ভালোবাসা’ আমার জীবনের অপার বিষ্ময়ের একটা শব্দ। সেই কৈশোর থেকে যখন বুঝতে শিখেছিলাম — আমি এই শব্দ দিয়েই পড়েছি কবিতা, সমস্ত গানেই পেয়েছি এই শব্দ। প্রথম পড়েছিলাম রোমিও-জুলিয়েট। কী অপার বিষ্ময়কর সেই ভালোবাসা!! কী চরম বিভেদ তাদের দুই পরিবারে, তারপরেও তাদের সেই গভীর ভালোবাসা তাদের নিয়ে গেলো মৃত্যুর টানে। একজন বিষ খেলো দেখে আরেকজন ছুরি বসিয়ে বিদায় নিলো পরপারে। শেক্সপীয়রীয় সাহিত্য — সাহিত্যজগতে সর্বাধিক পাঠ্যগুলোর একটা এই রোমিও-জুলিয়েট, নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমি এই পাঠে শেখার চেষ্টা করেছিলাম ভালোবাসা কী জিনিস।
সবাই বলতো দেবদাসের কথা। সেই কিশোর বয়সেই হাতে তুলে নিলাম শরৎ রচনাসমগ্র। পথের দাবী, দেবদাস, বড়দিদি, মেজদিদি ছিলো আজো মনে রাখার মতন। কিন্তু দেবদাসের জীবনটাও সেইরকম “ভালোবাসার”। পড়তে পড়তে স্বভাবসুলভভাবে নিজেকে বসিয়ে দিতাম দেবদাসের জায়গায়। পার্বতী এলোচুলে যখন বাসায় বসে, আমি বহুদূর থেকে ফিরে তাদের বাড়িতে গিয়ে পার্বতীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবার চেষ্টা করলাম কল্পনায়। তারপর নিজের সমস্ত বিশেষত্ব, প্রতিভা জলাঞ্জলি দিয়ে শহরে ভালোবাসায় চুর হয়ে চন্দ্রমুখীর বাহুবন্ধনে জ্ঞানহারা হবার ব্যাপারটাতে নিজেকে কিছুতেই বসাতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত মৃতদেহ যখন পার্বতীর বাড়ির সামনে পড়ে থাকলো –তখনো সেই ভালোবাসার স্বরূপ উদঘাটনপূর্বক অনুভব করতে না পারার কষ্টে আমি দেবদাসের বিশেষত্ব নিয়ে গল্প করিনি। এই মুভি (বাংলা বা হিন্দী) কোনটাই দেখতে যাইনি। আমি বইয়ের প্রতিটি লাইন যেভাবে গভীরতায় অনুভব করেছিলাম, চলচ্চিত্র সেখানে কোন প্রকৃত “ভালোবাসা” চেনাতে পারবে বলে বিশ্বাস করিনি।আরেকটু বড় হতেই হাবিবের গান খুব ভালো লাগতো — “দিন গেলো তোমার পথ চাহিয়া, মন পোড়ে সখী গো কার লাগিয়া, সহেনা যাতনা, তোমারো আশায় বসিয়া, মানেনা কিছুতে মন আমার যায় যে কাঁদিয়া, পুড়ি আমি আগুনে…” তারপরের লাইনে ছিলো “যার কথা মন ভেবে যায়, যার ছবি মন এঁকে যায়, যারে হায় এ মন যায়, জীবনে পাবো কি তার দেখা”… শুনতে এত ভালো লাগতো যে কারো জন্য ‘মন পোড়াতে’ ইচ্ছে করতো। শেষের লাইনটা হতাশার — জীবনে পাবো কি তার দেখা। সুরের মূর্ছনায় ডুবে সব জলাঞ্জলি দিয়ে “কারো জন্য” অপেক্ষার ব্যাপারটাতেই ‘ভালোবাসা’ পাওয়া যায় বলে বোদ্ধা বন্ধুদের দাবী ছিলো। আমি আরেকটা স্বরূপ পেলাম, যাকে ঠিক বিশেষায়িত করতে পারলাম না তখনো।
টাইটানিক মুভিটিতে নাকি কেট আর ডিক্যাপ্রিওর ছিলো অমর প্রেম, অনবদ্য ভালোবাসা। ভালোবাসার খোঁজে সেই মুভিটাও দেখেছিলাম। কিশোর ছেলের জন্য উষ্ণতা দেয়া ছাড়া, আর বিশাল টাইটানিকের ডুবে যাওয়ার মাঝে আমি ‘ভালোবাসা’ খুঁজে পাইনি। তারপর ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যাউঙ্গা’ দেখতে বসেছিলাম — সেটাও বন্ধুদের দাবীর ‘অপার ভালোবাসা’ খুঁজে পেতে। পারিবারিক কোন্দলকে বাড়িয়ে দেয়ার ‘চলচ্চিত্র’ কাহিনীর মাঝে বাস্তবিক ‘ভালোবাসা’ আমার খুঁজে পাওয়া হয়নি। শুধু নায়িকার রূপসৌন্দর্যে নিজের ভিতরের বুভুক্ষু প্রেমিকটা আরেকটু ‘বিরহে’ পড়ে গিয়েছিলো।
এই কাহিনীর ফিরিস্তি দিতে গেলে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে যাবো। হয়ত এরকম আরো অন্তত ৫০গুণ লাইন লিখতে হবে — কেবল অভিজ্ঞতা তথা অনুভূতি/ভাবনা শেয়ার করা হবে। কিন্তু আসল কথা হলো–সবকিছুর পরেও ছিলাম অন্ধকারেই। এরপর তারুণ্য পেরিয়ে যৌবনে এলাম। চারপাশে যৌবনের জয়জয়কার। এই যৌবন কোন বাধা মানে না। এই যৌবনে আছে ‘ভালোবাসা’ যেটা বাবা-মায়ের অগোচরে রোমান্টিক হওয়া। সিনেমার নায়িকাদেরকে নিজের ‘প্রেমিকা’, যাকে “আই লাভ ইউ” বলে অ্যাচিভ করা হয়েছে তার মাঝে খুঁজে পাবার শত চেষ্টা। কত বান্ধবীর যে পোশাক বদলে গেলো প্রেমের ফলে! বলাই বাহুল্য, এটুকু আমি শিখেছিলাম যে অপার ভালোবাসায় পতিত হবার পর সেটা যখন শেকলে আবদ্ধ হয় — তাকে প্রেম বলে। সবই আমার শেখা –আমার পারিপার্শ্বিকে আমি জীবনে এই শিক্ষাটা সস্তায় এবং সর্বাধিক পেয়েছিলাম — ‘ভালোবাসা কারে কয়’। দুঃখের ব্যাপার হলো — আমি বুঝিনি। আমি ভালোবাসার ‘ডেফিনিশান’টাই বুঝিনি।
কোথায় আমার লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েট, দেবদাস-পার্বতী, অপূর্ব-প্রভা, শাহরুখ-গৌরি সবাই আমাকে এমন কিছু দিয়ে গেলো। যা আমার জীবন দিয়ে অর্জন করা সম্ভব না। আমি ধুম করে মরে যেতে পারবো না এমন কারো জন্য যে আজ না হয় কাল মরেই যেতো। আমার যেই জীবনটার জন্য আমি দুই-তিনটি বছরের কোনরাতেই মা-কে ঘুমাতে দেইনি, লাথি দিয়ে, পেশাব করে, চিৎকার করে জীবনটা ফ্যানা ফ্যানা করে দিয়েছিলাম যেই মা’র, তার কথা না ভেবে আমি একটা নারীর জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে অমর ‘প্রেম’ রচনা করে ভালোবাসার সাক্ষর রেখে যাবো বলে বিশ্বাস করিনা, করিনি।
কবিগুরু আমার মত করেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, হয়ত সেদিনও উনি কনফিউজড ছিলেন (কবিতাটির ব্যাকগ্রাউন্ড জানিনা বলে ইউজ ভুল হতে পারে)। বেশ মজার লাইনগুলো। কবিতাংশটা অনেকটা এরকম —
তোমরা যে বল দিবস রজনী
‘ভালোবাসা, ভালোবাসা’ –
সখী ভালোবাসা কারে কয়?
সে কি কেবলই যাতনাময়!
সে কি কেবলই চোখের জল? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস?
লোকে তবে করে কি সুখেরই তরে এমনই দুখের আশ!
ক্যারিয়ারের চিন্তা করে বহু সায়েন্সের বন্ধুদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাংলা-ইংরেজি পড়বি? ওদের উত্তর ছিলো — তাদের চাকরি-বাকরি নাই, এই জিনিস পড়ার প্রশ্নই উঠেনা। সবচাইতে কম চিন্তার গভীরতাসম্পন্ন বন্ধুরাও এই উত্তরটাই দিতো। কী চিন্তা! যেখানে বিশেষ “লাভ” নেই বলে জানে, সেখানে পা দিবে না — এটাই সুস্থ মানবিক গুণাবলী। অথচ, নিশ্চিত “দুখের শ্বাস” সমৃদ্ধ ভালোবাসাতে কারো আগ্রহের কমতি থাকতো না। আমি জীবনের বহুবছর এই “ভালোবাসা” নাক জিনিসটার সঠিক কোন সংজ্ঞা পাইনি। উইকিপিডিয়া টাইপের সাইটের লিঙ্ক দিয়ে লেখাটার ভার বাড়াতে চাইছিনা। সংজ্ঞার চাইতে অনুভূতিটা নিয়েই ভাবছি আপাতত।
আমার বন্ধু ছিলো — ধরি তার নাম আকাশ আর তার প্রেমিকা নীলা। তিন বছর সম্পর্কের পর তারা পরষ্পরের নামে এমন সব কথা বলে বেড়াত নিজ নিজ মহলে। যেই কথা শুনলে, তার অশ্লীলতা চিন্তা করলে কানে আঙ্গুল দিয়েও নিবৃত্ত হতে পারিনি। প্রভা-রাজিবদের ঘটনাগুলো সেলিব্রিটি বলে কানে এসেছে — অমন দেহসর্বস্ব ভালোবাসা এখন তারুণ্যের মাঝে খুব খুব বেশি এভেইলেবল। আর এই ঘটনাগুলোও একই ছাঁচে বাঁধা। যার জন্য পরান দিওয়ানা বলে সবাই জানতো — কোন এক সময়ের স্রোতে তার প্রতিই ঘৃণা, ক্রোধ জমা হয়ে জিঘাংসা তৈরি হলো… সবচাইতে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো — ভালোবাসি ভালোবাসি বলে যার নাম বলে এসেছি “রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে”, পরমূহুর্তে তাকেই “খারাপ, ঘৃণা করি” বলে চিৎকার করার মাঝে যে নিজেরই অতীতকে অস্বীকার করা হয় — সেটা কেন কারো মাথায় আসে না?
আমি ভালোবাসা কারে কয় জানিনা। তবে বুঝেছি এই ভালোবাসা আমরা শিখেছি নাটকের সুন্দরী মেয়েটার প্রতি ছেলেটার শব্দচয়ন থেকে। সিনেমায় ক্যাটরিনা কাইফের, প্রিয়াংকা চোপড়ার হাসিতে মুগ্ধ হয়ে যাওয়া শাহেদ কাপুরদের অস্থির আচরণ থেকে। আমি পথ চলতে দেখি “দীঘল কালো চুলের বাঁধনে বাঁধুন প্রিয়জনকে”, ভুরু প্লাক করে, চুল সিল্কি করে নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করে “ভালোবাসা” ধরে রাখাটা শিখেছি “গীত, কাহানি ঘর ঘর কী” টাইপ শত-সহস্র সিরিয়াল থেকে। আমার জীবনের সবচাইতে “ক্রুশিয়াল, সফিস্টিকেইটেড” তথা গুরুত্বপূর্ণ আর সংবেদনশীল শিক্ষার ভার আমি টেলিভিশনের থেকে, প্রথম আলোর নকশা আর আনন্দ আলোর পাতা থেকেই শিখছি। অথচ ঢাকার সবচাইতে দামী টিচার “আজমল” স্যারের বাসায় লাইন ধরে অ্যাডভান্স ভর্তি হয়ে নিশ্চিত করি জীববিজ্ঞান শিক্ষা।
আসলে পুরো ব্যাপারগুলোই কেবল বয়ে যেতে দেয়া! সবাই চিন্তা ছাড়াই চালিয়ে দেয়। স্কুল-কলেজের রেজাল্টটা দেখা যায় তাই বাবা মা কনসার্নড। কিন্তু জীবনের এই শিক্ষাগুলোর পরীক্ষার মার্কসগুলো দেখা যায়না বলেই এই আধুনিক বাবা-মায়েরা যার-তার হাতে সন্তানের শিক্ষাটা তুলে দিচ্ছেন। আসলে আমি ভাবছিলাম, ভালোবাসা কী আমাকে জিঘাংসু হতে শেখায়? যাকে ভালোবাসতাম, তার সামনের শুভ্র-সুন্দর দিনের সম্ভাবনা থাকলেই কেন পুরোনো প্রেমিক তার গর্দান নিতে দৌড়ে যায়? তাহলে কেন এই ভালোবাসা? তা কেবলই ভোগের জন্য? ক্ষতিই যদি করতে চাই, তাহলে তো সে আমার নিজের হলেও তার ক্ষতিতে আমার কিছু যেত আসতো না! কী ভয়ংকর আমাদের রূপ! কী ভীষণ স্বার্থপর আমরা!!
ভালোবাসা যেন কেবল আমারই কোর্টের বল! তার অন্যথা হলেই, ভোগ করতে না পারলেই পাশবিক রূপ বের হয়ে পড়ে। এই ইন্দ্রিয়ের ভালোবাসার নামই আসলে ভালোবাসা– লোকে যাকে প্রেম নাম কহে। আমার দেহ, আমার চোখ, আমার কানকে তুমি যতক্ষণ সার্ভিস দিচ্ছ — ততদিন আমি ভালো, তোমায় ভালোবাসি। এর অন্যথা হলেই তোমায় ঘৃণা করি। আবার এই দামী জীবনটা যাদের বছরের পর বছরের কষ্টে, ক্লেদে, পরিশ্রমে বেড়ে উঠেছে — সেই মা-বাবা, ভাই-বোনেরাও দুধভাত হয়ে যায় একটা পুরুষ বা নারীর জন্য, যে আসলে তার ফিটনেস পরীক্ষায় পাসও করেনি। হয়ত প্রিয়জনদের কয়েক যুগের অপজিটে দশদিন কনসিস্টেন্সি রাখার যোগ্যতাও তার নেই।
যিনি আমার দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি করেছেন অপরূপ সুষমায়, যিনি আমাকে জ্ঞান-বুদ্ধি-মেধা দিয়েছেন তাকে ভালোবাসার কথা ভেবেও দেখিনা কখনো। উনি যদি “তোমার জন্য এত করলাম, তুমি আমার দিকে ফিরেও দেখলেনা, এখন তোমার খবর আছে” বলে আমাদের দেখে নিতেন — হলফ করে বলতে পারি এই পৃথিবীময় কেবল ছাই দেখা যেত কমপক্ষে। আমার এই ভালোবাসা কাকে দেবো বলে অনেকদিন ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়িয়েছি। জনমভোর বিদঘুটে ঘটনা, অপবিত্র-অশ্লীল ঘটনার মূলে আমাদের সমাজের লোকের কাছে শেখা “ভালোবাসা”কে খুঁজে পেয়ে আমি ক্লান্ত হয়েছি।
তারপর, একদিন সংকল্প করেছি ভালোবাসাকে নষ্ট হতে দেবো না। সুন্দরতম, প্রিয়তম, প্রেমময়, অন্তরতম জন, যিনি সবসময় আমাকে ভালোবাসতেন, ভালোবাসবেন — আমি তাকেই ভালোবাসবো। সবচাইতে বিপদের দিন যখন জগতের কেউ আমার পাশে আসবে না– সেদিন যিনি বিচারকের সামনে আমার পক্ষে হয়ে কথা বলবেন — তাকে ভালোবেসেই আমি স্বার্থপর হবো। এই স্বার্থপরতায় জগতে ক্ষতি নেই, এই প্রেমে নেই উন্মাদনা, নেই প্রচলিত নোংরা পরিণতি। এই ভালোবাসাতে হোক আমার জগত ভালোবাসাময়। এই ভালোবাসা ছড়িয়ে যাক সৃষ্টি চরাচরে, আমি চাই প্রেমময় পৃথিবী, আমি অর্থহীনতার মাঝে আমার ভালোবাসাকে উজাড় করে দিতে চাইনা। এক ভালোবাসাতেই ভালোবাসা ছেয়ে যাবে আমার চারপাশের মানুষের প্রতি। সবাই পাবে স্বার্থহীন ভালোবাসার স্পর্শ। যার পাওনা কেবল অনন্ত জগতেই, এই ক্ষুদ্র জীবনে তাই…
সমাপ্ত
সৌজন্য Ourislambd.com