এক.
র্যাগিং নামের একটি চর্চা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলে আসছে। সাউথ এশিয়ান দেশগুলোতে র্যাগিং নামে পরিচিত থাকলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও কাছাকাছি প্রচলন রয়েছে।
মূলত র্যাগিং একরকম নবীনবরণের অর্থ বোঝালেও আদতে তা নবীন শিক্ষার্থীদের অপেক্ষাকৃত সিনিয়র শিক্ষার্থী কর্তৃক অপমান, মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন করাকে বোঝায়।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগিংয়ের খণ্ডিত তথ্য বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেলেও এ বিষয়ে কোনো গবেষণা/জরিপ করা হয়েছে বলে জানা নেই। ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় গভর্নিং কাউন্সিল (UGC) কর্তৃক ২০১৫ তে ৩৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ১০,৬৩২ জন শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ করা হয়। এতে প্রায় ৪০% শিক্ষার্থী জানান তারা র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছিলেন, যার মধ্যে ৪.১% জানান যে তারা মারাত্মক র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন। দুটো সরকারী মেডিকাল কলেজের ৭০% শিক্ষার্থী জানান তারা র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন, অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের ৯০% শিক্ষার্থী র্যাগিংয়ের শিকার বলে জানান। র্যাগিংয়ের ধরণে রয়েছে সিনিয়রদের স্যার সম্বোধন করা থেকে শুরু করে গান গাওয়া, কাপড় খোলা, অশ্লীল চিত্র দেখা ও মারপিট করা ইত্যাদি। র্যাগিংয়ের প্রভাব হিসেবে শিক্ষার্থীরা হতাশা, ভয়, আত্মবিশ্বাসহীনতা, অন্যকে অবিশ্বাস করা, পড়াশোনায় গ্রেড কমে যাওয়া – ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন।
(গবেষণার লিংক: https://bit.ly/2IIRum4)
এই রিপোর্টটা এজন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ:
(১) এটা এমন একটি দেশের অবস্থা, যাদের দ্বারা আমরা সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিকভাবে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত।
(২) আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনো কোনো গবেষণা হয় নি।
দুই.
একজন মুসলিম হিসেবে সাধারণভাবে অপর মুসলিমকে অপমান করা, গালি দেয়াই হারাম, জাহান্নামে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট। তদুপরি তাকে শারীরিক নির্যাতন করা বা হত্যা করার শাস্তি তো প্রশ্নাতীত।
বুখারী শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, অপর মুসলিমকে গালমন্দ করা বড় অপরাধ (ফুসুক) এবং তাকে হত্যা করা বে-ঈমানী (কুফর)।
ইমাম নাখায়ী (রহ.) বলেন, কোনো ব্যক্তি যখন কাউকে বলে, “গাধা! শুয়োর!” – ক্বিয়ামতের দিন তাকে বলা হবে, “তুই কি মনে করেছিস আমি তাকে গাধা হিসেবে সৃষ্টি করেছি? শুকর হিসেবে সৃষ্টি করেছি”? (অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা প্রচণ্ড রাগ করবেন।)
আহমাদ ও ইবনে হিব্বান আবু হুরায়রা (রা.)-র বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, এক লোক বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), অমুক অনেক নামায, রোযা, যাকাত আদায় করে, কিন্তু তার প্রতিবেশীকে কথা দিয়ে কষ্ট দেয়। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সে জাহান্নামে যাবে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “সত্যিকারের মুমিন অন্যকে উপহাস করা, অভিশাপ দেওয়া, অশ্লীল কথা বলা বা গালি দেওয়াতে জড়িত থাকে না”। (তিরমিযী)
তিন.
আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগিংয়ের কথা পড়ছি, আমরা ভাবছি, তারা এত বাজে, হিংস্র ইত্যাদি। এবং মনের অজান্তেই নিজের ব্যাপারে তৃপ্ত হচ্ছি। আমি নিচে কয়েকটি প্রশ্ন রাখব, আপনার উত্তর যদি ‘হা’ হয়, তাহলে আপনার ভেতরেও বসবাস করছে একজন র্যাগার।
আপনি রিকশায় চড়ে গন্তব্যে নামার পর রিকশাচালক আপনার কাছে বাড়তি ভাড়া চাইলে আপনার কি তাকে চড় দিতে মন চায়? বা মনে করেন, চড়টা তার প্রাপ্য এবং আপনার অধিকার? মাঝেমধ্যে দুই-একটা চড় দিয়েই দেন এবং আনন্দ লাভ করেন?
গাড়ির ড্রাইভার বা বাসার দারোয়ানকে আপনার খুব ছোটলোক মনে হয়, এবং সুযোগ পেলেই তার ওপর চড়াও হয়ে পড়েন, অপমান করেন বা কখনো হাত ব্যবহার করে শাসিয়ে দেন?
কাজের মেয়েটার ২৪ ঘণ্টাই আপনার জন্য বরাদ্দ মনে করেন, এবং ঘুম থেকে দেরিতে উঠলে, কিংবা গোসলে সময় বেশি নিলে, বা একটু বসে থাকলেই রাগ/অপমান বা চড় বসাতে ভুল করেন না? এবং এটাকে সম্পূর্ণ নিজের অধিকার মনে করেন? ভাবেন, এদের সাথে এমন ব্যবহারই করা উচিৎ?
মিস্ত্রি একটু কাজে উল্টা-পাল্টা করলে মুখ থেকে গালি বের হয়ে আসে, হাতটা হিসপিস করে? ভাবেন, এদের জাতটা এমনই?
পথশিশু বা বস্তির লোকদের দেখলে গা ঘিনঘিন করে? মনে করেন, এদের জন্য এমন জীবনই ঠিক আছে?
অফিসের কর্মচারীদের ২৪ ঘণ্টা নিজের জন্য বরাদ্দ মনে করেন? অফিস টাইম শেষে তাদের মিটিংয়ে ডাকতে বা বসিয়ে রাখতে আনন্দ লাভ করেন? একটু এদিক-সেদিক হলেই অধীনস্থের ওপর চড়াও হন। ভাবেন, টাকা দিচ্ছেন বা বস্ হয়েছেন তো এই অধিকার আপনার আছেই?
ছেলের বউ দেরী করে ঘুম থেকে উঠলে রাগ ওঠে প্রচুর? তাকে অপমান করে আনন্দ পান? ভাবেন, কাজ না করলে কেমন বউ সে?
ভাড়াটিয়াকে ইচ্ছে করে সময় মত পানি না দিয়ে মাস শেষে ভাড়া পেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন? এমনকি উঠতে বসতে তাকে কটু কথা শোনান? ভাবেন, এই অধিকার আপনার আছে?
এভাবে আরো অনেক প্রশ্ন করা যাবে, শেষ হবে না। আপনি যদি কোনোভাবে কোনো ক্ষেত্রে অন্যকে অপমান করে আনন্দ বোধ করেন, অন্যকে কষ্ট দিয়ে আপনার আনন্দ হয়, অন্যকে বিপদে দেখলে আপনার হাসি পায় – নিশ্চিত থাকুন, আপনার ভেতরেও ভয়ংকর এক র্যাগার বসে আছে।
আমাদের সমাজে এভাবে স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, কর্মস্থলে, পরিবারে – প্রতিটা জায়গায় ছড়িয়ে আছে র্যাগিং, বুলিং বা অন্যকে অপমান করার চর্চা। নিজেকে পরিবর্তন করুন, নিজের সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দিন। তবেই আমরা এক পরিবর্তিত সমাজের স্বপ্ন দেখতে পারব ইনশা’আল্লাহ।
সৌজন্য OurislamBD.Com
One thought on "প্রসঙ্গ র্যাগিং, আপনিও কি একজন র্যাগার?"