Site icon Trickbd.com

ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৪

Unnamed


আসসালামু আলাইকুম

আশা করছি আপনারা সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।

আমার আগের তিনটি পর্ব:-

পর্ব ১:- ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ১

পর্ব ২:- ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ২

পর্ব ৩:-ইতিহাসের সেরা কিছু মুসলিম বিজ্ঞানী আর তারা যে কারনে বিখ্যাত।পর্ব ৩

7.ইবনে আল-হাইসাম(আলোকবিজ্ঞানের জনক)

ইবনে হাইসাম ৯৬৫ খৃস্টাব্দে বসরায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরাে নাম আবু আলী আল হাসান ইবনুল হাসান ইবনুল হাইসাম। পাশ্চাত্য জগতে তিনি আল হাজেন নামে পরিচিত।

সম্ভবত প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, সবই তিনি বাগদাদে লাভ করেন। তিনি ছিলেন ধনী পরিবারের সন্তান। সে সময়ে অধিক ব্যয়বহুল হওয়ায় কেবল সমাজের ধনীক শ্রেণীই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো। অন্যান্য মুসলিম পরিবারগুলোর মতো ইবনে আল হাইসামেরও শিক্ষা জীবন শুরু হয় বসরার একটি মক্তব থেকে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে।

তিনি তাঁর সময়কার সর্বশ্রেষ্ঠ অঙ্কশাস্ত্রবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এজন্য ঐতিহাসিক বায়হাকী তাঁকে দ্বিতীয় টলেমি বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু আধুনিক বিশ্বসভ্যতা তাঁকে ‘অপটিক’ (চক্ষু-চিকিৎসা)-এর জনক বলে চিহ্নিত করেছে।

অধ্যাপক মারটনের মতে তাঁর মেধাশক্তি ছিল বিস্ময়কর। বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করেই ইউরােপীয় অধ্যাপক এই প্রশংসা বাণী উচ্চারণ করেন।

তার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে কায়রোতে তৎকালীন খলিফা হাকিমের রাজ্যে ভ্রমণ। নীলনদের বাঁধ দিয়ে উন্নত চাষাবাদের জন্য তিনি বহু দিনের পরিকল্পিত একটি বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা খলীফা হাকিমের কাছে পেশ করেন।

খলীফা পরিকল্পনাটি ভালভাবে দেখে নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য না করেই হায়সামকে রাজস্ব বিভাগে একটি উচ্চপদের চাকরি দিয়ে দেন।

তিনি দ্রুতই তার এ পরিকল্পনার অবাস্তবায়নযোগ্যতা উপলব্ধি করতে পারেন।তখনকার কায়রোর খলিফা তার বিভিন্ন স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপের জন্য উন্মাদ খলিফা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, বলা বাহুল্য এতে তিনি খলিফার রোষে পতিত হন।

তবে এখানে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে। কাজে ব্যর্থ হয়ে হাইথাম খলিফার ক্রোধ থেকে বাঁচতে নাকি পাগলের ভান করেছিলেন এবং গৃহবন্দী হয়ে থেকেছিলেন একেবারে খলিফা হাকিমের মৃত্যু পর্যন্ত!

আর এই গৃহবন্দী অবস্থায়ই তিনি লিখেছিলেন তার সেরা বই, ‘কিতাব আল মানাযির’(বুক অব অপটিকস), যাকে কিনা নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকার সাথে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী বই গণ্য করা হয়।রজার বেকন এবং জোহান কেপলারের মতো বিজ্ঞানীরা হাইথামের বুক অব অপটিকস দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিলেন।

তার এই সাত খণ্ডে প্রকাশিত বইটি আলোকবিজ্ঞান সম্বন্ধে সমসাময়িক তো বটেই, অনাগত কয়েক প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের ধারণায় আমূল পরিবর্তন আনে। তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল চোখ থেকে আলো কোনো বস্তুর উপর পড়লে আমরা সে বস্তুটি দেখতে পাই। এই ধারণাটি ছিল অ্যারিস্টটলের।

কিন্তু হাইথাম বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে এটি ভুল প্রমাণিত করেন। যেমন- বহুদূরের তারকারাজি আমরা চোখ মেললেই দেখতে পাই। আমাদের চোখের আলো কতটা শক্তিশালী যে এতো পথ মূহুর্তেই পাড়ি দিয়ে সে তারকার কাছে পৌঁছে যায়? প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি ঘোষণা করলেন কোনো বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে এলেই তবে আমরা সে বস্তুটি দেখতে পাই।

তিনি আলোকরশ্মির সরল পথে গমনের বিষয়েও পরীক্ষা করেন এবং প্রমাণ করেন। স্নেলের সাইন সূত্রটি বস্তুত তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। তবে তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ কিংবা গাণিতিক ব্যাখ্যা করতে পারেননি হাইথাম। এছাড়াও তিনি প্রথম বর্ননা দেন ক্যামেরা অবস্ক্যুরা’র -একটা ছোট ছিদ্র যুক্ত বাক্স, যা সুক্ষভাবে কোন চিত্র আকার জন্য যে কোন প্রতিচ্ছবি পর্দায় প্রক্ষেপন করতে পারতো – এবং যা আধুনিক ক্যামেরার পুর্বসুরী।

তিনিই প্রথম আলোর বিভ্রম (Optical illusion) এবং মানুষের দেখার পদ্ধতি আর এর পেছনে চিন্তার প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি বিস্তারিত গবেষনা করেন।

এছাড়াও তার অমর কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যানালাইসিস অ্যান্ড সিনথেসিস, ব্যালেন্স অব উইজডম, কনফিগারেশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড, অপসকুলা, মোশন অব ইচ সেভেন প্লানেটস, ট্রিটিজ অন লাইট, ট্রিটিজ অন প্ল্যাস, দ্য রেজুলেশন ইত্যাদি।তিনি চাঁদ সম্বন্ধে লিখেছেন মাক্বালা ফি দাও আল-ক্বমার( চাঁদের আলো সম্পর্কে)।

আল-হাজেন দৃষ্টিকৌশল নিয়ে আলোচনা করেছেন, চোখের গঠন, চোখের অভ্যন্তরে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি এবং দর্শন তন্ত্র ইয়ান পি হাওয়ার্ড পারসেপশন এর একটি নিবন্ধে যুক্তি দেখান যে ইবন আল হাইসামকেই বিভিন্ন উদ্ভাবন এবং তত্ত্বের কৃতিত্ব দেয়া উচিত।

যেগুলোকে সাধারণত পশ্চিম ইউরোপীয়দের বলে চালিয়ে দেয়া হয়,যদিও শতাব্দী পরে সেগুলো তাঁরা লিখেছেন।

অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে ইবনে আল হাইসাম ছিলেন আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবক্তা। তার আগে বিজ্ঞানীগণ যে পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ চালাতেন তা যথাযথ ছিল না।

ফলে অনেক সময় হাইথামকে বলা হয় প্রথম ‘আধুনিক বিজ্ঞানী’। তিনি যেকোনো বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য কঠোর পরীক্ষামূলক পদ্ধতির প্রচলন করেন। তার পরীক্ষার পন্থা অনেকাংশে আধুনিককালের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মতো। তার পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার ধাপ সাতটি-

১.পর্যবেক্ষণ
২.সমস্যা নির্দিষ্টকরণ

৩.সমাধান অনুমান করা
৪.পরীক্ষার মাধ্যমে অনুমান যাচাই করা
৫.পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করা
৬.তথ্যের বিশ্লেষণ, তুলনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ
৭.ফলাফল প্রকাশ করা

অধ্যাপক মারটনের মতে আল-বেরুনী, ইবনে সিনা ও ইবনুল হায়সামের মধ্যে হায়সামই ছিলেন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ।

বুক অব অপটিকস ছাড়াও তিনি আলোকবিজ্ঞানের উপর ‘রিসালা ফিল-দাও’ বা ‘ট্রিটিজ অব লাইট রচনা করেন। এখানে তিনি আলোর প্রতিসরণ, বিচ্ছুরণ, গ্রহণ, রংধনু, অধিবৃত্তিক কাঁচ, বিবর্ধন কাঁচ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন। চোখের জৈবিক গঠন ও ব্যবচ্ছেদ বিষয়েও বিস্তর আলোচনা করেন। তিনি আলো বিষয়ক এতো গবেষণা করেন যে সেগুলো সবিস্তারে বর্ণনা করতে গেলে ভিন্ন একাধিক প্রবন্ধের প্রয়োজন হবে!

তিনি তার নফুসী হাইওয়ালিয়াহ’ গ্রন্থে জীবজন্তুদের উপরে সঙ্গীতের প্রভাব সম্বন্ধে আলােচনা করেন। তাশরিকুল ইনসান ইলাল মাউত গ্রন্থে মৃত্যু সম্বন্ধে আলােচনা করেন।

ইবনে আল হাইথাম নভোজোতির্বিজ্ঞান নিয়েও বিস্তর গবেষণা করেছেন। তিনি বিভিন্ন ভরের মধ্যকার অদৃশ্য আকর্ষণের কারণে ত্বরণের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন (মহাকর্ষ কী জানতেন তিনি!)। তার ‘মাকালা ফি’ল কারাস্তুন’ নামক গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন বস্তুর আকর্ষণ কেন্দ্র নিয়ে আলোচনা করেছেন যা আমরা ‘সেন্টার অব গ্রাভিটি’ নামে জানি।

অন্যদিকে তিনি ‘রিসালা ফি’ল মাকেন’ বা ট্রিটিজ অব প্ল্যাসে বস্তুর গতি নিয়েও আলোচনা করেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই দুটি বিষয়েই তার প্রায় সিংহভাগ কাজই হারিয়ে গেছে। অন্যথায় নিউটনের পূর্বেই হয়তো পৃথিবী মহাকর্ষ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে পারতো।

ইবনে হায়সাম “মিজানুল হিকমা’ গ্রন্থ ভারকেন্দ্র ও লম্বকেন্দ্রের সম্বন্ধ নিয়ে, নিক্তি ও লৌহ তুলাদণ্ডের স্থির ও দোদুল্যমান অবস্থায় অবস্থান সম্বন্ধে বিশেষভাবে আলােচনা করেন। বিচ্যুত বস্তুর দূরত্ব ও গতিশক্তি সময়ের পারস্পরিক সম্বন্ধ সম্পর্কেও তাঁর অভ্রান্ত ধারণা ও কৈশিকার্ষণ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, প্রাথমিক অবদান। পুস্তকটিতে বায়ুমণ্ডলে ভার বর্ধিত ঘনত্বের সম্বন্ধ বিশেষভাবে আলােচিত হয়েছে। এই বৈজ্ঞানিক আরাে পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করেছেন যে, একই জিনিসের ওজন বায়ুর হালকা ও ঘনত্বের তারতম্যের উপর নির্ভরশীল।

১০৩৮ সালে ইবনে আল হাইথাম প্রকাশ করেন ‘মোশনস অব ইচ অব দ্য সেভেন প্লানেটস’। এই বইতে তিনি মূলত মহাকাশে গ্রহ নক্ষত্র ও তারকাদের গতি আলোচনা করেন। তবে এই বইয়ের খুব সামান্যই পাওয়া গেছে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে হাইথামের ‘মোশনস অব ইচ অব দ্য সেভেন প্লানেটস’ মধ্যযুগে ইউরোপে রেনেসাঁর সময় জোতির্বিজ্ঞানের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। তবে তা কীভাবে হারিয়ে গেছে সে বিষয়ে ঠিক জানা যায় না।

গণিতে ইবনে আল হাইথাম কাজ করেছেন কণিক, সংখ্যাতত্ত্ব আর বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতি নিয়ে। তিনি ইউক্লিডীয় জ্যামিতির কিছু উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধন করেছেন।গ্রীক বৈজ্ঞানিকদের সমবাহু ত্রিভুজের জ্যামিতিক ভুলও তিনি সংশােধন করে দেন।

তিনি বুক অব অপটিকসের পঞ্চম খণ্ডে একটি সম্পাদ্য তৈরি করেন যা ইউরোপে রেনেসাঁর সময় ‘আল হ্যাজেনস প্রবলেম’ নামে বেশ জনপ্রিয় ছিল।

ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন, আইজ্যাক ব্যারো, জেমস গ্রেগরির মতো গণিতবিদরা তার সেই সম্পাদ্যের বীজগাণিতিক সমাধানের চেষ্টা করেন। হাইথাম বীজগণিত ও জ্যামিতির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে বিশ্লেষণমূলক জ্যামিতির উন্নয়ন সাধন করেন। তিনি প্রথম ১০০টি প্রকৃত সংখ্যা যোগ করার একটি সূত্র তৈরি করনে। তবে সূত্রটি তিনি প্রমাণ করেছিলেন জ্যামিতিক উপায়ে।

তাছাড়া তিনি ‘অ্যানালাইসিস অ্যান্ড সিনথেসিস’এ পূর্ণ সংখ্যার উপর গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করেছেন। তিনি জোড় পূর্ণ সংখ্যার সূত্র (2n−1(2n − 1)) আবিষ্কার করেন। অবশ্য সূত্রটি তিনি প্রমাণ করে যেতে পারেননি। গণিতবিদ অয়লার ১৯ শতকে এই সূত্রটি প্রমাণ করেন।

তাঁর অন্যতম অবদান হচ্ছে গনিতকে ব্যবহার করে ভৌতবিজ্ঞানের আলোচনা। তিনি প্যারাবলয়েডের আয়তন নির্ণয় করতে ক্রমিক স্বাভাবিক সংখ্যার চতুর্থ ঘাতের যোগফল বের করার যে পদ্ধতি বের করেছিলেন তা ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসের অন্যতম একটি ধারণা।

ইবনে আল হাইথামের মোট কাজের সংখ্যা দুশ’র অধিক, যার মধ্যে ৯৬টি বৈজ্ঞানিক। তবে সেগুলোর মধ্যে বর্তমানে সামান্য বা সম্পূর্ণরূপে টিকে আছে মাত্র ৪৬টি। তথাপি সেই ৪৬টিই তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন গবেষক, পর্যবেক্ষক এবং বিজ্ঞানী হিসেবে।

তার বুক অব অপটিকস এখনোও বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়। তার সম্মানে চাঁদের একটি জ্বালামুখের নামকরণ করা হয় ‘আল হ্যাজেন’। ‘অ্যাস্টেরয়েড ৫৯২৩৯ আল হ্যাজেন’ নামক একটি গ্রহাণুর নামকরণও করা হয় তার সম্মানে। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক আলোকবর্ষ উপলক্ষে জাতিসংঘ ইবনে আল হাইথামের আলোকবিদ্যা বিষয়ক কাজের ১,০০০ তম বার্ষিকী উদযাপন করে।

আলাের গতি সম্বন্ধে গােলাকৃতি লেন্সের ফোকাস সংক্রান্ত যে সমস্যার সমাধান ইবনে হায়সাম করেন, সেই সমস্যাটি অদ্যাবধি Al Hazen’s Prolem নামে ইউরােপে প্রচলিত আছে।

ইবনে হায়সাম মাকালাতু ফিল মাজরাত গ্রন্থে ছায়াপথের মহাশূন্যের নাক্ষত্রিক অবস্থান ইত্যাদি সম্বন্ধে বিস্তারিত আলােচনা ও আবিষ্কারের পথ প্রদর্শন করে রেখে গেছেন। এমন কি টলেমির চোখে যা ধরা পড়েনি, তারও তিনি সন্ধান দিয়ে গেছেন।

তিনি প্রায় দুশোতাধিক বই লিখেছিলেন, কিন্তু শুধু ৫৫ টি কাজ বর্তমানে জীবিত আছে। কিছু কিছু কাজের শুধু ল্যাটিন অনুবাদের মধ্যেই সংরক্ষিত হয়েছে।মধ্যযুগে তাঁর বই হিব্রু ল্যাটিন ফার্সি প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয়েছিলো। এ পর্যন্ত ইবনে হায়সামের ল্যাটিন, হিব্রু ও স্পেনীয় ভাষায় ২৫ টি গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে এবং সর্বমােট গ্রন্থের তালিকা পাওয়া গেছে ১৮২টি।

বাকিরা হয়ত চাপা পরে হারিয়ে গেছে অবহেলার ভারে । তবে যে গুটিকতক রয়েছে তা ই সবাইকে ভরকে দিতে যথেষ্ট এবং তার অন্যতম উদাহরণ হল Kitab al-Manazir (Book of Optics ) যা ছিল তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার।

মিসরের রাজধানী কায়রােতে ১০৩৮ খৃস্টাব্দে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ বিজ্ঞানী ইবনে হায়সাম ইন্তেকাল করেন।

8.ইবনে রুশদ(যিনি দর্শন আর ধর্মের মাঝে সংহতি স্থাপন করেছেন)

ইবনে রুশদ কর্ডোভার একটি বিখ্যাত অভিজাত পরিবারে ১১২৬ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরাে নাম আবুল ওয়ালিদ মােহাম্মদ ইবনে আহমেদ ইবনে মােহাম্মদ ইবনে রুশদ।তিনি পাশ্চাত্যে সমধিক পরিচিত ছিলেন Averros নামে।

তাঁর পূর্বপুরুষগণ স্পেনের রাজনীতিতে বিশিষ্ট ভূমিকায় ছিলেন। আন্দালুসিয়ার প্রধান বিচারপতি ছিলেন তাঁর পিতামহ এবং মালেকী মাজহাবের একজন প্রখ্যাত পণ্ডিতও ছিলেন।

ইবনে রুশদ ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান আধ্যাত্মবাদী। কথায় ও কাজে ছিলেন আল্লাহ পাকের এক অনুগত বান্দা। বাল্য ও কৈশােরে তিনি কর্ডোভা নগরীতে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি যে সকল শিক্ষকের নিকট জ্ঞান অধ্যয়ন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে দু’জনের নাম হল-ইবনে বাজা এবং আবু জাফর হারুন।

তিনি সুযােগ পান কর্ডোভা পাঠাগারে পড়াশােনার। এই পাঠাগারে ছিল ৫ লাখ বইয়ের সমাহার। এই বিপুল সংগ্রহের অনেক মৌলিক বই তিনি সেখানে পাঠ করেন। এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন আল হাকাম। তিনি ছিলেন স্পেনের উমাইয়া বংশীয় বিখ্যাত খলীফা।

জ্ঞান সাধনার প্রতি তাঁর ছিল অসীম আগ্রহ। তিনি তার মেধা ও প্রতিভার বলে খুব কম সময়ের মধ্যেই কোরআন, হাদিস, বিজ্ঞান, আইন, চিকিৎসা তার পাণ্ডিত্য ও কর্ম দক্ষতার সুনাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি জীবনের সমস্ত অবসর সময়ে দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, অঙ্কশাস্ত্র ও পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আলােচনা করেন। কথিত আছে, তিনি বিবাহ ও পিতার মৃত্যুর রাত্রি ছাড়া আর কোন রাত্রিতেই অধ্যয়ন ত্যাগ করেন নি।

অপরদিকে তাঁর চিকিৎসার খ্যাতি ও প্রতিপত্তিতে মুগ্ধ হয়ে খলিফা আবু ইয়াকুব ইউসুফ ১১৮২ খ্রিটাব্দে প্রখ্যাত দার্শনিক ও চিকিৎসক ইবনে তােফায়েলের মৃত্যুর পর তাকে রাজ চিকিৎসক হিসেবে নিয়ােগ করেন এবং পরবর্তীতে ইয়াকুবের পুত্র খলিফা ইয়াকুব আর মনুসুরও ইবনে রুশদকে রাজ চিকিৎসক পদে বহাল রাখেন।

আসলে সেখানেই সূচনা ঘটে ইবনে রুশদের বিজয় অভিযান। সে সূত্রে তিনি হতে সক্ষম হন সার্জারীর জনক। তিনি এ দায়িত্ব অব্যাহত রাখেন খলীফা ইয়াকুব আল মনসুর-এর ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে। আল মনসুর ছিলেন খলীফা ইবনে ইয়াকুবের পুত্র।

তিনি তার দর্শন ও ধর্মীয় বিষয়ে বলিষ্ঠ মতবাদ ব্যক্ত করতেন এবং ইসলামের সাথে দর্শনের সামঞ্জস্যবিধান করেন।

তিনি ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ে তিনি তাঁর মতামত প্রকাশ করতে শুরু করলে,
খলিফারা তাঁর নির্ভীক ও স্পষ্ট মতবাদে বিরক্ত ও ক্রোধান্বিত হয়ে উঠতেন।

অবশেষে খলিফা ইয়াকুব আল মনসুর তাকে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অপসারণ করেন। এতেও খলিফা সন্তুষ্ট হলেন না।

১১১৯ ইং সালে খলিফা তাকে কর্ডোভার নিকটবর্তী ইলিসাস নামক স্থানে নির্বাসন দেন।

১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে খলিফা তাঁর ভুল বুঝতে পেরে লােক পাঠিয়ে ইবনে রুশদকে ফিরিয়ে আনেন এবং পূর্ব পদে পুর্নবহাল করেন। কিন্তু তিনি এ সুযােগ বেশি দিন ব্যবহার করতে পারেননি। ১১৯৯ খ্রিষ্টাব্দে এ মুসলিম মনীষী ইহলােক ত্যাগ করেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২০টি। এগুলাের অধিকাংশই ইংরেজি, ল্যাটিন ও জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনি স্ট্রোকের নতুন তত্ত্ব প্রদান করেন এবং প্রথমবারের মতো পারকিনসন রোগের বর্ণনা দেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম ছিলেন যিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে রেটিনা হচ্ছে আলোক্সংবেদনশীলতার প্রকৃত স্থান।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর তার প্রণীত একটি উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ হচ্ছে, ‘আল-কুল্লিয়াত ফিত-তিব’ (পাশ্চাত্যে ল্যাটিনকৃত নাম কলিজেট[The Colliget] নামে পরিচিত)। । চিকিৎসা শাস্ত্রে এটি একটি মাস্টার ওয়ার্ক। ইবনে রুশদ এই বইটি লিখেন ১১৬২ খৃস্টাব্দের আগে।

এতে রয়েছে চিকিৎসা শাস্ত্রের তিনটি মৌল বিষয় : রােগ বিশ্লেষণ ডায়ােগনােসিস), নিরাময় (কিউর) এবং প্রতিরােধ (প্রিভেনশান)। বইটিতে ইবনে সিনার আল- কানুন সম্পর্কে সর্বশেষ উল্লেখ রয়েছে।

এ গ্রন্থটিতে তিনি অসংখ্য রােগের নাম, লক্ষণ ও চিকিৎসা প্রণালী বর্ণনা করেছেন।

এতে ইবনে রুশদের আসল পর্যবেক্ষণের বিষয় বিধৃত আছে। ল্যাটিনে অনুদিত হয়ে তাঁর এ বই ইউরোপে কয়েক শতাব্দীকাল ব্যাপী চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার প্রমিত গ্রন্থরূপে ব্যবহৃত হয়েছিলো।

তিনি অ্যারিস্টটলের কাজের ওপর তিনটি সমালােচনা প্রকাশ করেছিলেন। যে কারণে তিনি পাশ্চাত্যে ব্যাখ্যাদাতা(The Commentator) এবং যুক্তিবাদের জনক হিসেবে পরিচিত।

এর মধ্যে সবচেয়ে ছােট সমালােচনামূলক লেখাটি ছিল জামি’। মাঝারি আকারের বইটি তালখিস’ এবং বিস্তারিত বইটি ছিল তাফসিস’। আসলে ‘তাফসিস’ ছিল তার মূল অবদান। এতে আবু রুশদ তাঁর নিজস্ব বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। এই বিশ্লেষণের ভিত্তি ছিল কুরআনের ব্যাখ্যা।

‘কিতাব ফি হারাকাত আল ফালাক’ হচ্ছে ইবনে রুশদের জোতিবিদ্যা বিষয়ক একটি বই। এই বইয়ে ভূমন্ডলের গতি বিষয়ে তিনি আলােচনা করেন।এছাড়াও তিনি গােলকের গতি সম্বন্ধে এই বইয়ে আলোচনা করেন।

তাঁর লেখা বই ‘আল মাজেস্ট’ দুখণ্ডে বিভক্ত।এক খণ্ডে বর্ণনা আছে ভূমণ্ডলের। অন্য খণ্ডে বর্ণিত হয়েছে ভূমণ্ডলে গতির বিষয়টি। ১২৩১ খৃষ্টাব্দে এই বইটি আরবি থেকে হিব্রু ভাষায় অনুবাদ হয়। এর দুই বইয়ের অনুবাদক ছিলেন ইয়াকুব আনাতুলি। অন্য পরিচয়ে জেকব আনাতুলি।

ইবনে রুশদ জ্ঞান অর্জন করেন সঙ্গীতের জগতেও। তিনি অ্যারিস্টটলের সঙ্গীত বিষয়ক বই De Anima ‘র সমালােচনা করে বই লিখেন। মিশেল দ্যা স্কট নামে জনৈক অনুবাদক এটি লাতিন ভাষায় অনুবাদ করেন।

ধর্ম ও দর্শনের উপর তাঁর রচিত একটি উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ হচ্ছে তাহজুল আল তাহজুল’ যার ইংরেজি অনুবাদের নাম হচ্ছে, The Incoherence of the Incoherence’ এছাড়া ইবনে রুশদ সঙ্গীত ও ত্রিকোণমিতি সম্বন্ধেও গ্রন্থ রচনা করেন।

ইবনে আল আব্বার বলেছেন, ইবনে রুশদ ২০ হাজার পৃষ্ঠার বই লিখে গেছেন। এগুলাে মূলত দর্শন, চিকিৎসা ও মৌলিক আইন বিষয়ক বই। শুধু চিকিৎসা বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ২০টির মতাে বই। ইবনে রুশদের দর্শন বিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই হচ্ছে : ‘বিদায়াত আল মুক্তাসেদ ওয়া নেহায়েত আল মুকতাসেদ।’

এছাড়াও প্রাচ্যবিদ আর্নেস্ট রেনান এর মতে ইবন রুশদের অন্তত ৬৭ টি স্বতন্ত্র রচনা বিদ্যমান; তন্মধ্যে ২৮ টি দর্শন, ২০ টি চিকিৎসাবিদ্যা, ৮ টি আইনবিদ্যা, ৫ টি ধর্মতত্ত্ব ও ৪ টি ব্যকরণ নিয়ে, এর সাথে আছে অ্যারিস্টটলের সিংহভাগ কাজের উপর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং প্লেটোর রিপাবলিক এর উপর বক্তৃতা।ইবন রুশদের অনেক কাজের মূল আরবি পান্ডুলিপি পাওয়া যায় নি, বেশিরভাগই শুধুমাত্র হিব্রু এবং ল্যাটিন অনুবাদের পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ অ্যারিস্টটলের উপর তার দীর্ঘ ব্যাখ্যাগুলোর খুব কম অংশের মূল আরবি পান্ডুলিপি উদ্ধার সম্ভব হয়েছে।

মালেকী সম্প্রদায়ের ফিকাহ শাস্ত্রে একে সর্বোত্তম বই হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইবনে রুশদের বইগুলাে মূলত অনুবাদ হয়েছে ইউরােপীয় লাতিন, ইংরেজি, জার্মান, হিব্রু ইত্যাদি ভাষায়। তার দর্শন বিষয়ক বইগুলাে হিব্রু ভাষায় সংরক্ষিত আছে। সামান্য ক’টি বই পাওয়া যায় মূল আরবি পাণ্ডুলিপি আকারে। প্রাচ্যের চেয়ে পাশ্চাত্যে ছিল তার বেশি গ্রহণযােগ্যতা।

এ মনীষী দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, আইন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ব্যাকরণ, চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করে যান। কিন্তু তাঁর প্রণীত অনেক গ্রন্থই সংরক্ষণের অভাবে আজ বিলুপ্ত প্রায়।

প্ল্যাটোর রিপাবলিক, গ্যালেন-এর ট্রিটিজ অন ফিভারস, আল ফারাবীর লজিক সম্পর্কে তাঁর সমালােচনামূলক লেখাগুলাে হারিয়ে গেছে। তাঁর প্রণীত প্রায় ৮৭টি বই এখনাে পাওয়া যায়। ইবনে রুশদকে দ্বাদশ শতকের একজন শীর্ষ সারির চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

১৯৭৩ সালে রুশদের সম্মানে একটি গ্রহাণুর নাম রাখা হয় ‘৮৩১৮-অ্যাভেরস’। একটি বিশেষ প্রজাতির উদ্ভিদের গণ ‘অ্যাভেরোয়া’ করা হয় ইবনে রুশদের সম্মানে। তাছাড়া চাঁদের একটি ক্রেটারের নাম তার নামে ‘ইবনে রুশদ’ রাখা হয়।