ভূমিকম্পেরও পূর্বাভাস হতে পারে। আর তা ভূমিকম্পের ৭২ ঘণ্টা আগেই সম্ভব। নিখুঁতভাবেই সম্ভব। ভূমিকম্প কখনো বলে-কয়ে আসে না। আর এর কথা আগাম জানাও সম্ভব না এমনটাই এতদিন ভাবা হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা, বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন এই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্র আনন্দবাজার এ নিয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে পৃথিবীর এ প্রান্ত ও প্রান্ত ধরে চার বার বড় বড় ভূকম্পন হয়ে যাওয়ার পর এ প্রতিবেদনটি সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় দেশে বিদেশের পাঠকের কাছে তুলে ধরা হলো- এক সপ্তাহের মধ্যে চার বার বড় বড় ভূকম্পন। কখনও কাঁপল ভারতীয় উপমহাদেশ, কখনও কেঁপে উঠল পৃথিবীর পূর্বতম সেই প্রান্ত, যেখানে সূর্যোদয় হয় সবার আগে। কখনও কাঁপল সুদূর লাতিন আমেরিকা। উপর্যুপরি এত কম্পন কি অশনিসঙ্কেত? বিজ্ঞান বলছে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। পৃথিবীর প্লেটগুলো খুব অল্প সময়ে পর পর কয়েক বার নড়াচড়া করে ফেলেছে বটে, কিন্তু নীল গ্রহের গর্ভে অস্বাভাবিক কিছু ঘটার লক্ষণ এখনও দেখা যায়নি। বরং অনেক আগে থেকেই আজকাল বুঝে নেওয়া যাচ্ছে, পৃথিবীর ঠিক কোন অংশ কখন কাঁপতে চলেছে। আয়নোস্ফেরিক সায়েন্স হল সেই বিজ্ঞান, যা প্রায় নির্ভুল ভাবে বলে দিতে পারে, কোন অঞ্চলে ভূকম্পন হতে চলেছে। কম্পনের অন্তত ৭২ ঘণ্টা আগে সেই আভাস দিতে পারেন আয়নোস্ফেরিক সায়েন্সের বিশেষজ্ঞরা। ঠিক কী ভাবে পাওয়া যায় এই আভাস? সত্যেন্দ্রনাথ বসু জাতীয় মৌল বিজ্ঞান কেন্দ্রের সিনিয়র প্রফেসর সন্দীপ চক্রবর্তী বললেন, ‘‘বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ারে একটা বিশেষ অস্বাভাবিকতা থেকে বোঝা যায়, ভূমিকম্প আসতে চলেছে।’’ কী সেই অস্বাভাবিকতা? অধ্যাপক চক্রবর্তী জানালেন, আয়নোস্ফিয়ারের সবচেয়ে নীচের স্তরে মুক্ত ইলেকট্রনের সংখ্যা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেলেই বোঝা যায়, কম্পন হবে। উপযুক্ত পরিকাঠামো ব্যবহার করলে এটও বোঝা যায় যে পৃথিবীর ঠিক কোন অঞ্চল কাঁপতে চলেছে। আয়নোস্ফেরিক সায়েন্সের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুমণ্ডলের আয়ন স্তরে যে সব গ্যাস রয়েছে, সেগুলি আয়নীয় অবস্থায় থাকে, কারণ প্রচণ্ড তাপের কারণে অণুগুলি থেকে ইলেকট্রন ছিটকে বেরিয়ে যায়। সূর্যরশ্মিতে যে অতিবেগুনি রশ্মি এবং অবলোহিত রশ্মি থাকে, তা আয়নোস্ফিয়ারের তাপ অনেক বাড়িয়ে দেয়। তার জেরেই গ্যাসের অণু থেকে ইলেকট্রন ছিটকে বেরিয়ে প্রচুর আয়ন তৈরি হয় তার পাশাপাশি প্রচুর ইলেকট্রন সেখানে মুক্ত অবস্থায় ঘুরতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর যে অংশে যখন দিন, সেই অংশের উপরের আয়নোস্ফিয়ারে তখন মুক্ত ইলেকট্রনের সংখ্যা বেশি হয়। যে অংশে রাত, সেখানে মুক্ত ইলেকট্রনের সংখ্যা কম হয়। শুধু তাই নয়, আয়নোস্ফিয়ারের উপরের অংশ বেশি তপ্ত হওয়ায় সেখানে মুক্ত ইলেকট্রন যে সংখ্যায় থাকে, তলার দিকের স্তরে তার চেয়ে ওই সংখ্যা অনেক কম থাকে। আয়নোস্ফেরিক সায়েন্স বায়ুমণ্ডলের এই তলার স্তর বা ডি রিজিয়নের ইলেকট্রন সংখ্যা দেখেই বলে দিতে পারে, ভূকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে কি না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি দেখা যায় রাতেও আয়নোস্ফিয়ারের ডি রিজিয়নে মুক্ত ইলেকট্রনের সংখ্যা অস্বাভাবিক বেশি, তা হলে বুঝতে হবে সূর্যরশ্মির কারণে নয়, ভূগর্ভ থেকে নির্গত র্যাডন গ্যাসের কারণে সেটা হয়েছে। এই র্যাডন গ্যাস ভূগর্ভের বিভিন্ন খাঁজে জমে থাকে। টেকটনিক প্লেট নড়াচড়া করলে ওই গ্যাস বাইরে বেরিয়ে আসে। তা সোজা আয়নোস্ফিয়ারে পৌঁছে ডি রিজিয়নে আটকায়। সেই গ্যাসের অণু থেকেও ইলেকট্রন মুক্ত হতে থাকে এবং ডি রিজিয়নে মুক্ত ইলেকট্রনের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। আয়নোস্ফিয়ারের যে অংশে এই অস্বাভাবিকতা দেখা যায়, সেই অংশের নীচে পৃথিবীর কোন দেশ রয়েছে তা খতিয়ে দেখেন বিজ্ঞানীরা। সেই দেশে বা তার আশেপাশে অবস্থিত টেকটনিক প্লেটেই যে নড়াচড়া হচ্ছে, তা স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় এবং বিজ্ঞানীরা বলে দেন, কোথায় কম্পন হবে। কম্পনের ৭২ ঘণ্টা আগেই এই আভাস দেওয়া যায়।