ছোটবেলায় যখন ক্লাসে বসে স্যারের মুখে জিবনের প্রথম শুনেছিলাম যে, চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই, চাঁদ সূর্য থেকে আলো পায়, তখন সবার মত আমিও রীতিমতো অনেকটা অবাক হয়েছিলাম। আমার এখনো মনে আছে, এই ব্যাপারে স্যার একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন, যেটি বিজ্ঞান না পড়ুয়া কওমি মাদ্রাসার ছাত্র হয়েও এখন আমার কাছে খুব হাস্যকর বলে মনে হয়। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, সৌরবিদ্যুৎ যেমন দিনের বেলা সূর্যের আলোর মাধ্যমে চার্জ হয়ে রাতের বেলা আমাদেরকে আলো প্রদান করে, চাঁদও ঠিক তেমনই দিনের বেলা সূর্যের আলোর মাধ্যমে চার্জ হয়ে রাতের বেলা আমাদেরকে আলো প্রদান করে। এই বিষয়ে তখন এতো বেশি জ্ঞান না থাকার কারণে স্যারের কথাটিকেই আমি নির্ধিদায় সত্য বলে মেনে নিয়েছিলাম এবং পরবর্তীতে অবশ্য আরো বেশি জোরদারের সাথে বিশ্বাসীও হয়েছিলাম। তার কারণ হলো, প্লাস্টিকের তৈরি ছোট্ট একটি খেলনা তলোয়ার ছিলো আমার। যেই তলোয়ারটির চমৎকার একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো এরকম যে, অল্পক্ষণের জন্য তলোয়ারটা রৌদ্রের আলোতে রাখার পর অন্ধকারে নিয়ে গেলে কিছু সময়ের জন্য সেটা আপনা-আপনিই জ্বলতে থাকতো। অর্থাৎ, সূর্যের আলোর মাধ্যমে একপ্রকার চার্জ হয়ে থাকতো এবং ব্যাটারি ছাড়াই অন্ধকারে আলোকিত হতো। এরকম আকর্ষণীয় জিনিস বর্তমানেও অনেক পাওয়া যায়। যেমন, গ্লো-স্টোন নামক একপ্রকার জ্বলজ্বলে পাথর রয়েছে, যেগুলো বাসাবাড়ি ও বাগানের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এছাড়া এরকম এক ধরণের তসবিহও রয়েছে, যার পুতি বা দানাগুলো সম্ভবত থোরিয়াম নামক রাসায়নিক পদার্থের সাথে জিংক অক্সাইড মিশ্রণ করার মাধ্যমে তৈরি করা হয়ে থাকে। কেননা, এই দুইটা পদার্থকে যদি একসাথে মেশানোর পর তাতে আলো ফেলা হয়, তাহলে সেই মিশ্রিত পদার্থটি আলোকে শোষণ করে নিজের মধ্যে জমা রাখে এবং অন্ধকারে তা বিকিরণ করে, ঠিক যেরকমটা হয় আমার খেলনা তলোয়ারে। এমন বস্তু আমি আরো অনেক দেখেছিলাম, এসব দেখার ফলেই আমি একসময় ধারণা করতাম যে, হ্যা! স্যার যে ব্যাখ্যাটি দিয়েছিলেন সেটাই ঠিক। অর্থাৎ, চাঁদের উপর যখন সূর্যের আলো পতিত হয়, তখন এই আলো চাঁদের মধ্যে জমা থাকে এবং রাতে যখন সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়, তখন সেই আলো দ্বারা চাঁদকে আমরা আলোকিত হতে দেখতে পাই। এই ধারণার উপরই আমি একসময় দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বাসী ছিলাম, যা ছিলো সম্পূর্ণই আমার ভূল ধারণা। কারণ, বিজ্ঞান এই ব্যাপারে অন্য কথা বলে।
বিজ্ঞানের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে জানা যায় যে, রাতের অন্ধকারে চকচকে যে চাঁদ আমাদেরকে মুগ্ধ করে, এই চাঁদ দেখতে অনেকটা সুন্দর মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে চাঁদ এতোটা সুন্দর নয়। হ্যা! আপনি ঠিকই পড়েছেন, চাঁদ আসলেই এতো সুন্দর নয়, যতটা সুন্দর আমরা দেখি বা চাঁদকে নিয়ে ভাবি। চাঁদ নিয়ে আমাদের মনের ভিতর রয়েছে নানারকম কল্পনা, কত শত স্বপ্ন। এর রুপ-বৈচিত্র্য নিয়ে লেখা হলো কত কবিতা, সাহিত্য, গল্প আর রচনা এবং গাওয়া হলো কত গান। চাঁদের সাথে আমরা উপমা টানি প্রিয় মানুষের সৌন্দর্য, প্রিয় মানুষের হাসি, আর চাঁদের মাঝেই আমরা খুঁজে পাই সুন্দরতার শিরোমণি। অথচ এই চাঁদই নাকি বাস্তবে আমাদের মনে আঁকা সেই নিখুঁত রূপের চেয়ে ভিন্ন, এই সত্যটা যেন আমাদের মনের গভীরে জায়গা না নিতে চাওয়া একটি বিষয়।
চাঁদকে আমরা বরাবরই মুগ্ধতার প্রতীক হিসেবে দেখেছি। রাতের আধারে নীরবতায় চাঁদের মায়াবী আলো যেন পৃথিবীকে এক অন্য জগতে নিয়ে যায়। সেই আলোয় বসে চাঁদের এই ঝকঝকে সাদা বর্ণে তাকিয়ে জীবনের সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে মুছে স্বপ্নে আঁকা স্বপ্নাদেশে পাড়ি জমানো মানুষের হয়তো অভাব হবে না। অথচ তাদের অনেকেই হয়তো জানে না যে, সাদা বর্ণ ধারণ করা এই চাঁদ তার প্রকৃতগতভাবে বেশ খানিকটা কালো বর্ণ ধারণ করে আছে। হ্যা! আপনি ঠিকই পড়েছেন, চাঁদের মাটি হলো অনেকটা কালচে বর্ণের, যাকে বলা হয় গাঢ় ধূসর। এই ধূসর বর্ণের মাটি গুণগত মানের দিক দিয়ে পৃথিবীর মাটির তুলনায় বেশ খানিকটা আলাদা হলেও এটি পৃথিবীর মাটির মতো এক-ই খনিজ দিয়ে গঠিত। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক তো চাঁদ থেকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা মাটিতে সরিষা গাছের ন্যায় ‘থ্যাল ক্রেস’ বা ‘আরাবিডোপসিস থালিয়ানা’ নামক এক প্রজাতির গাছের বীজ রোপণ করে চারাগাছ জন্মিয়েও দেখিয়েছেন। এর অর্থ, পৃথিবীর মাটি যেমন সাধারণ, চাঁদের মাটিও সাধারণ। অর্থাৎ, এই মাটির মধ্যে এমন কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য নেই, যার ফলে সেই মাটি সূর্যের আলোকে নিজের মধ্যে জমিয়ে রাখতে পারে। এর মানে হলো, রাতের আকাশে যেই চাঁদকে আমরা আলোকিত অবস্থায় দেখে থাকি, যদিও এই আলো সূর্য হতে প্রাপ্ত, তবে এই আলোটা মূলত চাঁদের মধ্যে জমিয়ে রাখা কোনো আলো নয়। এখন অনেকের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে যে, যেহেতু সূর্যের আলোকে চাঁদ নিজের মধ্যে জমিয়েও রাখে না, আবার তার নিজস্ব কোনো আলোও নেই, তাহলে রাত্রিবেলা চাঁদ আমাদেরকে আলো কিভাবে প্রদান করে? সেটাও আবার সূর্য হতে প্রাপ্ত আলো। এর সঠিক উত্তর হলো, চাঁদ মূলত কোনো আলোই প্রদান করে না, বরং সে নিজেই সূর্যের আলো দ্বারা আলোকিত হয়, আর সেই আলোকেই আমরা পৃথিবীতে বসে দেখে থাকি। অর্থাৎ, চাঁদের মধ্য হতে যে আলোটা রাত্রিবেলা পৃথিবীতে পৌছে, এটা হচ্ছে চাঁদের মাধ্যমে সূর্যের প্রতিফলিত আলো। চাঁদ কেবল এখানে মাধ্যম মাত্র। বিষয়টি সহজভাবে বুঝার জন্য চলুন এটির বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রতি অগ্রসর হয়ে সূর্য হতে চাঁদের আলো গ্রহণের প্রক্রিয়াটি এবার তাহলে বৈজ্ঞানিকভাবে জেনে আসি—
বিজ্ঞান আমাদেরকে বলে যে, রাত্রিবেলায় যদিও আকাশে সূর্য দেখা যায় না তবে সূর্য ঠিকই তার নিজ অবস্থানেই বিদ্যমান থাকে। এমনকি এই সূর্য দিনের বেলা যেমন আলোকোজ্জ্বল থাকে, রাত্রিবেলাও ঠিক একইভাবে আলোকোজ্জ্বল থাকে। ফলে সবসময়-ই আমাদের গোলাকার পৃথিবীর অর্ধেকাংশ থাকে রাত এবং বাকি অর্ধেকাংশ থাকে দিন। এজন্যই বিভিন্ন দেশে রাত-দিনের তফাৎটা হয় ভিন্ন ভিন্ন। আমাদের ঘূর্ণায়মান গোলাকার পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে তার যেই পার্শ্বটা সূর্যের বিপরীত দিকে চলে যায়, তখন সেই বিপরীত পার্শ্বে সূর্যের আলো পৌছতে পারেনা বিধায় পৃথিবীর সেই পার্শ্বটা থাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত। অথছ, তখন তার অপর পার্শ্বে ঠিকই থাকে আলোকিত দিন। অর্থাৎ, বর্তমানে আমি বা আপনি পৃথিবীর যেই অংশে বাস করছি, সেই অংশে দিন থাকুক বা রাত থাকুক, সূর্যের আলোকে আমরা দেখতে পাই বা না পাই, সূর্য সর্বদা তার নিজ তেজদীপ্ততায় প্রজ্বলিত অবস্থায় ঠিকই আলোকোজ্জ্বল রয়েছে। আর এই আলো রাতের বেলা আমরা সরাসরি দেখতে না পাওয়ার কারণ হচ্ছে আমরা তখন থাকি সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবীর বিপরীত পার্শ্বে। এখন কথা হচ্ছে, যদিও আমরা আড়ালে থাকার কারণে রাতের আকাশে সূর্যকে আমরা দেখতে পাই না, তবে সূর্য তো ঠিকই সেই সময়ও তার সকল দিকেই আলো ছড়াচ্ছে। আর এই আলোটাই রাতে যখন চাঁদের উপর পতিত হয়, তখন সেই চাঁদকে আমরা আলোকিত অবস্থায় দেখে থাকি পৃথিবীতে বসে। এই রকম দৃশ্য শুধু চাঁদে নয়, চাঁদ ছাড়া আরো অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমরা অবলোকন করি। উদাহরণস্বরূপ ধরে নিন যে, মহারাণীতুল্য পরীর মত সুন্দরী টুকটুকে একটা আদুরে বউ আছে আপনার। আর এই মহারাণীতুল্য টুকটুকে বউটা কোনো একদিন অন্ধকার রাতে আলোকিত রুমে খাটের উপর শুয়ে শুয়ে ফোন ব্যবহারে মগ্ন রয়েছে এবং এটাও ধরে নিন সে, তখন আপনি একই রুমে কম্পিউটার টেবিলে বসে অফিশিয়াল কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। এমতাবস্থায় হঠাৎ করে কারেন্ট চলে গেলো, ফলে পুরো রুম অন্ধকার হয়ে গেলো। এখন আপনার বউয়ের দিকে তাকিয়ে আপনি লক্ষ্য করলেন যে, আপনার টুকটুকে বউয়ের ফুটফুটে চেহারাটা অন্ধকারেও যেন আলোকিত অবস্থায় ঝলঝল করছে। এবার আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, কী কারণে আপনার বউয়ের চেহারাটা এভাবে ঝলঝল করছে? নিশ্চয় আপনি উত্তর দিবেন, মোবাইলের স্কিনের আলো যেহেতু আপনার বউয়ের চেহারার উপর গিয়ে পড়ছে, একারণেই মনে হচ্ছে তার চেহারাটা বুঝি অন্ধকারে জ্বলে উঠছে। চাঁদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা ঠিক এমনই হয়। অন্ধকার রাতে চতুর্দিকে ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় সূর্যের আলো যখন চাঁদের উপর পতিত হয় তখন চাঁদকে আমরা ঝলঝল করতে দেখতে পাই। একারণেই বলা হয়, চাঁদের কোনো নিজস্ব আলো নেই, চাঁদ সূর্যের কাছ থেকে আলো পায়। এটাই হল তার আসল রহস্য।
চাঁদের আলোর এই রহস্যের সাথে চাঁদের আকার কমে যাওয়া ও বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও সম্পৃক্ত। কেননা, পৃথিবীতে সূর্যের আলো পড়ার ফলে যেমন পৃথিবীর অর্ধেক অংশ আলোকিত হয় এবং বাকি অর্ধেক অংশ অন্ধকার থাকে, ঠিক তেমনই চাঁদের উপরেও সূর্যের আলো পড়ার ফলে চাঁদের অর্ধেক অংশ আলোকিত হয় এবং বাকি অর্ধেক অংশ অন্ধকার থাকে। আর পৃথিবী ও চাঁদ যেহেতু সর্বদা তাদের কক্ষপথে গতিশীল থাকার কারণে একেক সময় এরা একেক অবস্থানে থাকে, তাই চাঁদকে আমরা একেক সময় একেক আকৃতিতে দেখি। চাঁদের আলোকিত অংশটা যখন পৃথিবীর দিকে সোজাসুজি মুখ করে থাকে, তখন আমরা চাঁদকে পরিপূর্ণরূপে দেখি, যাকে বলা হয় পূর্ণিমা। আর যখন চাঁদের আলোকিত অংশটা পৃথিবীর দিকে সোজাসুজি না হয়ে কিছুটা আড় হয়ে অন্য দিকে মুখ করে থাকে, তখন চাঁদের আলোকিত অংশটিকে সম্পূর্ণভাবে আমরা দেখতে পারি না বিধায় চাঁদের আকার কিছুটা কমে গেছে বলে মনে হয়, অথচ তখনও পরিপূর্ণ চাঁদটি আমাদের চোখের সামনেই থাকে, কিন্তু এ সময় যেহেতু চাঁদের বাকি অংশে সূর্যের আলো নেই, সেজন্য তা আমাদের নজরে আসে না। এভাবে চাঁদের আলোকিত অংশটা পৃথিবী থেকে যত বেশি অন্য দিকে ঘুরে যায়, চাঁদের আকার ঠিক ততোটাই কমে যেতে দেখা যায়। এমনকি এক পর্যায়ে যখন চাঁদের আলোকিত অংশ পুরোপুরি পৃথিবীর বিপরীত দিকে ঘুরে যায়, তখন আমরা চাঁদকে আর দেখতেই পারি না। এ সময় চাঁদের আলোকিত অংশটা থাকে পৃথিবীর বিপরীত দিকে এবং অন্ধকার অংশটা থাকে পৃথিবীর দিকে মুখ করে। ফলে এই চাঁদ তখন আমাদের চোখের সামনে থাকা সত্বেও আমরা তাকে দেখতে পাই না। চাঁদের এই অবস্থাকে বলা হয় অমাবস্যা। এরপর আবার চাঁদ ও পৃথিবীর গতিশীলতার কারণে যেহেতু তাদের অবস্থানে পরিবর্তন ঘটে, ফলে অমাবস্যার পর সাধারণত ১ থেকে ২ দিনের মধ্যে চাঁদের সামান্য আলোকিত অংশ আবারও আমাদের নজরে পড়ে এবং দিন দিন এই আলোকিত অংশ বৃদ্ধি পেতে পেতে পুনরায় আমাদের মাঝে পূর্ণিমা চলে আসে। এভাবেই প্রতিনিয়ত চাঁদের পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে।
এখন কথা হলো, এই যে এই চাঁদ কখনো কমে যাচ্ছে, কখনো বেড়ে যাচ্ছে, কখনো পূর্ণিমা হচ্ছে, আবার কখনো অমাবস্যা হচ্ছে, এর কারণটা মূলত কী? অনেকেই হয়তো বলবে, চাঁদের দিক পরিবর্তনের কারণে এমনটা হয়। কিন্তু আমি বলবো যে না; এর মূল কারণটা হলো চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো না থাকাটা। চাঁদের যদি কোনো নিজস্ব আলো থাকতো, তাহলে সূর্যের মত চাঁদও তার সব দিকেই আলোকোজ্জ্বল থাকতো এবং সবসময় আমরা চাঁদকে পরিপূর্ণরূপেই দেখতে পেতাম, ফলে অমাবস্যা ও পূর্ণিমা বলতে কোনো শব্দই হয়তো বাকি থাকতো না এই পৃথিবীর বুকে, ঠিক যেরকম অন্ধকার না থাকলে আলোর কোনো সংজ্ঞা থাকতো না এবং অসুন্দর না থাকলে সুন্দরের কোনো পরিচয় থাকতো না।
উপরোক্ত আলোচনার মূল কথা হলো, এই সুন্দরতম চাঁদের সৌন্দর্যের পেছনে মূল অবদান হিসেবে রয়েছে সূর্যের আলো। সূর্য থেকেই চাঁদ আলো পায়, চাঁদের কোনো নিজস্ব আলো নেই। এই তথ্য আমরা জানতে পারলাম বিজ্ঞানের অবদানে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে তথ্যটি আমাদেরকে আধুনিক বিজ্ঞান জানাচ্ছে, কুরআন সেটা চৌদ্দ’শ বছর আগে থেকেই জানিয়ে আসছে, যা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো নিম্নোক্ত আলোচনায়—
এতক্ষণে এটুকু তো আশাকরি আপনারা সবাই বুঝতে পেরেছেন যে, চন্দ্র-সূর্যের ক্ষেত্রে ‘আলো’ শব্দটা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে চাইলে চাঁদ ও সূর্যের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ করাটা হবে একপ্রকার ভুল। আমার এ কথার উদ্দেশ্য হলো- “সূর্যের আলো” এই বাক্যটা আপনি যেকোনো জায়গায় ব্যবহার করতে পারবেন কোনো ভুল হবে না, কিন্তু “চাঁদের আলো” এই বাক্যটা আপনি চাইলেই যেকোনো জায়গায় ব্যবহার করতে পারবেন না। কিছু কিছু সূক্ষ্ম ক্ষেত্রে এভাবে ব্যবহার করাটা হবে নিতান্তই একটি ভুল। কারণ, চাঁদের তো নিজস্ব কোনো আলোই নেই। তাই “চাঁদের আলো” এই বাক্যটার উপর প্রশ্ন উত্তাপিত হতে পারে ক্ষেত্রবিশেষ। যেমন ধরুন, আপনি একটি বই লিখার পর সারাবিশ্বে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন এই বলে যে, এই বইতে বিন্দু পরিমাণ কোনো ভুল নেই। এরপর যদি আপনার সেই বইতে “চাঁদের আলো” এই বাক্যটার সন্ধান কেউ পেয়ে যায়, তাহলে কিন্তু নির্দ্বিধায় আপনার সেই বইকে ভুল প্রমাণ করে দেয়া সম্ভব। এজন্য আপনার অবশ্যই উচিৎ হবে আপনার উক্ত বইটাকে সম্পূর্ণরূপে নির্ভুলভাবে মানুষের নিকট তুলে ধরার জন্য সূর্যের আলো ও চাঁদের আলোকে এক না করা। আর মজার ব্যাপার হলো, আল্লাহ তা‘আলা তার পবিত্র কিতাব আল-কুরআনে ঠিক এমনটাই করেছেন। তিনি কুরআনকে বিশ্ববাসীর নিকট চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থাপন করে এতে এমন কিছু সুক্ষ্ম বিষয় সুক্ষ্মতার সহিত তুলে ধরেছেন, যা আপনাকে অবাক করে দিবে, তার মধ্যে চন্দ্র ও সূর্যের আলোর বিষয়টিও একটি।
কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় চন্দ্র-সূর্য নিয়ে অনেক আলোচনা এসেছে, তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো সেগুলোর প্রত্যেকটা জায়গাতেই চাঁদের আলো বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে একধরণের শব্দ এবং সূর্যের আলো বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে আরেক ধরণের শব্দ। পুরো কুরআনে কোনো একটা জায়গাও এমন নেই যেখানে কিনা চাঁদের আলো ও সূর্যের আলোর ক্ষেত্রে এক-ই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, অথচ চাঁদ ও সূর্য শব্দ দুইটা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে বহুবার। বিষয়টা কিন্তু খুবই ইন্টারেস্টিং। চলুন এবার তাহলে আমরা দেখে আসি আল-কুরআনে শব্দচয়নের ক্ষেত্রে চন্দ্র ও সূর্যের আলোকে কিভাবে পার্থক্য করা হয়েছে?
পবিত্র কুরআনে সূরা ইউনুস-এর ৫ নম্বর আয়াতের একদম শুরুতে বলা হয়েছে “আল্লাহ এমন, যিনি সূর্যকে করেছেন দীপ্তিময় ও চাঁদকে করেছেন আলোকময়”। লক্ষ্য করুন এই আয়াতে চাঁদের আলোকেও উল্লেখ করা হয়েছে, সূর্যের আলোকেও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু উভয়ের জন্য শব্দচয়ন কি একইরকম হয়েছে? মোটেই না। এখানে সূর্যের আলোর ক্ষেত্রে আরবি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে “ضياء” আর চাঁদের আলোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে “نور”। আর এই “نور” (নূর) শব্দটি হলো একটি ব্যাপক শব্দ, এই শব্দটি সাধারণভাবে যেমন সকল আলোর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, ঠিক তেমনই কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো উজ্জ্বল বস্তু হতে অন্য আরেকটি বস্তুর উপর প্রতিফলিত আলোর ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। পক্ষান্তরে এই আয়াতে সূর্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত “ضياء” শব্দটি এরূপ অর্থ বহন করে না, বরং এটি এমন অর্থ বহন করে যেন তা নিজেই প্রদীপ্ত আলো। একটু ভাবুন তো, একই আয়াত এবং একই বিষয়, অথচ শব্দচয়নে এতো ভিন্নতা কেন? এর উত্তরটা নিশ্চয় আপনার কাছে অস্পষ্ট নয়। তবুও বিষয়টি আরো দৃঢ়তার সাথে সুস্পষ্ট করার জন্য চলুন এবার আরেকটি আয়াতে যাওয়া যাক।
কুরআনের ২৫ নম্বর সূরা আল-ফুরকানের ৬১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে “কতই না মহান সেই সত্তা, যিনি আকাশে সৃষ্টি করেছেন তারকারাজি এবং তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ (সূর্য) ও জ্যোতির্ময় চন্দ্র।” লক্ষ্য করুন সূর্যকে এখানে সরাসরি প্রদীপ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যার আরবি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এখানে ‘সিরাজ’। আর এই ‘সিরাজ’ শব্দের অর্থ হলো এমন প্রদীপ, যাতে রয়েছে নিজস্ব আলো। অর্থাৎ, সূর্যের আলো যে নিজস্ব, এটা পূর্বে বলা আয়াতের মত এই আয়াতেও স্পষ্টভাবে উল্লিখিত। এবার তাহলে দেখে নিই চাঁদের আলো বুঝাতে এই আয়াতে ব্যবহার করা হয়েছে কেমন অর্থ বহনকারী শব্দ? এখানে চাঁদের আলোর জন্য আরবি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ‘মুনীর’ যা মূলধাতু ‘নূর’ হতে নির্গত, অর্থাৎ সেই নূর, যা কখনো কখনো অন্যের কাছ থেকে গৃহীত প্রতিফলিত আলোকে বুঝানো হয়। এতে অনেকের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে যে, ‘নূর’ শব্দটা তো অন্যের কাছ থেকে গৃহীত আলোকেও বুঝায়, আবার সাধারণভাবে অন্যসব আলোকেও বুঝায়, তাহলে চাঁদের ক্ষেত্রে যে এই ‘নূর’ শব্দটি অন্যের কাছ থেকে গৃহীত আলোকেই বুঝানো হয়েছে সেটা কিভাবে মেনে নিবো? আর মেনে নিলেও এই আলো যে সূর্য হতেই প্রাপ্ত এটার-ই বা কী প্রমাণ রয়েছে? চলুন তাহলে এই বিষয়টিকে স্পষ্ট করার জন্য আমরা এবার অন্য আরেকটি আয়াতে চলে যাই।
সূরা নূহ-এর ১৬ নম্বর আয়াতে একইভাবে চাঁদের জন্য ‘নূর’ ও সূর্যের জন্য ‘সিরাজ’ শব্দ ব্যবহার করে বলা হয়েছে “আর সেখানে চাঁদকে স্থাপন করেছেন আলোকরূপে ও সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপরূপে”। ভালোভাবে খেয়াল করুন এখানে সূর্যকে উপমা দেয়া হয়েছে প্রদীপের সাথে, আর চন্দ্রকে উপমা দেয়া হয়েছে আলোর সাথে। অর্থাৎ, সূর্য হল প্রদীপস্বরুপ এবং চন্দ্র হল আলোস্বরুপ। আর এটা তো কারো অজানা নয় যে, আলো সর্বদা প্রদীপ বা প্রদীপ জাতীয় বস্তু হতেই নির্গত হয়। অতএব, উল্লিখিত এই আয়াত দ্বারা এবং উপরে বলা আয়াতগুলো দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সূর্যের রয়েছে নিজস্ব আলো, কিন্তু চাঁদের কোনো নিজস্ব আলো নেই, বরং সূর্য হতে চাঁদ আলোপ্রাপ্ত হয়। যদিও এই বিষয়টি কুরআন থেকে আমাদের বোধগম্য হওয়ার জন্য হয়তো একটি আয়াতই যথেষ্ট ছিলো, তবুও আমি অতিরিক্ত দুটি আয়াত উল্লেখ করেছি যেন বিষয়টি আরো দৃঢ়তার সাথে সুদৃঢ় হয়।
সবশেষে এখানে ভাববার বিষয়টা হলো, এতো সুন্দরভাবে চাঁদের আলোর এই রহস্যটা পবিত্র কুরআনে কিভাবে এলো? মুহাম্মদ (সা.) কি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন? নাকি তিনি মহাকাশ বিষয়ক কোনো বিজ্ঞানী ছিলেন? ইসলাম এবং ইতিহাস তো বলে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো শিক্ষাই অর্জন করেননি। তিনি ছিলেন উম্মি। কোনো বিষয়ের জ্ঞান তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত জানতেন না, যতক্ষণ না তাকে আল্লাহ তা‘আলা জানাতেন। তাছাড়া, চাঁদের আলো সূর্য হতে প্রাপ্ত এই বিষয়ের জ্ঞান তৎকালীন সময়ের আরববাসীদের মধ্যে কেউই তা জানতো না। এমন কোনো সম্ভাবনাও ছিলো না যে, চাঁদের এই রহস্যময় তথ্যটি মুহাম্মাদ (সা.)-কে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক জানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তিনি তা কুরআনে যুক্ত করে দিয়েছেন। অতএব, এই কুরআন যদি কোনো ঐশী গ্রন্থ না হয়ে থাকে, এই কুরআন যদি আসমান হতে প্রেরিত না হয়ে থাকে, এই কুরআন যদি আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত না হয়ে থাকে, তবে মনগড়া বাণী বানিয়ে ইচ্ছামত তথ্য দিয়ে বিজ্ঞানপূর্ণ এই নির্ভুল কুরআনকে নিজের পক্ষ থেকেই রচনা করে ফেলা কোনো মানুষের পক্ষে কিভাবে সম্ভব হতে পারে? আছে কি কোনো উত্তর? উত্তর তো একটাই, তা হলো– পবিত্র এই কুরআন যে একমাত্র চন্দ্র-সূর্যের সৃষ্টিকর্তা মহাবিশ্বের পালনকর্তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকেই প্রেরিত হয়েছে, এতে না আছে কোনো সন্দেহ এবং না আছে তার অবকাশ।
এমন পুষ্ট আরও চাই ভাই
পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত অনুকল্প বা hypothesis কে থিওরি বলে।