বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে মুঠোফোন গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। এর বড় একটি অংশ স্বাক্ষরজ্ঞানহীন অথবা ইংরেজি পড়তে অক্ষম। কিন্তু বাজারে প্রচলিত বেশির ভাগ মুঠোফোন পরিচালনার জন্য দরকার কিছু কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি ইংরেজি পড়ার দক্ষতা। তা সত্ত্বেও স্বাক্ষরজ্ঞানহীন গ্রাহকরা কিভাবে মুঠোফোন ব্যবহার করছেন, ব্যবহার করতে গিয়ে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, কিভাবে তাদের জন্য উপযোগী মুঠোফোন ইন্টারফেস তৈরি করা যায় তা নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির একটি দল। এই দলে আছেন কর্নেল ইউনিভার্সিটির ইনফরমেশন সায়েন্স বিভাগের পিএইচডি ক্যান্ডিডেট ও বুয়েটের সাবেক প্রভাষক সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ এবং বুয়েটের নবম ব্যাচের তিনজন শিক্ষার্থী মারুফ হাসান জাবের, মেহরাব বিন মোর্শেদ ও হাবিবুল্লাহ বিন ইসমাইল। মারুফ বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। আর মেহরাব ও হাবিবুল্লাহ যথাক্রমে মুক্তসফট ও আইপে নামক দুটি সফটওয়্যার কম্পানিতে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। প্রকল্পটিতে সম্পাদিত হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত মাইক্রো-প্রসেসর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টেলের অর্থায়নে।

প্রকল্পের প্রথম ধাপে ছিল অক্ষরজ্ঞানহীন মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের জীবনযাত্রা এবং প্রযুক্তির সাথে সম্পর্ক পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা যাকে বলা হয় এথনোগ্রাফি। ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের রিকশাওয়ালাদের সাথে মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শুরু হয় ইশতিয়াকদের প্রকল্প। একটি রিকশা গ্যারাজের ১৫ জন রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে ধাপে ধাপে প্রায় ৬ মাস ধরে চলে তথ্য সংগ্রহ। পুরো প্রক্রিয়ায় ছিল রিকশাওয়ালাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার, তাদের জীবনবৃত্তান্ত, এবং আলোচনা সভা। বিস্তারিত এই স্ট্যাডির মাধ্যমে বের হয়ে আসে তাদের জীবনে মুঠোফোনের ভূমিকা, মুঠোফোন থেকে তারা কি ধরনের সেবা গ্রহণ করেন, সেসব সেবা নিতে গিয়ে কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন ইত্যাদি গুরুত্বপুর্ণ তথ্য। দলটি পর্যবেক্ষণ করে বের করে যে অশিক্ষিত কম্যুনিটিতে মুঠোফোনের ব্যবহার আসলে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। অন্যভাবে বলতে গেলে, অক্ষরজ্ঞানহীনদের জন্য আমরা যত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি তৈরি করি না কেন, দিন শেষে তারা তাদের পরিচিত ব্যক্তি, যারা উক্ত প্রযুক্তিটি ব্যবহার করতে সক্ষম তাদের সাহায্য নেয়। যেমন কামরাঙ্গীর চরের রিকশাওয়ালারা মুঠোফোন ব্যবহার করার সময় তাদের গ্যারাজ মালিক, ফ্লেক্সিলোডের দোকানদার, মুঠোফোন সার্ভিসিং সেন্টার, কিংবা অন্যকোনো শিক্ষিত পরিচিতজনদের সাহায্য নিতেন। এইসব সামাজিক সাহায্যকারীদের বলা যায় সোশ্যাল নোড। মুঠোফোন ব্যবহারের এই সামাজিক মডেলটি পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে অনুষ্ঠিত Symposium on Computing for Development সংক্ষেপে ACM DEV নামক একটি সম্মেলনে প্রকাশিত হয় যেখানে এই মডেলটি অত্যন্ত সুনামের সাথে গৃহীত হয়।

মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের পর পরবর্তী সমস্যা ছিল কিভাবে অশিক্ষিত মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের উপযোগী ইন্টারফেস তৈরি করা যায়। অশিক্ষিত মানুষের জন্য মোবাইল ফোনের ইন্টারফেস ডিজাইন বিষয়ে মাইক্রোসফট রিসার্চ থেকে একটি প্রযুক্তি প্রস্তাব করা হয়েছিল যা মোবাইলে লেখার বদলে ছবি দিয়ে অশিক্ষিত মানুষকে সাহায্য করত। সমস্যা হলো, ছবি মনে রাখাও একটা পর্যায়ের পরে সমস্যা হয়ে যায়, ছবি দিয়ে সার্চ করাও কঠিন। ফলে এই প্রযুক্তিটি মাঠপর্যায়ে খুব একটা সাফল্য পায়নি। এর পরের কাজটা আসে যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভারসিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলি থেকে। ওরা ভয়েস ব্যবহার করে একই সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছে। এখানেও সেই মনে রাখার সমস্যা থেকে যায়। এ ছাড়াও ভয়েস প্রসেসিং এ ভুল বেশি হয় এবং দামি মোবাইল সেট লাগে। এগুলোর বাইরেও বিগত এক দশকে প্রযুক্তির প্রস্তাব আসে বিভিন্ন গবেষকদের কাছ থেকে যেগুলোর বিভিন্ন ছোট খাট সমস্যা ছিল। এ জন্য এই সমাধানগুলো সীমিত পর্যায়ে কাজ করলেও ততটা কার্যকর হয়নি। কামরাঙ্গীর চরের রিকশাওয়ালাদের সাথে মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে ইশতিয়াকের দল ডিজাইন করে নতুন একটি ইন্টারফেস। কামরাঙ্গীর চরের রিকশাওয়ালারা তাদের সোশ্যাল নোডদের কাছ থেকে মুঠোফোনের ব্যাপারে সাহায্য নেয় ঠিকই। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় তারা ভৌগোলিকভাবে তাদের সাহায্যকারীদের থেকে দূরবর্তী কোনো স্থানে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় তাদের পক্ষে উপযুক্ত সামাজিক সেবা পাওয়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। ইশতিয়াক রিকশাওয়ালাদের নিকট সম্পর্কের শিক্ষিত ও সহানুভূতিশীল মানুষদেরকে প্রযুক্তির মাধ্যমে যুক্ত করে দেন তাদের ডিজাইনে। উক্ত ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় একটি মোবাইল অ্যাপ যেটি দিয়ে একজন ব্যবহারকারী ভয়েস কল, নাম্বার সেইভের মতো কাজ করতে পারে তাদের পরিচিত মুঠোফোনে পারদর্শী ব্যক্তিদের সহায়তায়। উক্ত অ্যাপটির ইন্টারফেসে ছিল একটি মাত্র বোতাম, ফলে ব্যবহারকারীর কোনো আলাদা প্রশিক্ষণের দরকার নেই। ব্যবহারকারী মোবাইল ব্যবহারের সময় কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে এই অ্যাপটি ব্যবহার করে তার সাহায্যকারীকে সংকেত পাঠাতে পারেন। সাহায্যকারী তার মুঠোফোনের অ্যাপটি ব্যবহার করে উক্ত সমস্যার সমাধান করে দিতে পারেন নিমেষেই। এই হিউম্যান-ইন-দা-লুপ সমাধানটি দেড় মাস ধরে রিকশাওয়ালাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। সাথে সাথে চলে তাদের কাছ মতামত সংগ্রহ। কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ইশতিয়াকদের প্রজেক্টে সাফল্য ছিল আশাতীত। রিকশাওয়ালারা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে তাদের প্রযুক্তি গ্রহণ ও ব্যবহার করে। এমনকি পর্যবেক্ষণের সময়ের পরও তাদেরকে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেতে দেখা যায়।

দলটি তাদের এই গবেষণা নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ লেখেন যা যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলন ACM DEV 2015 তে গৃহীত হয়। সম্প্রতি এই গবেষণাটি উক্ত সম্মেলনে পরিবেশিত হয়। সেখানে প্রবন্ধটি সেরা তিন গবেষণা প্রবন্ধের মাঝে একটি হিসেবে মনোনীত হয়। ইশতিয়াকদের এই প্রযুক্তির নাম দেওয়া হয় “সুহৃদ”, অর্থাৎ বন্ধু। বন্ধুসুলভ কারও কাছ থেকে সহজে সাহায্য নিয়ে মোবাইল চালানোই এর কাজ। বর্তমানে দেশে স্বল্পদামের স্মার্টফোনের ব্যবহার বেড়ে চলেছে দ্রুতগতিতে। স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কারণে ব্যাংকিং, অর্থ লেনদেন, জরুরি চিকিৎসা, দুর্যোগ ব্যবস্তাপনা ও কৃষি পরামর্শের মতো সেবা দিন দিন মুঠোফোনভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই ধরনের সেবাসমূহ অশিক্ষিত গ্রাহকরা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারছে না। ইশতিয়াকের মতে মুঠোফোন ব্যবহারের সামাজিক মডেলকে এই ধরনের মুঠোফোনভিত্তিক সেবা খাতেও কাজে লাগানো যেতে পারে। “সুহৃদ”র মতো এ ধরনের সফটওয়ার স্মার্টফোনে ব্যবহারের মাধ্যমে এই দেশের স্বল্পশিক্ষিত মানুষরা সহজেই মোবাইল ফোনের নানা আধুনিক সুবিধা উপভোগ করতে পারবে বলে ইশতিয়াকদের বিশ্বাস।

Leave a Reply