আমাদের সমাজে অনেক নারী আছেন, যারা প্রায় প্রতিদিনই নানাভাবে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বেশিরভাগই মুখ বুঝে সহ্য করে যান আর ভাবেন ঘরের কথা পরে জানলে লোকে খারাপ বলবে। আবার অনেকে জানেন না রাষ্ট্রের কাছে এর কোন প্রতিকার তিনি পেতে পারেন। বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় অন্যান্য অপরাধের সাথে পারিবারিক নানারকম নির্যাতনের ঘটনা যখন বেড়ে গেলো, তখন সরকার ২০১০ সালে ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিকার ও সুরক্ষা) আইন নামে একটি আইন তৈরি করেন। এই আইনে পারিবারিক সহিংসতার সংজ্ঞা এভাবে বুঝিয়েছেন-পারিবারিক সম্পর্ক আছে এমন কোনো ব্যক্তি দ্বারা পরিবারের অপর কোনো নারী বা শিশুর উপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতি বোঝায়। আইনে একই ধারায় নির্যাতনগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এভাবে-(ক) শারীরিক নির্যাতন বলতে এমন কোনো কাজ বা আচরণ করা, যা দ্বারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির জীবন, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা শরীরের কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকে এবং সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে অপরাধমূলক কাজ করতে বাধ্য করা বা প্ররোচনা করা বা বলপ্রয়োগও এর অন্তর্ভুক্ত; (খ) মানসিক নির্যাতন হচ্ছে মৌখিক নির্যাতন, অপমান, অবজ্ঞা, ভীতি প্রদর্শন বা এমন কোনো উক্তি করা, যা দ্বারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা হয়রানি হয় অথবা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হয় অর্থাৎ স্বাভাবিক চলাচল, যোগাযোগ বা ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশের উপর হস্তক্ষেপ; (গ) যৌন নির্যাতন বলতে যৌন প্রকৃতির এমন আচরণও অন্তর্ভুক্ত হবে, যা দ্বারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির সম্ভ্রম, সম্মান বা সুনামের ক্ষতি হয়; (ঘ) আর্থিক ক্ষতি অর্থে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যে সকল আর্থিক সুযোগ-সুবিধা, সম্পদ বা সম্পত্তি লাভের অধিকারী তা হতে বঞ্চিত করা অথবা বৈধ অধিকার প্রয়োগে বাধা দেওয়া; সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র প্রদান না করা; বিয়ের সময় প্রাপ্ত উপহার বা স্ত্রীধন বা অন্য কোনো দান বা উপহার হিসেবে প্রাপ্ত কোনো সম্পদ হতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা বা বৈধ অধিকার প্রয়োগে বাধা দেয়া; সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির মালিকানাধীন যেকোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি তার অনুমতি ছাড়া হস্তান্তর করা বা বৈধ অধিকার প্রয়োগে বাধা দেওয়া; অথবা পারিবারিক সম্পর্কের কারণে যে সকল সম্পদ বা সুযোগ-সুবিধাদিতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির ব্যবহার বা ভোগদখলের অধিকার রয়েছে তা হতে বঞ্চিত করা বা বৈধ অধিকার প্রয়োগে বাধা দেওয়া। এই আইনে বলা আছে, যদি কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা পারিবারিক সহিংসতার সংবাদ পান, তাহলে তিনি নির্যাতিত ব্যক্তিকে আইন অনুসারে প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, বিনা খরচে আইনগত সহায়তা প্রাপ্তির সুযোগ, চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির সুযোগ অবহিত করবেন। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা তার পক্ষে কোনো প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, সেবা প্রদানকারী বা অন্য কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন প্রতিকার পাবার জন্য আদালতে আবেদন করতে পারবেন।

ক্ষতিপূরণ আদেশ : সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করতে পারেন এবং আদালত এই আবেদন ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করবেন। আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে উভয়পক্ষকে শুনানির সুযোগ প্রদান করে আদালত যেরূপ উপযুক্ত মনে করবেন, সেরূপ আদেশ দিবেন। তবে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আদালত যে বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দিবেন সেগুলো হলো-
(১) সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আঘাত, ভোগান্তি, শারীরিক-মানসিক ভোগান্তি, ক্ষতির প্রকৃতি ও পরিমাণ; (২) ক্ষতির জন্য চিকিৎসা খরচ; (৩) ক্ষতির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব; (৪) ক্ষতির কারণে বর্তমান ও ভবিষ্যতে উপার্জনের ওপর প্রভাব; (৫) নির্যাতনের ফলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির ধ্বংসকৃত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য; (৬) সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার কারণে ইতোমধ্যে যে অর্থ ব্যয় করেছেন, তার যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ এবং (৭) সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও তার সন্তানের ভরণপোষণের জন্য তিনি যেরূপ জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত, সেরূপ জীবনযাত্রার জন্য পর্যাপ্ত ও যুক্তিসংগত অর্থ প্রদানের জন্য আদালত প্রতিপক্ষকে আদেশ দিতে পারেন। আদালত মনে করলে প্রতিপক্ষকে এককালীন মাসিক পরিশোধযোগ্য ভরণপোষণের আদেশ দিতে পারেন। আদালত ক্ষতিপূরণ আদেশের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ এবং সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট পাঠাবে। যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে ক্ষতিপূরণ আদেশের একটি অনুলিপি পাঠাবে। প্রতিপক্ষ ক্ষতিপূরণ দিতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযুক্ত ব্যক্তির মজুরি অথবা অন্য কোনো আয় থেকে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে সরাসরি অথবা তার ব্যাংক হিসাব নম্বরে জমা প্রদানের জন্যে নির্দেশ দিতে পারবেন।

One thought on "আইন জানুন আইন মানুন পর্ব ২০: পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হলে প্রতিকার"

Leave a Reply