রহমান রহীম আল্লাহ্ তায়ালার নামে-
৯. কোরবানির নিয়মাবলি | কোরবানির পশু কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট করা
কোরবানির জন্য পশু পূর্বেই নির্ধারণ করতে হবে। এর জন্য নিম্নোক্ত দুটো পদ্ধতির একটি নেয়া যেতে পারে।
(ক) মুখের উচ্চারণ দ্বারা নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। এভাবে বলা যায় যে ‘এ পশুটি আমার কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট করা হল।’ তবে ভবিষ্যৎ বাচক শব্দ দ্বারা নির্দিষ্ট হবে না। যেমন বলা হল—‘আমি এ পশুটি কোরবানির জন্য রেখে দেব।’
(খ) কাজের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা যায় যেমন কোরবানির নিয়তে পশু ক্রয় করল অথবা কোরবানির নিয়তে জবেহ করল। যখন পশু কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট করা হল তখন নিম্নোক্ত বিষয়াবলী কার্যকর হয়ে যাবে।
প্রথমত : এ পশু কোরবানি ছাড়া অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না, দান করা যাবে না, বিক্রি করা যাবে না। তবে কোরবানি ভালভাবে আদায় করার জন্য তার চেয়ে উত্তম পশু দ্বারা পরিবর্তন করা যাবে।
দ্বিতীয়ত : যদি পশুর মালিক ইন্তেকাল করেন তাহলে তার ওয়ারিশদের দায়িত্ব হল এ কোরবানি বাস্তবায়ন করা।
তৃতীয়ত : এ পশুর থেকে কোন ধরনের উপকার ভোগ করা যাবে না। যেমন দুধ বিক্রি করতে পারবে না, কৃষিকাজে ব্যবহার করতে পারবে না, সওয়ারি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, পশম বিক্রি করা যাবে না। যদি পশম আলাদা করে তাবে তা সদকা করে দিতে হবে,বা নিজের কোন কাজে ব্যবহার করতে পারবে, বিক্রি করে নয়।
চতুর্থত : কোরবানি দাতার অবহেলা বা অযতেœর কারণে যদি পশুটি দোষযুক্ত হয়ে পড়ে বা চুরি হয়ে যায় অথবা হারিয়ে যায় তাহলে তার কর্তব্য হবে অনুরূপ বা তার চেয়ে ভাল একটি পশু ক্রয় করা।
আর যদি অবহেলা বা অযতেœর কারণে দোষযুক্ত না হয়ে অন্য কারণে হয়, তাহলে দোষযুক্ত পশু কোরবানি করলে চলবে।
যদি পশুটি হারিয়ে যায় অথবা চুরি হয়ে যায় আর কোরবানি দাতার উপর পূর্ব থেকেই কোরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকে তাহলে সে কোরবানির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করবে। আর যদি পূর্ব থেকে ওয়াজিব ছিল না কিন্তু সে কোরবানির নিয়তে পশু কিনে ফেলেছে তাহলে চুরি হয়ে গেলে বা মরে গেলে অথবা হারিয়ে গেলে তাকে আবার পশু কিনে কোরবানি করতে হবে।
১০ – কোরবানির ওয়াক্ত বা সময়
কোরবানি নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কিত একটি এবাদত। এ সময়ের পূর্বে যেমন কোরবানি আদায় হবে না তেমনি পরে করলেও আদায় হবে না। অবশ্য কাজা হিসেবে আদায় করলে অন্য কথা।
যারা ঈদের সালাত আদায় করবেন তাদের জন্য কোরবানির সময় শুরু হবে ঈদের সালাত আদায় করার পর থেকে। যদি ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে কোরবানির পশু জবেহ করা হয় তাহলে কোরবানি আদায় হবে না। যেমন হাদিসে এসেছে—
আল-বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ স. খুতবাতে বলেছেন : এ দিনটি আমরা শুরু করব সালাত দিয়ে। অত:পর সালাত থেকে ফিরে আমরা কোরবানি করব। যে এমন আমল করবে সে আমাদের আদর্শ সঠিকভাবে অনুসরণ করল। আর যে এর পূর্বে জবেহ করল সে তার পরিবারবর্গের জন্য গোশতের ব্যবস্থা করল। কোরবানির কিছু আদায় হল না। [২৬]
সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে কোরবানি পশু জবেহ না করে সালাতের খুতবা দুটি শেষ হওয়ার পর জবেহ করা ভাল। কেননা রাসূলুল্লাহ স. এ রকম করেছেন। হাদিসে এসেছে:
সাহাবি জুনদাব ইবনে সুফিয়ান আল-বাজালী রা. বলেছেন : নবী কারীম স. কোরবানির দিন সালাত আদায় করলেন অত:পর খুতবা দিলেন তারপর পশু জবেহ করলেন। [২৭]
জুনদাব ইবনে সুফিয়ান বলেন, আমি কোরবানির দিন নবী কারীম সা.-এর সাথে ছিলাম। তিনি বললেন, যে ব্যক্তি নামাজের পূর্বে জবেহ করেছে সে যেন আবার অন্য স্থানে জবেহ করে। আর যে জবেহ করেনি সে যেন জবেহ করে। [২৮]
আর কোরবানির সময় শেষ হবে যিলহজ মাসের তেরো তারিখের সূর্যাস্তের সাথে সাথে। অতএব কোরবানির পশু জবেহ করার সময় হল চার দিন। যিলহজ মাসের দশ, এগারো, বার ও তেরো তারিখ। এটাই উলামায়ে কেরামের নিকট সর্বোত্তম মত হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে।কারণ : এক. আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন :—
‘যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদের চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে।’ [২৯]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বোখারি রহ. বলেন : ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন: ‘এ আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলো বলতে বুঝায় কোরবানির দিন ও তার পরবর্তী তিন দিন।’ [৩০]
অতএব এ দিনগুলো আল্লাহ তাআলা কোরবানির পশু জবেহ করার জন্য নির্ধারণ করেছেন। দুই. রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন :—
‘আইয়ামে তাশরীকের প্রতিদিন জবেহ করা যায়।’ [৩১]
আইয়ামে তাশরীক বলতে কোরবানির পরবর্তী তিন দিনকে বুঝায়।
তিন. কোরবানির পরবর্তী তিন দিনে সওম পালন জায়েজ নয়। এ দ্বারা বুঝে নেয়া যায় যে এ তিন দিনে কোরবানি করা যাবে।
চার. রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : ‘আইয়ামে তাশরীক হল খাওয়া, পান করা ও আল্লাহর জিকির করার দিন।’
এ দ্বারা বুঝে নিতে পারি যে, যে দিনগুলো আল্লাহ খাওয়ার জন্য নির্ধারণ করেছেন সে দিনগুলোতে কোরবানির পশু জবেহ করা যেতে পারে।
পাঁচ. সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত হয়, কোরবানির পরবর্তী তিনদিন কোরবানির পশু জবেহ করা যায়।
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন : আলী ইবনে আবি তালেব রা. বলেছেন : ‘কোরবানির দিন হল ঈদুল আজহার দিন ও তার পরবর্তী তিন দিন।’ অধিকাংশ ইমাম ও আলেমদের এটাই মত। যারা বলেন, কোরবানির দিন হল মোট তিন দিন; যিলহজ মাসের দশ, এগারো ও বার তারিখ। এবং বার তারিখের পর জবেহ করলে কোরবানি হবে না, তাদের কথার সমর্থনে কোন প্রমাণ নেই ও মুসলিমদের ঐক্যমত (ইজমা) প্রতিষ্ঠিত হয়নি। [৩২]
১১ – মৃত ব্যক্তির পক্ষে কোরবানি
মূলত কোরবানির প্রচলন জীবিত ব্যক্তিদের জন্য। যেমন আমরা দেখি রাসূলুল্লাহ স. ও তার সাহাবাগণ নিজেদের পক্ষে কোরবানি করেছেন। অনেকের ধারণা কোরবানি শুধু মৃত ব্যক্তিদের জন্য করা হবে। এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। তবে মৃত ব্যক্তিদের জন্য কোরবানি করা জায়েজ ও একটি সওয়াবের কাজ। কোরবানি একটি সদকা। আর মৃত ব্যক্তির নামে যেমন সদকা করা যায় তেমনি তার নামে কোরবানিও দেয়া যায়।
যেমন মৃত ব্যক্তির জন্য সদকার বিষয়ে হাদিসে এসেছেঃ
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত : এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল—হে রাসূল ! আমার মা হঠাৎ ইন্তেকাল করেছেন।কোন অসিয়ত করে যেতে পারেননি। আমার মনে হয় তিনি কোন কথা বলতে পারলে অসিয়ত করে যেতেন। আমি যদি এখন তার পক্ষ থেকে সদকা করি তাতে কি তার সওয়াব হবে ? তিনি উত্তর দিলেন : হ্যাঁ। [৩৩]
মৃত ব্যক্তির জন্য এ ধরনের সদকা ও কল্যাণমূলক কাজের যেমন যথেষ্ট প্রয়োজন ও তেমনি তাঁর জন্য উপকারী।
এমনিভাবে একাধিক মৃত ব্যক্তির জন্য সওয়াব প্রেরণের উদ্দেশ্যে একটি কোরবানি করা জায়েজ আছে। অবশ্য যদি কোন কারণে মৃত ব্যক্তির জন্য কোরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য পূর্ণ একটি কোরবানি করতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায় ব্যক্তি নিজেকে বাদ দিয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য কোরবানি করেন। এটা মোটেই ঠিক নয়। ভাল কাজ নিজেকে দিয়ে শুরু করতে হয় তারপর অন্যান্য জীবিত ও মৃত ব্যক্তির জন্য করা যেতে পারে। যেমন হাদিসে এসেছেঃ
আয়েশা রা. ও আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. যখন কোরবানি দিতে ইচ্ছা করলেন তখন দুটো দুম্বা ক্রয় করলেন। যা ছিল বড়, হৃষ্টপুষ্ট, শিংওয়ালা, সাদা-কালো বর্ণের এবং খাসি। একটি তিনি তার ঐ সকল উম্মতের জন্য কোরবানি করলেন ; যারা আল্লাহর একত্ববাদ ও তার রাসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে, অন্যটি তার নিজের ও পরিবার বর্গের জন্য কোরবানি করেছেন। [৩৪]
মৃত ব্যক্তি যদি তার সম্পদ থেকে কোরবানি করার অসিয়ত করে যান তবে তার জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।
১২ – অংশীদারির ভিত্তিতে কোরবানি করা
যাকে ‘ভাগে কোরবানি দেয়া’ বলা হয়।
ভেড়া, দুম্বা, ছাগল দ্বারা এক ব্যক্তি একটা কোরবানি করতে পারবেন। আর উট, গরু, মহিষ দ্বারা সাত জনের নামে সাতটি কোরবানি করা যাবে। ইতিপূর্বে জাবের রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিস দ্বারা এটা প্রমাণিত হয়েছে।
অংশীদারি ভিত্তিতে কোরবানি করার দুটি পদ্ধতি হতে পারে :
( এক) সওয়াবের ক্ষেত্রে অংশীদার হওয়া। যেমন কয়েক জন মুসলিম মিলে একটি বকরি ক্রয় করল। অত:পর একজনকে ঐ বকরির মালিক বানিয়ে দিল। বকরির মালিক বকরিটি কোরবানি করল। যে কজন মিলে বকরি খরিদ করেছিল সকলে সওয়াবের অংশীদার হল।
( দুই) মালিকানার অংশীদারির ভিত্তিতে কোরবানি। দু জন বা ততোধিক ব্যক্তি একটি বকরি কিনে সকলেই মালিকানার অংশীদার হিসেবে কোরবানি করল। এ অবস্থায় কোরবানি শুদ্ধ হবে না। অবশ্য উট, গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি জায়েজ আছে।
মনে রাখতে হবে কোরবানি হল একটি এবাদত ও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য লাভের উপায়। তাই তা আদায় করতে হবে সময়,সংখ্যা ও পদ্ধতিগত দিক দিয়ে শরিয়ত অনুমোদিত নিয়মাবলি অনুসরণ করে। কোরবানির উদ্দেশ্য শুধু গোশত খাওয়া নয়, শুধু মানুষের উপকার করা নয় বা শুধু সদকা (দান) নয়। কোরবানির উদ্দেশ্য হল আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের একটি মহান নিদর্শন তার রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে আদায় করা।
তাই, আমরা দেখলাম কীভাবে রাসূলুল্লাহ সা. গোশতের বকরি ও কোরবানির বকরির মাঝে পার্থক্য নির্দেশ করলেন। তিনি বললেন যা সালাতের পূর্বে জবেহ হল তা বকরির গোশত আর যা সালাতের পরে জবেহ হল তা কোরবানির গোশত।
১৩ – কোরবানি দাতা যে সকল কাজ থেকে দূরে থাকবেন
হাদিসে এসেছেঃ
উম্মে সালামাহ রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : তোমাদের মাঝে যে কোরবানি করার ইচ্ছে করে সে যেন যিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে । ইমাম মুসলিম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তার অন্য একটি বর্ণনায় আছে—‘সে যেন চুল ও চামড়া থেকে কোন কিছু স্পর্শ না করে। অন্য বর্ণনায় আছে ‘কোরবানির পশু জবেহ করার পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থায় থাকবে।’ [৩৫]
কোরবানি দাতা চুল ও নখ না কাটার নির্দেশে কি হিকমত রয়েছে এ বিষয়ে উলামায়ে কেরাম অনেক কথা বলেছেন। অনেকে বলেছেন : কোরবানি দাতা হজ করার জন্য যারা এহরাম অবস্থায় রয়েছেন তাদের আমলে যেন শরিক হতে পারেন, তাদের সাথে একাত্মতা বজায় রাখতে পারেন।
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেছেন : ‘কোরবানি দাতা চুল ও নখ বড় করে তা যেন পশু কোরবানি করার সাথে সাথে নিজের কিছু অংশ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কোরবানি (ত্যাগ) করায় অভ্যস্ত হতে পারেন এজন্য এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ [৩৬] যদি কেউ যিলহজ মাসের প্রথম দিকে কোরবানি করার ইচ্ছা না করে বরং কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর কোরবানির নিয়ত করল সে কি করবে? সে নিয়ত করার পর থেকে কোরবানির পশু জবেহ পর্যন্ত চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকবে।
১৪ – কোরবানির পশু জবেহ করার নিয়মাবলি
কোরবানি দাতা নিজের কোরবানির পশু নিজেই জবেহ করবেন, যদি তিনি ভালভাবে জবেহ করতে পারেন। কেননা রাসূলুল্লাহ সা. নিজে জবেহ করেছেন। আর জবেহ করা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম। তাই প্রত্যেকের নিজের কোরবানি নিজে জবেহ করার চেষ্টা করা উচিত।
ইমাম বোখারি রহ. বলেছেন : ‘সাহাবি আবু মুসা আশআরী রা. নিজের মেয়েদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন নিজ হাতে নিজেদের কোরবানির পশু জবেহ করেন।’ [৩৭ ] তার এ নির্দেশ দ্বারা প্রমাণিত হয় মেয়েরা কোরবানির পশু জবেহ করতে পারেন। তবে কোরবানি পশু জবেহ করার দায়িত্ব অন্যকে অর্পণ করা জায়েজ আছে। কেননা সহিহ মুসলিমের হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সা. তেষট্টিটি কোরবানির পশু নিজ হাতে জবেহ করে বাকিগুলো জবেহ করার দায়িত্ব আলী রা.-কে অর্পণ করেছেন। [৩৮]
জবেহ করার সময় যে সকল বিষয় লক্ষণীয়
- (১) যা জবেহ করা হবে তার সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবে , তাকে আরাম দিতে হবে। যাতে সে কষ্ট না পায় সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। হাদিসে এসেছে ,সাহাবি শাদ্দাদ ইবনে আউস রা. থেকে বর্ণিত যে নবী কারীম স. বলেছেন : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সকল বিষয়ে সকলের সাথে সুন্দর ও কল্যাণকর আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে তখন সুন্দরভাবে করবে আর যখন জবেহ করবে তখনও তা সুন্দরভাবে করবে। তোমাদের একজন যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং যা জবেহ করা হবে তাকে যেন প্রশান্তি দেয়। [৩৯]
- (২) যদি উট জবেহ করতে হয় তবে তা নহর করবে । নহর হল উটটি তিন পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে আর সম্মুখের বাম পা বাধা থাকবে। তার বুকে ছুরি চালানো হবে। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন:‘সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় তাদের উপর তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর।’ [৪০]
ইবনে আব্বাস রা. বলেন : এর অর্থ হল তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর সামনের বাম পা বাধা থাকবে। [৪১]
উট ছাড়া অন্য জন্তু হলে তা তার বাম কাতে শোয়াবে। ডান হাত দিয়ে ছুরি চালাবে। বাম হাতে জন্তুর মাথা ধরে রাখবে। মোস্তাহাব হল জবেহকারী তার পা জন্তুটির ঘারে রাখবে। যেমন ইতিপূর্বে আনাস রা. বর্ণিত বোখারির হাদিসে আলোচনা করা হয়েছে।
- (৩) জবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ বলতে হবে । কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন : ‘যার উপর আল্লাহর নাম (বিসমিল্লাহ) উচ্চারণ করা হয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর।’[৪২] জবেহ করার সময় তাকবীর বলা মোস্তাহাব। যেমন হাদিসে এসেছে:—
জাবের রা. থেকে বর্ণিত … একটি দুম্বা আনা হল। রাসূলুল্লাহ স. নিজ হাতে জবেহ করলেন এবং বললেন ‘বিসমিল্লাহ ওয়া আল্লাহু আকবর, হে আল্লাহ ! এটা আমার পক্ষ থেকে। এবং আমার উম্মতের মাঝে যারা কোরবানি করতে পারেনি তাদের পক্ষ থেকে।’[৪৩] অন্য হাদিসে এসেছে—
রাসূলুল্লাহ সা. দুটি শিংওয়ালা ভেড়া জবেহ করলেন, তখন বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বললেন। [৪৪] জবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর পাঠের পর— ﺍﻟﻠّﻬُﻢَّ ﻫَﺬَﺍ ﻣِﻨْﻚَ ﻭَﻟَﻚَ —(হে আল্লাহ এটা তোমার তরফ থেকে, তোমারই জন্য) বলা যেতে পারে। যার পক্ষ থেকে কোরবানি করা হচ্ছে তার নাম উল্লেখ করে দোয়া করা জায়েজ আছে। এ ভাবে বলা—‘হে আল্লাহ তুমি অমুকের পক্ষ থেকে কবুল করে নাও।’ যেমন হাদিসে এসেছে আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. কোরবানির দুম্বা জবেহ করার সময় বললেন :—
‘ আল্লাহ নামে, হে আল্লাহ ! আপনি মোহাম্মদ ও তার পরিবার-পরিজন এবং তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করে নিন। ’ [৪৫]
কোরবানির গোশত কারা খেতে পারবেন
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন :—
‘ অত:পর তোমরা উহা হতে আহার কর এবং দু:স্থ, অভাবগ্রস্থকে আহার করাও ।’[৪৬] রাসূলুল্লাহ স. কোরবানির গোশত সম্পর্কে বলেছেন :—
‘ তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর ।’ [৪৭]
‘আহার করাও’ বাক্য দ্বারা অভাবগ্রস্থকে দান করা ও ধনীদের উপহার হিসেবে দেয়াকে বুঝায়। কতটুকু নিজেরা খাবে, কতটুকু দান করবে আর কতটুকু উপহার হিসেবে প্রদান করবে এর পরিমাণ সম্পর্কে কোরআনের আয়াত ও হাদিসে কিছু বলা হয়নি। তাই উলামায়ে কেরাম বলেছেন : কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজেরা খাওয়া, এক ভাগ দরিদ্রদের দান করা ও এক ভাগ উপহার হিসেবে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের দান করা মোস্তাহাব।
কোরবানির গোশত যতদিন ইচ্ছা ততদিন সংরক্ষণ করে খাওয়া যাবে। ‘কোরবানির গোশত তিন দিনের বেশি সংরক্ষণ করা যাবে না’—বলে যে হাদিস রয়েছে তার হুকুম রহিত হয়ে গেছে। তাই যতদিন ইচ্ছা ততদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
তবে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ বিষয়ে একটা সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : সংরক্ষণ নিষেধ হওয়ার কারণ হল দুর্ভিক্ষ।দুর্ভিক্ষের সময় তিন দিনের বেশি কোরবানির গোশত সংরক্ষণ করা জায়েজ হবে না। তখন ‘সংরক্ষণ নিষেধ’ সম্পর্কিত হাদিস অনুযায়ী আমল করতে হবে। আর যদি দুর্ভিক্ষ না থাকে তবে যতদিন ইচ্ছা কোরবানি দাতা কোরবানির গোশত সংরক্ষণ করে খেতে পারেন। তখন‘সংরক্ষণ নিষেধ রহিত হওয়া’ সম্পর্কিত হাদিস অনুযায়ী আমল করা হবে।
কোরবানির পশুর গোশত, চামড়া, চর্বি বা অন্য কোন কিছু বিক্রি করা জায়েজ নয়। কসাই বা অন্য কাউকে পারিশ্রমিক হিসেবে কোরবানির গোশত দেয়া জায়েজ নয়। হাদিসে এসেছে :—
‘তার প্রস্তুত করণে তার থেকে কিছু দেয়া হবে না।’ [৪৮]
তবে দান বা উপহার হিসেবে কসাইকে কিছু দিলে তা না-জায়েজ হবে না।
১৫ – আইয়ামুত-তাশরীক ও তার করণীয়
আইয়ামুত-তাশরীক বলা হয় কোরবানির পরবর্তী তিন দিনকে। অর্থাৎ যিলহজ মাসের এগারো, বারো ও তেরো তারিখকে আইয়ামুত-তাশরীক বলা হয়। তাশরীক শব্দের অর্থ শুকানো। মানুষ এ দিনগুলোতে গোশত শুকাতে দিয়ে থাকে বলে এ দিনগুলোর নাম‘আইয়ামুত-তাশরীক’ বা ‘গোশত শুকানোর দিন’ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
আইয়ামুত তাশরীক এর ফজিলত
এ দিনগুলোর ফজিলত সম্পর্কে যে সকল বিষয় এসেছে তা নীচে আলোচনা করা হল :—
(১) এ দিনগুলো এবাদত-বন্দেগি, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জিকির ও তার শুকরিয়া আদায়ের দিন। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
‘তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করবে।’ [৪৯]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বোখারি রহ. বলেন :—
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন—‘নির্দিষ্ট দিনগুলো বলতে আইয়ামুত-তাশরীককে বুঝানো হয়েছে।’ [৫০]
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন : ইবনে আব্বাসের এ ব্যাখ্যা গ্রহণে কারো কোন দ্বি-মত নেই।[৫১] আর মূলত এ দিনগুলো হজের মওসুমে মিনাতে অবস্থানের দিন। কেননা হাদিসে এসেছে—
মিনায় অবস্থানের দিন হল তিন দিন। যদি কেউ তাড়াতাড়ি করে দু দিনে চলে আসে তবে তার কোন পাপ নেই। আর যদি কেউ বিলম্ব করে তবে তারও কোন পাপ নেই।[৫২] হাদিসে এসেছে—
নাবীশা হাজালী থেকে বর্ণিত যে রাসূলে কারীম স. বলেছেন : ‘আইয়ামুত-তাশরীক হল খাওয়া-দাওয়া ও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জিকিরের দিন।’[৫২]
ইমাম ইবনে রজব রহ. এ হাদিসের ব্যাখ্যায় চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেন : আইয়ামুত-তাশরীক এমন কতগুলো দিন যাতে ঈমানদারদের দেহের নেয়ামত ও স্বাচ্ছন্দ্য এবং মনের নেয়ামত তথা স্বাচ্ছন্দ্য একত্র করা হয়েছে। খাওয়া- দাওয়া হল দেহের খোরাক আর আল্লাহর জিকির ও শুকরিয়া হল হৃদয়ের খোরাক। আর এভাবেই নেয়ামতের পূর্ণতা লাভ করল এ দিনসমূহে। [৫৪]
(২) আইয়ামুত-তাশরীকের দিনগুলো ঈদের দিন হিসেবে গণ্য। যেমন হাদিসে এসেছে—
‘সাহাবি উকবাহ ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলে কারীম স. বলেছেন: আরাফাহ দিবস, কোরবানির দিন ও মিনার দিন সমূহ (কোরবানি পরবর্তী তিন দিন) আমাদের ইসলাম অনুসারীদের ঈদের দিন।’ [৫৫]
(৩) এ দিনসমূহ যিলহজ মাসের প্রথম দশকের সাথে লাগানো। যে দশক খুবই ফজিলতপূর্ণ। তাই এ কারণেও এর যথেষ্ট মর্যাদা রয়েছে।
(৪) এ দিনগুলোতে হজের কতিপয় আমল সম্পাদন করা হয়ে থাকে। এ কারণেও এ দিনগুলো ফজিলতের অধিকারী।
আইয়ামুত তাশরীকে করণীয়
এ দিনসমূহ যেমনি এবাদত-বন্দেগি, জিকির-আযকারের দিন তেমনি আনন্দ-ফুর্তি করার দিন। যেমন রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : ‘আইয়ামুত-তাশরীক হল খাওয়া-দাওয়া ও আল্লাহর জিকিরের দিন।’ [৫৬]
এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দেয়া নেয়ামত নিয়ে আমোদ-ফুর্তি করার মাধ্যমে তার শুকরিয়া ও জিকির আদায় করা।
জিকির আদায়ের কয়েকটি পদ্ধতি হাদিসে এসেছে।
- (১) সালাতের পর তাকবীর পাঠ করা। এবং সালাত ছাড়াও সর্বদা তাকবীর পাঠ করা। এ তাকবীর আদায়ের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ দিতে পারি যে এ দিনগুলো আল্লাহর জিকিরের দিন। আর এ জিকিরের নির্দেশ যেমন হাজীদের জন্য তেমনই যারা হজ পালনরত নন তাদের জন্যও।
- (২) কোরবানি ও হজের পশু জবেহ করার সময় আল্লাহ তাআলার নাম ও তাকবীর উচ্চারণ করা।
- (৩) খাওয়া-দাওয়ার শুরু ও শেষে আল্লাহ তাআলার জিকির করা। আর এটা তো সর্বদা করার নির্দেশ রয়েছে তথাপি এ দিনগুলোতে এর গুরুত্ব বেশি দেয়া। এমনিভাবে সকল কাজ ও সকাল-সন্ধ্যার জিকিরগুলোর প্রতি যতœবান হওয়া।
- (৪) হজ পালন অবস্থায় কঙ্কর নিক্ষেপের সময় আল্লাহ তাআলার তাকবীর পাঠ করা।
- (৫) এ গুলো ছাড়াও যে কোন সময় ও যে কোন অবস্থায় আল্লাহর জিকির করা
সংকলনঃ আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুররহমান
সম্পাদনাঃ আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
[১]আবু দাউদ-১৯৪৫, হাদিসটি সহিহ
[২]আবু দাউদ-১৮৬৫, হাদিসটি সহিহ
[৩]লাতায়েফুল মাআরিফ : ইবনে রজব র., পৃ- ৪৮২-৪৮৩
[৪]সূরা জারিয়াত : ৫৬
[৫]ফতহুল মজিদ : ১৭
[৬]সূরা আনআম : ১৬২-১৬৩
[৭]সূরা কাওসার : ২
[৮]মুসলিম, শরহে নবভী
[৯]সূরা মায়িদাহ : ৩
[১০]আবু নঈম, আহমদ
[১১]সূরা মায়েদা : ৭২
[১২]সূরা কাওসার : ২
[১৩]সূরা আনআম ঃ ১৬২-১৬৩
[১৪]বোখারি- ৫৫৪৫, মুসলিম-১৯৬১
[১৫]বোখারি-৫৫৬৫, মুসলিম-১৯৬৬
[১৬]আহকামুল উযহিয়্যা : মুহাম্মদ বিন উসাইমীন, পৃ- ২৬
[১৭]সূরা কাওসার : ২
[১৮]মুসনাদ আহমাদ, ইবনে মাজা- ৩১২৩ হাদিসটি হাসান
[১৯]মুসনাদ আহমাদ, ইবনে মাজা- ৩১২৫ হাদিসটি হাসান
[২০]মুসলিম- ১৯৭৭
[২১]সূরা হজ্ব : ৩৭
[২২]সূরা হজ্ব : ৩৪
[২৩]মুসলিম- ১৯৬৩
[২৪]ইবনে মাজা- ৩১৩২, হাদিসটি সহিহ
[২৫]তিরমিজি-১৫৪৬, নাসায়ি- ৪৩৭১, হাদিসটি সহিহ
[২৬]বোখারি- ৯৬৫
[২৭]বোখারি- ৯৮৫
[২৮]বোখারি- ৫৫৬২
[২৯]সূরা হজ্ব : ২৮
[৩০]ফাতহুল বারী, ২য় খন্ড, পৃ-৫৬১
[৩১]আহমদ- ৪/৮২, হাদিসটি সহিহ
[৩২]যাদুল মাআদ, ২য় খন্ড, পৃ-৩১৯
[৩৩]বোখারি-১৩৩৮, মুসলিম-১০০৪
[৩৪]ইবনে মাজা, হাদিসটি সহিহ
[৩৫]মুসলিম-১৯৭৭
[৩৬]আহকামুল উযহিয়্যাহ : ইবনে উসাইমীন। পৃ-৭৭
[৩৭]ফাতহুল বারী ১০/২১
[৩৮]মুসলিম- ১২১৮
[৩৯]মুসলিম-১৯৫৫
[৪০]সূরা হজ : ৩৬
[৪১]তাফসীর ইবনে কাসির
[৪২]সূরা আনআম : ১১৮
[৪৩]আবু দাউদ
[৪৪]সুনানে দারামী- ১৯৮৮, হাদিসটি সহিহ
[৪৫]মুসলিম- ১৯৬৭
[৪৬]সূরা হজ্ব-২৮
[৪৭]বোখারি-৫৫৬৯
[৪৮]বোখারি -১৭১৬ মুসলিম-১৩১৭
[৪৯]সূরা বাকারা : ২০৩
[৫০]ফতহুল বারী, ঈদ অধ্যায়
[৫১]তাফসীর কুরতুবী
[৫২]আবু দাউদ- ১৯৪৯, হাদিসটি সহিহ
[৫৩]মুসলিম- ১১৪১
[৫৪]লাতায়েফুল মাআরেফ : ইবনে রজব র. পৃ-৫০৪
[৫৫]আবু দাউদ-২৪১৩, হাদিসটি সহিহ
[৫৬]মুসলিম-১১৪১
সবাই ভালো থাকবেন ভালো রাখবেন আর Trickbd সাথেই থাকবেন।
এটাই কি শেষ পার্ট?