একটা সময় ভোর না হতেই ঠুক ঠাক, টুং টাং আওয়াজে জেগে উঠতো রাজধানীর জিঞ্জিরা। আওয়াজের ছন্দে সৃষ্টি হতো শৈল্পিক এক ইতিহাস। তার মাঝে শ্রমিকদের হাতের ফাঁজে উজ্জ্বল রঙের ঝিলিক দিয়ে উঠতো কাঁসার তৈরি পাত্রগুলো। এককালে কাঁসা শিল্পের ব্যাপক প্রসার ও রমরমা অবস্থা থাকলেও বর্তমানে চলছে চরম দুর্দিন। এখন আর সেই ব্যস্ততা চোখে পড়ে না। দেখতে হয়না কাঁসা পল্লীর শ্রমিকদের ছোটাছুটি। বহুমুখী সঙ্কটে পড়ে বিলুপ্তির পথে এখন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই কাঁসা শিল্প।
কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতা, অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ও কাঁসার বিকল্প হিসেবে সিরামিক ও মেলামাইনের তৈরি তৈজসপত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায়, এখন আর কাঁসার তৈরি পণ্যের তেমন একটা কদর নেই। চাহিদা কমে যাওয়ায় গত ২০ বছরে বাংলাদেশে বন্ধ হয়ে গেছে শত শত কারখানা। বেকার হয়ে পড়েছেন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার কারিগর। ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মোঘল আমল থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব বড় শহরে ছিল কাঁসা-পিতল কারখানা। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতেও প্রায় চোখে মিলতো এসব কারখানা। ভোর থেকে সারাদিন কাঁসার বাসনপত্র তৈরিতে কারিগরদের ঠুকঠাক শব্দে মুখরিত থাকতো এসব জনপদ। রাং এবং তামার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করা হতো কাঁসার থালা, বাটি, গ্লাসসহ নানান পণ্য।
নব্বইয়ের দশকেও যে কোনো অনুষ্ঠানে উপহার সামগ্রীর তালিকায় থাকতো কাঁসা-পিতলের তৈরি সামগ্রী। সভ্যতার ক্রম বিকাশ আর আধুনিকতার ভিড়ে বদলে গেছে অনেক কিছু। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই শিল্পের কাঁচামাল( তামা ও রাং)-এর দাম অনেক বেড়ে যাওয়া, চাহিদামতো কাঁচামাল এর অভাব পাশাপাশি সিরামিক, মেলামাইন, অ্যালুমিনিয়ামের সামগ্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না কাঁসার সামগ্রী। অল্প দামে বিকল্প সামগ্রী কিনতে পারায় কাঁসার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
ঢাকার কাঁসা ব্যবসায়ী তিতাস ব্যাপারী বাংলামেইল২৪ডটকমকে বলেন, কাঁসা শিল্পের বিরাজমান দুরবস্থার দিকে সরকারের নজর দেয়া দরকার। কারণ হিসাবে দেখছেন কম সুদে লোন প্রাপ্তি এবং সঠিক পরামর্শ পাওয়া না গেলে এক সময় ঐতিহ্যবাহী এই কুটির শিল্পটি হারিয়ে যাবে।
কাঁসা শিল্পীরা জানান, ঢাকার বকশীবাজার থেকে ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা কেজি দরে কাঁচামাল কিনে নানা সামগ্রী তৈরি করে তা বিক্রি করেন মাত্র ২৭০ থেকে ২৯০ টাকায়। তবে পাইকাররা তাদের কাছ থেকে কম দামে কিনলেও বেশি দামে তা বিক্রি করেন। আরেক কাঁসা শিল্পী রুবেল সরদার বলেন, কাঁসার জিনিস তৈরিতে ব্যবহার্য কাঁচামালের দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থের অভাবে অনেক কারিগর তা কিনতে পারছে না।
চরম দুর্দিন আর প্রতিকূলতার মাঝেও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে কাঁসা শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকেরা। বর্তমানে দেশে এই শিল্পের চর্চা খুব কম হলেও ঢাকার ধামরাই এখনো চলে তামা কাসা পিতলে সৃষ্টি এক নতুন সুরের ছন্দে। নানা প্রতিকূলতার কারণে এই কাঁসা শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। এরই মধ্যে বহু শ্রমিক পেটের দায়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। আবার অনেকে জীবিকার অন্বেষণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে গেছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা গৌড় গোবিন্দের শাসনামলে ভারতের কংশ বণিকদের মাধ্যমে বাংলাদেশে কাঁসা শিল্পের আবির্ভাব ঘটে। কংশ বণিকরাই এ শিল্পের স্রষ্টা। হিন্দুদের বিয়ে এবং পূজা-পার্বণে কাঁসার ব্যবহারকে পূত-পবিত্র বলে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে। বর্তমানে ঢাকার ধামরাই ছাড়াও জিঞ্জিরা, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নরসিংদী এবং বিক্রমপুরে কাঁসা শিল্প কোনোমতে টিকে আছে।