পঞ্চগড় ভ্রমণ৷
আমার কাছে চলাটাই জীবন,
থেমে যাওয়া মানে মৃত্যু। আমার মনের স্বভাব বুনো জন্তুর মতোন সে কি আর চারদেয়ালে আটকায়!
এবারে হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনের দিন জয়ের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে তিনবন্ধু মিলে ঠিক করা হলো এবার তবে দূরে কোথাও যাওয়া যাক। হুটহাট কথা হলো চলো তবে পঞ্চগড় যাওয়া যাক। কি করবো না করবো সেসব ভাবনা ভাবিনি ট্রেনে উঠলাম চলে এলাম। কালী পূজার ঘোর আমাবস্যা তিথিতে আমরা বেরোলাম নিজেদের মনের খোরাক খুঁজতে। লোকাল ধরে তালোড়া ছেড়ে শান্তাহার ইস্টেশনে নামলাম।
টিকিট কেনার পর জানলাম ট্রেন আরো তিনঘণ্টা বাদে আসবে। বন্ধু থাকলে আর কি লাগে। সান্তাহারের অলিগলিতে চক্কর দিতে দিতে কখন যে সময়টুকু কেটে গেছে টেরই পাইনি কেউ। সময়ের আধাঘন্টা পরে ‘বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস’ ভিড়লে তাতে চেপে বসি। ওরে মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি জীবনের শেষ রাত৷ ট্রেনে উঠে গল্প আর একে অপরকে জ্বালাতে জ্বালাতেই বেশ সময় কেটে যাচ্ছিলো। তবে শেষদিকে নিরব ছাড়া আমি আর জয় দুজনই ঘুম। সকালে ঘুম যখন ভাঙলো তখন ট্রেনের জানালায় সূর্য তার দিনের প্রথম স্বর্গীয় আলো ছড়াচ্ছে।
এরপর বীর সিরাজুল ইসলাম ইস্টিশনে (পঞ্চগড়) নমলাম৷ এদিকে এতো শীত তাতো ভাবিইনি। হুট খোলা ভ্যানে চেপে যখন মৌচাক মোড়ের দিকে যাই তখন শীতের তীব্রতা আন্দাজ করা যাচ্ছিলো। সেই শীতের বাতাস লাগাতে লাগাতে মৌচাক মোড়ে যাই৷ মৌচাক মোড়ে নাস্তা সেড়ে সেখান থেকেই লোকাল বাস ধরে অমিত দাদার দেওয়া ঠিকানা মতো পৌঁছে যাই ভজনপুরে। সেখানকার গেস্টহাউজে উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পরি চারজনে মটোরসাইকেল নিয়ে।
ওহ বলে রাখি গেস্ট হাউজের পেছন দিকটাতে গিয়েই জীবনের প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন হয়। সময় নষ্ট না করে সকালের মিষ্টি রোদকে সাথে নিয়ে দুপাশের চা বাগানকে ঘিরে যে স্বর্গীয় রাস্তাটি গিয়েছে তার উপর দিয়ে আমরাও আমাদের যান্ত্রিক বাহনকে নিয়ে ছুটি নিজেদের মনকে শান্ত আর জীবনকে স্বার্থক করতে। রাস্তা ধরে এগোবার সময়ই বারবার চোখে পরছিলো কল্পনাতীত বিশাল এক পর্বতমালা। মোহনীয় তার রূপ এইতো সে যে আমাদের টানে। এরপর তেঁতুলিয়ার পুরাতন বাজারের নিচে মহানন্দার ঘটে বসে অপূর্ব কাঞ্চনজঙ্ঘা আর মহানন্দা একযোগে ধরা দেয় আমাদের চোখে। দেখলাম মহানন্দার বুক চিরে অনেক লোক পাথর তুলছে৷ জানলাম সেটাই তাদের জীবিকা।
প্রাকৃতিক পরিবেশ বদলে গেলে সেই সম্পর্কিত জনজীবনও পাল্টে যাবে স্বাভাবিক বিষয়। একটু দূরে অবস্থিত তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোতেও গেলাম। ডাকবাংলোর সামনে থেকে নিচে মহানন্দার কলকল শব্দ ছাপিয়ে আবার সেই কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় রূপ। এবার আর সে সেই ভোরের রুদ্রমূর্তি ধারণ না করে বরং অনেকটাই কোমল। বাংলোর বিশাল কড়ই গাছটা মনে এতো দাগ কেটেছে যে না ছুঁয়ে আসতে পারিনি। এরপর সেখান থেকে সোজা গেলাম বাংলাবান্ধা। এপাশ থেকে ওপাশের সীমান্ত রক্ষীদের মাথা রোদে চকচক করা চোখে পরতেই কাঁটাতারের কথা মনকে বিষন্ন করে তুলেছিলো। সে যাক পুঁজিবাদীদের জয় হোক, আমরা পদদলিত হয়েই রবো নাহয়। বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে খুব অল্পসময়ের জন্য থাকার অনুমতি মিলতে না মিলতেই সেদিকে হাঁটা শুরু করেছি৷ গিয়ে খুব অল্প সময়ে নিজেদের ছবি তুলে ফিরে এসেছি।
এরপর সেখান থেকে কাজী এন্ড কাজী টি এটেস্টে ঘুটলাম৷ তাদের বিখ্যাত অর্গানিক মিষ্টি খেলাম। সেইসাথে বিখ্যাত চা পাতাও কিনলাম৷ চা বাগানে ঘুরলাম সবাই ছবি তুললাম৷ তেঁতুলিয়া বাজারে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিজদের রুমে বসে একটু জিরোতে না জিরোতেই মোটরসাইকেল নিয়ে আবার দৌড় দিয়েই করোতোয়া যেদিক দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে সেদিকের ছোট্ট এক ব্রীজে দাঁড়ালাম৷ তারপর কিছু দূর এগোতেই চোখে পরলো ডাহুক তীরের চোখ ঝলসানো রূপ। নিজেদের আটকাতে না পেরে আমরাও গেলাম তার কাছে। শত হলেও নদীর ডাক উপেক্ষা করার সাহস হয়ে ওঠেনি কখনো।
এরপর আবার ডাকবাংলোর নদীর পাশটায় বসে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে সাথে আমরা সূর্যের মিলিয়ে যাওয়া দেখলাম৷ অনেকক্ষণ ধরে বসেই রইলাম৷ পরে অমিত দাদার উদ্বিগ্নতার কারণে সেখান থেকে উঠে তেঁতুলিয়া বাজারে খাওয়া দাওয়া সেরে তিনবন্ধু হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে টুকটুক করে ছাব্বিশ মাইল শীত সাগর পাড়ি দিয়ে রুমে। গান যতোটাই বেসুরো হোক নিজেদের তৃপ্তির সুর কখনো কাটেনি৷ সারাদিনের ঘোরাঘুরির পর অমিতদা আবার নিয়ে গেলো ভজনপুর বাজারে৷ সেখানে গরম গরম ডিমভাজা আর চা খেলাম সবাই৷ রুমে আসতে দেরী হলেও সারাদিনের ক্লান্তির জন্য ঘুমাতে কেউ দেরী করেনি৷ পরদিন ঘুম ভাঙার পর দরজা খুলে দেখি রাতেরও ঘুম ভাঙেনি তখন ঠিকমতো কিন্তু সূর্য তার কাঁথা নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে৷ আমরাও দেরী না করে চটজলদি রেডি হয়ে তিনজনে বেরিয়ে পরলাম মহানন্দার নির্জন কোন পাড়ে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভোরের রূপ দেখাবার জন্য।
স্বার্থক এক সকাল। গিয়েই দেখি রণচণ্ডী রূপে আবার আর্বিভূত হয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমাদের পক্ষে ভাগ্যদেবীর যথেষ্ট কৃপা ছিলো। যেটুকু সময় ছিলাম রাতের আঁধার ছাড়া বাকি সময়টুকু কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান ছিলো। সকালের অনেকটা কাটালাম সেই পাড়ে। সেখান থেকে সকালের নাস্তা সেরে ভারতের সীমানার উপর কসরত করে নো ম্যান ল্যান্ডসে’র মধ্যে চা বাগানে ঢুকে ছবি তুললাম। চা বাগানকে সকালের অভ্যর্থনা জানালাম।
অমিত দাদার এতো সুন্দর আতিথ্য আর অফুরান সাহায্যের জন্যই মূলত এতো কম সময়ে এতো সুন্দর সময় কেটেছে। এরপর রুমে এসে স্নান সেরে লোকাল বাস ধরে পঞ্চগড় শহর৷ বেশ ছিমছাম এক শহর। সেখান থেকে আবার সেই হুট খোলা ভ্যানে বসে ইস্টিশন। এ বিদায় যে শেষ বিদায় নয় তা পঞ্চগড়কে সাফ জানিয়ে দিয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম তিনজনে৷
বি.দ্র – আমরা পঞ্চগড় পৌঁছেছিলাম ১৪ নভেম্বর এবং ফিরে আসি ১৬ নভেম্বর। সেই পুরোটা সময়ই কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান ছিলো। যদি কারো উদ্দেশ্য হয় শুধুমাত্র কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবার তবে দয়া করে আবহাওয়া চেক করে যাবেন। আর যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না দয়া করে৷