আশা করছি আপনারা সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।
আমার আগের দুটি পর্ব:-
পর্ব ১:- ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ১
পর্ব ২:- ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ২
5.আল বেরুনী ( অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের প্রথম যথার্থ বর্ণনাকারী)
আল-বেরুনী ৯৭৩ খৃস্টাব্দ ৪ সেপ্টেম্বর মােতাবেক ৩৬১ হিজরীর ৩ জিলহজ পারস্যের খাওয়ারিজমে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরাে নাম আবু দায়হান মুহাম্মদ ইবন আহমদ আল বিরুনী।
তাঁর পিতা মুহাম্মদ ছিলেন একজন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। প্রবল জ্ঞানস্পৃহা ছিল আল-বেরুনীর। পুত্রের লেখা পড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে সাধ্য সীমিত থাকা সত্ত্বেও পিতা মুহাম্মদ চেষ্টার সামান্যতম ক্রটি করেননি। কোন কোন ক্ষেত্রে সাধ্যাতীত হলেও ছেলের শিক্ষা দীক্ষার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছেন তিনি।
যে কারণে ছাত্রজীবনে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন আল- বেরুনী। অল্প সময়ের মধ্যেই তার পাণ্ডিত্যের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য জ্ঞান অর্জনের জন্য তাঁকে দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটতে হয়েছে দিনের পর দিন।
তিনি অন্তরে বিশ্বাস করতেন, আল্লাহ সবই জানেন। অতএব, আল্লাহর বান্দা অবশ্যই অজ্ঞ থাকতে পারে না। তিনি তাঁর এ বিশ্বাস লালন করে চার দশক ধরে বিচরণ করেন জ্ঞানের পথে। তাঁর জীবন ছিল ঐশ্বরিক শুভাশীযসমৃদ্ধ। তার অবাধ বিচরণ ছিল পদার্থবিদ্যা, গণিত, ইতিহাস, ভূগােল এবং অধিবিদ্যায় এবং অধ্যয়ন করেছেন আবু সিনা।
গজনীর সুলতান মাহমুদ যখন উজবেকিস্তানে আমুদরিয়ার নিম্নভাগের একটি স্থান খিভা জয় করেন।তখন আল-বেরুনীর খ্যাতি চারদিকে। মাহমুদ তাকে সাথে নেন। তাকে বসানাে হয় রাষ্ট্রীয় উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পদে। আল-বেরুনী বেশ কয়েকবার সুলতান মাহমুদের সাথে ভারত সফর করেন।
তিনি ব্যাপকভাবে সফর করেন পরবর্তী দুই দশক সময় পরিধিতে। এ সময় জ্ঞান বিনিময় করেন ভারতীয় পণ্ডিতদের সাথে। গণিত, ভূগােল, আধ্যাত্মিক দর্শন বিষয়ে। তিনি হিন্দু ধর্ম দর্শন সম্পর্কে তাদের কাছ থেকে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। এর বিনিময়ে তিনি ভারতীয় পণ্ডিতদের শেখান গ্রীক ও আরবদের বিজ্ঞান ও দর্শন।
আল-বেরুনীর লেখা ‘কিতাব আল-হিন্দ’ বইটি এ উপমহাদেশের সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানের ওপর এক দুষ্প্রাপ্য উপস্থাপনা। তিনি নিজে দু’টি বইয়ের অনুবাদ করেছিলেন সংস্কৃত ও আরবী ভাষায়। একটি ‘সাক্ষ্য’ অন্যটি পতঞ্জলি। সাক্ষ্য’-তে আলােচনা করা হয়েছে পদার্থের সৃষ্টি ও ভিন্নতা নিয়ে। আর পতঞ্জলি’-তে ব্যাপক আলােচিত হয়েছে দেহ ও আত্মা সম্পর্কে। আত্মার পলায়নের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে এতে আলােচনা করা হয়।
আল বেরুনী ভারত থেকে গজনীতে প্রত্যাবর্তন করার কিছুদিন পরেই সুলতান মাহমুদ ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর পুত্র সুলতান মাসউদ ১০৩১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন আরােহণ করেন। সুলতান মাসউদও আল বেরুনীকে খুব সম্মান করতেন। এ সময়ে আল বেরুনী রচনা করেন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কানুনে মাসউদী। এ সুবিশাল গ্রন্থখানা সর্বমােট ১১ খণ্ডে সমাপ্ত। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গ্রন্থটিতে আলােচনা করা হয়। ১ম ও ২য় খণ্ডে আলােজনা করা হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে ৩য় খণ্ডে ত্রিকোণমিতি; ৪র্থ খণ্ডে-spherical Astronomy: ৫ম খণ্ডে-গ্রহ, দ্রাঘিমা, সূর্যের মাপ; ৬ষ্ঠ খণ্ডে-সূর্যের গতি; ৭ম খণ্ডে-চন্দ্রের গতি; ৮ম খণ্ডে-চন্দ্রের দৃশ্যমান ও গ্রহণ; ৯ম খণ্ডে-স্থির নক্ষত্র; ১০ম খণ্ডে-৫টি গ্রহ নিয়ে এবং একাদশ খণ্ডে-আলােচনা করা হয়েছে জ্যোতিষ বিজ্ঞান সম্পর্কে। এ অমূল্য গ্রন্থটি সুলতানের নামে নামকরণ করায় সুলতান মাসউদ অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে আল বেরুনীকে বহু মূল্যবান রৌপ্য সামগ্রী উপহার দেন। কিন্তু আল বেরুনী অর্থের লােভী ছিলেন না। তাই তিনি এ মূল্যবান উপহার সামগ্রী রাজকোষে জমা দিয়ে দেন।
আল বিরুনি ‘কানুন আল মাসুদি’ বইয়ে চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের চমৎকার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি ঊষা এবং গোধুলি লগ্নের বিস্ময়কর ব্যাখ্যা দান করেন। তিনি দেখান, সূর্য দিগ্বলয়ের ১৮° ডিগ্রি নিচে থাকতে গোধুলির আগমন ঘটে এবং এ বিষয়টি আধুনিককালের জোতির্বিদরা প্রমাণ করেছেন। সূর্যের ব্যাপারে আল বিরুনি বলেন, সূর্য হচ্ছে একটি সৌর অগ্ন্যুৎপাতের গোলকীয় অগ্নিকুণ্ড। অন্যদিকে চাঁদ যে কক্ষে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে তা পূর্ণ গোলক নয় বলে দাবি করেন তিনি। তিনি পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব সঠিকভাবে নির্ণয় করতে না পারলেও পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন কত হতে পারে তা হিসাব করেন। জোয়ার-ভাটার ব্যাপারে তিনি চাঁদের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন অবস্থানকে দায়ী করেন।
আল বেরুনী বহু জ্ঞান বিজ্ঞান সভ্যতার ইতিহাস, মৃত্তিকা তত্ত্ব, সাগর তত্ত্ব এবং আকাশ তত্ত্ব মানবজাতির জন্যে অবদান হিসেবে রেখে গেছেন। ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের মতে বেরুনী নিজেই বিশ্বকোষ।
একজন ভাষাবিদ হিসেবেও তিনি ছিলেন বিখ্যাত। আরবী, ফারসী, সিরিয়া গ্রীক, সংস্কৃতি, হিব্রু প্রভৃতি ভাষার উপর ছিল তাঁর পাণ্ডিত্য। ত্রিকোণমিতিতে তিনি বহু তথ্য আবিষ্কার করেছেন। কোর্পানিকাস বলেছিলেন, পৃথিবী সহ গ্রহগুলাে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে অথচ কোর্পানিকাসের জন্মের ৪২৫ বছর পূর্বেই আল বেরুনী বলেছেন, “বৃত্তিক গতিতে পৃথিবী ঘুরে।”
তিনি টলেমি ও ইয়াকুবের দশমিক অংকের গণনায় ভুল ধরে দিয়ে তাঁর সঠিক ধারণা দেন। তিনিই সর্ব প্রথম প্রাকৃতিক ঝর্ণা এবং আর্টেসীয় কূপ এর রহস্য উদঘাটন করেছিলেন। জ্যোতিষ হিসেবেও তার প্রসিদ্ধি ছিল অত্যাধিক। তিনি যে সব ভবিষ্যৎ বাণী করতেন সেগুলাে সঠিক হত। তিনি শব্দের গতির সাথে আলাের গতির পার্থক্য নির্ণয় করেছিলেন। তিনি এরিস্টটলের হেভেন গ্রন্থের ১০টি ভুল আবিষ্কার করেছিলেন। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্কেও তিনি আবিষ্কার করেন।
তিনিই বিভিন্ন প্রকার ফুলের পাপড়ি সংখ্যা হয়, ৩, ৪, ৫, ৬ এবং ১৮ হবে কিন্তু কখনাে ৭ বা ৯ হবে না; এ সত্য আবিষ্কার করেন।
আল-বেরুনী সূক্ষ্ম ও শুদ্ধ গণনায় একটি অভিনব ও বিস্ময়কর পন্থা উদ্ভাবন করেন। “The Formula of Intarpolation পন্থাটির বর্তমান নাম। তার সাইন তালিকা ও ট্যানজেন্ট তালিকায় তিনি Sin O’ এবং Tan 90 মূল্য একই ভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন-এই চিহ্নটি হলাে Z।
দ্রাঘিমাংশ ও অক্ষাংশের প্রথম যথার্থ বর্ণনা তুলে ধরেন আর-বেরুনী। জিও-ইকোনমিকস বা ভৌগলিক অর্থনীতির সুনির্দিষ্ট আকার দেন এই অসাধারণ মেধাবী বিজ্ঞানী। এ বিষয়ে তার বইয়ের নাম ‘আল-আতাহার আল-বাকিয়া’। ঘনত্ব ও আকার দৃষ্টে তিনি আবিষ্কার করেন ১৮টি দামী পাথর।
জুয়েলারী বিষয়ে তার গবেষণা সবাইকে অবাক করে দেয়। হীরা, মুক্তা, রত্ন ও অন্যান্য দামী পাথর ছিল তার গভীর ও ব্যাপক গবেষণার বিষয়। এই বিষয়ে তিনি যে বই লিখে গেছেন তার নাম “কিতাব আল জামাহির’। শারীরবিদ্যা ও ওষুধ সম্পর্কিত তাঁর বই একটি অনন্য ভাণ্ডার। এতে ম্যাটেরিয়া ও মেডিকার সবকিছুর মধ্যে সম্মিলন ঘটানাে হয়েছে। এই বইটির নাম দেয়া হয়েছে “কিতাব আল-সাইয়েদেনা। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আরবীয় শরীরবিদ্যার জ্ঞান। আছে সেই সাথে ভারতীয় ভেষজ বা ওষুধ সম্পর্কে সারগর্ভ আলােচনা।
অধ্যাপক হামারনেহ বলেছেন, “শুধু মুসলিম জগতেই নয় পৃথিবীর সমস্ত সভ্য জগতের মধ্যে আল বেরুনীই সর্ব প্রথম ব্যক্তি, যিনি খ্রিস্টপূর্বকাল থেকে তাঁর সময়কাল পর্যন্ত ঔষধ তৈরি করার পদ্ধতি ও তার ইতিহাস নিয়ে আলােচনা করেছেন।
অধ্যাপক মাপা বলেন, “আল-বেরুনি শুধু মুসলিম বিশ্বেরই নন, বরং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের একজন।
আল-বিরুনির সর্বমোট ১১৪টি গ্রন্থের উল্লেখ তিনি নিজে করেছেন। এর মধ্যে ১০৩টি গ্রন্থ সম্পূর্ণ হয়েছে এবং ১০টি অসম্পূর্ণ গ্রন্থের উল্লেখ রয়েছে।
এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ হচ্ছে-কিতাবুত তাফহিম’। এটি ৫৩০ অধ্যায়ে বিভক্ত। এতে অংক, জ্যামিতি ও বিশ্বের গঠন সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। ইফরাদুল ফাল ফিল আমরিল আযলাল’-এটিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ছায়াপথ সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে।
ভেষজ নিয়েও তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন, যার নাম ‘কিতাব-ই- সায়দানা’।জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত বিষয়ে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘আল-তাফিম লী-আওয়াইল-সিনাত-আল-তাঞ্জিম।
আল আহারুল বাকিয়া আলাল কুবানিল কালিয়া’-এটিতে পৃথিবীর প্রাচীন কালের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। ‘যিজে আবকন্দ (নভােমণ্ডল ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত)। আলাল ফি যিজে খাওয়ারিজমি (যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে) তাঁর উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ। বিশাল আকৃতির শতাধিক গ্রন্থ এক ব্যক্তির পক্ষে রচনা করা কত যে দুঃসাধ্য ব্যাপার তা ভাবতেও অবাক লাগে।
আল বেরুনী ছিলেন সর্বকালের জ্ঞানী শ্রেষ্ঠদের শীর্ষ স্থানীয় এক মহাপুরুষ। দশম শতাব্দীর শেষ এবং একাদশ শতাব্দীতে যার একান্ত সাধনায় জ্ঞান বিজ্ঞানের দিগন্ত এক নব সূর্যের আলােতে উল্লাসিত হয়েছিল তিনি হলেন আল বেরুনী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক। তিনি বিশ্বাস করতেন আল্লাহই সকল জ্ঞানের অধিকারী।
এ মনীষী ৬৩ বছর বয়সে গুরুতর রােগে আক্রান্ত হন। আস্তে আস্তে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। কোন চিকিৎসাই তাঁকে আর সুস্থ করে তােলা যায়নি। অবশেষে ৪৪০ হিজরীর ২ রজব মােতাবেক ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর রােজ শুক্রবার ৭৫ বছর বয়সে আবু রায়হান মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বেরুনী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
6.আল বাত্তানী(যিনি প্রথম সঠিকভাবে সৌর বছরের পরিমাপ বের করেন)
আল-বাত্তানী ৮৫৮ খৃস্টাব্দ মােতাবেক ২৪৪ হিজরীতে মেসােপটেমিয়ার অন্তর্গত বাত্তানে জন্মগ্রহণ করেন বলে তিনি বাত্তানী নাম ধারণ করেন। তাঁর পুরাে নাম আবু আবদুল্লাহ মােহাম্মদ ইবনে শরীফ সিনান, আল হারবানী আল বাত্তানী আল-সাবি।
শৈশবেই আল-বাত্তানীর শিক্ষা শুরু হয়। তিনি ভাষাতত্ত্ব বিজ্ঞান, দর্শন, ভূতত্ত্ব, ইতিহাসসহ নানা বিষয়ে বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করেন। মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও অংক শাস্ত্রের পণ্ডিত হিসাবে সুধীমহলে স্থান লাভ করতে সক্ষম হন।
তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ জ্যোতির্বিদ। তখন তাঁর সমতুল্য জ্যোতির্বিদ কেউ ছিলেন না। সেই সাথে তিনি ছিলেন বড় মাপের গণিতবিদ। তিনি একটানা ৪২ বছর নানা গবেষণা চালিয়ে যান।
তিনি গবেষণা চালান গণিত আর জ্যোতির্বিদ্যার নানা শাখায়। এসব গবেষণার মাধ্যমে তিনি মানব জাতির সামনে অসাধারণ সত্য উদঘাটন করে গেছেন।
তিনি হিসেব করে দেখান ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে এক সৌর বছর। সেখানে আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে আজ আমরা জানি সৌরবছরের দৈর্ঘ্য ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড। আল বাত্তানির হিসাবে মাত্র ২১ সেকেন্ডের তফাৎ! বিস্ময়কর নয় কি?
কোনোরকম উন্নত টেলিস্কোপ কিংবা আধুনিক জোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় যন্ত্রপাতি ছাড়াই তার এই পরিমাপ সত্যিই বিস্ময়কর।সে কারণে সত্যিকার অর্থে সৌর বছরের আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি পাবার যােগ্য হচ্ছেন আল-বাত্তানী।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে টলেমী সহ পূর্বতন বহু বৈজ্ঞানিকের ভুলও তিনি সংশােধন করে দেন। সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ সম্পর্কিত টলেমী যে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন, আল বাত্তানী তা সম্পূর্ণ ভুল বলে বাতিল করে দিতে সক্ষম হন। হন। তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, সূর্যের আপাত কৌণিক ব্যাসার্ধ বাড়ে ও কমে। নতুন চন্দ্র দেখার ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ নতুন ও নির্ভুল বক্তব্য পেশ করেন।
সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ সম্পর্কে ও তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট।তিনি আরো একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে, যখন সূর্যগ্রহণ হয়, তখন চাঁদ সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে অবস্থান নেয়। এবং সূর্য যখন পৃথিবী থেকে সর্বোচ্চ দূরত্বে অবস্থান করে, তখন গ্রহণের সময় চাঁদের চারধারে উজ্জ্বল আলোর রেখার সৃষ্টি হয়।
আল বাত্তানী তাঁর নতুন উদ্ভাসিত যন্ত্র আর্মিলারি স্ফিয়ার দিয়ে প্রমাণ করে দিলেন যে,
সূর্য স্থির বলে এতদিনের প্রচলিত টলেমীর মতবাদটি সত্য নয়। সূর্য তার নিজ কক্ষে গতিশীল। আল বাত্তানী আরাে প্রমাণ করেন যে, টলেমীর সময় থেকে তাঁর সময় পর্যন্ত সূর্যের দূরত্ব ১৬°৪৭ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং সূর্য স্থির নিশ্চল নয় এবং তার নিজ কক্ষে গতিশীল।
বাত্তানী টলেমির প্রচারিত আরও কয়েকটি মতবাদ ভুল প্রমাণ করেন। যার মধ্যে
সূর্যের আপাত কৌণিক ব্যাসরেখা পরিবর্তন অন্যতম। বাত্তানী অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রেরও গতির অসমতা সম্পর্কে নতুনভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। এর ফলে টলেমির তালিকার পরিবর্তে তিনি নতুনভাবে একটি তালিকা প্রস্তুত করেন একারণে যে সূর্যের (Apogee) অপভূ সম্বন্ধে টলেমির মতবাদে ভুল ছিল।
আল বাত্তানি পৃথিবীর বিষুবরেখার মধ্য দিয়ে যাওয়া কাল্পনিক সমতলের সাথে সূর্য ও পৃথিবীর কক্ষপথের মধ্যে যে সমতল, তা অসদৃশ বলে ব্যাখ্যা করেন। বিস্ময়করভাবে তিনি এই দুই কাল্পনিক সমতলের মধ্যকার কোণ পরিমাপ করেন। এই কোণকে বলা হয় ‘সৌর অয়নবৃত্তের বাঁক’। আল বাত্তানি এর পরিমাপ করেন ২৩ ডিগ্রি ৩৫ মিনিট যা বর্তমানের সঠিক পরিমাপ ২৩ ডিগ্রি ২৭ মিনিট ৮.২৬ সেকেন্ডের খুবই কাছাকাছি।
অমাবস্যার সঠিক গণনা সহজ সুন্দর নবতর নিয়ম অনুসারে প্রচলনকারী হিসাবে বাত্তানী জ্যোতির্বিজ্ঞান জগতে সুপরিচিত।
তিনি ঋতুর সময়-পরিধিও নির্ণয় করেন। সঠিকভাবে সূর্যের কক্ষপথে পরিভ্রমণ পরিস্থিতি তুলে ধরতে সক্ষম হন। তিনি এর সবচে কম গড়ও নির্ধারণ করেন।
তিনি অক্ষর মালাকে সংখ্যার প্রতীক হিসেবে ব্যবহারমূলক একটি ‘জিজ’ তালিকা তৈরি অনুদিত হয়ে প্রকাশিত করেন। এটি ইউরােপীয় পন্ডিতদের দ্বারা ৩ খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
গণিতের বিষয়েও তিনি ছিলেন একজন অগ্রদূত।বাত্তানীই প্রথম ত্রিকোনমতির সম্পূর্ণ স্বাধীন স্বরূপ আলােচনায় প্রবৃত্তও হন। এ যে একটি স্বয়ং স্বাধীন বিজ্ঞান একথা প্রথম আবিষ্কার করেন আল-বাত্তানী।
সাইন, কোসাইন, ট্যানজেন্ট, কো-ট্যানজেন্ট প্রভৃতি ত্রিকোনমিতির সহজ সুন্দর সাংকেতিক নিয়মগুলাে ব্যবহার উপযােগী বৈশিষ্ট্যময় করে ফুটিয়ে তােলার ব্যাপারটা বাত্তানীর আগে কেউ ভাবতেও পারেন নি। ত্রিকোনমতির সমস্যা সমাধান টলেমি Chords ব্যবহারে যে উপপাদ্যের সাহায্য নিয়েছিলেন, এমন জটিল ও দুর্বোধ্য ছিল যে, মানুষ তা অর্থহীন মনে করে এর ধারে কাছেও আসতে চাইত না। বাত্তানী ত্রিকোনমিতিতে আরবী শব্দ জাইব’ (বক্র) ব্যবহার করেন।
জাইবের ল্যাটিন অনূদিত অর্থ ‘Sinus’ থেকেই Sine’ (সাইন) শব্দের উৎপত্তি হয়। আরবদের আবিষ্কৃত ছায়াঘড়ির উপরের সমতলস্থ ছায়ার ধারণা থেকে কোট্যানজেন্ট এবং উপরস্থ ছায়ার ধারণা থেকে ট্যানজেন্টের শাব্দিক অবয়বের উদ্ভব হয়। অর্থাৎ ত্রিকোনমিতির এই শব্দগুলাের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার বৈশিষ্ট্য আবিষ্কারের মূলে রয়েছেন আল-বাত্তানী। সাইন, কোসাইনের সঙ্গে ট্যানজেন্টের সম্পর্ক বাত্তানীই প্রথম আবিষ্কার করেন। ত্রিভুজের বাহুর সঙ্গে কোণের ত্রিকোনমিতির সম্বন্ধও তাঁরই আবিষ্কার (বিশ্ব সভ্যতায় মুসলিম অবদান, পৃ. ৮৬-৮৭)।
জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত তাঁর ৪ টি গ্রন্থের পরিচয় নিম্নরূপ
১. “কিতাব মারেফাতে মাতালী আল-বরুজ ফি মা বায়না আরবা আল ফালাক” অংকের সাহায্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সমাধান।
২. রিসালা ফি তাহকিক আবদার আল-ইল্লিসালাত’-এ গ্রহ নক্ষত্রাদির গতিবিধি সম্পর্কে ত্রিকোনমিতিক সমাধান।
৩. ‘সাবাহ আল-মাকালাত আল-আরবা লিকাতমিয়াম’ টলেমির টেট্রাবিবলসের ভাষ্য।
৪. ‘আজ-জিজ’ জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রন্থ তালিকা। উল্লিখিত বই গুলাের মধ্যে
এই বইটিই সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বশ্রেষ্ঠ। এই গ্রন্থটি প্লেটো টিবারটিলুজ ও রেজিওমন্টেনাস কর্তৃক ল্যাটিনে অনূদিত হয় ।
‘আজ-জিজ’ গ্রন্থটি শুধু যে আরব বৈজ্ঞানিকদেরকেই অনুপ্রাণিত করেছিল তাই নয়, ইউরােপের নবজাগরণে এই পুস্তকটি প্রভাব বিস্তার করেছিল। এর প্রমাণ হিসাবে বলা যেতে পারে-ক্যাস্টাইলের দশম আলফালনাে এর ল্যাটিন অনুবাদে তুষ্ট না হয়ে মূল আরবী থেকে স্পেনীয় ভাষায় পুন: অনুবাদ করেন।এছাড়াও কিতাবুল আয-জিজ থেকে কোপারনিকাস সহ অনেক মধ্যযুগীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা উদ্ধৃতি প্রদান করতেন।
বাগদাদ থেকে ফেরার পথে টাইগ্রিস নদীর পূর্ব তীরে সামারার কাছাকাছি কামর আজ-জিস নামক একটি গ্রামে ৯২৯ সালে ৩১৭ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। আজও এখানে তার সমাধি রয়েছে।
তার মৃত্যুর পর তার কিতাব আল জিজের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে যায়। পরবর্তীকালের সময়ের প্রায় সকল মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীই তার কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ইসলামের স্বর্ণযুগ বলে পরিচিত মুসলিমদের গৌরবোজ্জ্বল যে সময়কালের কথা ইতিহাসে লেখা আছে, সে সময়ের একজন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব এই আল বাত্তানি। তার অবদান ধর্ম নির্বিশেষে জোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।