শহিদমিনারে ফুল দেয়াকে মূর্তিপূজার সাথে তুলনা করতে,শেরেক সাব্যস্ত করতে এবং প্রোপাগান্ডা চালিয়ে উঠতিপ্রজন্মকে শহিদমিনার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সারা বছরতৎপর থাকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। অথচ শহিদমিনারএকটি ধর্মনিরপেক্ষ ভাস্কর্য। এতেবাঙালিরা ফুল দেনভাষাশহিদদের প্রতি নিছক শ্রদ্ধা দেখাতে। আজ পর্যন্তকোথাও শোনা যায়নি— শহিদমিনারের শিক ধরে কেঁদেকেটেকোনো হিন্দু নারী হাত জোড় করে উত্তম স্বামী চেয়েছেনকিংবা কোনো মুসলিম ছাত্রী পরীক্ষায় ভালো ফল পেতেশহিদমিনারে গিয়ে তসবি জঁপেছেন। আজ পর্যন্ত শোনাযায়নি— রোগমুক্তির জন্য কোনো বৃদ্ধ জাতীয়স্মৃতিসৌধে পাঁঠা বলি দিয়েছেন কিংবা কোনো ধ্বজভঙ্গপুরুষ দাম্পত্য জীবনে সুখী হবার জন্য অপরাজেয় বাংলায়খাসি মানত করেছেন। শেরেক যদি হয়েইথাকে, তা অহরহহয়ে চলছে বিবিধ পিরের দরগায়। শহিদমিনারে-ভাস্কর্যে হয়নিছকই সংস্কৃতির চর্চা, অপসংস্কৃতির ধারকদের তাইশহিদমিনারকে এত ভয়।বিভিন্ন ভাস্কর্যকে মূর্তি বলে প্রচার করে পৈশাচিক আনন্দপায় প্রতিক্রিয়াশীলেরা। তারা ভালো করেই জানে মূর্তি ওভাস্কর্যের পার্থক্য। তারাও জানে— ধর্মীয় উদ্দেশ্যেতৈরি প্রাণীপ্রতিকৃতি মূর্তি, আর সর্বজনীন উদ্দেশ্যেতৈরি প্রাণীপ্রতিকৃতি ভাস্কর্য।
কোনো এলাকায় একটি শহিদমিনার বামুক্তিযুদ্ধের কোনো ভাস্কর্য নির্মিত হলে তা নিছকভাস্কর্য থাকে না; অল্পদিনের মধ্যেই সেটি পরিণত হয় একটিসাংস্কৃতিক কেন্দ্রে, ভাস্কর্যটিকে কেন্দ্র করে সেখানেতৈরিহয় একটি অঘোষিত সাংস্কৃতিক বলয়; সেখানে মঞ্চস্থ হতেথাকে মুক্তিযুদ্ধের নাটক, ধ্বনিত হতে থাকেরাজাকারবিরোধী কবিতা, পরিবেশিত হতে থাকেতিমিরবিদারী নৃত্য। বাহান্ন থেকেএকাত্তর পর্যন্তসংগ্রামে-সমরে বাঙালিকে সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত করেছে‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটিই। আমরা বাহান্নতেপেয়েছি বাংলা, একাত্তরে পেয়েছি দেশ। শহিদমিনারে না,প্রতিক্রিয়াশীলদের যাবতীয় অ্যালার্জি শহিদমিনারেপরিবেশিত নাটকে-নৃত্যে গানে-কবিতায়। তাই ওরা সমূলেউপড়ে ফেলতে চায় শহিদমিনারের প্রতিটি ইট, প্রতিটি রড!পাকিস্তান সরকার কেন্দ্রীয় শহিদমিনার ভেঙেছিল দুইবার—১৯৫২ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি একবার, ১৯৭১ সালের ২৫শেমার্চ রাতে আরেকবার। আলী আকবর টাবীর ‘দৈনিক সংগ্রাম— মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা’ বইটি ওলটাতে-ওলটাতে ৯৫পৃষ্ঠায় দেখলাম ১৯৭১ সালের ১৬ই জুলাই জামায়াতেরমুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদকীয়তে লেখা আছে—‘আইয়ুব খানের গভর্নর আজম খান ছাত্রদেরকে খুশি করারজন্য যে শহিদমিনার তৈরি করলেন, তাকে পূজামণ্ডপ বলাযেতে পারে। কিন্তু মিনার কিছুতেই না। সেনাবাহিনী এইকুখ্যাত মিনারটি ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ গড়ে শহিদদেরপ্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন জেনেদেশবাসী খুশি হয়েছে।’ অর্থাৎ শহিদমিনারের সাথেপ্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ও জামায়াতিদের শত্রুতা বেশপুরোনো। ভাষা-আন্দোলনের নেতৃত্ব যদি জামায়াতেরকেউ দিত; তা হলে শহিদমিনার পূজামণ্ডপও হতো না,শহিদমিনারে ফুল দেয়া শেরেকও হতো না। যুদ্ধাপরাধীদেরবিচার যেই শুরু হলো, অমনি জামায়াত গোলাম আজমকেভাষাসৈনিক বলে প্রচার করা শুরু করল।
ঘটনাচক্রে একটিমানপত্র পাঠ করে এখন ভাষাসৈনিক-বনে-যাওয়া এই গোলামআজমই আবার সত্তর সালে প্রকাশ্যে বলেছে ভাষা-আন্দোলন করে সে ভুল করেছে। অর্থাৎনিক্ষিপ্ত থুতুপুনরায় গলাধঃকরণ করা প্রতিক্রিয়াশীলদের মজ্জাগতস্বভাব। একজন ভাষাসৈনিককেও খুঁজেবের করা যাবে না,যিনি শহিদমিনারে ফুল দেয়াকে শেরেক মনে করেন।শহিদমিনারে ফুল দেয়াকে শেরেক ও শহিদমিনারকেপূজামণ্ডপ মনে করেন বা করতেন বাংলার একমাত্র ছহি ওআসল ‘ভাষাসৈনিক’ গোলাম আজম গং!বাংলাদেশের যে মাজারটিতে সবচেয়ে বেশি ফুল দেয়া হয় এবংসমর্থকদের মধ্যে যে মাজারটিতে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়,সেটি জিয়াউর রহমানের মাজার। জামায়াতিদের মুখে কখনওশোনা যায়নি— জিয়ার মাজারে শেরেক হচ্ছে কিংবা জিয়ারমাজারটি একটি পূজামণ্ডপ। সালাম-বরকতরা ধর্মযুদ্ধেনিহত নন বলে জামায়াতিরা তাদেরকে ‘শহিদ’ বলতে নারাজ।অথচ ধর্মযুদ্ধে নিহত-না-হওয়া জিয়াউর রহমানকে বিএনপি‘শহিদ রাষ্ট্রপতি’ বলে প্রচার করে চললেও তাতে কখনোইআপত্তি করেনি জামায়াত! শহিদমিনারে ফুল দেয়াকেঅনেকেই ‘অর্থের অপচয়’ বলে বলে প্রচার করে। এদের কাছেঅবশ্য সবই অর্থের অপচয়; এদের কাছে ফুলও অপচয়,পহেলা বৈশাখের ইলিশও অপচয়। সে দিনদূরে না, যেদিন এরাইলিশকেও মুরতাদ মাছ বলে ঘোষণা করবে, ইলিশ খাওয়াকেহারাম ও শেরেক বলে ফতোয়া দেবে!এক শহিদমিনারের যে পরিমাণ রেপ্লিকা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়েআছে, তা পৃথিবীর আর কোনো ভাস্কর্যের নেই। বাঙালিজাতি অন্য কোথাও ঐক্যবদ্ধ না হলেওঅন্ততশহিদমিনারে ও ভাষার প্রশ্নে এক ও ঐক্যবদ্ধ। বাঙালিরএই ঐক্যের জায়গাটিতে ফাটল ধরাতেই শেরেকতত্ত্ব নিয়ে ৬৪বছর ধরে ছটফট করছে বাঙালি জাতিরই একটি বেওয়ারিশঅংশ।