুনিয়াবি বিষয়ের খবর রাখতে পারি নাই। —বাবা, তাহলে তো ভালোই হলো। আপনার এলাকার টিমের পাওয়ার বাড়ানোর জন্য কিছু করেন। আজ বাংলাদেশের খেলা আছে। আপনি কিছু না করলে আজও খেলায় হারার আশঙ্কা আছে বাবা। প্যাকেট থেকে আমিত্তি নিতে নিতে বাবা বললেন, তুই টেনশন করিস না। আমি যখন হাত দিছি তখন কেউ আমাদের হারাতে পারবে না। চল স্টেডিয়ামে যাই। খেলা দেখতে দেখতেই পাওয়ার বাড়াব। মাঠে খেলা চলছে। জটাধারী ‘মুচকি হাসি’ বাবা এবং জানে আলম গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছেন। ব্যাট করছেন সাকিব। তাঁকে দেখে কপাল কুঁচকে বাবা বললেন—দেশি পোলা এমন চিমশা কালা হইলো কেমনে রে? —রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কালো হয়েছে বাবা। কালো হলে কী হবে। এরা একেকটা রত্ন। —তাই তো বলি, এমন তো হবার কথা না। যা-ই হোক, আমি ধ্যানে বসতেছি। তুই নজর রাখ যেন আমাকে কেউ ডিস্টার্ব না করে। যখন আমি বুড়ো আঙুল তুলে ইশারা করব, তখন বুঝবি এবার ছক্কা হবে, কেমন? জানে আলম হ্যাঁসূচক মাথা নাড়তেই বাবা দুই চোখ বন্ধ করে ধ্যানে চলে গেলেন। তাঁর এক পা আরেক পায়ের ওপরে বিশেষ ভঙ্গিতে তোলা। হাত দুটি টান টান করে পায়ের ওপরে রাখা। তবে জানে আলমের নজর বাবার বুড়ো আঙুলের দিকে। কখন সেটা উঁচু হবে আর সাকিবের ছক্কা দেখবেন সেই টেনশনে জানে আলম উত্তেজিত। এক মিনিট যায়, দুই মিনিট যায় ঠিক তিন মিনিট পর বাবার আঙুল নড়েচড়ে উঠতে দেখা গেল। জানে আলম বাতেনি ইশারা টের পেয়ে মাঠের দিকে তাকালেন। বোলার বল করতে এগিয়ে যাচ্ছেন। সাকিব ব্যাট হাতে তাঁর পজিশনে। বোলার বল করলেন। বল দেখে সাকিব দেরি করলেন না। সর্বশক্তি দিয়ে হাঁকালেন। মুহূর্তেই বল উঠে পড়ল আকাশে। জানে আলম লাফিয়ে উঠে চিত্কার দিলেন—‘ছক্কা’। তখনই ঘটল দুর্ঘটনাটা। বল উড়ে এসে সোজা বাবার মাথায় পড়ল। আঘাতের চোটে ব্যালেন্স হারিয়ে বাবা দুই ধাপ নিচে গিয়ে পড়লেন। দৌড়ে গেলেন জানে আলম। বাবাকে টেনে তুললেন। এক হাতে ব্যথার জায়গাটা ডলতে ডলতে বাবা বললেন—সামনের বার ধ্যানে যাওয়ার আগে একটা হেলমেট পরে নিতে হবে রে পাগলা।
ট্রিকবিডির সাথেই থাকুন