সম্প্রতি একটি জরিপ পরিচালনা করতে গিয়ে দেখলাম, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বন্ধুদের প্রায় ৯৯ শতাংশ একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন বা ব্যর্থ হয়েছেন। আমার প্রশ্নটি ছিল, ‘মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমাদের দেশে কী কী ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে, তার অন্তত পাঁচটি উদাহরণ (বা প্রস্তাব বা আইডিয়া) দেবেন।’ উত্তর না পেয়ে আমি মোটেই অবাক হইনি, কারণ প্রাক্-জরিপ আলোচনায় বন্ধুদের অনেকেই কিছু উল্লেখ করতে না পেরে বিব্রত হয়েছিলেন।
উল্লিখিত প্রশ্নটিসহ আরও যেসব প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে এই লেখার অবতারণা সেগুলো হলো: ১। মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমাদের কর্মশক্তির (ইউএনডিপির ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ ভাগ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪) কত ভাগ প্রত্যক্ষ আয় সৃজনে সমর্থ হচ্ছেন?
২। ইউএনডিপির তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৯ ভাগ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৪, যাদের ধরা হয় ব্যাপক সম্ভাবনার শক্তি হিসেবে, তাদের কত ভাগ মোবাইল ইন্টারনেট ‘ব্যবহারকারী’ এবং তারা তাদের সম্ভাবনা শক্তির কত ভাগ ব্যবহার করে নিজেদের কর্ম সৃজনের সুযোগ পেয়েছে বা পাচ্ছে?
৩। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো এপ্রিল ২০১৬ প্রতিবেদনে বলছে, গত ২ বছরে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে ছয় লাখ, যা হওয়া উচিত ছিল ন্যূনতম ২৬ লাখ। এই ছয় লাখের কতজন মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ‘ব্যবহার’ করে কর্মস্থলে ভূমিকা রাখছেন, তা জানার উপায় কী?
৪। দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর ৭৪ ভাগ তরুণ। মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে এঁদের জন্য কী কী সুযোগ তৈরি হতে পারে, সে বিষয়ে ভাবনার দায়িত্ব কার?
৫। ইউএনডিপি বলছে, বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে আড়াই কোটি নতুন কর্মসংস্থান দরকার হবে। সে হিসাবে প্রতিবছর নতুন কর্মসংস্থানের প্রয়োজন হবে ১৬ লাখ। মোবাইলে ইন্টারনেটের কত ভাগ কর্মসৃজনে ভূমিকা রাখবে?
মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট দিয়ে আমরা তরুণ সমাজের বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করতে পারিনি। থ্রিজি আর একটি স্মার্ট ফোন দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকে একেবারেই ‘প্রাইভেট’ করে দেওয়া হলো বলে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। অপারেটররা যুবসমাজের নির্ঘুম রাত এমনকি ডেটা ব্যবহারের সস্তা নামক প্যাকেজ দিয়ে যেসব কার্যক্রম করছে, তা থামাতে আমাদের হাইকোর্টের নির্দেশনা লেগেছে, ব্যাপারটা দুঃখজনক। উন্নত দেশে বা শহরাঞ্চলে নাগরিক সুবিধার জন্য সাধারণত থ্রি বা ফোরজি (এখন এলটিই প্রযুক্তি) ব্যবহার করা হয়। ম্যাপ, ঠিকানা, হোটেল–রেস্তোরাঁ খুঁজে বের করা বা ব্যাংকিং বা ভ্রমণকাজে নানা রকম অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে তাৎক্ষণিক সেবার সুবিধা গ্রহণে এই প্রযুক্তি জনপ্রিয় হয়েছে।
২০০৯ সালে গৃহীত ব্রডব্যান্ড নীতিমালা ত্রি-স্তর উদ্দেশ্য-সংবলিত যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, সেসব বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ২০১৫ সালের মধ্যে। এই নীতিমালা প্রাথমিকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে খুব সহজেই বোঝা যায়, একে প্রায় উপেক্ষা করা হয়েছে। সে তুলনায় মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার সম্প্রসারণেই আমরা অনেক বেশি ব্যস্ত থেকেছি। এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে ইতিমধ্যে সারা দেশের পোস্ট অফিস, হাসপাতাল, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পেত। গ্রামে গ্রামে যদি এই সেবা সম্প্রসারিত হতো, ঘরে বসে বা পাড়ায় পাড়ায় আইটি খাতে সৃজনশীল কর্মব্যবস্থা গড়ে উঠত। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠত তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক নানামুখী প্রশিক্ষণকেন্দ্র। শুধু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপাত্ত সংগ্রহের কাজ করে দিয়েই গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠত সৃজনশীল জ্ঞানকর্মী। জনমিতির তথ্য সংগ্রহ, স্বাস্থ্য তথ্য, হাঁস, মুরগি, গবাদিপশু, গাছপালা এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক তথ্য সরবরাহের এমন সহজ সুযোগ সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করতে পারছে না। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের পরিকল্পনা উপেক্ষা করে এ কাজের সুযোগ নষ্ট করা হচ্ছে।
এখনো সময় আছে। আমাদের সংগ্রহে পর্যাপ্ত ব্যান্ডউইট্থ আছে। উপজেলা পর্যায়ের প্রায় সবগুলো এক্সচেঞ্জ উচ্চগতির ইন্টারনেট দিতে সক্ষম। দরকার শুধু মূল কেন্দ্র থেকে তার দিয়ে তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া। ক্ষেত্রবিশেষে তারবিহীন ব্যবস্থাও সম্ভব। দরকার শুধু সদিচ্ছা আর মোবাইল ইন্টারনেটের দুর্বল বুলির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো।
রেজা সেলিম: পরিচালক, আমাদের গ্রাম-উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প।