১৯৪৩ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারি মেস্কিকোর এক গ্রামে মাটি খুঁড়ে হঠাৎ বেরিয়ে এল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল ফুটন্ত লাভা। গ্রামের পর গ্রাম হারিয়ে যাচ্ছে লাভার তলে । লক্ষ লক্ষ টন লাভা নির্গত হচ্ছে যা বন্ধ করার উপায় জানা নেই কারাে। প্রকৃতির কাছে মানুষ। দারুণ অসহায় হয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানীরা নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগলেন। ক্ষয়ক্ষতি কমাবার । লাভার স্রোত নিচে নামার সময়ে পুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ফসলের মাঠ, গ্রামীণ লােকজনের ঘরবাড়ি। এক সময়ে অগ্ন্যুৎপাত কমে এল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন বিজ্ঞানীরা নবজাত এই আগ্নেয়গিরির নাম রাখলেন তারা প্যারিকুটিন ।
অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা এই যে প্রথম তা নয় । মনে করা হয়ে থাকে পৃথিবী। সৃষ্টির আদি থেকেই অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটে আসছে। তখন জীবের সৃষ্টি হয়নি। কোটি কোটি বছর ধরে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে। তার নিঃসরিত লাভা ঠান্ডা হয়েছে। অগ্ন্যুৎপাতের যে ঘটনা ইতিহাসে প্রথম লিখিত হয়েছে তা ঘটেছে ৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। ইতালি দেশের ভিসুভিয়াসের মুখ দিয়ে প্রচণ্ড অগ্ন্যুৎপাত ঘটে। এই অগ্ন্যুৎপাত পম্পেই ও হারকিউলেসিয়াস নগরী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই সময়ের বিখ্যাত রােমা বিজ্ঞানী পিনি এই অগ্ন্যুৎপাতের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে যেয়ে বাষ্পর মারা যান। ১৮৮৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার ক্রাকাটাই আগ্নেয়গিরির । অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল তার প্রভাবে বিলীন হয়ে গিয়েছিল অনেক জনপদ।শান্ত নিরীহ পাহাড়ে হঠাৎ করে আগ্নেয়গিরি মাথা তুলে কেন দাঁড়ায়, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা কী ধারণা দিয়েছেন আমাদের।
আমরা জেনেছি, পৃথিবীর সবচেয়ে বাইরের দিকে অর্থাৎ ভূ-ত্বক তৈরি হয়েছে মাটি বা পাললিক শিলা দিয়ে। এই স্তরটার নিচে রয়েছে গ্রানাইট বা ব্যাসাল্ট স্তর। এর পরের স্তরটা হলাে ম্যাগমা স্তর । ম্যাগমা স্তরটা খুবই উত্তপ্ত, টগবগ করে ফুটছে সর্বক্ষণ। এরা সব সময়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। উপরে উঠে আসার জন্য। কিন্তু ব্যাসাল্ট স্তরের জন্য কিছুতেই সুবিধে করতে পারছে না। কিন্তু কখনাে কখনাে ভূমিকম্পের ধাক্কায় পাহাড়ে ফাটল দেখা দিলে বেধে যায় বিপত্তি। ফুটন্ত ম্যাগমা হুড়মুড় করে ঐ ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। তখনই সৃষ্টি হয় আগ্নেয়গিরির। আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি সম্পর্কে প্রাথমিক একটা ধারণা মৌ দিতে চায় ছােট বােনকে ।
আমরা মাঝে মাঝে পত্রিকায় দেখতে পাই সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হতে আবার অগ্ন্যুৎপাত শুরু হওয়ার খবর । অগ্ন্যুৎপাতই যদি হবে তাহলে সুপ্ত বলা হলাে কেন। আর সুপ্তই যাদি হয়ে থাকবে তাহলে অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে কেন।
বিষয়টি নিয়ে তুমি একটু বেশি মাথা ঘামিয়ে ফেলেছ । সুপ্ত বলতে যে। অগ্ন্যুৎপাত সংঘটনা কিছুদিন বা কয়েক বছরের জন্য বন্ধ হয়েছিল। তবে এর । আগে আমরা জেনে নেই, বিজ্ঞানীরা আগ্নেয়গিরিদের তিন ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমভাগে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি, দ্বিতীয় মৃত আগ্নেয়গিরি আর তৃতীয় সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। যেসব আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে প্রায়ই অগ্ন্যুৎপাত ঘটে সেগুলাে। জীবন্ত । যার অগ্ন্যুৎপাত এক সময়ে ঘটেছিল কিন্তু ভবিষ্যতে জীবন্ত হওয়ার। কোনাে সম্ভাবনা নেই সেগুলাে মৃত। আর যে ধরনের আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে এখন অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে না তবে ভবিষ্যতে হবার সম্ভাবনা রয়ে গেছে সেগুলাে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। তুমি এমনই কোনাে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির কথা পড়েছ ।
তিন ধরনের আগ্নেয়গিরির কথা যে বললে সারা পৃথিবী জুড়েই কী। এই তিন ধরনের আগ্নেয়গিরি অবস্থান করতে পারে ।
বিজ্ঞানীরাও এটা নিয়ে বিস্মিত। পৃথিবীর মানচিত্রটা হাতে নিলে। দেখবে আগ্নেয়গিরির অবস্থান বেশ বিস্ময়কর। আগ্নেয়গিরিগুলাে একটা বৃত্তের মতাে প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা কৌতুক করে তাই এর নাম রেখেছেন Ring of fire. যে সব আগ্নেয়গিরি বেচে আছে এদের। প্রায় তিনশাের কাছাকাছি। এরা যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই পৃথিবী জুড়ে এদের অবস্থান নয়। নির্দিষ্ট অঞ্চল বরাবর এরা এগিয়ে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এরও একটা নাম রেখেছেন Volcanic belt. এই বেল্ট বা কোমরবন্ধের কাছাকাছি জায়গায় আবার রয়েছে কমবেশি পাহাড়ের সারি আরও বিস্ময়কর বিষয় হলাে, Volcanic belt এর কাছাকাছি অবস্থান রয়েছে ভূমিকম্পের মূল এলাকা যাকে বলা হয় Earthquake.
আগ্নেয়গিরির আলােচনায় ভূমিকম্পের কথাও এসে গেল । তাহলে। ভূমিকম্পের সাথে আগ্নেয়গিরির একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কি রয়ে গেছে?
বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করছেন এবং বলছেন এই সম্পর্কটা যমজ বােনাের মতাে। এই এলাকার ভূমিস্তরে কম বয়সী পাহাড়ের দুপাশে প্রচণ্ড চাপ পড়ার। জন্য পাহাড়ের কোনাে অংশ ফেটে যেতে পারে। এই চাপে পড়ে পাহাড়ের কোনাে অংশ যদি একটু নিচে নেমে যায় বা স্থানচ্যুত হয় তখনই ঐ ফাটল। দিয়ে ম্যাগমা উপরে উঠে আসার চেষ্টা করে। আবার এমনাে হতে পারে ফুটন্ত ম্যাগমার মধ্যে পাহাড়ের একটা অংশ দেবে যেয়েও সৃষ্টি করতে পারে প্রচণ্ড চাপের । ফলে শুরু হয়ে গেল ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের প্রভাবে প্রচণ্ড বেগে পাহাড়ের মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল ম্যাগমা । শুরু হলাে আগ্নেয়গিরির অগ্নৎপাত।।
এভাবেই আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হচ্ছে বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা ঠান্ডা হবে কী করে ।।
তােমার জানতে ইচ্ছে করছে অগ্ন্যুৎপাত থামবে কী করে। অনেক সময় দেখা যায় অগ্ন্যুৎপাতের পর আগ্নেয়গিরি মুখে কঠিন লাভা জমে তার মুখটা বন্ধ হয়ে যেতে পরে । লাভা ঠান্ডা হয়ে শিলাখণ্ড তৈরি হয়। এই শিলাখণ্ডের উপস্থিতির জন্যও মুখটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে । তখন অগ্নৎপাত নিজে নিজেই থেমে গেল ।
পুরাতন আগ্নেয়গিরি থেকে অর্থাৎ সুপ্ত আগ্নেয়গিরি থেকে আবার। মাঝেমধ্যে অগ্ন্যুৎপাত হয় বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন।
এই আগ্নেয়গিরিগুলােকে বিজ্ঞানীরা বলছেন সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। আগ্নেয়গিরির নিচে বাস্পরাশির ক্রমবর্ধমান চাপ পড়তে খাকলে তখন হঠাৎ ভীষণ। বেগে আগ্নেয়গিরির মুখটা খুলে যায় । বাষ্প ও তরল লাভার অগ্নিস্রোত বের হতে থাকে । এইভাবে লাভা জমে কখনাে আগ্নেয়গিরির মুখ বন্ধ হয়ে যায় আবার প্রচণ্ড চাপ পড়ে মুখ খুলে যায় । সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হতে লাভা বেরিয়ে আসছে বহু বছর অন্তর অন্তর । সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উত্তরে আট হাজার একশাে ফুট উঁচু মাউন্ট সিনাবাং আগ্নেয়গিরিতে অগ্নৎপাত শুরু হয়েছে। সেখানে জারি করা হয়েছে বিপদ সংকেত । চারশাে বছর সুপ্ত থাকার পর আগ্নেয়গিরিটি লাভা ছড়াতে শুরু করেছে। হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অন্যত্র ।
মাউন্ট সিনাবাং তাহলে সুপ্ত অবস্থাতে ছিল । এটা চারশাে বছর ধরে সুপ্ত অবস্থায় ছিল। প্রথমে এখান থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। একদিন পরে জ্বালামুখ দিয়ে লাভ বেরিয়ে আসতে শুরু করে । দেখতে দেখতে লাভা আগুনের বলের মতাে রূপ নেয়। তখন এর পাশের চারটি গ্রাম হতে দশ হাজারের মতাে লােককে সরিয়ে নেওয়া হয় । অবশ্য অনেক আগেই অনেকে সরে যায়। জ্বালামুখ দিয়ে ছােট ছােট উত্তপ্ত পাথর আর সালফার বের হওয়ার সাথে সাথে ভয় পেয়ে বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে যায় অনেকে। | এমনি করেই ঘটে চলেছে পৃথিবীর উপরিভাগের নানা পরিবর্তন। আজ বিস্তীর্ণ অঞ্চল যা শস্য শ্যামল হয়ে রয়েছে, হাজার বছর পরে সে জায়গা হয়ত। থাস করে নেবে আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভা। আবার এখন বিস্তীর্ণ এলাকা। বরফের হিমশীতল রাজ্য, সেখানে একেবারে পাল্টে গিয়ে ঘন জঙ্গলে আচ্ছন্ন। হয়ে উঠতে পারে। আবহাওয়ার এই পরিবর্তন ঘটে অত্যন্ত মন্থর গতিতে। কখনাে লক্ষ বছরের ব্যবধানে।
One thought on "চলুন জেনে নেওয়া যাক আগ্নেয়গিরি সম্পর্কে"