♦ >>সকল বিদ‘আত কর্মই মূলত জায়েজ [পর্ব–১] *
উপরের উদাহরণটি বিবেচনা করুন। যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বা লাফিয়ে যিকর বা সালাম পালন করছেন তিনি স্বীকার করবেন যে, রাসূলুল্লাহ সা. বা সাহাবীগণ দাঁড়িয়ে বা লাফিয়ে যিকর, দরুদ বা সালাম পালন করেছেন বা করতে উৎসাহ দিয়েছেন বলে তিনি কোথাও দেখেন নি। তিনি স্বীকার করবেন যে, রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবীগণ বসেবসে যিকর, দরুদ ও সালাম পাঠ করতেন বলে তিনি অনেক হাদীস থেকে জেনেছেন। তারপরও তিনি বসে যিকর বা দরুদ-সালাম পালনে অস্বস্তিবোধ করবেন। বিভিন্ন ‘দলীল’ দিয়ে এ সকল ইবাদত বসে পালনের চেয়ে দাঁড়িয়ে বা নেচে পালন করা উত্তম বলে প্রমাণের চেষ্টা করবেন।
তাঁর বিদআতকে প্রমাণ করতে তিনি অনেক অপ্রাসঙ্গিক দলীল পেশ করবেন এবং সুন্নাত-প্রমাণিত পদ্ধতিকে অবজ্ঞা করতে তিনি বলবেন: ‘সবকিছু কি সুন্নাত মত হয়? ফ্যান, মাইক… কত কিছুই তো নতুন। ইবাদতটি একটু নতুন পদ্ধতিকে করলে সমস্যা কী? উপরন্তু সুন্নাতের হুবহু অনুসরণ করে বসেবসে দরুদ, সালাম ও যিকর পালনকারীর প্রতি কম বা বেশি অবজ্ঞা অনুভব করবেন।
(চ) তাওহীদের বিশ্বাসের ঘাটতি থেকে শিরকের উৎপত্তি এবং রিসালাতের বিশ্বাসের ঘাটতি থেকে বিদআতের উৎপত্তি। বিদআত মূলত মুহাম্মাদ সা.-এর রিসালাতের সাথে অন্য কাউকে শরীক করা বা রিসালাতের পূর্ণতায় অনাস্থা। শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি যেমন শিরক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ‘গাইরুল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া অন্য)-এর প্রতি হৃদয়ের আস্থা অধিক অনুভব করেন তেমনি বিদআতে লিপ্ত ব্যক্তি বিদআতের ক্ষেত্রে ‘গাইরুন্নবী’ (নবী ছাড়া অন্য)-এর অনুসরণ-অনুকরণে অধিক স্বস্তি বোধ করেন। তিনি সর্বদা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ‘সব কিছু কি নবীর তরীকায় হয়?’ বলে এবং নানাবিধ ‘দলীল’ দিয়ে ইত্তিবায়ে রাসূল সা. গুরুত্বহীন বা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকেন। পাশাপাশি তার ‘বিদআত’ আমল বা পদ্ধতিকে উত্তম প্রমাণ করতে ‘গাইরুন্নবী’ অর্থাৎ বিভিন্ন বুজুর্গের কর্মের প্রমাণ প্রদান করেন।
(ছ) মুশরিকগণ আল্লাহর প্রতিপালনের একত্বে বিশ্বাস করত এবং তাঁর ইবাদত করত, তবে তাঁর একার বন্দনায় তৃপ্তি পেত না। তাঁর যিকর বা বন্দনার পাশাপাশি ‘গাইরুল্লাহ’-এর যিকর-বন্দনা হলে তাদের হৃদয় তৃপ্ত হতো। আল্লাহ বলেন: ‘যখন শুধু আল্লাহর একার যিকর হয় তখন আখিরাতে অবিশ্বাসীদের হৃদয় বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয়। আর তিনি ছাড়া অন্যদের যিকর হয় তখন তারা আনন্দে উল্লসিত হয়।” (সূরা ৩৯-যুমার: আয়াত ৪৫) আমরা দেখি যে, বিদআতে লিপ্ত মানুষদের হৃদয়ের অবস্থা মুহাম্মাদ (সা.)-এর ক্ষেত্রে ঠিক একইরূপ হয়ে যায়। তাঁরা তাঁকে মানেন। কিন্তু যখন শুধু তাঁরই অনুসরণ অনুকরণের কথা বলা হয় তখন তারা বিরক্তি অনুভব করেন। কিন্তু তাঁর পাশাপাশি অন্যান্য বুজুর্গের কথা বলা হলে তারা তৃপ্তি বোধ করেন।
অনেকেই বলেন: ‘আমি শুধু অমুক বুজুর্গকে অনুসরণ করব। অন্য কারো বিষয়ে আমার অভিযোগ নেই। তবে আমি অনুসরণ করব শুধু তাঁকেই। তিনি যা করেছেন তা করব এবং যা করেন নি তা করব না। তিনি জান্নাতে গেলে আমিও যাব। …।’ বর্তমান যুগ থেকে অতীতের যে কোনো ‘গাইরুন্নবী’ আলিম, ইমাম বা বুজুর্গের নামে এ কথাটি বলা হলে তাতে সাধারণত আপত্তি করা হয় না। কিন্তু যদি এ কথাটিই মুহাম্মাদ সা.-এর বিষয়ে বলা হয় তবে বিদআতে আক্রান্ত মুমিনগণ তা পছন্দ করবেন না।
সকল বিদআতের ক্ষেত্রেই এটি সুস্পষ্ট। মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় অধঃপতন তো আর কিছুই হতে পারে না যে, তাঁর হৃদয় রাসূলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাত গ্রহণ করতে অস্বস্তি বা অবজ্ঞা বোধ করে। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বারবার বলেছেন: “তাঁর সুন্নাত যে অপছন্দ বা অবজ্ঞা করবে সে তাঁর উম্মাত নয়।”
(জ) অন্যান্য পাপ যতই ভয়ঙ্কর হোক, মুমিন সাধারণত এগুলো থেকে তাওবা করতে পারেন, কিন্তু বিদআত থেকে তাওবা করা খুবই কঠিন। কারণ সকল পাপের ক্ষেত্রে মুমিন জানেন যে তিনি পাপ করছেন; ফলে তাওবার একটি সম্ভাবনা থাকে। পক্ষান্তরে বিদআত পালনকারী তার বিদআতকে নেক আমল মনে করেই পালন করেন। কাজেই এর জন্য তাওবার কথা তিনি কল্পনাও করেন না।
(ঝ) বিদআতের অন্য অপরাধ তা সুন্নাত হত্যা করে। সুন্নাত বহির্ভুত কোনো কর্ম বা পদ্ধতি ইবাদতে পরিণত হওয়ার অর্থ সংশ্লিষ্ট মাসনূন ইবাদত বা পদ্ধতির মৃত্যু। যিনি দাঁড়িয়ে বা লাফিয়ে যিকর বা সালাম পাঠ উত্তম বলে গণ্য করছেন রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবীগণের পদ্ধতিতে বসে যিকর বা সালম তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে যাবে। এভাবে সমাজের অন্যান্য মানুষেরা যখন এভাবে ইবাদতটি পালন করতে থাকবেন তখন সমাজ থেকেও সুন্নাতটি অপসারিত হবে।?
সম্মানিত পাঠক, বিদআত শিরকের পথ উন্মুক্ত করে এবং শিরক আল্লাহর বেলায়াতের পথ চিররুদ্ধ করে। মক্কার কাফিরগণ ইবরাহীম (আ)-এর উম্মাত ছিল। তারা প্রথমে ইত্তিবায়ে রাসূল অবহেলা করে। দীনের বিভিন্ন বিষয়ে ইবরাহীম (আ)-এর হুবহু অনুসরণ না করে যুক্তি দিয়ে নতুন কর্ম করতে শুরু করে। যেমন হজ্জের সময় আরাফাতে না যেয়ে মুযদালিফায় অবস্থান, তাওয়াফের সময় উলঙ্গ হওয়া, তালি বাজিয়ে যিকর করা ইত্যাদি। এর ধারাবাহিকতায় যুক্তি ও দলীলের পথ ধরে তাদের মধ্যে শিরক প্রবেশ করে। উম্মাতে মুহাম্মাদীর শিরকে লিপ্ত মানুষগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে আপনি একই অবস্থা দেখবেন।
আল্লাহর বেলায়াত বা নৈকট্য অর্জনের অর্থ তো সর্বদা তাঁরই নৈকট্য অনুভব করা। সর্বদা হৃদয়ে তাঁরই রহমতের স্পর্শ, সকল আনন্দ-বেদনায় শুধু তাঁরই কথা মনে পড়া, তাঁরই সাথে কথা বলা, তিনি সাথে আছেন এবং তাঁর রহমতময় দৃষ্টি আমাকে ঘিরে রয়েছে বলে সর্বদা অনুভব কর। শিরকে লিপ্ত ব্যক্তির অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি আল্লাহর ইবাদত করেন। তবে আনন্দ-বেদনায় তার মনে পড়ে ‘গাইরুল্লাহ’ কথা। অর্থাৎ যে বুজুর্গকে তিনি ‘ভক্তি’ করেন তাঁরই কথা তার মনে পড়ে, তাঁকেই স্মরণ করেন, তাঁরই দরদভরা দৃষ্টি অনুভব করেন, আনন্দে তাঁরই প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং বিপদে তাঁরই প্রতি আকুতি তার হৃদয় আলোড়িত করে। শিরকের এ বৃত্ত আল্লাহর বেলায়াতের পথ চিরতরে রুদ্ধ করে।
বিস্তারিত আলোচনা, তথ্য, তথ্যসূত্রের জন্য আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স প্রকাশিত, ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রচিত ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থটি দেখুন।