পরকালের #অনন্তকালের জীবনের জন্য আমাদের প্রথম স্টেশান হচ্ছে কবর। শুধুমাত্র যাদের উপর কেয়ামত কায়েম হবে তারা ছাড়া, আর সকলকেই এই কবরের মধ্য দিয়ে পরকালের জীবন শুরু করবে।
প্রথম এই স্টেশানটা যিনি নিরাপদে পার করতে পারবে, মোটামুটি আশা করা যায় – রোয কেয়ামতের
দিন, হাশর ও মীযানের সময়ও তিনি নিরাপদে পার করতে পারবেন। তাই আমাদের সকলের চেষ্টা করা উচিত, কবরের জীবনে যাতে করে শান্তিতে থাকতে পারি তার জন্য আত্মনিয়োগ করা।
কবরের জীবনের ফেতনাঃ
প্রতিটি আদম সন্তান, সে কাফের হোক, ঈমানদার বা মুনাফেক হোক – সকলকেই কবরে ৩টি প্রশ্নের মুখোমুখী হতে হবে।
১. ‘মার-রব্বুকা’ – তোমার #রব্ব কে?
২. ‘ওয়ামা দ্বীনুকা’ – তোমার #দ্বীন (ধর্ম/জীবন ব্যবস্থা) কি?
৩. এই ব্যক্তি কে (#রাসুল সাঃ এর ন ব্যপারে প্রশ্ন করা হবে)?
একে #কবরের #ফেতনা বলা হয়। শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি সঠিক ঈমান রেখে এবং ক্বুরান ও সুন্নাহ অনুযায়ী নেক আমল করে, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত যথাযথভাবে পালন করে, দুনিয়াতে আল্লাহকে ভয় করে যারা আল্লাহর অনুগত থাকবেন, শুধুমাত্র তারাই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারবেন, চাই সে আরবী জানুক আর না জানুক। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে সেখানে তারা কেয়ামত পর্যন্ত সুখের ঘুমানো, জান্নাতের বিছানা ইত্যাদি নেয়ামতের মাঝে থাকবে।
আর কাফের, মুশরেক, মুনাফেক বা নামকাওয়াস্তে মুসলমান, বেনামাযী, কবর-মাযারপূজারী, হালাল-হারাম সম্পর্কে বেপরোয়া, ফাসেক, পাপাচারী, পাপিষ্ঠ – এরা দুনিয়ার জীবনে যতই নিজেকে মুসলমান দাবী করুক না কেনো, তারা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কস্মিন কালেও দিতে পারবেনা। তারা হায় আফসোস! আমি জানিনা, আমি জানিনা বলে আহাজারি করবে এবং কঠিন শাস্তি ভোগ করতে থাকবে।
কবরের আযাবঃ
দুনিয়ার জীবনে পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তিদের যারা তোওবা করবেনা, আল্লাহর রহমত অর্জন করতে ব্যর্থ হবে, তাদের জাহান্নামের শাস্তি কবরের জীবনেই শুরু হয়ে যাবে। এই শাস্তি চলবে কেয়ামত পর্যন্ত, আর জাহান্নামের শাস্তিতো আরো #কঠিন ও #দীর্ঘস্থায়ী। এইজন্য রাসুল সাঃ আমাদেরকে বারবার কবরের আযাব থেকে বাঁচার জন্য, আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। তিনি নিজেও নামাযের ভেতরে ও বাইরে কবরের আযাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন। কবরের আযাবের ভয়াবহতা চিন্তা করে সাইয়্যিদিনা উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) কবরের কথা স্মরণ করলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন, এমনকি তাঁর কাপড় ভিজে যেত চোখের পানিতে।
কবরের শাস্তি হিসেবে যা থাকবে তার উদাহরণঃ
১. #কাজ্জাব বা বড় মিথ্যাবাদী ও মিথ্যা কথা প্রচারকারীর শাস্তিঃ
কাজ্জাবকে দাঁড়ানো অবস্থায় এক পাশের চোয়াল এমনভাবে আকড়া দিয়ে বিদ্ধ করা হবে যে, সেটা তার চোয়াল বিদীর্ণকরে মস্তকের পশ্চাদভাগ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। তারপর অপর চোয়ালটিকেও একইভাবে বিদীর্ণ করা হবে। এইভাবে তাদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
২. #ক্বুরান শিখে সে অনুযায়ী আমল না করা এবং #বেনামাযীদের শাস্তিঃ
ক্বুরানকে অবহেলাকারী ও বেনামাযীকে মাটিতে ফেলে তার মাথার কাছে একজন আজাবের ফেরেশতা দাঁড়িয়ে পাথরদিয়ে আঘাত করে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে। নিক্ষিপ্ত পাথর দূরে গড়িয়ে যাওয়ার ফলে তা তুলে নিয়ে শায়িত ব্যক্তিরকাছে ফিরে আসার আগেই ভেঙ্গে যাওয়া মাথা আগের মতো আবার জোড়া লেগে যাবে। ফেরেশতা পুনরায় তার মাথারউপরে পাথর নিক্ষেপ করবে। এইভাবে তাদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
৩. #জেনাকারী, নারী-পুরুষের অবৈধ যৌন সম্পর্কের শাস্তিঃ
চুলার ন্যায় বড় একটা গর্ত থাকবে যেন সেটা বিশাল একটা কড়াই। গর্তের উপরিভাগ হচ্ছে সরু ও নীচের অংশ চওড়াএবং এর নিচ থেকে আগুন জ্বলতে থাকবে। এর ভেতরে জেনাকারী নারী ও পুরুষদেরকে উলংগ করে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেওয়া হবে। আগুন গর্তের একেবারে মুখের কাছে চলে আসলে জেনাকারীরা আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরেউপরে চলে আসবে যেন তারা গর্ত থেকে পালিয়ে যেতে পারে। ফেরেশতারা তাদেরকে আবার আগুনের গর্তে ফেরত পাঠাবেন। আগুনের তাপ একটু কমে আসলে তারা আবার গর্তে নিচে ফিরে যাবে। এইভাবে তাদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
ঘরে স্বামী/স্ত্রী রেখে অন্য কারো সাথে জেনা করার শাস্তিঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মি’রাজের রাত্রিতে একদল লোকের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন তাদের সামনে একটি পাত্রে গোশত রান্না করে রাখা হয়েছে। অদূরেই অন্য একটি পাত্রে রয়েছে পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত কাঁচা গোশত। লোকদেরকে রান্না করে রাখা গোশত থেকে বিরত রেখে পঁচা এবং দুর্গন্ধযুক্ত, কাঁচা গোশত খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। তারা চিৎকার করছে এবং একান্ত অনিচ্ছা সত্বেও তা থেকে ভক্ষণ করছে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিবরীল ফেরেশতাক জিজ্ঞেস করলেনঃ এরা কোন শ্রেণীর লোক? জিবরীল বললেনঃ এরা আপনার উম্মতের ঐ সমস্ত পুরুষ লোক যারা নিজেদের ঘরে পবিত্র এবং হালাল স্ত্রী থাকা সত্বেও অপবিত্র এবং খারাপ মহিলাদের সাথে রাত কাটাতো। উৎসঃ আল-খুতাবুল মিম্বারিয়াঃ ডা সালেহ আল-ফাওজান।
৪. #সুদখোরের শাস্তিঃ
জাহান্নামে একটি রক্ত প্রবাহিত নদী আছে যার মাঝখানে সুদখোর দাঁড়ানো থাকবে। নদীর তীরে একজন ফেরেশতা থাকবে যার সামনে অনেক পাথর থাকবে। সুদখোর রক্তের নদী থেকে বের হয়ে আসার জন্য তীরে আসার চেষ্টা করলে তীরেদাঁড়ানো আজাবের ফেরেশতা সে ব্যক্তির মুখ বরাবর পাথর নিক্ষেপ করবে, এতে সুদখোর আবার নদীর মাঝখানে চলে যাবে। এমনভাবে যতবার সুদখোর তীরে উঠে আসতে চেষ্টা করবে, ততবার ঐ ফেরেশতা তার মুখ বরাবর পাথর নিক্ষেপকরে পূর্বস্থানে ফিরে যেতে বাধ্য করবে। এইভাবে তাদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
উপরের দীর্ঘ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে সহীহ বুখারীঃ জানাজা অধ্যায়ে।
৫. এছাড়া উহুদ পাহাড়ের সমান ওজনের হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করা, বিষাক্ত সাপের দংশন, বিচ্ছুর কামড় ইত্যাদি শাস্তি থাকবে কবরে।
কবরে আযাব হওয়ার কারণঃ
কবরের আযাব হওয়ার কারণ হচ্ছে দুনিয়ার জীবনে #কবীরাহ গুনাহ বা বড়বড় পাপকাজে লিপ্ত থাকা। কবীরাহ গুনাহতে লিপ্ত থাকা এবং তোওবা না করে, সংশোধন না করেই মৃত্যুবরণ করা। হাদীসে বিশেষ ২টি কারণ উল্লেখ করা আছে, যেই দুইটি পাপকে মানুষ ছোট মনে করে কিন্তু অনেকেই এই ২টি পাপ কাজের কারণে আযাব দেওয়া হবে।
১. চোগলখুরী করা (এক জনের গীবত আরেকজনের কাছে বলে মানুষের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করা)।
২. পেশাবের অপবিত্রতা থেকে সাবধান না থাকা।
একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনা বা মক্কার কোন একটি বাগানের পাশদিয়ে অতিক্রম করছিলেন।তথায় তিনি দু’জন এমন মানুষের আওয়াজ শুনতে পেলেন যাদেরকে কবরে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তাদেরকে আযাব দেয়া হচ্ছে অথচ বড় কোন অপরাধের কারণে আযাব দেয়া হচ্ছে না।অতঃপর তিনি বললেনঃ তাদের একজন পেশাব করার সময় আড়াল করতোনা। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগাত। বুখারীঃ কিতাবুল ওযু অধ্যায়।
কাতাদা (রঃ) বলেনঃ আমাদেরকে বলা হয়েছে কবরের আযাবের এক তৃতীয়াংশ হবে #গীবতের কারণে, এক তৃতীয়াংশ #পেশাব থেকে সাবধান না থাকার কারণে এবং এক তৃতীয়াংশ #চুগলখোরীর কারণে। যেহেতু গীবতকারী এবং চুগলখোর মিথ্যা কথাও বলে থাকে তাই সে #মিথ্যাবাদীর শাস্তিও ভোগ করবে।
কবরের আযাব থেকে বাঁচার উপায়ঃ
১. কবরের আযাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া ও দুয়া করাঃ
কবররে আযাব থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে নিয়মিত দুয়া করতে হবে, বিশেষ করা দুয়া মাসুরাতে বেশি বেশি দুয়া করতে হব। যেই দুয়া মাসুরা পড়তে হবেঃ
দুয়া মাসুরা অর্থ হচ্ছে হাদীসে বর্ণিত দুয়া যেইগুলো রাসুল সাঃ করতেন। আমাদের দেশের মানুষ মনে করে, দুয়া মাসুরা শুধুএকটাই (আল্লাহুম্মা ইন্নি জালামতু নাফসান যুলমান কাসিরাও…), এটা ভুল। নামাযে সালাম ফিরানোর আগে পড়তে হয় এমন অনেক সুন্দর সুন্দর দুয়া আছে সহীহ হাদীসে। কারণ, ফরয নামাযে আত্তাহিয়্যাতু ও দুরুদ পড়ার পরে, সালাম ফেরানোর আগে দুয়া বেশি কবুল করা হয়। দুয়া মাসুরা এক বা একের অধিক, যত ইচ্ছা পড়া যায়। এইগুলো মুখস্থ করেআমল করা উচিত।
৪টি জিনিস থেকে আশ্রয় চাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুয়া মাসুরা আছে। কবরের আজাব, জাহান্নামের আজাব, দুনিয়ার ফেতনা ও মৃত্যুর সময়ের ফেতনা ও দাজ্জালের ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য দুয়া মাসুরাঃ
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এইগুলো থেকে বাঁচার জন্য ফরয, নফল বা সুন্নত, যেকোনো সালাতে তাশাহুদ ও দুরুদের পরে সালাম ফিরানোর আগে এই দুয়া পড়তে বলেছেন।
اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ، وَمِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ، وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ، وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْمَسِيْحِ الدَّجَّالِ.
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা ইন্নী আ’উযুবিকা মিন আ’যাবিল ক্বাবরি ওয়া মিন আ’যাবি জাহান্নাম, ওয়ামিন ফিতনাতিল মাহ’ইয়া, ওয়াল্ মামাতি, ওয়ামিং সাররি ফিতনাতিল্ মাসীহি’দ্-দাজ্জাল।
অর্থঃ হে আল্লাহ! তুমি আমাকে কাবরের আযাব থেকে রক্ষা করো,আমাকে জাহান্নামের আযাব, এবং দুনিয়ার ফিৎনা ও মৃত্যুর ফেতনা এবং দাজ্জালের ফিৎনা থেকে রক্ষা করো।
বুখারী ২১০২, মুসলিম ১/৪১২, হিসনুল মুসলিম, পৃষ্ঠা – ৯০।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) দুয়া মাসুরা হিসেবে এই দুয়া পড়তে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন।
২. কবীরা গুনাহ, যেইগুলো বড়বড় পাপকাজ, সেইগুলো যে কারনে ক্বুরান ও সহীহ হাদীসে কঠিন শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে, সেইগুলো বর্জন করা ও আল্লাহর বেঁধে দেওয়া ফরয ও ওয়াজিব হুকুম পালনে যত্নবান হওয়া।
৩. সুরা মুলক
প্রতিদিন সুরা মুলক তেলাওয়াত করলে আশা করা যায় আল্লাহর রহমতে কবরের আজাব ও কেয়ামতের দিন শাস্তি থেকেনিরাপদ থাকা যাবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি প্রতিদিন রাতের বেলা তাবারাকাল্লাযী বিয়াদিহিল মুলক (সুরা মুলক)তেলাওয়াত করবে আল্লাহ তাকে কবরের আজাব থেকে রক্ষা করবেন। রাসুলুল্লাহ সাঃ এর যামানায় এই সুরাটিকে আমরা“আল-মা’আনিয়াহ” বা সুরক্ষাকারী বলতাম। যে রাতের বেলা এই সুরাটি পড়বে সে খুব ভালো একটা কাজ করলো”।
সুনানে আন-নাসায়ী ৬/১৭৯, শায়খ আলবানীর মতে হাদীসটি হাসান সহীহ, সহীহ আত-তারগীব ওয়াল তারহীব ১৪৭৫।
এই সুরা প্রত্যেকদিন রাতের বেলা তেলাওয়াত করলে কিয়ামতের দিন শাফায়াত করে জান্নাতে নিয়ে যাবে ইন শা’ আল্লাহঃ
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেনঃ “কুরআনে এমন একটা সুরা আছে যার মধ্যে ৩০টা আয়াত রয়েছে যেটা একজন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করবে এবং তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর সেটা হলো তাবারাকাল্লাযী বিয়াদিহিল মুলকু (সুরা মুলক)”।
সুনানে আত-তিরমিযী ২৮৯১, সুনানে আবু দাউদ ১৪০০, মুসনাদের আহমাদ, ইবনে মাজাহ ৩৭৮৬।
ইমাম তিরমিযী বলেছেন হাদীসটি হাসান, ইবনে তাইমিয়্যা বলেছেন সহীহ মাজমু ২২/২২৭, শায়খ আলবানীর মতে হাদীসটি সহীহ, সহীহ তিরমিযী ৩/৬, সহীহ ইবনে মাজাহ ৩০৫৩।
বিঃদ্রঃ এইখানে তেলাওয়াত মানে শুধু তোতা পাখির মতো রিডিং পড়ে যাওয়া না। এই প্রসংগে সউদী আরবের স্থায়ী ফতোয়া বোর্ডের আলেমদের ফতোয়া হচ্ছেঃ “এই হাদীসগুলোর আলোকে বলা যায়ঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সুরা মুলক বিশ্বাস করবে ও তেলাওয়াত করবে, এই সুরাতে যে শিক্ষা দেওয়া আছে তা গ্রহণ করবে এবং যে হুকুম আহকাম দেওয়া আছে সেইগুলো মেনে চলবে কেয়ামতের দিন তার জন্য এই সুরাটি শাফায়াত করবে”।
ফতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দায়িমাহ ৪/৩৩৩-৩৩৫।
কিতাবুল ইমান : প্রবন্ধ নং- ৩১ : কবরের আজাব
কবরের আজাব
কবরের পরীক্ষার প্রতি ঈমান আনার পাশাপাশি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংবাদ মুতাবেক, কবরের আজাব ও নেয়ামতসমূহের ওপরও আমাদের ঈমান আনতে হবে।
কবরের আজাবের ব্যাপারে আল-কোরানের দলিল,
فَوَقَاهُ اللَّهُ سَيِّئَاتِ مَا مَكَرُوا وَحَاقَ بِآَلِ فِرْعَوْنَ سُوءُ الْعَذَابِ. النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آَلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ.
‘অতঃপর তাদের ষড়যন্ত্রের অশুভ পরিণাম থেকে আল্লাহ তাকে রক্ষা করলেন আর ফির‘আউনের অনুসারীদেরকে ঘিরে ফেলল কঠিন আজাব। তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় আগুনের সামনে উপিস্থত করা হয়’ – (সূরা গাফের , ৪৫)।
প্রথমত, সকাল-সন্ধ্যায় আগুনের সামনে উপস্থিত করা হয়, ইরশাদ হয়েছে,‘النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا ‘তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় আগুনের সামনে উপিস্থত করা হয়’-এ আয়াতাংশটি যার প্রতি ইঙ্গিত করছে।
দ্বিতীয়ত, যার প্রতি- يَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آَلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ ‘যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে ( সেদিন ঘোষণা করা হবে), ‘ফিরউনের অনুসারীদেরকে কঠোরতম আজাবে প্রবেশ করাও।’-এ আয়াতাংশ ইঙ্গিত করছে। দ্বিতীয়টিকে প্রথমটির সঙ্গে আত্ফ (সংযোজন) করা হয়েছে। আর ব্যাকরণ অনুযায়ী মা‘তুফ (সংযোজিত) মা‘তুফ আলাইহি (যার সঙ্গে সংযোজন করা হয়) থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। অতএব প্রথম আয়াতাংশে ইঙ্গিতকৃত আজাব থেকে দ্বিতীয় আয়াতাংশে ইঙ্গিতকৃত আজাব ভিন্ন হওয়াটাই ব্যাকরণগত দাবি। তাই, দ্বিতীয় আজাবটি যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পরে সংঘটিত হয়, তাহলে প্রথম আজাবটি অবশ্যই মৃত্যু থেকে পুনরুত্থানের সময়সীমার মধ্যে হবে। আর তা হলো কবরের আজাব।
মৃত্যুর পরের আজাবের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন ,
وَلَوْ تَرَى إِذِ الظَّالِمُونَ فِي غَمَرَاتِ الْمَوْتِ وَالْمَلَائِكَةُ بَاسِطُو أَيْدِيهِمْ أَخْرِجُوا أَنْفُسَكُمُ الْيَوْمَ تُجْزَوْنَ عَذَابَ الْهُونِ بِمَا كُنْتُمْ تَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ غَيْرَ الْحَقِّ وَكُنْتُمْ عَنْ آَيَاتِهِ تَسْتَكْبِرُونَ
‘আর যদি তুমি দেখতে, যখন যালিমরা মৃত্যু কষ্টে থাকে, এমতাবস্থায় ফেরেশতারা তাদের হাত প্রসারিত করে আছে (তারা বলে), ‘তোমাদের জান বের কর। আজ তোমাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে লাঞ্ছনার আজাব, কারণ তোমরা আল্লাহর উপর অসত্য বলতে এবং তোমরা তার আয়াতসমূহ সম্পর্কে অহংকার করতে’ – (সূরা আল আনআম , ৯৩)।
ইবনে আববাস (রাযি.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,‘এটা হলো মৃত্যুর সময়। হাত প্রসারিত করার অর্থ প্রহার করা- ফেরেশতারা তাদের চেহারায় ও পশ্চাতে প্রহার করবে। ইবনে হাজার (রাযি.) বলেন, যুদ্ধ বিষয়ক সূরার একটি আয়াত এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। আয়াতটি হলো,
فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ
‘অতঃপর তাদের অবস্থা কেমন হবে, যখন ফেরেশতারা তাদের মুখমন্ডল ও পৃষ্ঠদেশসমূহে আঘাত করতে করতে তাদের জীবনাবসান ঘটাবে?’ (সূরা মুহাম্মাদ , ২৭)।
এরপর তিনি বলেছেন, (যদি দাফনের পূর্বেও আজাব দেয়া হয়, তবে তাও ওই আযাবের মধ্যে শামিল হবে, যা কিয়ামতের পূর্বে দেয়া হবে। কেননা, এ জাতীয় আজাবকে কবরের সঙ্গে এ জন্য সম্পৃক্ত করা হয়েছে যে, তার অধিকাংশই সংঘটিত হবে কবরে)। [ফাতহুল বারী ৩/১৮০]
কবরের আজাব প্রমাণ করে, এমন হাদিসের সংখ্যা এত বেশি যে, সব মিলিয়ে তা মুতাওয়াতির পর্যায়ের, অর্থাৎ যার প্রামাণিকতা সন্দেহাতীত। ইমাম নববী র. সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেন,‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের মাযহাব হলো, কবরের আযাবের সত্যতার প্রতি বিশ্বাস করা। কবরের আজাব সম্পর্কে কোরান সুন্নাহর বহু প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا
‘তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় আগুনের সামনে উপিস্থিত করা হয়’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে একদল সাহাবীর (রাযি.) বর্ণনায়, বিভিন্ন উপলক্ষে, এ বিষয়ক হাদিস উল্লিখিত হয়েছে। পাশাপাশি, মানুষের শরীরের কোনো অংশ অকেজো হয়ে গেলে তাতে পুনরায় জীবনসম্পন্দন ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা মানববুদ্ধি অস্বীকার করে না। আর যা মানববুদ্ধি অস্বীকার করে না এবং শরীয়তও যা মানার ব্যাপারে তাগিদ করে, তা বিশ্বাস করা এবং মেনে নেয়া অত্যাবশ্যক। [দেখুন শারহুন নববি আলা সহীহি মুসলিম ১৭/২০০-২০১]
যাদের কবরে আজাব হচ্ছে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এমন ব্যক্তিদের কবরের আজাব শোনা, আহলে কুলাইব-এর সঙ্গে তাঁর কথা বলা। ‘তোমরা তাদের চেয়ে অধিক শ্রবণকারী নও’ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কথা বলা, মৃত ব্যক্তি নাজাতপ্রাপ্তদের মধ্যে হলে তার কবর প্রশস্ত হয়ে যাওয়া, জান্নাত ও জাহান্নামে মৃত ব্যক্তির অবস্থানের জায়গা দেখিয়ে দেয়া ইত্যাদি প্রমাণ করে সহিহ মুসলিমে বহু হাদিস এসেছে। [দেখুন মুসলিম, আস-সহিহ (নববীর ব্যাখ্যাসহ) ১৭/২০০-২০৭ ] সহিহ মুসলিমে যেসব হাদিস উল্লিখিত হয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা বনী নাজ্জারের একটি বাগানে একটি গাধীর ওপর আরোহিত অবস্থায় ছিলেন। আমরাও তাঁর সঙ্গে ছিলাম। গাধীটি হঠাৎ এমনভাবে পথ থেকে দূরে চলে গেল যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ফেলে দেয়ার উপক্রম করল। দেখা গেল যে সেখানে ছয়জন অথবা পাঁচজন অথবা চারজনের একটি কবর রয়েছে। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এ কবরগুলোয় কারা শায়িত আছে, তোমরা কি কেউ চেন? এক ব্যক্তি বলল, আমি চিনি। তিনি বললেন, এরা কবে মারা গিয়েছে? লোকটি বলল, এরা মুশরিক অবস্থায় মারা গিয়েছে। তিনি বললেন, এই উম্মতকে কবরে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। আমার যদি আশঙ্কা না হত যে, তোমরা ভয়ে মারা যাবে, তাহলে আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম, যাতে তিনি তোমাদের কবরের আজাব শোনান যেভাবে আমি শুনি। এরপর তিনি বললেন, তোমরা আল্লাহর কাছে কবরের আজাব থেকে পানাহ চাও। তারা বললেন, আমরা আল্লাহর কাছে কবরের আজাব থেকে পানাহ চাই। তিনি বললেন, তোমরা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ফেতনা থেকে পানাহ চাও। তারা বললেন, আমরা প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য ফেতনা থেকে পানাহ চাই। তিনি বললেন, দাজ্জালের ফিতনা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও। তারা বললেন, আমরা দাজ্জালের ফেতনা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। [মুসলিম, আস-সহিহ (নববীর ব্যাখ্যাসহ) ১৭/২০০-২০১]
ইবনে আববাস (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুটি কবরের পাশ দিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, এ কবরবাসীদ্বয়ের আজাব হচ্ছে। অবশ্য বড় কোনো পাপের কারণে তাদের আজাব হচ্ছে না। এরপর তিনি বললেন, হ্যাঁ, এদের একজন কথা চালাচালি করত। আর অন্যজন তার পেশাব গায়ে-কাপড়ে লেগে যাওয়া থেকে সতর্কতা অবলম্বন করত না। [বুখারি ও মুসলিম]
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন মারা যায় তখন সকাল- বিকাল তার স্থানটি দেখানো হয়। যদি সে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে তবে জান্নাতবাসীদের মধ্যে। আর যদি জাহান্নামবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে তবে জাহান্নামবাসীদে মধ্যে। অতঃপর তাকে বলা হয়, এটা তোমার স্থান কিয়ামত পর্যন্তের জন্য।’ [বুখারি ও মুসলিম]
কবরের আজাব ও নিয়ামতের বিস্তারিত ধরন-ধারণ কী, কীভাবে মৃতব্যক্তির মধ্যে রূহ ফিরে আসে, ইত্যাদির ক্ষেত্রে সহিহ হাদিসে যেটুকু পাওয়া যায় সেটুকুতে বিশ্বাস করাই হলো আমাদের কর্তব্য এবং এর ওপর অতিরিক্ত কিছু বাড়িয়ে বিশ্বাস করা বৈধ নয়। ‘আল আকীদা আত্-তাহাবিয়া’র ব্যাখ্যাকার বলেন,‘কবরের আজাব ও নিয়ামত- যে যেটার উপযোগী-এবং দুই ফেরেশতার প্রশ্ন ইত্যাদি প্রমাণে বহু হাদিস এসেছে। অতএব এ ব্যাপারে ঈমান আনা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। তবে তার ধরন-ধারণ কী, সে ব্যাপারে আমরা কথা বলব না; কারণ বিষয়টি মানববুদ্ধির আওতাভুক্ত নয়। এ ব্যাপারে মানববুদ্ধির আদৌ কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। আর মানববুদ্ধি যা অসম্ভব মনে করে তা নিয়ে শরীয়তও নাযিল হয় না। তবে মানববুদ্ধি যে ব্যাপারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়, সে ব্যাপারে শরীয়ত আসতে পারে। মানুষের শরীরে আত্মা ফিরে আসা, দুনিয়ায় আমরা যেভাবে দেখি সেভাবে নাও হতে পারে। বরং দুনিয়ার পরিচিত পদ্ধতির বাইরে অন্যকোনো পদ্ধতিতে তার মধ্যে রুহ ফিরে আসতে পারে।
আরেকটি বিষয় আমাদের জানা প্রয়োজন। আর তা হলো, কবরের আজাবই হলো বরযখ-জীবনের আজাব। অতএব যে ব্যক্তি আযাবের হকদার হয়ে মারা গেল, সে আযাবের মুখোমুখি হবে, চাই তাকে কবর দেয়া হোক বা না হোক। চাই তাকে হিংস্র কোনো প্রাণী খেয়ে ফেলুক অথবা পুড়ে গিয়ে ছাই হয়ে যাক, বা বাতাসে উড়ে যাক। চাই তাকে শুলিতে চড়ানো হোক অথবা সাগরে ডুবে মৃত্যুবরণ করে থাকুক। অর্থাৎ মৃত্যুর পর সে যে অবস্থাতেই থাক না-কেন, তার শরীর ও আত্মায় আজাব পৌঁছবে, যেভাবে পৌঁছে কবরস্থ ব্যক্তির কাছে। মৃতব্যক্তিকে বসানো, তার পাঁজরের হাড় পরস্পরে ঢুকে যাওয়া ইত্যাদির দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে অর্থ উদ্দেশ্য করেছেন, সে অর্থেই আমাদের তা নিতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো অতিরঞ্জন অথবা বাতিলকরণ শুদ্ধ হবে না। অতএব তার কথা এমন অর্থে নেয়া যাবে না, যা তা বহন করে না। আবার তিনি তাঁর কথা দ্বারা যে হিদায়েত ও বয়ান উদ্দেশ্য করেছেন, তা থেকে কোনো কিছু বাতিল করে দেওয়াও শুদ্ধ হবে না। [শারহুল আকীদা আত্-তাহাবিয়্যাহ পৃ. ৪৫১-৪৫২]
ইবনুল কাইয়েম র. বলেন,‘এ উম্মতের উত্তম পূর্বপুরুষ ও ইমামদের মাযহাব হলো, যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায়, সে তখন নেয়ামত অথবা আযাবে থাকে। আর তা ব্যক্তির আত্মা ও শরীর উভয়টির জন্যই। এরপর যখন বড় কেয়ামত কায়েম হবে আত্মাকে শরীরে ফিরিয়ে দেয়া হবে। মানুষ তখন রাববুল আলামীনের জন্য কবর থেকে উঠে দাঁড়াবে। শরীরের এই পুনরুত্থান বিষয়ে মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিষ্টান সবাই একমত।
মূল : ড. মুহাম্মাদ নাঈম ইয়াসিন
বাংলা অনুবাদ : ড. মাওলানা শামসুল হক সিদ্দিক