নেটওয়ার্ক তৈরির প্রতিযোগিতায় অপরিকল্পিতভাবে বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস) স্থাপন করেছে সেলফোন অপারেটররা। গত দুই দশকে সারা দেশে ছয় সেলফোন অপারেটর নিজস্ব টাওয়ারে বিটিএস বসিয়েছে প্রায় ৪০ হাজার। যদিও এর দুই-তৃতীয়াংশ দিয়েই সারা দেশে নেটওয়ার্ক কাভারেজ দেয়া সম্ভব। এ হিসাবে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিটিএস রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার!
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত এসব বিটিএস পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। অপচয় হচ্ছে জমিরও। পাশাপাশি এসব টাওয়ার ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজন হচ্ছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ, যা চাপ তৈরি করছে জ্বালানির ওপর। সর্বোপরি এগুলো পরিচালনায় ব্যয় বাড়ছে অপারেটরদের।
টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপনে প্রতিটি টাওয়ারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ— দুই ধরনের অবকাঠামো ব্যবহার করা হয়। টাওয়ার স্থাপনে ব্যবহূত ভূমি, ভবন, ছাউনি, অ্যান্টেনা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ও ব্যাটারিকে বিবেচনা করা হয় পরোক্ষ অবকাঠামো হিসেবে। প্রত্যক্ষ অবকাঠামোর অংশ হিসেবে প্রতিটি টাওয়ারে থাকে বিটিএস বা বেতার তরঙ্গসংশ্লিষ্ট যন্ত্র।
দেশে বিপুলসংখ্যক টাওয়ার থাকলেও অপারেটরদের ভাগাভাগির মাধ্যমে এ সংখ্যা কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ভিন্নতা অনুযায়ী প্রতিটি টাওয়ারে একাধিক জিএসএম ও মাইক্রোওয়েভ অ্যান্টেনা ব্যবহার করা যায়। ফলে একই টাওয়ারের মাধ্যমে একাধিক অপারেটরের বিটিএস ব্যবহার করা সম্ভব।
বাংলাদেশেও ২০০৮ সালে অবকাঠামো ভাগাভাগি নীতিমালা করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। ২০১১ সালে তা সংশোধনও করা হয়। টাওয়ারের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভূমি ও জ্বালানি ব্যয় কমিয়ে আনার লক্ষ্যে নীতিমালাটি করা হয়। সেলফোন অপারেটরদের পরিচালন ব্যয় কমিয়ে আনাও ছিল এর আরো একটি উদ্দেশ্য।
তবে এটি পরিপালনে বাধ্যবাধকতা না থাকায় তুলনামূলক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপারেটরগুলো পৃথক টাওয়ারই এখনো ব্যবহার করছে।
শ্রীলংকাভিত্তিক আঞ্চলিক তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্নএশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাইদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, নীতিমালা মেনে চলা বাধ্যতামূলক না করায় এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বাধ্যতামূলক করার আগে এ-সংক্রান্ত অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থায় আধুনিক টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি সম্পর্কে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জনবলের অভাবে নীতিমালায় নানা দুর্বলতা রয়ে গেছে।
পরিবেশগত ঝুঁকি বিবেচনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো প্রতিবেশী ভারতও বিটিএস ব্যবস্থাপনায় বেশকিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে টাওয়ার স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র নেয়া আবশ্যক করা হয়েছে। টাওয়ারের অবস্থান, অবকাঠামোগত নিরাপত্তা, স্থানীয় পরিবেশ— এসব দিক বিবেচনায় নিয়েই এ ছাড়পত্র দেয়া হয় দেশটিতে। এছাড়া বিটিএসের সর্বোত্তম ব্যবহার ও সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৃতীয় পক্ষের হাতে এর ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দিয়েছে ভারতীয় সেলফোন অপারেটররা।
পরিবেশের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশও টাওয়ার স্থাপনের ক্ষেত্রে সুুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা চালু করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফ্রান্স। ফোরজি প্রযুক্তির বিটিএসের মাধ্যমে তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রের সংস্পর্শে আসা নাগরিক ৫০ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে ধারণা করছে দেশটির সরকার। এ কারণে ফ্রান্সসহ ইউরোপের দেশগুলোয় পরিবেশের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী টাওয়ার স্থাপনের বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কর্মী স্থপতি ইকবাল হাবিব এ বিষয়ে বলেন, দেশে কয়েক কোটি সেলফোন ব্যবহারকারী রয়েছে। এ যোগাযোগের প্রয়োজনে অপারেটরদের বিটিএস স্থাপন করতে হয়েছে।
একই বিটিএস সব অপারেটরের ভাগাভাগির মাধ্যমে ব্যবহার করা সম্ভব হলে যেমন জমির অপচয় রোধ করা যাবে, তেমনি জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিকিরণও কমে আসবে। কারণ এ বিকিরণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে। এ বিষয়ে বিটিআরসিকে জানানো হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে নীতিমালাও করেছে সংস্থাটি। তবে সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষেত্রে দুর্বলতার কারণে এটির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
টেলিযোগাযোগ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনায় বিপুল ব্যয়ের পাশাপাশি এর সঙ্গে বড় জনবলের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এছাড়া ভূমি ও বিদ্যুত্সহ আরো বেশকিছু সমস্যার কারণে এটি থেকে সরে আসতে চাইছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মাধ্যমে পরিচালন ব্যয়ের পাশাপাশি অবকাঠামোগত খাতেও প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় কমবে। নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে ছেড়ে দিয়ে সেবার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে আগ্রহী অপারেটররা।
নিজেদের নেটওয়ার্ক অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছেড়ে দিতে ২০১২ সালে বিটিআরসির কাছে সহযোগী প্রতিষ্ঠান গঠনের আবেদন করে রবি আজিয়াটা। গত বছরের জানুয়ারিতে রবিকে নেটওয়ার্কের পরোক্ষ অবকাঠামো সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইসিএল) কাছে হস্তান্তরের অনুমোদন দেয় কমিশন। পরবর্তীতে কমিশনের অনুমোদনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে ইডটকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড রাখা হয়।
গত বছরের মাঝামাঝি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কাছে নেটওয়ার্ক অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার অনুমতি পায় এয়ারটেল বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে নেটওয়ার্কসংশ্লিষ্ট সব ধরনের পরোক্ষ অবকাঠামো সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করতে পারবে প্রতিষ্ঠানটি।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ ইনফ্রাটেল নেটওয়ার্কস লিমিটেড (বিআইএনএল) নামে একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান গঠন করেছে এয়ারটেল বাংলাদেশ। এয়ারটেলের শতভাগ মালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠান নেটওয়ার্ক টাওয়ার ও ভবন নির্মাণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, বিকল্প হিসেবে ব্যাটারি ব্যাকআপ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, নিরাপত্তাসহ অন্যান্য অবৈদ্যুতিক অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবে। পাশাপাশি দেশের অন্য সেলফোন অপারেটরদেরও একই ধরনের সেবা দিতে পারবে এয়ারটেলের এ সহযোগী প্রতিষ্ঠান।
সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার অনুমোদন প্রসঙ্গে বিটিআরসি সাবেক চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস এর আগে জানান, টেলিযোগাযোগ খাতের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। নেটওয়ার্ক ভাগাভাগির বিষয়ে এরই মধ্যে নীতিমালা করা হয়েছে। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে টাওয়ার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিটিআরসি।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সিদ্ধান্তের ফলে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিযোগাযোগ সেবা আরো সহজলভ্য হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেসব অপারেটরের বিটিএস নেই, তারা ভাড়া ভিত্তিতে বিটিএস নিয়ে সেলফোন সেবা দিতে পারবে। একটি বিটিএস বিভিন্ন অপারেটর ব্যবহার করতে পারলে অনেক অপারেটরকেই নতুন করে আর বিটিএস স্থাপন করতে হবে না। নতুন করে বিটিএস স্থাপনের খরচ কমে যাওয়ায় সেলফোন অপারেটরদের ব্যয়ও কমবে। আর এতে গ্রাহকদের কাছে আরো সুলভে সেবা পৌঁছে দিতে পারবে প্রতিষ্ঠানগুলো।
তারা বলছেন, এজন্য স্থানীয় দক্ষতা ব্যবহারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের সেবা গ্রহণের সুযোগ রাখতে হবে। বিটিএস ব্যবস্থাপনা সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কাছে ছেড়ে দেয়ার সুযোগ রাখার পাশাপাশি তা যেন সীমাবদ্ধ করা না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন।source:bdmobile