আশ্চর্য রমজান উপলক্ষে আমরা কিভাবে প্রস্তুতি নিব
সকল প্রশংসা কেবল আল্লাহ তায়ালার জন্যে, যিনি আমাদের উপর রমুজানের সিয়াম ফরজ করেছেন তাকওয়া হাসিলের জন্যে। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর, রমযানের যার ইবাদত অন্য মাসের তুলনায় বহুগুন বেড়ে যেত।
প্রিয় মুসলিম ভাই,
বর্তমানে আমরা এমন একটি ফিতনার যুগে এসে পৌঁছেছি, যখন সিয়াম সম্পর্কে বহু মানুষের ধ্যান ধারণা পাল্টে গেছে। তারা এই মাসকে খাবার-দাবার, পান-পানীয়, মিষ্টি-মিষ্টান্ন, রাত জাগা ও স্যাটেলাইট চ্যানেল উপভোগ করার মৌসুম বানিয়ে ফেলেছে। এর জন্য তারা রমজান মাসের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে; এই আশংকায় যে- কিছু খাদ্যদ্রব্য কেনা বাদ পড়ে যেতে পারে অথবা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। এভাবে তারা খাদ্যদ্রব্য কেনা, হরেক রকম পানীয় প্রস্তুত করা এবং কী অনুষ্ঠান দেখবে, আর কী দেখবে না সেটা জানার জন্য স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর প্রোগ্রামসূচী অনুসন্ধান করার মাধ্যমে এর জন্য প্রস্তুতি নেয়। অথচ রমজান মাসের তাৎপর্য সম্পর্কে সত্যিকার অর্থেই তারা অজ্ঞ। তারা এ মাসকে ইবাদত ও তাকওয়ার পরিবর্তে উদরপূর্তি ও চক্ষুবিলাসের মৌসুমে পরিণত করে।
অপরদিকে কিছু মানুষ রমজান মাসের তাৎপর্য সম্পর্কে সচেতন। তারা শাবান মাস থেকেই রমজানের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এমনকি তাদের কেউ কেউ শাবান মাসের আগ থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
রমজানের জন্য প্রস্তুতির কিছু পদক্ষেপ:
১. একনিষ্ঠভাবে তওবা করা :
তওবা করা সবসময় ওয়াজিব। তবে ব্যক্তি যেহেতু এক মহান মাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাই অনতিবিলম্বে নিজের মাঝে ও স্বীয় রবের মাঝে যে গুনাহগুলো রয়েছে এবং নিজের মাঝে ও অন্য মানুষের মাঝে অধিকার ক্ষুণ্ণের যে বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলো থেকে দ্রুত তওবা করে নেয়া উচিত। যাতে করে সে পূত-পবিত্র মন ও প্রশান্ত হৃদয় নিয়ে এ মুবারক মাসে প্রবেশ করতে পারে এবং আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতে মশগুল হতে পারে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “আর হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহ্*র কাছে তওবা কর; যাতে করে সফলকাম হতে পার।”[২৪ আন-নূর : ৩১]
আল-আগার্*র ইবনে ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
( يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ فَإِنِّي أَتُوبُ فِي الْيَوْمِ إِلَيْهِ مِائَةَ مَرَّةٍ ) رواه مسلم ( 2702 )
“হে লোকেরা, আপনারা আল্লাহ্*র কাছে তওবা করুন। আমি প্রতিদিন তাঁর কাছে ১০০ বার তওবা করি।” [হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম (২৭০২)]
২. বেশি বেশি দোআ করা:
কিছু কিছু সলফে সালেহীন হতে বর্ণিত আছে যে, তারা ৬ মাস আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন যেন আল্লাহ তাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছান। রমজানের পর পাঁচ মাস দোয়া করতেন যেন আল্লাহ তাঁদের আমলগুলো কবুল করে নেন।
তাই একজন মুসলিম তার রবের কাছে বিনয়াবনতভাবে দোয়া করবে যেন আল্লাহ তাআলা তাকে শারীরিকভাবে সুস্থ রেখে, উত্তম দ্বীনদারির সাথে রমজান পর্যন্ত হায়াত দেন। সে আরো দোয়া করবে আল্লাহ যেন তাকে নেক আমলের ক্ষেত্রে সাহায্য করেন। আরো দোয়া করবে আল্লাহ যেন তার আমলগুলো কবুল করে নেন।
৩. এই মহান মাসের আসন্ন আগমনে খুশি হওয়া :
রমজান মাস পাওয়াটা একজন মুসলিমের প্রতি আল্লাহ তাআলার বিশেষ নেয়ামত। যেহেতু রমজান কল্যাণের মৌসুম। যে সময় জান্নাতের দরজাগুলো উন্মুক্ত রাখা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ রাখা হয়। রমজান হচ্ছে- কুরআনের মাস, সত্যমিথ্যার মধ্যে পার্থক্য রচনাকারী জিহাদি অভিযানগুলোর মাস। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
( قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ ) [10 يونس : 58]
“বলুন, এটি আল্লাহ্*র অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক । এটি তারা যা সঞ্চয় করে রাখে তা থেকে উত্তম।” [১০ ইঊনুস : ৫৮]
৪. কোন ওয়াজিব রোজা নিজ দায়িত্বে থেকে থাকলে তা হতে মুক্ত হওয়া :
আবু সালামাহ্* হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন:
كَانَ يَكُونُ عَلَيَّ الصَّوْمُ مِنْ رَمَضَانَ فَمَا أَسْتَطِيعُ أَنْ أَقْضِيَهُ إِلا فِي شَعْبَانَ . رواه البخاري ( 1849 ) ومسلم ( 1146 )
“আমার উপর বিগত রমজানের রোজা বাকি থাকলে শা‘বান মাসে ছাড়া আমি তা আদায় করতে পারতাম না।”[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী (১৮৪৯) ও ইমাম মুসলিম (১১৪৬)]
হাফেয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “আয়েশা (রাঃ) এর শাবান মাসে কাযা রোজা আদায় পালনে সচেষ্ট হওয়া থেকে বিধান গ্রহণ করা যায় যে, রমজানের কাযা রোজা পরবর্তী রমজান আসার আগেই আদায় করে নিতে হবে।” [ফাতহুল বারী (৪/১৯১)]
৫. রোজার মাসয়ালা-মাসায়েল জেনে নেয়া এবং রমজানের ফজিলত অবগত হওয়া।
৬. যে কাজগুলো রমজান মাসে একজন মুসলমানের ইবাদত বন্দেগীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে সেগুলো দ্রুত সমাপ্ত করার চেষ্টা করা।
৮. রমজানের রোজার প্রস্তুতিস্বরূপ শাবান মাসে কিছু রোজা রাখা:
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ : كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُ حَتَّى نَقُولَ لا يُفْطِرُ وَيُفْطِرُ حَتَّى نَقُولَ لا يَصُومُ ، فَمَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلا رَمَضَانَ ، وَمَا رَأَيْتُهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِي شَعْبَانَ . رواه البخاري ( 1868 ) ومسلم ( 1156 )
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনভাবে সিয়াম পালন করতেন যে, আমরাবলতাম – তিনি আর সিয়াম ভঙ্গ করবেন না এবং এমনভাবে সিয়াম ভঙ্গ করতেন যে আমরা বলতাম – তিনি আর সিয়াম পালন করবেন না। আমিরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে রমজান ছাড়া অন্য কোন মাসের গোটা অংশ রোজা পালন করতে দেখিনি এবং শাবান ছাড়া অন্য কোন মাসেঅধিক সিয়াম পালন করতে দেখিনি।” [এটি বর্ণনা করেছেন আল-বুখারী (১৮৬৮) ও মুসলিম (১১৫৬)]
عَنْ أُسَامَة بْن زَيْدٍ قَالَ : قُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ لَمْ أَرَكَ تَصُومُ شَهْرًا مِنْ الشُّهُورِ مَا تَصُومُ مِنْ شَعْبَانَ ، قَالَ : ( ذَلِكَ شَهْرٌ يَغْفُلُ النَّاسُ عَنْهُ بَيْنَ رَجَبٍ وَرَمَضَانَ ، وَهُوَ شَهْرٌ تُرْفَعُ فِيهِ الأَعْمَالُ إِلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ فَأُحِبُّ أَنْ يُرْفَعَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ ) . رواه النسائي ( 2357 ) وحسَّنه الألباني في ” صحيح النسائي ”
উসামাহ ইবনে যায়েদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: “আমি বললাম : ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমি আপনাকে শাবান মাসের মত অন্য কোন মাসে এত রোজা পালন করতে দেখিনি। তখন তিনি বললেন: “এটি রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী মাস। এ মাসের ব্যাপারে মানুষ গাফেল। অথচ এ মাসে বান্দাদের আমল রাব্বুল আলামীনের কাছে উত্তোলন করা হয়। তাই আমি পছন্দ করি যে, রোজা পালনরত অবস্থায় আমার আমল উত্তোলন করা হোক।”[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম নাসা’ঈ (২৩৫৭) এবং আলবানী একে ‘সহীহুন নাসা’ঈ’ গ্রন্থে হাসান বলেছেন।]
এ হাদিসে শাবান মাসে রোজা পালনের হেকমত (গুঢ় রহস্য) বর্ণনা করা হয়েছে। সে হেকমত হচ্ছে- এ মাসে বান্দার আমলগুলো উত্তোলন করা হয়। জনৈক আলেম আরো একটি হেকমত উল্লেখ করেছেন সেটা হচ্ছে- শাবান মাসের রোজা যেন ফরজ নামাজের আগে সুন্নত নামাজের তুল্য। এই্ সুন্নতের মাধ্যমে ফরজ পালনের জন্য আত্মাকে প্রস্তুত করা হয় এবং ফরজ পালনের জন্য প্রেরণা তৈরী করা হয়। একই হেকমত রমজানের পূর্বে শাবানের রোজার ক্ষেত্রেও বলা যেতে পারে।
৯. কুরআন তেলাওয়াত করা
সালামাহ ইবনে কুহাইল বলেছেন: “শাবান মাসকে তেলাওয়াতকারীদের মাস বলা হত।” শাবান মাস শুরু হলে আমর ইবনে কায়েস তাঁর দোকান বন্ধ রাখতেন এবং কুরআন তিলাওয়াতের জন্য অবসর নিতেন।
আবু বকর আল-বালখী বলেছেন: “রজব মাস হল- বীজ বপনের মাস। শাবান মাস হল- ক্ষেতে সেচ প্রদানের মাস এবং রমজান মাস হল- ফসল তোলার মাস।” তিনি আরও বলেছেন: “রজব মাসের উদাহরণ হল- বাতাসের ন্যায়, শাবান মাসের উদাহরণ হল- মেঘের ন্যায়, রমজান মাসের উদাহরণ হল- বৃষ্টির ন্যায়। তাই যে ব্যক্তি রজব মাসে বীজ বপন করল না, শাবান মাসে সেচ প্রদান করল না, সে কিভাবে রমজান মাসে ফসল তুলতে চাইতে পারে?”
এখন তো রজব মাস গত হয়ে গেছে। আপনি যদি রমজান মাস পেতে চান তাহলে শাবান মাসের জন্য আপনার কি পরিকল্পনা? এই হল এই মুবারক মাসে আপনার নবী ও উম্মতের পূর্ববর্তী প্রজন্মের অবস্থা। এই সমস্ত আমল ও মর্যাদাপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে আপনার অবস্থান কী হবে!!
এটি এই মুবারক মাসে একজন মুসলিমের জন্য প্রস্তাবিত রুটিন :
রমজান মাসে একজন মুসলিমের সারাদিন :
আল্লাহ তাআলা সকলের সৎ কথা ও কাজ কবুল করুন এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে আমাদেরকে ইখলাস (একনিষ্ঠতা) দান করুন।
একজন মুসলিম তাঁর দিন শুরু করবে ফজরের সালাতের আগে সেহেরী গ্রহণের মাধ্যমে। উত্তম হচ্ছে যদি রাতের শেষ সময় পর্যন্ত বিলম্ব করে সেহেরী গ্রহণ করা যায়। আযানের আগে তিনি ফজরের সালাতের জন্য প্রস্তুতি নিবেন। বাসা হতে ওজু করে আযানের আগেই মসজিদে যাবেন। মসজিদে প্রবেশ করে প্রথমে ‘তাহিয়্যাতুল মসজিদ’ দুই রাকাত সালাত আদায় করবেন। এরপর মুয়াজ্জিন আযান দেয়ার আগ পর্যন্ত বসে বসে দোয়া দরুদ, কুরআন তিলাওয়াত বা যিকির আযকারে মশগুল থাকবেন। আযান দিলে মুয়াজ্জিনের সাথে সাথে আযানের বাক্যগুলোর পুনরাবৃত্তি করবেন। আযান সমাপ্ত হওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত দুআ পাঠ করবেন। এরপর ফজরের দুই রাকাত সুন্নত নামায আদায় করবেন। তারপর ফরজ সালাত দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত যিকির, দুআ ও কুরআন তিলাওয়াতে মনোনিবেশ করবেন। “সালাতের জন্য অপেক্ষমাণ ব্যক্তি সালাতেই রয়েছেন”। [ বুখারী (৬৪৭) ও মুসলিম (৬৪৯)]
জামাতের সাথে সালাত আদায় শেষে, সালাম ফিরানোর পর তিনি শরিয়ত নির্দেশিত দুআসমূহ পাঠ করবেন। এরপর চাইলে সূর্যোদয় পর্যন্ত মসজিদে থেকে যিকির, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকবেন। এটি করতে পারলে ভাল। ফজরের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে আমল করতেন। এরপর সূর্যোদয়ের পর সূর্য কিছুটা উপরে উঠলে এবং উদয়নের পর ১৫ মিনিটের মত অতিক্রান্ত হলে তিনি চাইলে সালাতুদ্* দোহা তথা চাশ্*তের নামায (সর্বনিম্ন দুই রাকাত) আদায় করবেন। এটি ভাল। আর চাইলে কিছুটা দেরী করে এই নামায পড়ার উত্তম সময়ে নামাযটি পড়তে পারেন। উত্তম সময় হলো- সূর্য আরো উপরে উঠলে এবং রোদের প্রখরতা বাড়লে। এই সময়ে নামাযটি পড়তে পারলে আরো ভাল। [মুসলিম (৭৪৮), তিরমিযী (৫৮৬)]
এরপর কর্মস্থলে যাওয়ার প্রস্তুতিস্বরূপ কিছু সময় ঘুমাতে চাইলে এই ঘুমের দ্বারা ‘ইবাদত ও রিযিক অন্বেষণের নিমিত্তে শক্তি অর্জনের নিয়্যত করবেন। যাতে আল্লাহ চাহেত এ ঘুমের মাধ্যমে সওয়াব পেতে পারেন। ইসলামী শরিয়ত যেসব কথা ও কাজকে ঘুমের আদব হিসেবে নির্ধারণ করেছে সেগুলো পালনে যত্নবান হওয়া উচিত। এরপর তিনি তার কর্মস্থলে যাবেন। যোহরের নামাযের ওয়াক্ত নিকটে এলে যথাসম্ভব শীঘ্রই আযানের আগে অথবা আযানের পরপরই মসজিদে হাযির হবেন। নামাযের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে থাকবেন। এরপর তিনি ২ সালামে যোহরের ৪ রাকাত সুন্নত নামায আদায় করবেন। এরপর কুরআন তিলাওয়াতে মনোনিবেশ করবেন যতক্ষণ পর্যন্ত না জামাত শুরু হয়। এরপর জামাতের সাথে সালাত আদায় করবেন। জামাতের পর যোহরের ২ রাকাত সুন্নত নামায আদায় করবেন। সালাত আদায় শেষে তার ডিউটির বাকী অংশ সম্পন্ন করবেন। ডিউটি শেষে তিনি বাসায় ফিরে আসবেন। যদি আসরের সালাতের পূর্বে লম্বা সময় বাকি থাকে তাহলে কিছু সময় বিশ্রাম নিবেন। আর যদি ঘুমানোর মত বেশি সময় বাকি না থাকে এবং ঘুমিয়ে পড়লে আসরের সালাত ছুটে যাওয়ার আশংকা করেন তাহলে নামাযের ওয়াক্ত হওয়া পর্যন্ত উপযুক্ত কোন কাজে ব্যস্ত থাকবেন। যেমন– বাসার লোকজনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী কিনতে বাজারে যাওয়া। নতুবা কর্মস্থল থেকে ফিরে সোজা মসজিদে চলে যাবেন এবং আসরের সালাত পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান করবেন। আসরের পর একজন মানুষ তার নিজের অবস্থা বিবেচনা করবে। তিনি যদি মসজিদে বসে কুরআন তিলাওয়াতে নিয়োজিত থাকার মত শক্তি পান তাহলে এটা এক মহান সুযোগ। আর যদি তিনি ক্লান্তি বোধ করেন তবে এ সময়ে বিশ্রাম নিবেন; যাতে রাতে তারাবীর নামাযের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারেন।
মাগরিবের আযানের আগে তিনি ইফতারের জন্য প্রস্তুতি নিবেন। এই মুহূর্তগুলোকে তিনি যে কোন ভালো কাজে ব্যয় করবেন। যেমন- কুরআন তিলাওয়াত করা, দুআ করা, অথবা পরিবার ও সন্তানদের নিয়ে ভাল কোন কথা আলোচনা করা। এ সময়ের সবচেয়ে ভাল কাজ হল – রোযাদারদের ইফতার করানোতে অংশ নেওয়া। হয়তো তাদের জন্য খাবার কিনে দেয়ার মাধ্যমে অথবা তা বিতরণ করার মাধ্যমে অথবা এর ব্যবস্থাপনা করার মাধ্যমে। এই আমলের মধ্যে অপরিসীম আনন্দ রয়েছে। এটা তিনিই জানেন যিনি নিজে এ আমল করেছেন।
ইফতারের পর তিনি জামাতের সাথে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদে যাবেন। এরপর দুই রাকাত মাগরিবের সুন্নত সালাত আদায় করবেন। বাসায় ফিরে তিনি প্রয়োজনমাফিক খাদ্য গ্রহণ করবেন। অতিরিক্ত খাবেন না। এরপর এই সময়কে তার নিজের জন্য ও তার পরিবারের জন্য কল্যাণকর কোন পন্থায় ব্যয় করবেন। যেমন – কোন কাহিনীর বই পড়া, দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় হুকুম আহকামের কোন বই পড়া, প্রতিযোগিতার বই পড়া, বৈধ কোন আলাপ আলোচনায় রত থাকা অথবা অন্য যে কোন আকর্ষণীয় কল্যাণকর কাজে ব্যয় করা এবং এগুলোর মাধ্যমে মিডিয়ায় সম্প্রচারিত হারাম অনুষ্ঠান থেকে পরিবারের সদস্যদেরকে বিরত রাখা। কারণ চ্যানেলগুলোর জন্য এটি পিক আওয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই আপনি দেখবেন এ সময় তারা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। যে অনুষ্ঠানগুলো আক্বীদা বিনষ্টকারী ও আখলাক বিনষ্টকারী বিষয়াদিতে ভরপুর থাকে।
প্রিয় ভাই, এসব অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করুন এবং আপনার অধীনস্থদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন। যাদের ব্যাপারে কিয়ামাতের দিন আপনি প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। সেদিনের প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য এখনই প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।
এরপর এশার সালাতের জন্য প্রস্তুতি নিন এবং মসজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হোন। মসজিদে গিয়ে কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল হোন। অথবা মসজিদে কোন ইলমী আলোচনা অনুষ্ঠান থাকলে তা শুনুন। এরপর এশার সালাত আদায় করুন। অতঃপর ২ রাকাত এশার সুন্নত নামায আদায় করুন। এরপর ইমামের পিছনে তারাবির নামায খুশূ (আল্লাহর ভয়), তাদাব্বুর (অনুধাবন), তাফাক্*কুর (চিন্তাভাবনা) এর সাথে আদায় করুন। ইমাম নামায শেষ করার আগে আপনি নামায ছেড়ে চলে যাবেন না। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
” إنه من قام مع الإمام حتى ينصرف كتب له قيام ليلة “. رواه أبو داود (1370) وغيره ، وصححه الألباني في “صلاة التراويح ” (ص 15)
“ইমাম নামায শেষ করা পর্যন্ত যে ব্যক্তি তাঁর সাথে নামায আদায় করবে তার জন্য পুরো রাত নামায পড়ার সওয়াব লিখে দেয়া হবে।”[হাদিসটি আবু দাউদ (নং ১৩৭০) এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ সংকলন করেছেন। আলবানী সালাতুত্* তারাবীহ অধ্যায়ে হাদিসটিকে সহীহ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন]
সালাতুত্* তারাবীর পর আপনি আপনার নিজস্ব ব্যতিব্যস্ততার সাথে সামঞ্জস্যশীল প্রোগ্রাম তৈরি করে নিন। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখবেন:
– সমস্ত হারাম থেকে এবং হারামের আহ্বায়ক বিষয়বস্তু থেকে বিরত থাকুন।
– আপনার বাসার সদস্যদেরকে হারাম থেকে ও হারামের যাবতীয় উপকরণ থেকে কৌশলে বিরত রাখুন। যেমন– তাদের জন্য বিশেষ কোন প্রোগ্রাম তৈরি করুন। অথবা তাদের নিয়ে শরিয়ত অনুমোদিত স্থানে ঘুরতে বের হোন। তাদেরকে অসৎসঙ্গ থেকে দূরে রাখুন। তাদের জন্য সৎ সাহচর্যের অনুসন্ধান করুন।
– কম ফজিলতপূর্ণ বিষয়ের পরিবর্তে বেশি ফজিলতপূর্ণ আমলে মশগুল হওয়া।
আগে আগে বিছানায় যেতে চেষ্টা করুন। ইসলামী শরিয়ত যেসব কথা ও কাজকে ঘুমের আদব হিসেবে নির্ধারণ করেছে সেগুলো পালনে যত্নবান হবেন। ঘুমের আগে যদি কিছু কুরআন তেলাওয়াত বা ভাল কোন বইয়ের কিছু অংশ পড়তে পারেন তবে তা ভাল। বিশেষ করে আপনি যদি কুরআন থেকে আপনার দৈনন্দিন পাঠ্য (ওয়াজীফাহ্) শেষ না-করে থাকেন তবে তা সম্পন্ন না করে ঘুমাবেন না। এরপর সেহেরীর আগে যথেষ্ট সময় নিয়ে ঘুম থেকে উঠুন। যাতে দুআতে ব্যস্ত হতে পারেন। কারণ এই সময় – রাতের শেষ তৃতীয়াংশ – আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে থাকেন। আল্লাহ তাআলা এ সময়ে ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের প্রশংসা করেছেন। এ সময়ে দুআকারীদের দুআ কবুলের এবং তওবাকারীদের তওবা কবুলের ওয়াদা করেছেন। তাই এই মহা সুযোগটি আপনার হাতছাড়া করা উচিত হবে না।
জুমাবার:
জুমাবার সপ্তাহের দিনগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম। তাই এই দিনের ‘ইবাদত ও আনুগত্যের জন্য বিশেষ প্রোগ্রাম থাকা উচিত। এক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলো খেয়াল রাখা দরকার :
# আসরের সালাতের পর মসজিদে অবস্থান করা এবং এ দিনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিলাওয়াত ও দুআতে ব্যস্ত থাকা। কারণ এ সময়ে দুআ কবুল হওয়ার আশা করা হয়।
# সপ্তাহের মাঝে যে কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারেননি তা সম্পন্ন করতে এই দিনকে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করুন। যেমন কুরআনের সাপ্তাহিক পাঠ্য (ওয়াজীফাহ) বা কোন বই পাঠ অথবা ক্যাসেট শোনা অথবা এ জাতীয় কোন ভাল কাজের কিছু অসম্পন্ন থাকলে এদিনে তা সম্পন্ন করুন।
শেষ দশক: লাইলাতুল কদর
রমজানের শেষ দশকে আছে লাইলাতুল কদর (ভাগ্য রজনী)। যে রাত হাজার মাস থেকে উত্তম। তাই এই দশকে মসজিদে ই‘তিকাফ করার বিধান এসেছে। লাইলাতুল ক্বদর পাওয়ার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে ইতিকাফ করেছেন। সুতরাং যার ইতিকাফ করার সুযোগ রয়েছে তার জানা উচিত এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য এক মহান করুণা। আর যার পুরো দশদিন ইতিকাফ করার সুযোগ নেই তিনি যে কয়দিন পারেন ইতিকাফ করতে পারেন। আর যার একেবারেই ইতিকাফ করার সুযোগ নেই তিনি যেন এ রাত্রিগুলোতে ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে কাটাতে সচেষ্ট হন। যেমন কুরআন তিলাওয়াত করা, যিকির করা, দু‘আ’ করা। রাতজেগে এসব আমল করার জন্য তিনি যেন দিনের বেলা বিশ্রাম নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
লক্ষণীয় কিছু বিষয় :
# এই রুটিন একটি প্রস্তাবিত রুটিন। এটি একটি পরিবর্তনযোগ্য রুটিন। যে কেউ তার ব্যতিব্যস্ততার আলোকে এটি পরিবর্তন করে নিতে পারেন।
# এই রুটিনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছ থেকে প্রমাণিত সুন্নতসমূহ যথাযথভাবে পালনের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর মানে এই নয় যে, এতে উল্লেখিত সবকিছুই ওয়াজিব বা ফরজ। বরং এতে অনেক সুন্নাহ ও মুস্*তাহাব্ব কাজ রয়েছে।
# আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় হল সে কাজ যা নিয়মিত করা হয় – তা অল্প হলেও। রমজান মাসের শুরুতে মানুষ আনুগত্য ও ইবাদতের খুব যোশ নিয়ে সক্রিয় থাকে। কিছুদিন পর নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তাই এ ব্যাপারে সাবধান থাকুন এবং এই মহান মাসে পালনকৃত সমস্ত কাজ নিয়মিতভাবে ধরে রাখতে সচেষ্ট হউন।
# একজন মুসলিমের উচিত এই মুবারক মাসে তার সময়ের সঠিক ব্যবস্থাপনায় সচেষ্ট হওয়া। যাতে করে কল্যাণ ও ভাল কাজে এগিয়ে যাওয়ার বড় বড় সুযোগ তার হাতছাড়া হয়ে না যায়। যেমন– রমজান মাস শুরু হওয়ার আগেই পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনে দিতে সচেষ্ট হওয়া। একইভাবে দৈনিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এমন সময়ে কিনতে সচেষ্ট হওয়া যখন বাজারে ভিড় থাকে না। আরেকটি উদাহরণ হল: ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দেখা সাক্ষাতের জন্য এমন রুটিন করে নেয়া যাতে ইবাদতে বিঘ্ন না ঘটে।
# এই মুবারক মাসে বেশি বেশি ইবাদত করা ও আল্লাহর নৈকট্য লাভকে আপনার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করুন।
# সালাতের নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই মসজিদে হাযির হওয়ার ব্যাপারে মাসের শুরুতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। আল্লাহ তাআলার কিতাব তিলাওয়াত খতম (সমাপ্ত) করার সিদ্ধান্ত নিন। এই মহান মাসে নিয়মিত ক্বিয়ামুল লাইল পালন করার সংকল্প করুন। স্বীয় সম্পদ থেকে সাধ্যানুপাতে দান করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হউন।
# এই রমজান মাসে আল্লাহ তাআলার কিতাবের সাথে সম্পর্ক মজবুত করার সুযোগ গ্রহণ করুন। নিম্নোক্ত পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে হতে পারে:
– সঠিক উচ্চারণে কুরআন তিলাওয়াত করা। ভাল একজন কুরআনের শিক্ষকের (ক্বারীর) নিকট কুরআন পড়া সংশোধন করে নেয়া। আর তা সম্ভব না হলে দক্ষ ক্বারীগণের তিলাওয়াতের ক্যাসেট অনুসরণ করা।
– আল্লাহ আপনাকে যতটুকু কুরআন হিফ্*জ করার তাওফিক দিয়েছেন তা রিভিশন দেওয়া এবং হিফ্*জ করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া।
– কুরআনের আয়াতের তাফসীর পাঠ করা। এটা হতে পারে যে আয়াত বুঝতে আপনার সমস্যা হয় সে আয়াতের তাফসীর নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থগুলো (যেমন– তাফসীরে বাগাবী, তাফসীরে ইবনে কাছীর ও তাফসীরে সা‘দী) থেকে সেটা জেনে নেওয়া। অথবা নির্দিষ্ট কোন তাফসীর গ্রন্থ থেকে নিয়মিত পড়ার জন্য রুটিন তৈরি করে নেয়া। প্রথমে আমপারা (পারা-৩০), তারপর তাবারাকা পারা (পারা-২৯) এভাবে পড়তে থাকবেন।
– আল্লাহ তাআলার কিতাবে যে আদেশাবলী পাওয়া যায় তা বাস্তবায়নে যত্নশীল হওয়া।
আমরা দু‘আ’ করছি যাতে আল্লাহ তাআলা সিয়াম, ক্বিয়াম সম্পন্ন করার তাওফিক দানের মাধ্যমে আমাদের উপর রমজান মাস পাওয়ার নেয়ামত পূর্ণ করে দেন। আমাদের পক্ষ থেকে তা কবুল করে নেন এবং আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো মাফ করে দেন।
10 thoughts on "রমজান উপলক্ষে আমরা কিভাবে প্রস্তুতি নিব"