এক সময় ভাবতাম, ধোয়া কেনো নিচের দিকে না নেমে উপরের দিকে উঠে যায়? মাধ্যাকর্ষণের ফলে সকল বস্তুর আকর্ষণ তো নিচের দিকেই থাকে। তবে ধোয়া বা এজাতীয় জিনিস কেনো উপরের দিকে আকর্ষিত হয়! বিষয়টি আমি ভাবতাম কোনো এক সময়। যা এখন আর ভাবতে হয় না। কেননা, পদার্থবিজ্ঞান আমাদের বলে যে, পদার্থের তিনটি অবস্থা রয়েছে। যা হলোঃ ‘কঠিন’, ‘তরল’ ও ‘বায়বীয়’। কঠিন পদার্থ যেমন ইট, পাথর বা এজাতীয় বস্তু। আর তরল হলো পানি জাতীয় এবং বায়বীয় পদার্থ হলো অক্সিজেন বা বাতাস জাতীয় বিষয় সমুহ। এগুলোর মধ্যে যার ঘনত্ব যত বেশি হবে, সেগুলো ততো নিচে থাকবে।
উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, কোনো পাত্রের ভিতর যদি পাথর কণা, পানি ও বাতাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তবে দেখা যাবে সেখানে পাথর সবার নিচে থাকবে, তার উপর থাকবে পানি এবং এর উপরে ফাঁকা জায়গায় থাকবে বাতাস। কেননা এটিই প্রকৃতির নিয়ম যে, যেই পদার্থ যত হালকা হয়, সেটি ততো উপরে থাকে। আর ধোয়া, আগুণ ও গ্যাসীয় পদার্থগুলো হয়তো বাতাসের চেয়েও অনেক হালকা হয়ে থাকে। সেজন্যই এগুলো নিচে না নেমে সোজা গিয়ে উপরে উঠে। এই ধারণাটি আমার নিজেরই ছিলো, যা পরে বিজ্ঞানের সাথেও মিল পেয়েছিলাম।
বিষয়টির সাথে অবশ্য জলীয় বাষ্পকেও সম্পৃক্ত করা যায়। কেননা আমরা যদি জলবিজ্ঞানের দিকে তাকাই তবে জানতে পারি, বৃষ্টির মাধ্যমে যেই পানিকে আমরা বর্ষিত হতে দেখতে পাই, জলীয় বাষ্প হয়ে সেই পানি আবার আকাশের দিকে উঠে যায়! এটি সম্পর্কে আমরা প্রায় সবাই অবগত। সূর্যের তাপে নদীনালা ও বিভিন্ন জলাশয়ের পানি উত্তপ্ত হয়ে আস্তে আস্তে তা বাষ্পে পরিণত হয়ে বাতাসের সাথে মিশে যায়। এমনকি তা সাধারণ বাতাসের চেয়েও খুব হালকা হয়ে থাকে বিধায় এই জলীয় বাষ্প উপরের দিকে উঠতে থাকে। আর উপরের আবহাওয়া যেহেতু মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা, তাই সেই উপরে উঠা জলীয় বাষ্প ঠান্ডা বাতাসের সাথে মিশে নিজেও সে ঠান্ডা হয়ে যায় এবং তার ঘনত্ব বেড়ে গিয়ে বিন্দু বিন্দু জলীয় কণায় পরিনত হয়। তারপর এই জলীয় কণাগুলো একে অপরের সাথে একত্র হয়ে মেঘের সৃষ্টি করে। অতঃপর তা বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীর বুকে ঝরে পড়ে এবং পুনরায় তা বাষ্প হয়ে আবার আকাশের দিকেই উড়ে যায়। পানির এই পুনরাবৃত্তিকে বলা হয় পানিচক্র।
পানিচক্রের এই প্রক্রিয়াটি কিন্তু আজ থেকে পাঁচশত বছর আগেও কেউ জানতো না। আজকের এই আধুনিক বিজ্ঞান বিভিন্ন চিন্তা-গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে বিষয়টি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। জানা যায়, ১৫৮০ সালে জলবাহী প্রকৌশলী বার্নার্ড প্যালিসি প্রথম পানিচক্রের এই ধারণাটি আবিষ্কার করেন। অথছ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, পানিচক্রের যেই বিষয়টি আজকের এই আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জানাচ্ছে, তা কিন্তু আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগেই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত একটিমাত্র শব্দেই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। সূরা ‘আত-তারিক’ এর ১১নং আয়াতে তিনি বলেন, ‘‘শপথ আসমানের যা ধারণ করে বৃষ্টি’’ এখানে বৃষ্টি অর্থে আরবী ‘রাজ’আ’ (رجع) শব্দটির ব্যবহার হয়েছে। শব্দটি যদিও পরোক্ষভাবে বৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত। তবে এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ‘ফিরে আসা’। এতে জলীয় বাষ্প বারবার আকাশে ফিরে যাওয়া ও বৃষ্টি আকারে পুনরায় তা মাটিতে ফিরে আসা এই পানিচক্রের প্রক্রিয়াটির প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু প্রেরণ করি, অতঃপর আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করি।’’ [সূরা আল-হিজরঃ ২২] এখানে আরবি শব্দ “لواقح” বৃষ্টিগর্ভ, বৃষ্টিবাহী বা বৃষ্টি-সঞ্চারী বায়ু এই জন্য বলা হয়েছে, যেহেতু বাতাস বৃষ্টিভর্তি মেঘমালাকে বহন করে। আমরা জানি, বৃষ্টির উপকরণ হচ্ছে জলীয় বাষ্প। আর এই জলীয় বাষ্প বাতাসের সাথে মিশেই সেটা বায়ু আকারে উপরে গিয়ে বৃষ্টি উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে কাজ করে। আর আয়াতে বর্ণিত “لواقح” শব্দের আভিধানিক অর্থও হচ্ছে ‘উৎপাদনশীল’। যা এখানে ‘উৎপাদনশীল বায়ু’ বা ‘উর্বরকারী বায়ু’ কথাটি বুঝিয়ে থাকে। যেটি কিনা বৃষ্টির জন্য উর্বরকারী বায়ু হিসেবে ধরা যায়।
বৃষ্টি উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে এভাবেও বলেন যে, ‘‘তুমি কি দেখো না, আল্লাহ পরিচালিত করেন মেঘমালাকে, তারপর তিনি তা একত্রে জুড়ে দেন এবং পরে স্তুপীকৃত করেন, অতঃপর তুমি তার মধ্য হতে পানির ধারা বের হতে দেখতে পাও।’’ [সূরা আন-নূরঃ ৪৩]
উল্লিখিত আয়াতগুলো দ্বারা বুঝাই যায়, জলীয় বাষ্প থেকে শুরু করে বৃষ্টি বর্ষণের পুরো চক্রটিই আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজিদে উল্লেখ করে দিয়েছেন।
বিষয়টি শুধু এখানেই শেষ নয়। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের এটাও বলে যে, প্রতি বছরে যেই পরিমাণ পানির বাষ্প আকাশে উঠে যায়, তার সমপরিমাণ পানিই আবার বৃষ্টিধারায় ঝরে যায়! গবেষণায় আন্দাজ করা হয়েছে যে, প্রতি সেকেন্ডে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬ মিলিয়ন টন পানি বাষ্প হয়ে আকাশে চলে যায়। বছরে এই পরিমাণটি দাড়ায় প্রায় ৫১৩ ট্রিলিয়ন টন। আর প্রতিবছর যে বৃষ্টি হয়, তার পরিমাণও ৫১৩ ট্রিলিয়ন টন। অর্থাৎ যেই পরিমাণ পানি বাষ্প হয়, সেই পরিমাণ পানিই বৃষ্টি হয়। এর মানে এই বুঝায় যে, পানিচক্রের প্রক্রিয়াটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের সাথে পরিমিত। যা আমাদের আধুনিক বিজ্ঞান জানাচ্ছে।
আশ্চর্যকথা হলেও এটাই সত্য যে, বিজ্ঞানের এই রহস্যজনক তথ্যটিও কিন্তু আজ থেকে আরো চৌদ্দশত বছর আগেই কোরআনে কারীমে ঘোষিত হয়েছে। যা সূরা ‘আয-যুখরুফ’ এর ১১নং আয়াতে বর্ণিত যে, ‘‘যিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন পরিমিতভাবে’’। অন্য আয়াতেও আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি আকাশ থেকে পরিমিত পরিমানে বৃষ্টি বর্ষণ করি’’ [সূরা আল-মুমিনুনঃ ১৮] এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, বৃষ্টি বর্ষণের একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ রয়েছে। যার উপর ভিত্তি করেই প্রতিবছর বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। আর আজকের বিজ্ঞানও আমাদের ঠিক এটাই বলছে। যা শত শত বছর আগে থেকেই পবিত্র কোরআনে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
বিজ্ঞানের এই সূক্ষ্ম তথ্যগুলো কিভাবে এলো সেই শত শত বছর আগের বর্ণিত কিতাবে? সে যুগে তো কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিও ছিলো না। ছিলো না কোনো সূক্ষ্মদর্শী বিজ্ঞানবিদ। যে কিনা বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারগুলো নিজের ধারণায় লিখে নিবে বড়সড় কোনো গ্রন্থাকারে। তবে কে দিলো আমাদের বিজ্ঞানের এই রহস্যময় অজানা তথ্যগুলো আজ থেকে আরো চৌদ্দশত বছর আগেই?
সেই বিজ্ঞানী তো আর কেউ নয়; জগত সমুহের স্রষ্টা, সৃষ্টি জগতের বাদশাহ, বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী, আবিষ্কারকদের আবিষ্কারক, শানে মানে জাল্লা, তিনিই আমাদের আল্লাহ!!
16 thoughts on "[কোরআন ও বিজ্ঞান] পানিচক্র ও বৃষ্টির পরিমাণ সম্পর্কিত কোরআন ও আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর তথ্য"