বর্তমান যুগে ফ্রিল্যান্সিং একটি জনপ্রিয় পেশা হয়ে উঠেছে। ঘরে বসে আয় করার সুযোগ, নিজের সময় মতো কাজ করার স্বাধীনতা, এবং কোনো বসের অধীনে না থাকার সুবিধা—সব মিলিয়ে অনেকেই ফ্রিল্যান্সিংকে স্বপ্নের চাকরি হিসেবে দেখে থাকেন। তবে এই স্বপ্নপূরণের পথে রয়েছে অনেক ভয়াবহতা, যা নতুনদের জন্য একেবারে অজানা এবং প্রস্তুতিহীন হলে তা এক সময় দুঃস্বপ্নে রূপ নিতে পারে।

১. কাজ পাওয়ার কঠিন বাস্তবতা

ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রথম চ্যালেঞ্জই হচ্ছে কাজ পাওয়া। নতুন ফ্রিল্যান্সাররা অনেক সময় ধরে প্রোফাইল তৈরি করে, স্কিল শেখে, অথচ মাসের পর মাস কোনো কাজই পায় না। বড় বড় ফ্রিল্যান্সাররা যেখানে হাজার হাজার রিভিউ নিয়ে কাজ করছেন, সেখানে একজন নতুন মানুষকে কেউ বিশ্বাস করতেও চায় না।

২. ক্লায়েন্ট দ্বারা প্রতারণা

ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মের বাইরে অনেকেই ক্লায়েন্টদের সাথে সরাসরি কাজ করে। অনেক সময় এই ক্লায়েন্টরা কাজ করিয়ে নিয়ে পেমেন্ট না করে ব্লক করে দেয়। কোনো ধরনের আইনি সহায়তা ছাড়াই ফ্রিল্যান্সারকে লোকসান গুনতে হয়।

৩. আর্থিক অনিশ্চয়তা

ফ্রিল্যান্সিংয়ে মাসে মাসে নির্দিষ্ট আয়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই। এক মাস অনেক কাজ পাওয়া গেলেও, পরের মাসে হয়তো একটাও কাজ পাওয়া গেল না। এই অনিশ্চয়তা পরিবার চালানো বা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

৪. সময় ব্যবস্থাপনায় হিমশিম

ফ্রিল্যান্সিং মানেই স্বাধীনতা নয়। বরং অনেক সময় ক্লায়েন্টের টাইম জোন অনুযায়ী রাত জেগে কাজ করতে হয়। একদিকে ক্লান্তি, অন্যদিকে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে প্রভাব পড়ে। দিন-রাতের পার্থক্য ঘুচে যায়, মানসিক চাপ বাড়ে।

৫. স্ক্যাম ও ভুয়া কোর্স

নতুন ফ্রিল্যান্সারদের লক্ষ্য করে অনেক স্ক্যামার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের নামে হাজার হাজার টাকা নিয়ে ভুয়া কোর্স চালায়। সার্টিফিকেট দেয়, অথচ কোনো কাজ পাওয়ার জন্য উপযোগী স্কিল শেখায় না।

৬. প্রতিযোগিতার তীব্রতা

বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ ফ্রিল্যান্সার প্রতিদিন কাজের জন্য বিড করছে। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা খুব কঠিন। যারা ভালো ইংরেজি জানে, ভালো প্রেজেন্টেশন দিতে পারে, তাদেরকেই বেশি গুরুত্ব দেয় ক্লায়েন্টরা।

৭. মানসিক চাপ ও একাকীত্ব

ঘরে বসে কাজ করার সুবিধার পাশাপাশি থাকে গভীর একাকীত্ব। অফিসের মতো সহকর্মী, আলাপচারিতা বা বাইরের পরিবেশ নেই। দিনের পর দিন একা বসে থেকে মানসিক অবসাদ তৈরি হয়, যা ধীরে ধীরে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।

৮. কাজের মূল্যায়নহীনতা

ফ্রিল্যান্সিংয়ে অনেক সময় ক্লায়েন্টরা ফিডব্যাক দেয় না। তারা শুধু ফলাফল চায়, পরিশ্রমের কদর করে না। অনেক ভালো কাজ করেও এক লাইন “Thanks” বা একটি ভালো রেটিং না পাওয়ায় আত্মবিশ্বাসে ধাক্কা লাগে।

৯. নির্ভরযোগ্য পেমেন্ট গেটওয়ের অভাব

বাংলাদেশে অনেক আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে এখনো সুবিধাজনকভাবে কাজ করে না। ফ্রিল্যান্সারদের বিভিন্ন ঝামেলা পোহাতে হয় টাকা তুলতে। ফি বেশি, সময় লাগে অনেক, আবার কিছু সময়ে অ্যাকাউন্টই বন্ধ হয়ে যায়।

১০. লোভ ও শর্টকাটের ফাঁদ

অনেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে দ্রুত টাকা আয়ের আশায় শর্টকাট খোঁজে। কপি-পেস্ট করে কাজ জমা দেয়, অন্যের কাজ নকল করে, কিংবা ভুয়া স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করে। এসবের ফলে এক সময় প্রোফাইল ব্যান হয়ে যায়, বিশ্বাস হারিয়ে যায়, এবং ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার এখানেই শেষ হয়।

১১. ভাষাগত সীমাবদ্ধতা

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই ইংরেজিতে দুর্বল। অথচ ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মে সফল হতে হলে ভালো ইংরেজি জানা অত্যন্ত জরুরি। ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ, প্রজেক্ট ব্রিফ বোঝা এবং প্রেজেন্টেশন দেওয়া—সবকিছুর জন্যই ভাষাজ্ঞান দরকার।

১২. সঠিক গাইডলাইনের অভাব

নতুনরা অনেক সময় ভুল পথে হাঁটে কারণ তারা জানেই না সঠিক পথ কোনটি। ফেসবুকে দেখছে কেউ লাখ টাকা ইনকাম করেছে, কিন্তু বাস্তবতা জানে না। ফলে তারা নিজের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

১৩. স্বাস্থ্য সমস্যা

ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকার ফলে চোখ, ঘাড়, পিঠ ও হাতের নানা সমস্যা দেখা দেয়। নিয়মিত শরীরচর্চা না করলে এই সমস্যাগুলো স্থায়ী রূপ নিতে পারে।

১৪. কাজের পুনরাবৃত্তি ও ক্লান্তি

একই ধরনের কাজ বারবার করতে করতে অনেক সময় ফ্রিল্যান্সাররা বোর ফিল করে। সৃজনশীলতা কমে যায়, কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যায়।

শেষ কথা

ফ্রিল্যান্সিং একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র, তবে এটি যেন কোনো ফাঁদ না হয়ে দাঁড়ায়, সে জন্য প্রস্তুতি, সঠিক দিকনির্দেশনা ও বাস্তব জ্ঞানের প্রয়োজন। যারা এই জগতটিতে প্রবেশ করতে চায়, তাদের উচিত প্রথমে যথাযথ স্কিল শেখা, ধৈর্য ধরে চেষ্টা করা, এবং বাস্তবতা মেনে চলা।

ফ্রিল্যান্সিং হোক সাফল্যের পথ, দুঃস্বপ্ন নয়।

Leave a Reply