বর্তমান ইন্টারনেটের জগতে গোটা বিশ্ব একটা ঐতিহাসিক সময় পার করছে । অনলাইনের জগত থেকে বর্তমানে অনেক দেশের যুবসমাজ আয় করছেন । তারা হয়েছেন আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বি । আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয় । বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ লাখ ফ্রিল্যান্সার দেশের মাটিতে বসে বিদেশের ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে । (সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন ।০২/০৭/২০২১) । সারা বিশ্ব জুড়ে প্রায় ১.১ বিলিয়ন ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন । যারা আয় করছেন মিলিয়ন, বিলিয়ন ছাড়িয়ে কয়েক ট্রিলিয়ন । (সূত্রঃ ddiy.co)
এরপরেও আমাদের মধ্যে অনেক মানুষের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে এই ফ্রিল্যান্সিং বিষয়টি নিয়ে । আমাদের দেশের অনেক মানুষ ফ্রিল্যান্সিং এর কথা শুনলে তেমন একটা গুরুত্ব দেন না । কিন্তু তাঁরা জানেন না যে, একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা যে স্যালারি পান, তার থেকে অন্তত দশগুণ অর্থ একজন ফ্রিল্যান্সার উপার্জন করতে পারেন । বর্তমানে আমাদের সমাজে ফ্রিল্যান্সিং বিষয় নিয়ে যে বিরূপ কিছু প্রশ্ন প্রচলিত রয়েছে । আজকের আলোচনায় সেগুলোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব ।
প্রশ্নঃ সব জায়গায় ব্যর্থ হয়ে শেষে ফ্রিল্যান্সিং,কেন?
উত্তরঃ অনেকেই পড়ালেখা কিংবা অন্য কিছু করতে ব্যর্থ হচ্ছেন । প্রকৃতপক্ষে কোন কিছু করার ব্যাপারে তারা খুবই অলস, আর সে কারণেই ক্যারিয়ার সাজাতে পারছেন না । আর এরকম কিছু মানুষও ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে সফল হওয়ার চিন্তা করে থাকেন । কিন্তু সেটা হয়ে ওঠে না । ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে অযোগ্যদের জায়গা নেই । যত বেশি যোগ্যতা অর্জন করবেন, অনলাইনে আপনার আয় ততই বৃদ্ধি পাবে । যোগ্যতা ছাড়া হয়তো সাময়িক ভাবে পাঁচ-দশ হাজার টাকা আয় করতে পারবেন । এক কথায় বলতে হয়, ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল হতে গেলে অবশ্যই যোগ্যতার দরকার আছে ।
প্রশ্নঃ ফ্রিল্যান্সিং মানেই কি আপওয়ার্কে কাজ করা?
উত্তরঃ সারা বিশ্বের যত কাজ আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে পাওয়া যায় বা আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে কাজ করানো হয়, তার মাত্র ৭ শতাংশ কাজ মার্কেটপ্লেসগুলোতে পাওয়া যায় । শুধুমাত্র আপওয়ার্কে নয়, আপওয়ার্ক, ফাইবার, পিপল পার আওয়ার, ৯৯ ডিজাইন, এনভাটো, মাইক্রোওয়ার্কারস, ক্লিকব্যাংক, অ্যামাজন ইত্যাদি । মার্কেটপ্লেসের এই ৭ শতাংশ কাজ বাদ দিলে আরো ৯৩ শতাংশ কাজ থাকে । এই কাজগুলো সম্পূর্ণ মার্কেটপ্লেসের বাইরেই হয়ে থাকে । যারা মনে করেন ফ্রিল্যান্সিং মানেই আপওয়ার্ক, তাদের বলবো এই ৯৩ শতাংশ কাজের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিন ।
প্রশ্নঃ ফ্রিল্যান্সিং করতে গেলে কি অল্প যোগ্যতাই যথেষ্ট?
উত্তরঃ ফ্রিল্যান্সিং জায়গাটা শুধুমাত্র যোগ্য ব্যক্তিদের জন্য । কারণ কোনো ক্রেতা তার কাজ করানোর জন্য সারা বিশ্বের অনেক ফ্রিল্যান্সারদের মধ্য থেকে সেরা কাউকে বাছাই করে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন । সুতরাং যাদের যোগ্যতা কম তাদের তখন কাজ না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে । ফ্রিল্যান্সিং এর শুরুতে প্রচুর সময় এবং পরিশ্রম করে নিজেকে যোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে । এরপরই ফ্রিল্যান্সিং কাজে সফলতা পাওয়া যাবে ।
প্রশ্নঃ ফ্রিল্যান্সিং করার জন্য কি অনেক গুণের অধিকারী হতে হয়?
উত্তরঃ যারা অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং করার জন্য আসেন এবং খোঁজ খবর নিয়ে দেখেন যে, যারা ফ্রিল্যান্সিং করে অনলাইনে আয় করছেন তাদের মত যোগ্যতা নতুনদের নেই । তারা অনেকেই ভেবে থাকেন এই পর্যায়ে পৌঁছানো তারপর সম্ভাব না– এ ধারণা থেকেই অনেকে পিছিয়ে পড়েন এবং এক পর্যায়ে ফ্রিল্যান্সিং সেক্টর থেকে পিছিয়ে আসেন ।
আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলব, যারা এই মুহূর্তে সফলভাবে অনলাইনে আয় করছেন, তারাও একসময় খুবই সাধারন ছিলেন । পরিশ্রম এবং প্রশিক্ষণ তাদের আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে । কেউ যদি কাজ শিখে নেন এবং প্রচুর পরিশ্রম করেন তাহলে অনেকেই অনলাইনে সফল হতে পারবেন ।
প্রশ্নঃ ফ্রিল্যান্সিংকে পার্ট টাইম নাকি ফুলটাইম নেওয়া উচিত?
উত্তরঃ আমাদের দেশে এখনো অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং বিষয়টাকে চাকরির বিকল্প ভাবতে পারছেন না । চাকরি কিংবা লেখাপড়ার পাশাপাশি পার্টটাইম হিসাবেই ফ্রিল্যান্সিংকে এখন সবাই ভাবছেন । আর সে কারণেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আমাদের দেশে যে পরিমাণ আয় করা সম্ভব সেটি বাস্তবে পরিণত হচ্ছে না । ফ্রিল্যান্সিং শুধুমাত্র অতিরিক্ত টাকা আয়ের মাধ্যম নয় । ফ্রিল্যান্সিংকে অবশ্যই চাকরির বিপরীতে ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়া সম্ভব । কারণ ফ্রিল্যান্সার হিসাবে মূলত উন্নত দেশের কোনো কোম্পানির হয়েই কাজ করছেন । অনেকেই আবার অন্য কোম্পানির নিয়মিত কর্মচারী হিসেবে এদেশের মাটিতে বসেই চাকরিও করছেন ।
প্রশ্নঃ ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে আয় কি অনিশ্চিত ?
উত্তরঃ চাকরির ক্ষেত্রে কম টাকা হলেও মাস শেষে নিশ্চিতভাবে হাতে টাকা আসে । কিন্তু ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে চাকরির বেতনের থেকেও ৫-১০ গুন আয় হওয়ার পরও এদেশের পরিবারগুলো ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয় করতে বাধা দিয়ে থাকে । তাদের বদ্ধমূল ধারণা- একসময় ফ্রিল্যান্সিংয়ের আয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে ।
ধরুন, কোন একজন মার্কেটিংয়ের কাজ করে অনলাইনে আয় থেকে আয় করেন । তাহলে তার এক সময় কোনো কাজ থাকবে না, এর মানে দাঁড়ায় পৃথিবীতে আর কোন প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিংয়ের প্রয়োজন নেই । সেটি যদি হয়ে থাকে তাহলে দেশের ভেতরেও যারা মার্কেটিং এর কাজ করেন, তারাও বেকার হয়ে পড়বেন । কোন সেক্টর হিসাব করলে লোকাল পর্যায়ে যদি চাকরির সুযোগ থাকে ১০০ প্রতিষ্ঠানে, তাহলে অনলাইনে চাকরির সুযোগ থাকবে ১ লাখ প্রতিষ্ঠানে । কারণ অনলাইনে সারাবিশ্বের সব প্রতিষ্ঠানেই আপনার চাকরি করার সুযোগ থাকছে ।
প্রশ্নঃ ফ্রিল্যান্সিং এ কাজ করতে গেলে ইংরেজি জানাটা কি জরুরী?
উত্তরঃ অবশ্যই জরুরী । কারণ অনেকেই অনেক কাজের ক্ষেত্রে ভালো দক্ষতা থাকার পরও ইংরেজিতে দুর্বল হওয়ার কারণে ফ্রিল্যান্সিংয়ে ভালো করতে পারেন না । অনলাইনে কাজের ক্ষেত্রে দক্ষতা সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেন বায়ার/ ক্লায়েন্টরা ।
সে ক্ষেত্রে বায়ার/ ক্লায়েন্ট কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার সময় যদি দেখেন ফ্রিল্যান্সার ভাষার দুর্বলতার কারণে কাজ সঠিকভাবে বুঝে নিতে পারছেন না কিংবা ফ্রিল্যান্সার বায়ার/ ক্লায়েন্টকে কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার ভাষা বুঝতে তার জন্য কষ্টসাধ্য হয় বা হচ্ছে, তখন বায়ার/ ক্লায়েন্ট কিছুটা বিরক্ত বোধ করেন । সে ক্ষেত্রে কাজে দক্ষ থাকলে অনেক সময় বায়ার/ ক্লায়েন্ট ভাষার দুর্বলতাকে বিবেচনা করেন । তবে ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজ করতে গেলে অবশ্যই ইংরেজিতে পারদর্শী হওয়াটা জরুরী ।
প্রশ্নঃ লেখাপড়া না জেনেও ফ্রিল্যান্সিং করা যাবে?
উত্তরঃ সবকিছুর জন্যই লেখা পড়ার দরকার আছে । শিক্ষিত ব্যক্তির জ্ঞানের পরিধি একজন অশিক্ষিত ব্যক্তির থেকে অনেক বেশি উন্নত হবে এটাই স্বাভাবিক । যদিও শুধু চাকরি করার জন্য লেখাপড়া করতে হয়, এরকম একটি ভুল আমাদের দেশে প্রচলিত রয়েছে । আপনি যদি লেখাপড়া না জানেন, তাহলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে উন্নততর প্রশিক্ষণ কিভাবে নিবেন? ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজ করতে গেলে প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণের দরকার হয় এজন্য প্রচুর পরিমাণ পড়াশোনা করতে হয় । শুধুমাত্র কোনো একটি বিষয়ে পারদর্শী হলেই চলবে না । এজন্য অবশ্যই আপনাকে লেখাপড়া জানতে হবে ।
প্রশ্নঃ ফ্রিল্যান্সিং করার জন্য কতদিনের প্রস্তুতি নিতে হয়?
উত্তরঃ ফ্রিল্যান্সিং করার জন্য যে বিষয়টি আপনি বেছে নিয়েছেন, সেটি খুব ভালোভাবে দক্ষ হওয়া ছাড়া কাজ করে প্রচুর পরিমানে আয় করার সম্ভাবনা কম থাকে । আর ভালো ভাবে দক্ষ হওয়ার জন্য অবশ্যই ট্রেনিং নেওয়ার পাশাপাশি সেটি প্রচুর পরিমাণে প্র্যাকটিস করার জন্য সময় দেওয়া দরকার ।
এ বিষয়ে অভিজ্ঞরা বলে থাকেন, মাসে ২০ হাজার টাকার চাকরি পাওয়ার জন্য স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে যদি ২০ বছর ব্যয় করতে হয়, তাহলে অনলাইনে আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা আয় করার জন্য কমপক্ষে ছয় মাস থেকে এক বছর সময় ব্যয় করার মত ধৈর্য থাকাটা আবশ্যক ।
প্রশ্নঃ ট্রেনিং সেন্টারে কোর্স না করলে ফ্রিল্যান্সার হওয়া যায় না?
উত্তরঃ অবশ্যই যায় । বর্তমানে অনলাইনে বিভিন্ন ব্লগে, ইউটিউবে এখন প্রচুর ভিডিও টিউটোরিয়াল আছে । ইচ্ছা থাকলে সেগুলো দেখে দেখে ঘরে বসেই সবকিছু শিখে অনলাইনে ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব । বর্তমানে বাংলাতেই অনেক ভালো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে, যা কাজ শুরু করার জন্য যথেষ্ট । তবে এটা সত্য, নিজে নিজে সেগুলো পড়ে শিখতে গেলে পরিশ্রম এবং সময় অনেক বেশি লাগে । যদি একটা কোর্স করে যথাযথ কাজের নির্দেশনা পাওয়া যায় তাহলে সে কাজ করা অনেক সহজ হবে ।
প্রশ্নঃ সাইন্সের স্টুডেন্ট না হলে ফ্রিল্যান্সিং করা যায় না?
উত্তরঃ অবশ্যই যায় । অনলাইনে ক্যারিয়ারের সাথে অ্যাক্যাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কোন ধরনের সম্পর্ক নেই । মানবিক কিংবা বাণিজ্য অথবা সাইন্স যে কোন বিভাগের যে কেউ অনলাইনে কাজের দক্ষতা অর্জন করে সেগুলোর মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং করে সফল হতে পারবেন ।
বর্তমান অনলাইনের যুগে যারা এখনো বেকার অবস্থায় রয়েছেন, তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলবো আপনারা অনলাইনে কাজের ক্ষেত্রগুলোতে কর্ম খোজার চেষ্টা করুন । নিজেকে স্ব-উদ্যোগী হয়ে স্বাবলম্বী করুন । আপনি হয়তো জানেন না যে আমাদের পাশের দেশ ভারত এবং পাকিস্তানের প্রচুর যুবক ফ্রিল্যান্সিং করে আজ তারা স্বাবলম্বী । ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের দেশও যে পিছিয়ে আছে তা নয় । আমাদের দেশের অনেক যুবক ফ্রিল্যান্সিং করে আজ স্বাবলম্বী । সমাজে তাদের মান মর্যাদাও অনেক উঁচুতে । তাই আপনাদের বলব, আর বেকারত্ব নয় কাজ শিখুন, ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হন । আল্লাহ হাফেজ ।।
4 thoughts on "ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে কিছু প্রশ্ন এবং উত্তর"