কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে হত্যার আগে
ধর্ষণ করা হয়। তাঁর শরীর থেকে নেওয়া নমুনার
ডিএনএ পরীক্ষা করে ধর্ষণের আলামত মিলেছে
বলে মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি নিশ্চিত
করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত-তদারক
কর্মকর্তা সিআইডির কুমিল্লার বিশেষ পুলিশ সুপার
নাজমুল করিম খান গতকাল সোমবার রাতে প্রথম
আলোকে বলেন, ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন
পাওয়ার পর তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন, তনুকে ধর্ষণ করা
হয়েছে। তিনি বলেন, ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে
মোট চারজনের ডিএনএ প্রোফাইলের কথা বলা
হয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রোফাইল তনুর রক্তের।
বাকি তিনটি প্রোফাইল পৃথক তিনজনের। পরীক্ষায়
এই তিনজনের বীর্যের আলামত পাওয়া গেছে।
সিআইডির অপর একটি সূত্র জানায়, ডিএনএ
পরীক্ষার প্রতিবেদন কিছুদিন আগেই সিআইডির
কাছে এসেছে। তারা বিষয়টি স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করেছে। এ বিষয়ে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের
কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন,
মামলাটির তদন্ত চলছে। তদন্তাধীন বিষয়ে তিনি
কোনো মন্তব্য করবেন না।
ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলের কথা জানিয়ে
প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তনুর বাবা ইয়ার
হোসেন গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে
বলেন, ‘সিআইডির পুলিশ সুপার নাজমুল করিম খান
যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমি সঠিক বলে মনে করি।
আমি আগেই এমন ধারণা করেছিলাম।’
এর আগে গত ৩০ মার্চ দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের জন্য
তনুর লাশ কবর থেকে তোলা হয়। তখন ডিএনএ
পরীক্ষার জন্য তনুর শরীর থেকে কিছু নমুনা নেওয়া
হয়েছিল। ওই দিন সন্ধ্যায় কুমিল্লার পুলিশ সুপার
মো. শাহ আবিদ হোসেন প্রথম আলোকে
পারিপার্শ্বিক আলামত থেকে ধারণা করা হচ্ছে,
তাঁকে হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছে। তাই দ্বিতীয়
দফা ময়নাতদন্তে এ-সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার
প্রতিবেদন চেয়েছেন তাঁরা। প্রতিবেদন পাওয়ার পর
সব বিষয় স্পষ্ট হবে।
এরপর ১ এপ্রিল মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব
পুলিশের কাছ থেকে সিআইডিতে স্থানান্তরিত হয়।
এর দেড় মাসের মাথায় এসে গতকাল সিআইডির
তদন্ত-তদারক কর্মকর্তা জানালেন, ডিএনএ পরীক্ষায়
তনুকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে তনুর মা আনোয়ারা বেগম গত রাতে
মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার
মেয়েকে যারা ধর্ষণ করেছে, আমি তাদের ফাঁসি
চাই।’ তিনি বলেন, দেরিতে হলেও আস্তে আস্তে এই
হত্যার জট খুলছে। এ জন্য তিনি পুলিশকে ধন্যবাদ
জানান।
তনুর মা এর আগে ১০ মে কুমিল্লায় প্রথমে
সাংবাদিকদের, তারপর সিআইডির কর্মকর্তাদের
বলেছিলেন, সেনানিবাসের ভেতরে তনুকে হত্যা
করা হয়েছে। সার্জেন্ট জাহিদ ও সিপাহি জাহিদ
তনুকে ডেকে নিয়ে যান। এরপর আর তনু ফিরে
আসেননি। ওই দুই সেনাসদস্য এ হত্যায় জড়িত বলে
তিনি মনে করেন।
কুমিল্লার সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস
বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান
তনু গত ২০ মার্চ খুন হন। ওই দিন রাতে কুমিল্লার
ময়নামতি সেনানিবাসের ভেতর একটি ঝোপ থেকে
তাঁর মরদেহ উদ্ধার করেন বাবা ইয়ার হোসেন। এরপর
তনু হত্যার ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে।
তনুর খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে সারা
দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের
শিক্ষার্থীরাসহ নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক
সংগঠন টানা বেশ কিছুদিন কর্মসূচি পালন করে।
তনুর বাবা গত ৩০ মার্চ প্রথম আলোকে বলেছিলেন,
তিনি প্রথম যখন তনুকে উদ্ধার করেন, তখন তাঁর মাথার
পেছনে ও নাকে জখম দেখেছেন। তাঁর জামার দুই
বাহুর নিচের দিকে ছেঁড়া ছিল। কানের নিচের আঁচড়
চুলও ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল। তিনি ওই দিন
বলেছিলেন, তিনি যখন মেয়েকে খুঁজছিলেন, তখন
ঝোপের দিকে তিনজনকে পালিয়ে যেতে দেখেন।
ওরা কারা, সেটা জানার জন্য তিনি তখন উপস্থিত
এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেসও করেছিলেন। এরপর একটু
এগিয়েই মেয়ের লাশ দেখতে পান তিনি। ততক্ষণে
ওই তিনজন দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
তনুর লাশ উদ্ধারের পরদিন লাশের প্রথম ময়নাতদন্ত
হয় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের মর্গে। গত ৪ এপ্রিল
প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তাতে
বলা হয়, তনুর মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট হয়নি। প্রতিবেদনে
তনুর মাথার পেছনের জখমের কথা গোপন করা হয়
এবং গলার নিচের আঁচড়কে পোকার কামড় বলে
উল্লেখ করা হয়। এ নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর পুলিশের
আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মেডিকেল বোর্ড গঠন
করে দ্বিতীয় দফা লাশের ময়নাতদন্ত করার নির্দেশ
দেন আদালত। এরপর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের
ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
কামদা প্রসাদ সাহার নেতৃত্বে তিন সদস্যের
মেডিকেল বোর্ড ৩০ মার্চ দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত
করে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের
প্রতিবেদন জমা দেয়নি ওই মেডিকেল বোর্ড। এর
মধ্যে পার হয়েছে ৪৬ দিন। কবে ময়নাতদন্তের
প্রতিবেদন দেওয়া হবে, তা-ও নিশ্চিত করে বলছেন
না মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা।