রাগ হলো একটি স্বাস্থ্যপ্রদ, স্বাভাবিক আবেগ। কিন্তু রাগ মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে বা ক্রমিক (ক্রনিক) রাগ হলে, রাগের বিস্ফোরণ ঘটলে, এর গুরুতর পরিণতি হতে পারে পরস্পর সম্পর্ক, স্বাস্থ্য, মনের অবস্থা—সবকিছুর ক্ষেত্রেই।
কারও প্রতি অন্যায়-অবিচার হলে তার রেগে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। অনুভূতিটি সমস্যা নয়, রাগকে কীভাবে সামলানো হলো এটি বড় কথা।
অনেকে খুব বদমেজাজি, কথায় কথায় রেগে যান, মনে হতে পারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে এটি। কিন্তু যা আমরা ভাবি এর চেয়ে অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ আমাদের রাগের ওপর। আমরা যদি অন্যকে আহত না করে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করি, তখন নিজেরও ভালো লাগে।কী করে রাগকে সামাল দেওয়া যায়, রাগের সময় নিজেকে শান্ত রাখা যায় সে ব্যাপারে কিছু পরামর্শ মেনে চলা যেতে পারে।
বেশি বেশি রাগ মানুষের ক্ষতি করে। শরীরের ক্ষতি, মনের ক্ষতি, জীবিকা ও পেশার (ক্ষতি), এমনকি স্বজনের সম্পর্কও নষ্ট হতে পারে চণ্ডাল রাগের জন্য। সেই মুহূর্তে শীতল হন।যখন রেগে যেতে থাকবেন, তখনই শীতল হতে হবে। এ জন্য যা যা করা যায়—
হাঁটতে বেরিয়ে পড়ুন
যে পরিস্থিতি রাগিয়ে দিল, সেই জায়গা থেকে সরে এলে শান্ত হতে সাহায্য হয়।
ঘর থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে হাঁটলে মন অনেক শান্ত হয়। তখন হাঁটলে অনেক সময় রাগ উবে যায়, সমস্যা থেকেও বেরিয়ে আসা যায়।
বলুন, বলতে দ্বিধা করবেন না, ‘আমি একটু হাঁটতে বেরোলাম।’
রাগের প্রথম আবেগটা সামলাতে হবে
দুর্বাসা মুনির মতো রাগ যাঁদের, প্রচণ্ড রাগী, ক্ষণে ক্ষণে যাঁদের রাগ, তাঁদের রাগের প্রথম দমকটাই প্রচণ্ড। হয়তো রেগে গাড়ির কাচে লাঠির আঘাত করলেন, নয়তো কংক্রিটের দেয়ালে ঘুষি মেরে বসলেন, চেঁচিয়ে উঠলেন বিকটভাবে—এমন বিধ্বংসী প্রকাশের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা কেন? একটু ভাবুন এমন প্রচণ্ড না রেগে নিজেকে একটু সামলান।
ঘর থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে হাঁটলে মন অনেক শান্ত হয়। তখন হাঁটলে অনেক সময় রাগ উবে যায়, সমস্যা থেকেও বেরিয়ে আসা যায়।
গভীর শ্বাসক্রিয়া
চেয়ারে সোজা হয়ে বসুন। নাক দিয়ে গভীর শ্বাস নিন, ১ থেকে ৬ পর্যন্ত গুনুন। এরপর শ্বাস ছাড়ুন ১ থেকে ৮ গোনা পর্যন্ত। থামুন, এ রকম করুন ১০ বার। শ্বাসকর্মের দিকে কেবল নজর রাখুন, মন হবে পরিষ্কার মেঘমুক্ত নীল আকাশ, যা কিছু মন খারাপের জন্য দায়ী, তা পরিষ্কার হয়ে গেছে…।
৫০ থেকে পেছন দিকে গুনুন
সশব্দে গুনলে এমনকি সংখ্যাগুলো নিজের প্রতি ফিসফিস করে বললেও এক মিনিটে জলদি শান্ত হওয়া সম্ভব। এটি করার সময় শরীরকে শান্ত রাখতে হবে, যা নিয়ে নজর থাকবে তা হলো সংখ্যাগুলো।
এই সহজ ও সুনির্দিষ্ট কার্যটির দিকে লক্ষ করলে সেই মুহূর্তে অন্য কিছু দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার আশঙ্কা কমে এবং অনেক শান্ত মাথায় সমস্যা মোকাবিলা করা যায়। এরপরও রাগ থাকলে, চর্চাটি পুনরায় করা যায়, ১০০ থেকে পেছন দিকে গুনুন।
ধ্যান করুন
ধ্যান আবেগ বা ইমোশন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যদি বোধ করেন যে আপনার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে, নিয়ন্ত্রণ থাকছে না, তখন ধ্যান চর্চার মধ্যে একটু মনকে ছুটি দিলে ভালো। সে পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিন, চলে যান অন্য কোনো ঘরে, এমনকি স্নানঘরেও যেতে পারেন।
ধীর, গভীর শ্বাস নিন। এ রকম শ্বাসক্রিয়া চলতে থাকলে হৃদ্ঘাত হার নেমে আসে। শ্বাসগ্রহণ এত গভীর হওয়া উচিত যেন প্রতিটি শ্বােস প্রথমে পেট ফুলে ওঠে।
মনশ্চক্ষুতে দেখুন একটি সোনালি-শ্বেত আলো, প্রতিটি শ্বাসগ্রহণের সময় সেই আলো পূর্ণ করছে শরীর। যখন শ্বাস ছাড়বেন, মনশ্চক্ষুতে দেখুন কর্দমাক্ত গাঢ় রংগুলো শরীরকে ছেড়ে যাচ্ছে।
…প্রতিদিন সকালে ধ্যান করার অভ্যাস করুন, রাগ না থাকলেও; এতে সার্বিকভাবে অনেক শান্ত থাকবে মন।
মনের চোখে দেখুন একটি প্রশান্তির দৃশ্যপট
চোখ দুটো বুজে পৃথিবীর একটি প্রিয়স্থানকে ভাবুন, হয়তো কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকতে বালুকাবেলায় শুয়ে আছেন, নয়তো খুব সুন্দর হ্রদের ধারে ছোট শিশুর মতো ছোটাছুটি করছি। হতে পারে দেখছেন চোখ বুজে এমন একটি স্থান যেখানে কখনোই যাওয়া হয়নি, একটি ঘন অরণ্য, ফোটা ফুলভর্তি মাঠ, সুন্দর নিসর্গ দৃশ্য…। মন শান্ত হয়ে গেল। শ্বাস হয়ে এল স্বাভাবিক। প্রতিটি জিনিসের খুঁটিনাটি দেখুন, রাগের ভাবনাগুলো উড়ে যাবে।
মন শিথিল করা কোনো সংগীত শুনুন
প্রিয় শিল্পীর গান শুনলে মনের রাগ চলে যায়। মেজাজ ভালো হয়ে ওঠে। উচ্চাঙ্গসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, জ্যাজ বা যার যেমন পছন্দ তেমন গান শুনতে পারেন। শান্ত হয় মন।
ইতিবাচক চিন্তা আসুক মনে
নিজের মনের ইতিবাচক চিন্তার দিকে লক্ষ করলে রাগকে কমানো সহজ হয়। চোখ বুজুন, নেতিবাচক সব চিন্তা মন থেকে দূর করে দিন, ইতিবাচক চিন্তা করুন যেমন:
* আমার এ রাগ চলে যাবে।
* একে সামলানো আমার জন্য খুব সহজ কাজ।
* চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি আসলে আমার জীবনে সুযোগ মাত্র।
* চিরদিন রেগে থাকব না, এ নিতান্ত সাময়িক আবেগ।রাগ হবে দূর। তবে দুজনে রাগ করে যদি পরে তা অনুরাগে পরিণত হয়, তাহলে সে রাগ ভালো।
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা