Site icon Trickbd.com

শালা–দুলাভাই শুধুই কি ইয়ার্কির সম্পর্ক?

Unnamed


-বৈকালে যামু নে…।
মানিক তখন ডাব কেটে দুলাভাইকে
দিতে দিতে বলে,
‘দুলাভাই, তয় কী মাছ আনুম?
-ইলিশ মাছ আনিস।
অনেক আগে বিটিভিতে প্রচারিত
জনপ্রিয় এক বিজ্ঞাপনের এই
সংলাপগুলো শুনে দুটো জিনিস
বোঝা যায়—শ্বশুরবাড়িতে
জামাইয়ের আদর-আপ্যায়ন আর শ্যালক-
দুলাভাইয়ের মধ্যকার মধুর সম্পর্ক।
বড় বোনের বিয়ের সময়ে বন্ধুদের
নিয়ে বরের গেট ধরা কিংবা বিয়ের
আসরে বরের জুতা লুকিয়ে রাখা দিয়ে
যে সম্পর্কের শুরু, সেটার মধ্যে একধরনের
মাধুর্য যেমন আছে, তেমনি ইয়ার্কির
ব্যাপারটাও রয়েছে। আবার শ্যালক বা
শালা যদি তখন শিশু বয়সের হয়ে থাকে,
তবে বিয়ের আসরে দুলাভাইয়ের
কোলে চড়েই এই সম্পর্কের শুরু।
জামাই শ্বশুরবাড়ি গেলে যেমন
বাড়তি আদর-আপ্যায়ন চলে, তেমনি
বোনের বাড়ি শ্যালক বেড়াতে
এলেও দুলাভাই হাঁক দিয়ে বলেন,
‘আরে বড় কুটুম দেখি! আছ কেমন? এই শুনছ,
বড় কুটুমকে কী খাওয়াবে ঠিক করো।
ভালো কিছু না হলে কিন্তু আমার
দুর্নাম হবে।’
আমাদের আবহমান সংস্কৃতিতে এই
সম্পর্কগুলো দারুণ। সাধারণভাবে
শালা-দুলাভাইয়ের সম্পর্কটা ইয়ার্কি-
ফাজলামির মনে করা হয়। কিন্তু
সম্পর্কটা কি শুধুই ইয়ার্কির?
সেদিন একজন বলছিলেন। বিয়ের পর
তাঁর বউ তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমার
ছোট ভাইকে নিজের ভাইয়ের মতো
দেখবে।’ স্বামীর জবাব ছিল, ‘ও তো
আমার ভাই না, আমার শালা।
শালাকে শালার মতোই দেখব, আদর
করব আর ভাইকে ভাইয়ের মতো।’
শ্যালক ভাই নয় ঠিকই, তবে সম্পর্কের
বাঁধনে তার স্থানটাও সবিশেষ।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্য সম্পর্কগুলোর
মতো এই শ্যালক-দুলাভাইয়ের সম্পর্কেও
অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান
বিভাগের অধ্যাপক মো. মশিউর রহমান
যেমন বললেন, গ্রামবাংলায় শালা-
দুলাভাইয়ের যে সম্পর্ক, শহরের সঙ্গে
তার পার্থক্য আছে। গ্রামীণ
অর্থনীতির কারণে সেখানে শালা-
দুলাভাই সম্পর্কটা হাস্যরসের। নাগরিক
জীবনে সম্পর্কটা যে খারাপ হয়ে যায়

তা নয়, তবে জটিলতা থাকে।
সমাজবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী
গ্রামে এই সম্পর্কে যতখানি হৃদ্যতা
রয়েছে, শহরে তা নেই। এখানে
আনুষ্ঠানিক একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
কারণ হতে পারে শ্রেণিগত অবস্থানের
পার্থক্য। পেশাগত ভিন্নতার কারণেও
এমন হয়। শহুরে সংস্কৃতিতে গড়ে উঠেছে
অণুপরিবার (নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি)।
ফলে রসাত্মক সম্পর্কের সুযোগটাই বা
কোথায়?
অধ্যাপক মশিউর রহমানের মতে, গ্রামে
শালা-দুলাভাইয়ের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ
সম্পর্কটা আরও কিছু দিন হয়তো
থাকবে। সেখানেও দেখা যাচ্ছে
দুলাভাই হয়তো বিদেশে গিয়ে বেশ
ভালো আয় করছেন, নিজের ভাইকেও
হয়তো নিয়ে গেছেন, কিন্তু শালা
গ্রামে বেকার বসে আছে। স্ত্রীও মনে
করছেন যে তাঁর স্বামী চাইলেই তো
শালাকে নিয়ে যেতে পারেন।
এভাবে বৈরিতা তৈরি হচ্ছে।
অনেক সময় দেখা যায় দুলাভাইয়ের
বাসায় থেকে শালা পড়াশোনা বা
চাকরি করছে। উল্টোটাও হয়—
দুলাভাই-ই হয়তো শ্বশুরবাড়ি থাকছেন।
একসঙ্গে থাকলে সম্পর্কটায় ঝুঁকির
মাত্রা কিছুটা হলেও বেড়ে যায়।
দুজনের কোনো একজন অন্যজনের
পরিবারে যখন নাক গলাতে থাকেন,
তখন সম্পর্কে মধু আর থাকে না। শহুরে
পরিবেশে এ রকম সমস্যার আশঙ্কা
বেশিই। মশিউর রহমান বললেন,
‘আমাদের সংস্কৃতিতে পশ্চিমের
অনেক কিছুই ঢুকে গেছে। আমরা কিছু
নেব কিছু নেব না, তা তো আর হয় না।
পশ্চিমা সংস্কৃতির নেতিবাচক
বিষয়গুলোও তো মেনে নিতে
হবে।’ তাই শালা-দুলাভাইয়ের
সম্পর্কের মাধুর্য ধরে রাখতে চাইলে
বাংলার চিরন্তন ঐতিহ্যের চর্চা
চালিয়ে যেতে হবে বলে মনে করেন
মশিউর রহমান। ‘কিছুদিন পরপর
পারিবারিক অনুষ্ঠানের আয়োজন
করা যেতে পারে। যেখানে স্বামী-
স্ত্রী দুজনের ভাইবোনেরাই আসবেন,
একত্র হবেন। পার্টি-ফার্টি নয়, সে
আয়োজন হবে অনানুষ্ঠানিক। আর
কোনো অবস্থাতেই কারও ব্যক্তিগত
বা পারিবারিক বিষয়ে অযাচিত
হস্তক্ষেপ নয়।’ এতে সম্পর্ক নষ্ট হতে বাধ্য।
শালা-দুলাভাই আসলে মধুর সম্পর্ক। তবে
এই সম্পর্কের মধুরতর অবস্থা অনেক সময়
সমস্যা তৈরি করে। এমন মত জাতীয়
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের
সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন
আহমেদের। তিনি বলেন, ‘অনেক সময়
আমরা এমন মাদকাসক্ত রোগী পাই,
যে জীবনের প্রথম মাদক গ্রহণ করেছে
দুলাভাইয়ের কাছ থেকে বা তাঁর
সহায়তায়। ফলে দুলাভাইকে
অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিতে হবে।
তিনি তো শ্যালকের একরকম
অভিভাবকই। এই সম্পর্ক শুধু আবেগের হলে
হবে না।’
দুলাভাই আর শ্যালকের সম্পর্কে
দায়িত্বশীলতা থাকতে হবে। এ তো
আর রক্তের সম্পর্ক নয়, এটা আইনি সম্পর্ক।
শালা বা দুলাভাইয়ের ইংরেজি
নামটাও তেমন—‘ব্রাদার ইন ল’। তাই শুধুই
ইয়ার্কি বা মধুর আবেগপ্রবণ নয়, এটা হতে
হবে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহ
মেশানো এক সম্পর্ক।
অনেক সময় দেখা যায় সম্পত্তি নিয়ে
ভাইবোনের মধ্যে বিরোধ দেখা
দিয়েছে। দুলাভাই হয়তো তাঁর
স্ত্রীর পক্ষ নিলেন। তবেই হলো,
শালা-দুলাভাইয়ের আত্মিক সম্পর্কের
আত্মাটাই উড়ে যাবে। হেলাল উদ্দীন
আহমেদ স্পষ্ট বলে দিলেন, ‘এমন ক্ষেত্রে
দুলাভাইকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে।
মনে রাখতে হবে, একটা আইনি সম্পর্কে
তিনি স্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে যুক্ত,
সরাসরি ওই পরিবারের সদস্য নন। তাই
কোনোভাবেই সেখানে অনুপ্রবেশ
করা যাবে না।’ আবার শালা-
দুলাভাইয়ের সম্পর্কে টানাপোড়েন
তৈরি হলে স্ত্রীকেও থাকতে হতে
নিরপেক্ষ। ভাইয়ের মঙ্গলটা ভাবতে
হবে তাঁকে। একই অফিসে কাজ করলে
বা একই পেশায় শালা-দুলাভাই
থাকলে কর্মক্ষেত্রে দুজনের সম্পর্কটা
পেশাদারত্বের মধ্যেই থাকা
ভালো। সেখানে ব্যক্তিগত সম্পর্কের
চর্চা জটিলতাই বাড়াবে। অফিসে
কলিগ আর বাসায় আত্মীয়—এই চর্চা
চালিয়ে যাওয়া মঙ্গলজনক।
সবকিছুর ওপরে হলো দুজনের প্রতি
দুজনেরই ভালোবাসা আর সম্মান
থাকা। কারও কোনো ব্যাপারে
বাড়তি হস্তক্ষেপ না করলে,
নাক না গলালে শালা-দুলাভাইয়ের
চিরন্তন সম্পর্কের মাধুর্যটা যেমন টের
পাওয়া যাবে আবার সেটা ধরেও
রাখা যাবে। শ্যালক যেন
সব সময় ‘শালাবাবু’ হয়ে থাকতে পারে
দুলাভাইয়ের কাছে।

plz visit my site