২০২৪ জুলাই মাস। চারদিকে সবুজ, লাল আর হলুদ। গ্রীষ্মে লন্ডনের সকাল হয় পাঁচটায়। হাসপাতালের ছোট্ট ঘর। জানালা খোলা। কোকিল ডাকছে জোরে মন খুলে। জানালার বাইরে দারুন বাগান। পাশে লেক। অনেকটা ধানমন্ডি লেকের মতো। আলো আর রং। সে রং মিশে আছে একে অপরের সঙ্গে। মনে হয় কেউ যেন ছবি এঁকে দিয়ে গেছে। সন্ধ্যার পর ফুলের গন্ধ আসে। লন্ডনের এই বিশেষায়িত হাসপাতালে প্রিয়ার আসার কথা ছিল না। প্রথম সন্তান সিজারিয়ান সেকশন করে পূর্বনির্ধারিত। ইংল্যান্ডে প্রতি চারটি জন্মের একটি হয় সিজার করে। খুব সহজ অস্ত্রোপচার। সারা বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এ ধরনের অস্ত্রোপচার হয়। প্রিয়া অস্ত্রোপচারের পর আক্রান্ত হয়েছেন সুপার বাগে।

ব্যাকটেরিয়ার সাধারণ আক্রমণ। কিন্তু এই ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। সাধারণ এন্টিবায়োটিক এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধ করতে পারে না। তার প্রত্যঙ্গ গুলো আর কাজ করছে না। কৃত্রিমভাবে তাকে শ্বাস দেওয়া হচ্ছে। প্রিয়ার চিকিৎসক ডক্টর জনসন বলছেন প্রিয়ার বাঁচার আশা ক্ষীণ। ভবিষ্যতে প্রিয়ার মতোই অসংখ্য মা মারা যেতে পারেন সুপার বাগ বা এ ধরনের ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত হয়ে।

শুধু ইংল্যান্ডে প্রতিবছর চার লাখ অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর সংক্রমণ ঠেকাতে দেওয়া হয় অ্যান্টিবায়োটিক। এই অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করলে সাধারণত অস্ত্রোপচারে্ই মারা যেতে পারে অসংখ্য মানুষ। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে ৩ কোটি ৪০ লাখ নারী। প্রতি বছর অন্তত ১ কোটি ৭০ লাখ নারী জীবনের যেকোনো একটা সময় মূত্রনালীর সংক্রমণে ভোগেন । প্রতি বছর বিশ্বে এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হন। ক্যানসারের অধিকাংশ প্রচলিত ওষুধ রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাদের নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিফাঙ্গাল আর অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দিতে হয়।

এর বাইরে অনেক রোগী আছেন, যাঁরা অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর নির্ভর করেন। অঙ্গ প্রতিস্থাপনকারী ব্যক্তি বা দাঁতের সাধারণ চিকিৎসাতেও বন্ধু সেই অ্যান্টিবায়োটিক। অ্যান্টিবায়োটিক আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম আবিষ্কার। গবেষকরা বলছেন, আমাদের প্রত্যেকের গড় আয়ু ২০ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে এই অ্যান্টিবায়োটিক। এটি ছাড়া অনেক ছোট ছোট কাটাছেঁড়া, সহজ অস্ত্রোপচারও জীবন বিধ্বংসী হয়ে উঠবে। শুরুতে যে প্রিয়ার কথা বলছিলাম, তার মতো কোটি কোটি প্রিয়ারা মারা যাবেন কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া।

কিন্তু এখন প্রাণী ও মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ হচ্ছে না—এমন ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতিবছর ১০ মিলিয়ন মানুষ মারা যাবে অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ করে না—এমন ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের মাধ্যমে। স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বে প্রতিবছর সাত লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে এমন ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হয়ে, যেগুলোর কোনো অ্যান্টিবায়োটিক নেই ।

মানুষ ও পশুর মারাত্মক সংক্রমণ রোধে অ্যান্টিবায়োটিক অত্যন্ত জরুরি। সমস্যাটা হচ্ছে যথেচ্ছ ব্যবহারে। গবেষণা বলছে, গবাদিপশুকে শুধু ভবিষ্যত সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর মানুষের জন্য অনুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিকসের ৭০ শতাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে পশুর জন্য।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ হলো আমাদের অতি প্রয়োজনীয় এক বন্ধু। সভ্যতা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরি। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এক কার্যকর পদ্ধতি। সমস্যা হলো, অত্যন্ত ছোট ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাস ধীরে ধীরে কার্যকারিতা প্রতিরোধ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজেকে প্রস্তুত করে। একপর্যায়ে আন্টিঅ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টি ভাইরাল হয়ে যায়। এই প্রতিরোধী ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া অন্য কোনো ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস থেকে শক্তিশালী ও দ্রুত বাড়তে থাকে। এটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে অনেক বেশি।

করোনা–সংক্রমণ প্রতিরোধে আমাদের করণীয় খুবই কম।কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে আমরা প্রত্যেকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারি। কীভাবে?

অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার কমাতে আমরা কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারি। সাধারণ সর্দি বা কাশি হলে ডাক্তারদের অ্যান্টিবায়োটিক দিতে অনুরোধ করা পরিহার করতে পারি। ভাইরাল ইনফেকশনে সর্দি বা কাশি হয়। অ্যান্টিবায়োটিক দরকার হয় না । করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আমরা যেমন নিয়মিত হাত ধুই, হাঁচি-কাশি নিয়ন্ত্রণে যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, এগুলো সুপারবাগের বিস্তার রোধ করতে সমানভাবে কার্যকর হবে।

সারা বিশ্বে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। আমাদের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলে চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে সম্পূর্ণ ডোজ শেষ করতে হবে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার শুরু করলে অনেক সময় মাঝপথে রোগের উপসর্গ কমে যায়। এরপরও অ্যান্টিবায়োটিক চালিয়ে যেতে হবে।

আমাদের দরকার নতুন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি ষাট, সত্তর, আশির দশকে যেভাবে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়েছে, সেভাবে এখন আর হচ্ছে না। যেসব অ্যান্টিবায়োটিক বাজারে আছে, সেগুলো প্রায় ৩০ বছর আগে এসেছে। গলাব্যথা হলে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় অনেক দেশে। কিন্তু মাত্র ১০ শতাংশ গলাব্যথা অ্যান্টিবায়োটিক সেরে ওঠে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ৪৭ মিলিয়ন ডোজ দেয়া হয় এ কারণে। একই কারণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের হার অন্যান্য দেশে আরও বেশি। এই হার কমানো খুবই জরুরি। একই সঙ্গে অন্য প্রাণীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের উৎপাদন উৎসাহিত করতে হবে। এর সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়মিত হাত ধুয়ে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঠেকাতে হবে। তা না হলে শেভ করার বা কেটে গেলে আর সেই কাটা জায়গায় সংক্রমণ হলে অ্যান্টিবায়োটিক ভবিষ্যতে কাজ নাও করতে পারে।

আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। বন্ধ করতে হবে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার। তাহলে আমরা ঠেকাতে পারবো অ্যান্টিবায়োটিকরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার। তা না হলে ভবিষ্যতে আমাদের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে মারা যাবে কোনরকম চিকিৎসা ছাড়া। নিরাময় আমাদের হাতে। এখনই সময় সচেতন হবার।

7 thoughts on "আরেক মহামারি ঘটাতে পারে ‘ব্যাকটেরিয়া’"

  1. Vodrosoytan Contributor says:
    যথেচ্ছ ki??
  2. Masum Khan Author says:
    প্রথম আলো ফুল কপি

Leave a Reply