Site icon Trickbd.com

আপনার কম্পিউটারের জন্য “ নকল র‌্যাম “ কিনছেন না তো?

কম্পিউটারের জন্য র‌্যাম কিনতে চান? হুট করেই কিনে ফেলবেন না যেন। বাজারে কম্পিউটারের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় আসল র‌্যামের পাশাপাশি রয়েছে নকল র‌্যামের ছড়াছড়ি। নাম এক, লোগো এক, এমনকী র‌্যামের প্যাকেটে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নিরাপত্তা সিলও (ট্যাগ) রয়েছে। ফলে বোঝা বেশ শক্ত কোনটি আসল, কোনটি নকল র‌্যাম।

নকল র‌্যামের দাম আসল র‌্যামের তুলনায় অনেক কম হওয়ায় ক্রেতারা না বুঝে, না চিনে ‘নকলের’ প্রতি ঝুঁকছে। ‘নতুন র‌্যাম’ লাগানোর পর কম্পিউটার আগের মতো পারফর্ম করছে না, গতি ধীর হয়ে যাচ্ছে, কখনও হ্যাং করছে, কাজের মাঝে হঠাৎ রিস্টার্ট হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সবই হচ্ছে কম্পিউটারে নকল র‌্যাম লাগানোর ফলে। কারণ, নকল র‌্যাম কম্পিউটারে ব্যবহার করা হলে এ ধরনের সমস্যা হয়ই।

সম্প্রতি বাজারে নকল ও কপি র‌্যামের সরবরাহ ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। যদিও এমন অভিযোগ আগে থেকেই ছিল। অতিসম্প্রতি তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশের প্রযুক্তি বাজারে র‌্যামের পরিবেশকরা (আমদানিকারকরা) বলছেন, তারা মেমোরি মডিউলের ব্যবসা থেকে সরে যেতে চাইছেন। কারণ হিসেবে বলছেন, আগে তারা মাসে ১৫ হাজার বিক্রি করলেও এখন এক হাজার র‌্যাম বিক্রি করতেও হিমশিম খাচ্ছেন। এছাড়া আসল র‌্যামের সঙ্গে নকল র‌্যামের দামের পার্থক্য ২০০-৩০০ টাকা হওয়ায় তারা নিজেরাও কোনও ধরনের মার্জিন রাখতে পারছেন না। অন্যদিকে ক্রেতাদেরও বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছেন আসল র‌্যামের সুফল। প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, শুধু নকল র‌্যামের কারণে শিগগিরই শত শত কম্পিউটার অচল হয়ে পড়তে পারে।

দেশের প্রয‌‌‌ুক্তি বাজারে ট্রান্সসেন্ড, অ্যাপাসার, এ-ডাটা, টুইনমস, টিইএম ব্রান্ডের র‌্যাম রয়েছে এবং এগুলোর অনুমোদিত পরিবেশকও রয়েছে। ডাইনেট, টি-র‌্যাম নামের স্বল্প পরিচিত ব্র্যান্ডের র‌্যামও রয়েছে বাজারে। এর পাশাপাশি নন ব্র্যান্ডের কিছু র‌্যাম বাজারে পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নামি-দামি ব্র্যান্ডের র‌্যামই কপি বা নকল হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ‌‌‌দেশের এক শ্রেণির প্রযুক্তি ব্যবসায়ীরা চীন ও হংকং থেকে নন ব্র্যান্ডের র‌্যাম কিনে দেশের বাজারে ছাড়ছে। আরও অভিযোগ রয়েছে চীন ও হংকংয়ের বাজারে নামহীন বিভিন্ন ধরনের র‌্যাম পাওয়া যায়। চাইলে ওই নাম-পরিচয়হীন ব্র্যান্ডের র‌্যামের উৎপাদকরা ক্রেতার দেওয়া নাম বসিয়ে (প্রিন্ট) দিচ্ছে র‌্যামের গায়ে। এমনকি নামি ব্র্যান্ডের র‌্যামের আমদানিকারকদের নিরাপত্তা সূচক ট্যাগও তৈরি করে মোড়কের গায়ে বসিয়ে দিচ্ছে। ফলে কোনওভাবেই আসল-নকল চেনার উপায় থাকছে না।

এ প্রসঙ্গে গ্লোবাল ব্র্যান্ডের (এ-ডাটা ব্র্যান্ডের পরিবেশক) চেয়ারম্যান আবদুল ফাত্তাহ বলেন, আমরা মেমোরি মডিউলের ব্যবসা ছেড়ে ‌‌‌দিচ্ছি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আগে আমরা প্রতিমাসে ১২-১৫ হাজার র‌্যাম বিক্রি করতাম, এখন তা এক হাজারে নেমে এসেছে। এভাবে তো টিকে থাকা যাবে না। তিনি জানান, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশে প্রচুর পরিমাণে পণ্য (র‌্যাম, প্রসেসর) ঢুকছে কেজি হিসেবে। আর তারা পণ্য আমদানি করেন প্রতি পিস হিসেবে। এভাবে চললে তো বৈধ পথের আমদানিকারকরা টিকে থাকতে পারবে না। আর এ কারণে সরকার প্রচুর পরিমানে রাজস্ব হারাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আবদুল ফাত্তাহ আরও জানান, বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম পোর্টে ‘নন চ্যানেলের’ মাধ্যমে দেশে প্রচুর পরিমাণ এসব পণ্য ঢোকায় সঠিকভাবে শুল্কায়ন হচ্ছে না। এসব সমস্যার কথা সম্প্রতি তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে জানিয়েছেন। তার মতে, এ সবের প্রতিকার না হলে, দিন দিন এসব পথে দেশে দেদার পণ্য ঢুকবে। তিনি জানান, তাদের আমদানি করা র‌্যামও (এ-ডাটা) কপি হচ্ছে। কোনওভাবেই তা রোধ করতে পারছেন না তারা।

ট্রান্সসেন্ড ব্র্যান্ডের র‌্যামের পরিবেশক ইউসিসির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী সারোয়ার মাহমুদ খান জানান, ট্রান্সসেন্ড চীন থেকে কপি করে এনে দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এতে করে অরিজিনাল র‌্যাম বাজার হারাচ্ছে। তিনি বলেন, এই কিছুদিন আমরা যে র‌্যামের কোটেশন করলাম ২ হাজার ৮০০ টাকা, অন্য একটি প্রতিষ্ঠান তা কোট করল মাত্র ১ হাজার ৬০০ টাকায়। তিনি প্রশ্ন করেন, এটা কপি বা নকল না হলে কীভাবে সম্ভব? তিনি জানান, ইউসিসি আগে মাসে ১৫ হাজার র‌্যাম বিক্রি করলেও এখন হচ্ছে এক হাজারের কিছু বেশি।

অরিজিনাল র‌্যামের সঙ্গে নকল র‌্যামের বা কপি র‌্যামের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এতে লো কোয়ালিটি বা ডাউন গ্রেডের চিপ ব্যবহার করা হয়। এর পিসিবি বোর্ডটাও থাকে নকল। সারোয়ার মাহমুদ খান আরও বলেন, চীনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদক) র‌্যাম তৈরি করে। তাদের কাছে যেকোনও নামের র‌্যাম দিতে বললে, র‌্যামের ওপর ওই নাম প্রিন্ট করিয়ে দিচ্ছে। এসব র‌্যাম নিম্নমাণের। এর চেয়েও নিম্নমানের র‌্যাম হলো যেগুলোয় নকল চিপ ও পিসিবি বোর্ড দিতে তৈরি করা হয়। এসব পণ্যই বাজার দখল করে নিচ্ছে।

অ্যাপাসার র‌্যামের পরিবেশ কম্পিউটার সোর্সের স্ট্র্যাটেজিক বিজনেস ইউনিট বিভাগের প্রধান মেহদী জামান তানিম বলেন, দেশে এখন পকেটে পকেটে র‌্যাম ঢুকছে। এগুলো অরিজিনাল হলেও সরকার শুল্ক হারাচ্ছে। ক্রেতারা পাচ্ছে না ওয়ারেন্টি। বিমানবন্দর দিয়ে কপি ও নকল র‌্যাম ঢুকছে বক্স ভরে। তিনি আর বলেন, এই কিছু দিন আগেও মাসে আমাদের ১৫ হাজার পিস র‌্যাম বিক্রি করতে কোনও সমস্যা হতো না। আর এখন, এক হাজার পিস বিক্রি করতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। তার মানে কি র‌্যামের বাজার ছোট হয়ে গেছে? মোটেই না, বরং বেড়েছে। ওই জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে নকল র‌্যাম।

টুইনমস র‌্যাম বাজারজাত করে স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি পণ্য ব্যবস্থাপক আবদুল হান্নান বলেন, আমাদের টুইনমস র‌্যামও নকলের শিকার। তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের নাম সরাসরি উচ্চারণ করে বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটি চীন থেকে নকল র‌্যাম নিয়ে আসছে। এতে করে ক্রেতারা অরিজিনাল টুইনমস র‌্যাব কিনতে পারছে না। তিনি বলেন, এসব কারবারির আস্তানা এলিফ্যান্ট রোডের বাজারগুলোয়। এ সব কারবারীদের এখনই ঠেকাতে না পারলে এক সময় বাজারে অরিজিনাল র‌্যামও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সংশ্লিষ্টরা পরামর্শ দিলেন, কেনার আগে সংশ্লিষ্ট র‌্যামের অনুমোদিত পরিবেশক আছে কি না, তার খোঁজ করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা সিলসহ তা কেনা। তাহলে ঠকার শঙ্কা কম থাকবে। সংশ্লিষ্টরা বললেন, বাজারে নতুন আসা কোনও র‌্যাম নকল বা কপি হয় না। কোনও একটি ব্র্যান্ড জনপ্রিয়তা পেলে, বাজার শেয়ার দখলে নিলে সেই র‌্যামের দিকে চোখ পড়ে ‘দুষ্টচক্রের’। আশঙ্কা বেড়ে যায় তখনই। ফলে দেখা যাচ্ছে যে ব্যান্ড যত জনপ্রিয় সেই ব্র্যান্ডের নকল বা কপি হওয়ার ঝুকি তত বেশি।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এলিফ্যান্ট রোড কেন্দ্রিক প্রয‌‌ুক্তি বাজারগুলো এসব অপকর্মের আখড়া বলে বিবেচিত হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এখানে এসব পণ্য আসছে, পরে সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশের প্রযুক্তি বাজার এবং দোকানগুলোয়। সবাই সব জানে কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। যারা এসব করছে তারাও কম্পিউটার ব্যবসায়ী। কম্পিউটার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতিও তাদের ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব পোষণ করছে। অনেকে অভিযোগ করেছেন, সমিতি যদি এসব ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে যায় তাহলে, ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ হয়ে যাবে। সমিতির নেতাদের কাছে জানতে চাইলে তাদের গৎবাঁধা উত্তর রেডি, আমরাও শুনেছি। কিছু কিছু হচ্ছে। তবে এত বেশি নয়। তাদের ধরার বিষয়ে আমরা তৎপর রয়েছি। ভবিষ্যতে সব ঠিক হয়ে যাবে।