বন্ধুরা টাইটেল দেখেই জেনে গেছেন আজকের আলোচ্য বিষয় কি। হ্যাঁ আজকের বিষয় সাতোশি রহস্য। এই সাতোশি কি তা আমাদের সবারই কম বেশি জানা আছে। এক পয়সা যেমন এক টাকার সবচেয়ে ছোট একক, সাতোশি তেমনি বিট কয়েনের সবচেয়ে ছোট একক। এক বিট কয়েনের ১০ কোটি ভাগের ১ ভাগের নাম হলো সাতোশি। বিট কয়েনের সবচেয়ে ক্ষুদ্র একক।
এই সাতোশি নামের মধ্যেই জুড়ে আছে এমন এক রহস্য, যা আজ পর্যন্ত সমাধান হয়নি। এ রহস্যটি এসেছে সাতোশি নামের মানুষটা থেকে। যার পুরো নাম সাতোশি নাকামোতো। যিনি নিজেকে সবসময় আত্নগোপন রেখেছন। ২০০৮ সালে তিনি যুগান্তকারী এক প্রবন্ধ নিয়ে অনলাইনে আবির্ভূত হন। তিনি ফোরামে কিছু কিছু পোস্টিং দিতেন, হাতে গোনা কিছু মানুষের ই-মেইলের উত্তরও দিতেন। হঠাৎ ২০১১ সালে তিনি তাঁর অগণিত অনুসারীকে রেখে অনলাইন থেকে প্রস্থান করেন এবং সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যান। তাঁর পরিচয় বের করার জন্য বহু চেষ্টা, বহু গবেষণা হয়েছে, কিন্তু কেউ তাঁর প্রকৃত পরিচয় বের করতে পারেনি। তাঁর কাছে যে পরিমাণ বিট কয়েন আছে বলে ধারণা করা হয়, বর্তমান মূল্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু এমন একটি মহাপ্রতিভাবান মানুষ, যিনি এখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সফল মানুষদের একজন, তিনি পর্দার অন্তরালে থাকেন কেন তা কেউই বুঝতে পারেনা।
যে মানুষটির নাম বিভিন্ন কারণে অক্ষয় হয়ে থাকবে, তিনি কেন তাঁর পরিচয় কোনো দিন দেবেন না বলে পণ করেছেন, যার আপাতত কোনো যুক্তিসম্মত কারন কেউই উৎঘাটন করতে পারেনি। সেটাই একটা বিরাট রহস্য হয়ে থাকল।
আশির দশকের শেষ ভাগে কম্পিউটারের ‘সাংকেতিক রীতি’-বিষয়ক (ক্রিপ্টোগ্রাফি) বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারেন যে কম্পিউটার মুদ্রা (ডিজিটাল কারেন্সি) তৈরি করা সম্ভব, যা কাগজ বা ধাতব মুদ্রা থেকে অনেক সহজ ও উপযোগী হতে পারে। তার মানে টাকার বা ডলারের নোট আর দরকার হচ্ছে না। নোট জাল হয়, নোট ব্যবহারেও প্রচুর অসুবিধা, কম্পিউটার মুদ্রায় সেগুলো থাকবে না। যদি যথেষ্ট শক্ত ‘সাংকেতিক রীতি’ উদ্ভাবন করা যায়, তাহলে কম্পিউটার মুদ্রা বের করা সম্ভব। তবে একটি সমস্যার তাঁরা কিছুতেই সমাধান করতে পারেননি, তা হলো, ‘বহু-ক্রয়’ সমস্যা, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডাবল স্পেন্ডিং’। একটি কম্পিউটার মুদ্রাকে কপি করে একাধিকবার খরচ করা সম্ভব। কুমিরের ছানার মতো একটিকেই বারবার দেখানো। কাগজের নোটে এই সমস্যা নেই, একটি নোটকে একই সময় দুই দোকানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। একবার দিয়ে দিলে সেটা আরেকবার দিয়ে দ্বিগুণ পণ্য কেনাও সম্ভব নয়। কিন্তু ‘কম্পিউটার মুদ্রা’ বস্তু নয়, একটি মুদ্রার কপি করা হলে, দুটোর মধ্যে কোনোটাই আসল বা নকল নয়, দুটোই এক সমান। একটি ছবিকে দুটি কম্পিউটারে আপলোড করে রাখলে দুটোর কোনোটাই নকল নয়। এ সমস্যার সমাধানে সবাই হিমশিম খেয়ে গেল এবং দুই যুগেও তার সমাধান করতে পারল না। অথচ এর সমাধান হলেই মুদ্রা বা নোট বলে যে জিনিসটা সরকারি কোষাগারে, ব্যাংকের ভল্টে, মানুষের বাসায় আলমারিতে বা তোশকের নিচে এবং জামা-প্যান্টের পকেটে পকেটে থাকছে, সেটার আর একসময় কোনো দরকারই হবে না।
ব্যাপারটা কিন্তু ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের মতো নয়। ক্রেডিট কার্ডের বেলায় কোথাও একটা টাকা রক্ষিত আছে, তার সমমূল্যের অর্থ খরচ মানুষ করতে পারে সেই টাকাটাকে হাতে এনে বিনিময় না করেই। কিন্তু কোথাও কাগজের টাকা আছে। সেই কাগজের টাকার সঙ্গে ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের যোগ আছে। সেই কাগজের টাকা কোনো এক দেশের সরকার ছাপিয়েছে, বৈধতা দিয়েছে। কম্পিউটার মুদ্রা নিজেই নোট, নিজেই টাকা। আর কোনো নোটের সঙ্গে এর যোগসূত্র নেই। এটা কম্পিউটার বা ইন্টারনেটে থাকে বলে এটাকে বিনিময় করা বহুগুণ সহজতর। ভালো সাংকেতিক রীতি প্রয়োগ করে একে সম্পূর্ণ নিরাপদ করা সম্ভব। মালিকানা নির্ধারণ করা সহজ, এমনকি এর মালিকানা জাল করা অসম্ভব। আরও কত কী সুবিধা এই মুদ্রায়! বিশ্ব অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসতে পারে এবং তার আলামত এতই প্রকট যে বড় বড় অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক অবাক বিস্ময়ে নতুন এই প্রযুক্তির দিকে তাকিয়ে আছেন।
২০০৮ সালে কম্পিউটার মুদ্রার বহু-ক্রয় সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান দিয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠালেন রহস্যময় এক মানুষ। প্রায় অখ্যাত একটা অনলাইন ফোরামে তাঁর প্রবন্ধটি প্রকাশ পেল। নিজেকে তিনি জাপানের অধিবাসী হিসেবে দাবি করলেন, বয়স জানালেন ৩৫। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর প্রবন্ধ নিয়ে হইচই পড়ে গেল। ব্লক চেইন নামের এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি উপস্থাপন করেছেন তিনি, যার মাধ্যমে বহু-ক্রয়ের দীর্ঘদিনের সমস্যাকে এক লহমায় সমাধান করে ফেলা যায়। মুদ্রার মালিকানা স্থির করা এবং নিরাপত্তার ব্যাপারটিও একই সঙ্গে নিখুঁতভাবে সমাধান করা হয়েছে। প্রথম সর্বাত্মক সফল কম্পিউটার মুদ্রা, বিট কয়েনের যাত্রা শুরু হলো। সাতোশি মাঝেমধ্যে মেসেজ পাঠিয়ে, পোস্টিং দিয়ে তাঁর গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। এর বাইরে তাঁর সম্পর্কে কিছু জানা গেল না। সাতোশির ইংরেজি ভাষার দখল এবং আমেরিকা বা কানাডার মানুষের মতো বাক্য-বাগ্ধারা দেখে অনেকেই ভাবলেন, এই মানুষটি আসলে জাপানিজ নয়। তারপর একজন তাঁর ই-মেইল ও পোস্টিংয়ের সময় গবেষণা করে বললেন, লোকটা উত্তর আমেরিকায় থাকেন। তাঁর ঘুম ও কাজের (পোস্টিং) সময়ের যে চক্র, তা উত্তর আমেরিকার সময়ের সঙ্গে মেলে। অনেকে বললেন, সাতোশি নাকামোতো নামটাও হয়তো বানোয়াট। আরেকজন বের করলেন, চারটা নামকরা কোম্পানির নাম দিয়ে সাতোশি নাকামোতো হয় এভাবে SAmsung, TOSHIba, NAKAmichi ও MOTOrola আবার সাতোশি শব্দটার মানে জ্ঞানী। এর মধ্যে কোনো সংকেত লুকিয়ে আছে নাকি? এ যেন রবীন্দ্রনাথের সেই গুপ্তধন গল্পের সাংকেতিক নিশানা—‘পায়ে ধরে সাধা।/ রা নাহি দেয় রাধা॥/ শেষে দিল রা,/ পাগোল ছাড়ো পা॥/ তেঁতুল বটের কোলে/ দক্ষিণে যাও চলে॥/ ঈশান কোণে ঈশানী,/ কহে দিলাম নিশানী।’ যেখানে প্রথম চার লাইনের সাংকেতিক অর্থ ছিল ‘ধারাগোল’, একটি গ্রামের নাম।
জীবনটা গল্প নয়, কিন্তু তারপরও গল্পের মতোই আশ্চর্য ঘটনা বাস্তব জীবনেও ঘটে যায়। যেমন সাতোশি নাকামোতো।
২০১৪ সালের কথা। কত সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান গিয়ে হাজির ক্যালিফোর্নিয়ার টেম্পল সিটিতে, এক জাপানি লোকের বাসার সামনে। ফটাফট তাঁর ছবি তোলা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে সে সংবাদ। লোকটি ভীষণই সাদাসিধা, তাঁর মুখে ভ্যাবাচেকা ভাব। তিনি বলছিলেন, ‘আমি এসবের কিছুই জানি না।’ কে শোনে তাঁর কথা। ‘তুমিই সেই লোক। আমরা খবর নিয়েই এসেছি। সাদাসিধা ভোলাভালা কত বিজ্ঞানী আছে আমরা কি বুঝি না?’ নাম তাঁর ডোরিয়ান সাতোশি নাকামোতো। যিনি কম্পিউটার লাইনে দীর্ঘদিন চাকরি করার পর অবসর নিয়েছিলেন। দুদিন তাঁকে নিয়ে বেশ হুলুস্থুল চলল!! আদৌ কি ঐ ভদ্র ব্যাক্তিই আসল সাতোশি নাকামোতা ছিল?? নাকি সবে সাংবাদিকদের ডামাডোল ছিল মাত্র।
আবার যখন
সময়টা ঠিক ২০১৫ সাল। তখন দুটি সংবাদমাধ্যম অনুমান করতে লাগল যে অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য ও শিল্প উদ্যোক্তা, ক্রেইগ রাইট’ই আসলে সাতোশি নাকামোতোর ছদ্মবেশ ধরে ব্লকচেইন আবিষ্কার করেছেন। এমতাবস্থায় তাদের দাবিগুলো তিনি প্রায় এক বছর ধরে নীরবে সইলেন।
২০১৬ সালে হঠাৎ ক্রেইগ রাইট বলে বসলেন, ওই দুই পত্রিকার অনুমান সত্য। তিনিই আসলে ব্লকচেইন ও বিট কয়েন বের করেছেন। আরেক হুলুস্থুল কাণ্ড। কিন্তু কম্পিউটার বিশেষজ্ঞরা তাঁকে ছেঁকে ধরলেন, জটিল প্রশ্ন করতে থাকলেন। অনেক প্রশ্নের উত্তর তাঁর জানা নেই, অনেক কিছুই তাঁর সঙ্গে মেলে না। তিনি যেদিন তাঁর জ্বলন্ত প্রমাণ অনলাইনে তুলে ধরার কথা, সেদিন উল্টো ক্ষমা চেয়ে তিনি স্ট্যাটাস দিলেন। তাঁর পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব নয়, তিনি আসলে সেই ব্যক্তি নন!!!!!
(অনেকে ‘ক্রেইগ রাইট’কে ‘সাতোশি নাকামোতো’ বলে অনুমান করে, পরে তিনি ভুলটাকেই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাও করেন। কিন্তু শেষে ব্যাপারটা কেচে যায়)
বোঝা গেল কেউ যখন এই বিরল সম্মান নিতে রাজি নন, আবার সন্দেহের আঙুল যখন কিছুটা তাঁর দিকেও নির্দেশ করছে, তখন ক্রেইগ রাইট এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম। ব্যাপারটা মোটেও সহজ ছিল না। আপনারাও ক্রেইগ রাইটের মত এমন কাজ করতে যাবেননা। কপি করলে ক্রেডিট দিবেন।
তবে যাইহোক। সাতোশি নাকামাতো কে? একজন মানুষ নাকি একটা টিম। অনেকের ধারনা টিম গুগলের ভেতরের একটা টিম হতে পারে, অথবা আমেরিকার এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি) হয়তো এমন একটা গবেষণা টিম তৈরি করে গোপনে এ কাজ করেছে। তাই তারা পর্দার অন্তরালেই থেকে গেছে। দুনিয়াজুড়ে এত এত মিডিয়া, কম্পিউটার গিক ও হ্যাকার, তাদের সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে থাকা সাংঘাতিক একটা আশ্চর্য ব্যাপার। এ যেন যাঁকে নোবেল প্রাইজে ভূষিত করা হয়েছে, তিনি কিছুতেই দেখা দেবেন না। কেউ তাঁকে খুঁজেও পাচ্ছেন না, কেউ তাঁকে চেনেনও না। পৃথিবীতে কত হাজার রহস্য ছড়িয়ে আছে, সেখানে আরেকটা না হয় যোগ হলো। একদিন না একদিন অন্যসব রহস্যের মতো এটাও নিশ্চয়ই সমাধান হয়ে যাবে হয়তো।
ক্রেডিটঃ প্রথমআলো
post modify: riyad
,
তো সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন ট্রিকবিডির সাথেই থাকুন