সাদদুদ দারিয়া
সাধারন অর্থেঃ “সাদদুদ দারিয়া হচ্ছে” কোন কাজের মাধ্যম, উপকরন বা উসিলা। ইসলামিক পরিভাষায়ঃ এর অর্থ হচ্ছে কোন গুনাহ’র সম্ভাব্য পথ বন্ধ করে দেয়া। আমাদের সমাজে, সাধারনভাবে চলতে গেলে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের গুনাহের সম্মুখীন হতে হয়। সুতরাং, আমরা যদি এসব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে চাই তবে আমাদেরকে গুনাহ’র পথ(সমূহ)কে বন্ধ করে দিতে হবে।
“আর তারা আল্লাহ্কে ছেড়ে দিয়ে যাদের উপাসনা করে তাদের গালি দিও না, পাছে তারাও শত্রুতাবশতঃ আল্লাহ্কে গালি দেয় জ্ঞানহীনতার জন্য। এইভাবে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য তাদের ক্রিয়াকলাপ আমরা চিত্তাকর্ষক করেছি। তারপর তাদের প্রভুর কাছেই হচ্ছে তাদের প্রত্যাবর্তন, তখন তিনি তাদের জানিয়ে দেবেন কি তারা করতো। “ (সূরা আন’আমঃ ১০৮)
আমরা সবাই একটা প্রবাদ জানিঃ “খাল কেটে কুমির কুমির আনা”।
কিন্ত গুনাহের ক্ষেত্রে, এমন করা যাবেনা অর্থ্যাৎ কুমির আসার সম্ভাবনা থাকলে খাল কাটা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আল্লাহ্ ক্বুর’আনুল ক্বারীমের মাধ্যমে যখন ব্যাভিচারকে নিষেধ করলেন তখন তিঁনি সরাসরি ব্যাভিচার বন্ধ করার কথা না বলে, আমাদের দৃষ্টিকে সংযত করার কথা বলেছেন। লজ্জাস্থানকে হেফাযত করা অনেক সহজ দৃষ্টিকে হেফাযত করা থেকে। আর, এটাকে হেফাজত করতে পারলে, সহজেই দৃষ্টিকে হেফাজত করা যাবে এবং ব্যাভিচারের পথও বন্ধ হয়ে যাবে।
“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।“ (আন-নুর ৩০-৩১)
একজন গায়েরে মাহরাম পুরুষ ও নারী নির্জনে মিলিত হলে সেখানে তৃতীয় আরেকজন থাকে এবং সে হচ্ছে শয়তান। দাওয়া দেয়ার অজুহাতেও নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা করা যাবে না! আমরা স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল, তাই শয়তানকে কোনভাবেই সুযোগ দেয়া যাবেনা নয়তো শয়তান আমাদেরকে হারামের পথে নিয়ে যাবে। জনসম্মুখে দাওয়া দেয়া পুরুষের কাজ, নারীদের নয়। আর, মিশ্র পরিবেশে দাওয়া না দেয়াই উত্তম কেননা আগে নিজেকে রক্ষা করতে হবে এরপর দাওয়াতী কাজ করতে হবে।
হযরত ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন,
“যখনই কোন পুরুষ পর নারীর সাথে নির্জনে দেখা করে তখনই শয়তান সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত হয় ।“(সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং-২১৬৫, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং-৫৫৮৬)
অপর হাদিসে বলা হয়েছেঃ কুতাইবা ইবন সাঈদ (রহঃ)….ইবন আব্বাস (রাঃ) সূত্রে নাবী (সাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
কোন পুরুষ যেন অপর কোন মহিলার সাথে নির্জনে অবস্থান না করে, কোন স্ত্রীলোক যেন কোন মাহরাম সঙ্গী ব্যতীত সফর না করে। এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রসূল (সাঃ)! অমুক অমুক যুদ্ধের জন্য আমার নাম তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আমর স্ত্রী হাজ্জে যাবে। তখন রসূল (সাঃ) বললেন, ‘তবে যাও নিজ স্ত্রীর সঙ্গে হাজ্জ কর’।(ইসলামিক ফাউন্ডেশন | সহীহ বুখারি | অধ্যায়ঃ ৪৮/ জিহাদ | হাদিস নাম্বার: ২৭৯৮)
ক) ইন্টারনেটের ফিতনা থেকে দূরে থাকার জন্য আমরা আরো কিছু কাজ কররে পারিঃ
– খোলা জায়গায় ব্যাবহার করা
– অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে থেকে ব্যাবহার করা
– শুধুমাত্র কর্মস্থলে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাবহার করা
– কোন ওয়েবসাইট থেকে কি জ্ঞান আহরন করব তা নির্ধারন করে শুধুমাত্র তার জন্যই সময় ব্যায় করা
খ) টেলিভিশনঃ
বিভিন্ন ইসলামী চ্যানেলে (যেমন পিস টিভি) ইসলামী অনুষ্ঠানমালা দেখার জন্য টিভি ক্রয় এবং স্যাটেলাইট ক্যাবল সংযোগ না নেয়াই উত্তম। এটা এজন্য যে, দেখা যাবে শয়তানের ধোঁকায় আমরা আধা ঘন্টা ইসলামিক অনুষ্ঠান দেখলে ২ ঘন্টাই ইসলাম বিরোধী অনুষ্ঠানে মগ্ন থাকব। আমাদের অনেকেরই মনে এই কথা উঁকি দেয় যে, “আরে! মন্দটা না দেখলে ভালো আর মন্দের পার্থক্য করব কিভাবে!?” – এই ধরনের মন মানসিকতা ভুলেও লালন করা যাবেনা।
গ) হারাম চাকুরীঃ
“কয়েকদিন বা কিছু সময় সুদ, ঘুষ বা কোন হারাম উপার্জনের সাথে থাকি তারপর আবার হালাল পথে ফিরে আসব” – এমন নীতি মানা যাবেনা কেননা এতে আমাদের মনে সম্পদ ও ভোগ-বিলাসের লোভ ঢুকে পড়তে পারে এবং এর থেকে বেরিয়ে আসা বা পরবর্তীতে এই ভুল শুদ্রানোর সুযোগ না-ও পাওয়া যেতে পেরে।
তাছাড়া আমরা সবাই জানি, হালাল মাল ইবাদাত কবুলের অন্যতম শর্ত। সাহাবায়ে কেরামগন যাদের উপার্জন হালাল হবার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন তাদের জন্য দু’আ করতেও অসম্মতি জানাতেন।
প্রখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বসরার প্রশাসক ও আমীর আবদুল্লাহ ইবনে আমীরকে তার অসুস্থ অবস্থায় দেখতে যান। ইবনু আমির বলেনঃ ইবনু উমার, আপনি আমার জন্য একটু দু’আ করুন না! ইবনু উমার তার জন্য দু’আ করতে অসম্মত হন। কারন তিনি ছিলেন আঞ্চলিক প্রশাসক। আর এ ধরনের মানুষের জন্য হারাম, অবৈধ, জুলুম, অতিরিক্ত কর, সরকারি সম্পদের অবৈধ ব্যবহার ইত্যাদির মধ্যে নিপতিত হওয়া সম্ভব। এ কারনে ইবনু উমার (রাঃ) উক্ত আমীরের জন্য দু’আ করতে অস্বীকার করে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে বলতে শুনেছিঃ “ওজু গোসল ছাড়া কোন সলাত কবুল হয় না, আর ফাঁকি, ধোঁকা ও অবৈধ সম্পদের কোন দান কবুল হয় না”। আর আপনি তো বসরার গভর্নর ছিলেন। (সহীহ মুসলিম ১/২০৪, নং ২২৪)
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
হে মানুষেরা, আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র (বৈধ) ছাড়া কোন কিছুই কবুল করেন না। আল্লাহ মুমিনগনকে সেই নির্দেশ দিয়েছেন যে নির্দেশ তিনি নবী ও রসূলগনকে দিয়েছেন(বৈধ ও পবিত্র উপার্জন ভক্ষন করা)। তিনি (রসূলগনকে নির্দেশ দিয়ে) বলেছেনঃ হে রসূলগন, তোমরা পবিত্র উপার্জন থেকে ভক্ষন কর এবং সৎকর্ম কর, নিশ্চয় তোমরা যা কিছু কর তা আমি জানি।(আল মুমিনূন-৫১)
(আর তিনি মুমিনগনকে একই নির্দেশ দিয়ে বলেছেন) হে মুমিনগন, আমি তোমাদের যে রিযিক প্রদান করেছি তা থেকে পবিত্র রিযিক ভক্ষন কর(সূরা বাকারা-১৭২)।
এরপর তিনি একজন মানুষের কথা উল্লেখ করেন, যে ব্যক্তি (হজ্জ, উমরা ইত্যাদি পালনের জন্য, আল্লাহর পথে) দীর্ঘ সফরে রত থাকে, ধূলি ধূসরিত দেহ ও এলোমেলো চুল, তার হাত দুটি আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে দু’আ করতে থাকে, হে প্রভু! হে প্রভু!! কিন্তু তার খাদ্য হারাম, তার পোশাক হারাম, তার পানীয় হারাম এবং হারাম উপার্জনের জীবিকাতেই তার রক্তমাংস গড়ে উঠেছে। তার দু’আ কিভাবে কবুল হবে! (সহীহ মুসলিম ২/৭০৩, নং ১০১৫)
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন,
“মানুষের মধ্যে এমন এক সময় আসবে, যখন মানুষ নির্বিচারে যা পাবে তাই গ্রহণ করবে। হালাল সম্পদ গ্রহণ করছে না হারাম সম্পদ গ্রহণ করছে তা বিবেচনা করবে না”।(সহীহ বুখারী ২/৭২৬, নং- ১৯৫৪)
আরেক হাদীসে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,
“তোমরা কি জান কপর্দকহীন অসহায় দরিদ্র কে?” আমরা বললামঃ “আমাদের মধ্যে যার কোন অর্থ সম্পদ নেই সেই কপর্দকহীন দরিদ্র”। তিনি বললেনঃ “সত্যিকারের কপর্দকহীন দরিদ্র আমার উম্মতের ঐ ব্যক্তি যে কিয়ামতের দিন সলাত, সিয়াম, যাকাত ইত্যাদি নেককর্ম নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ বা অর্থ অবৈধভাবে গ্রহণ করেছে, কাউকে আঘাত করেছে, কারো রক্তপাত করেছে। তখন তার সকল নেককর্ম এদেরকে দেয়া হবে। যদি হক আদায়ের পূর্বেই নেককর্ম শেষ হয়ে যায়, তাহলে উক্ত ব্যক্তিদের পাপ তার কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হবে, এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহীহ মুসলিম ৪/১৯৯৭, নং ২৫৮১)
19 thoughts on "জেনে নিন “সাদদুদ দারিয়া” সম্পর্কে"