তার উঠে আসার গল্পটা রুপালি
পর্দার সিনেমাকেও যেন হার
মানাবে। জন্ম একেবারেই প্রান্তিক
এক জনপদে। নেত্রকোনার বাহাট্টা
থানার রায়পুর ইউনিয়নের
নোয়াপাড়া গ্রাম। বাবা
জালালউদ্দিন। গ্রামের হাটে
তিনি ধান-চালের ব্যবসা করতেন।
সংগ্রাম করতে করতেই যার কেটে
যায় পুরোটা দিন। ছেলের মাঝের
সুপ্ত প্রতিভার দিকে কতটাইবা নজর
দিতে পারতেন তিনি।
দুরন্ত আবু হায়দার রনি। জীবনযুদ্ধের
সেই সংগ্রামী বাবারই আদরের
ছেলে। পড়াশোনা করেছেন
নেত্রকোনার আঞ্জুমান সরকারি
আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে
আবু আব্বাস ডিগ্রী কলেজে ভর্তি
হওয়ার আগেই অবশ্য এলাকায় নাম
ডাক ছড়িয়ে পড়েছিল। এমন জোরে
বল ছোড়া ছেলে তো আর দশ
গ্রামে ছিল না! ডাক পড়লেই খ্যাপ
খেলতে যেতেন। কিন্তু তার স্বপ্নটা
তো আরো বড়। লাল-সবুজের হয়ে
প্রতিনিধিত্ব করা চাই। তাইতো
গ্রামের মায়া ছেড়ে এক সময় পা
বাড়ালেন শহরের পথে। এলেন
রাজধানীতে। তারপর অচেনা অলি-
গলি চিনতেই কেটে গেল খানিকটা
সময়। তবে হাল ছাড়লেন না। লক্ষ্যে
এগোতে থাকলেন ধীরে ধীরে।
একদিন সুযোগটা যখন মিলেই গেল,
তখন আর হাতছাড়া করা কেন? প্রথম
সুযোগেই নিজের জাতটা
চেনালেন। স্বপ্ন পূরণের পথটাও আরো
প্রশস্ত হল!
বয়স ২০-এর ঘর পেরোয়নি রনির। এমন এক
তরুণকে পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার
করাটা রীতিমতো অন্যায়ই। তার
ওপর এখনো জাতীয় দলের দরজা
খোলেনি ছেলেটির। তবে
ব্যাটসম্যানদের ডাক করতে বাধ্য
করানোর পর যে শারীরিক ভাষার
বহিঃপ্রকাশ, সেটি ক্ষিপ্র এক
পেসারের আবির্ভাবের সম্ভাবনার
কথাই জানিয়ে দেয়। সঙ্গে
বয়সভিত্তিক দলে টানা কয়েক বছর
প্রতিভার বিচ্ছুরণ, সামর্থ্যকে
পারফরমেন্সে রূপান্তরের দক্ষতা ও
টেম্পারামেন্টের দিকে খেয়াল
রাখলে অনায়াসেই বলে দেওয়া
যায়- বাংলাদেশ ক্রিকেট
আরেকজন তেজিবাঘের সার্ভিস
পেতে যাচ্ছে। বাঁহাতি পেসার
রনির জাতীয় দলে জায়গা করে
নেওয়াটা এখন যেন কেবল সময়ের
ব্যাপার মাত্র!
রনির বয়স সবে ১৯। মাস দেড়েক
পেরিয়ে গেলে বিশের ঘরে পা
রাখবেন। সদ্যগত বাংলাদেশ
প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল)
সবচেয়ে আলোচিত-নজরকাড়া
যাকে টুর্নামেন্টের ভাষায় বলে
“মোস্ট ভ্যালুয়েবল বাংলাদেশি
প্লেয়ার”।
মাত্র এক উইকেটের জন্য
টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট
শিকারী হতে পারেননি। তবে যে
সম্ভাবনার কথা জানান দিয়েছেন,
সেটি উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের
বার্তাই দিয়েছে। ১২ ম্যাচে ৪৫.৪
ওভার বোলিং করে নিয়েছেন ২১
উইকেট। সেরা ১৯ রানে ৪টি। যদিও
১৫.০৪ গড়ের সাথে ৬.৯১ ইকোনমির
দিকে তাকালে পুরোটা বোঝা
যাবে না, ঠিক কতটা ধারাবাহিক
ছিলেন এই তরুণ। প্রতি ১৩ বলে একটি
করে উইকেটের পরিসংখ্যানও রনির
মাঠের দাপটের কথা পুরোটা বলবে
না।
বলের গতিটা সময়ের সাথে আরো
খানিকটা বাড়বে নিশ্চিত! তবে
লাইন-লেংথ সহজাত। একই লেংথে,
একই জায়গায় টানা বল ফেলে
যেতে পারেন। আছে সুইং করানোর
স্বকীয় সামর্থ্যও। ইয়র্কার দিতে
পারঙ্গম। সাথে উইকেট প্রাপ্তির
বুনো উদযাপনের ধরন বলে দেয়- পেস
বোলারসুলভ আগ্রাসী মনোভাবটাও
আছে। সব মিলিয়ে ফলাফলটা
কোথায় দাঁড়াতে পারে সেটি
সদ্যগত বিপিএলের সিলেট সুপার
স্টার্সের এটি ম্যাচের দিকে
তাকালেই বোঝা যাবে।
ম্যাচের শেষ ওভারে ৬ উইকেট
হাতে রেখে সিলেট সুপার
স্টার্সের প্রয়োজন ছিল মাত্র ৪ রান।
উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়া রবি
বোপারা। সিলেটের একটি সহজ
জয়কে সেদিন প্রায় ছিনিয়েই
নিয়েছিলেন রনি। পারেননি। তবে,
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের এ তরুণ
পেসার টানা দুই বলে বোপারা ও
লঙ্কান শেহান জয়াসুরিয়াকে
ফিরিয়ে জানান দিয়েছেন,
ভরসাটা রাখলে প্রতিদান মিলবে!
সেই ম্যাচের ঐ ওভারটির জন্য
টাইগার ক্রিকেটের ‘জিওন কাঠি’
মাশরাফি বিন মুর্তজাও ধন্যবাদ
পেতে পারেন। কুমিল্লার অধিনায়ক
যদি তরুণ রনির হাতে সেদিন বল তুলে
না দিতেন, তবে ‘বাজির ঘোড়া’
সন্ধান যে অজানাই থেকে যেত!
অথচ বিপিএল শুরুর আগে সামান্যই
আলোচনায় ছিলেন ১৯-বর্ষী এ তরুণ
পেসার। আবার এমনো নয়, টাইগার
ক্রিকেটে নেত্রকোনার রনি
একেবারেই অচেনা কেউ।
বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক
দলগুলোতে নিয়মিতই খেলেছেন।
অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে বেশ
উজ্জ্বল পারফরমেন্স তার। তবে
সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন ২০১২
সালে জুনে, মালয়েশিয়ায় এসিসি
অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টের একটি ম্যাচ
দিয়ে।
রনির বয়স তখন ১৬। সেদিন ম্যাচে
রুদ্রমূর্তি দেখেছিল। মাত্র ৫.৪
ওভারে ১০ রানে ৯ উইকেট
নিয়েছিলেন। আর বাংলাদেশের
বেধে দেওয়া ৩৬৩ রানের লক্ষ্য
তাড়া করতে নেমে ৩৫ রানে
গুটিয়ে গিয়েছিল কাতার। যুবা
টাইগারদের বিশাল এ সংগ্রহের
দিনে আরেকজনের ব্যাটিং
তাণ্ডবের মুখেও পড়েছিল কাতার।
সেদিন ১৩৫ বলে ২০৯ রানের একটি
ইনিংস খেলেছিলেন জাতীয় দল
তারকা সৌম্য সরকার।
পরের বছর এসিসি অনূর্ধ্ব-১৯
টুর্নামেন্টেই আবারো নিজের জাত
চিনিয়েছিলেন রনি। আবুধাবিতে
মালয়েশিয়াকে ৫০ রানে গুটিয়ে
দেওয়ার দিনে ৮ ওভারে ৮ রানে
নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। ২০১২ ও ২০১৪
যুব টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে
খেলেছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটেও
সবার নজরেই ছিলেন। প্রথম শ্রেণির
ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত ১১ ম্যাচে ১৮
উইকেট তার। লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে
সেখানে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে
ভিক্টোরিয়ার হয়ে ১৭ উইকেট। আর
বিপিএল-২০১৫ তো তার জীবনটাই
বদলে দিয়েছে। যেখান থেকে আর
কখনো হয়তো পিছু ফিরে তাকাতে
হবে না তাকে।
টাইগারদের রঙিন পোশাকের
অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা আবু
হায়দার রনি সম্পর্কে নিজের
মুগ্ধতার কথা আগেই জানিয়ে
রেখেছেন। ম্যাশের মতে, ঠিকঠাক
পরিচর্যা করলে আগামী দুই-আড়াই
বছরে সেরা একজন পেসারের
সার্ভিসই আশা করতে পারে
বাংলাদেশ ক্রিকেট। তবে, কেউ
কেউ তো রনিকে জাতীয় দলের
দোরগোড়াতেই দেখছেন।
২০১৫ সালে টাইগার ক্রিকেটের
ঊর্ধ্বগামী পারফরমেন্সের সাথে
উঠতি খেলোয়াড়দের নিজেকে
মেলে ধরা যে প্রবণতা, তাতে
মুস্তাফিজুর রহমানের মত রনিকে
জাতীয় দলের জার্সিতে নামিয়ে
দিয়ে নির্বাচকরা আরেকটি জুয়া
খেলতেই পারেন। তেমন হলে, ঘরের
মাঠে আসছে বছরের শুরু দিকে
এশিয়া কাপে রনিকে লাল-সবুজের
জার্সিতে দেখা গেলেও অবাক
হওয়ার থাকবে না। দাবিটা যে
তিনি জানিয়েই রেখেছেন।.