একটি সংশয় ও তার জওয়াব :

৭৫ হ’তে ৮২ পর্যন্ত ৮টি আয়াতে যে বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে, এটি ইবরাহীমের শিশুকালে জ্ঞান-বুদ্ধির বয়স হবার সময়কার ঘটনা, নাকি নবী হবার পরের তর্কানুষ্ঠান, এ বিষয়ে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। ইবনু জারীর (মৃঃ ৩১০ হিঃ) প্রথমোক্ত মত পোষণ করেন। তিনি এ বিষয়ে আলী ইবনে ত্বালহার সূত্রে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনা পেশ করেছেন। তবে এই বর্ণনাটির সনদ যঈফ।[7]
মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব (৮৫-১৫০ হিঃ) বর্ণিত কিছু অলৌকিক ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে, যা উক্ত মতকে সমর্থন করে। যেমন বাদশাহ নমরূদ যখন জানতে পারেন যে, অচিরেই একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করবে, যে তার রাজ্য হারানোর কারণ হবে, তখন তিনি নবজাতক সকল পুত্র সন্তানকে হত্যা করার নির্দেশ জারি করেন। ইবরাহীমের মা তখন একটি পাহাড়ের গোপন গুহায় লুকিয়ে ইবরাহীমকে প্রসব করেন এবং ইবরাহীম একাকী সেখানে বড় হন। ইবরাহীমের এক আঙ্গুল দিয়ে দুধ বের হ’ত, এক আঙ্গুল দিয়ে মধু বের হ’ত ও এক আঙ্গুল দিয়ে পানি বের হ’ত। এভাবে তিনি সেখানে তিন বছর কাটান। তারপর তিনি সেখান থেকে বের হয়ে এসে মাকে বলেন, আমার প্রভু কে? মা বললেন, নমরূদ। তিনি বললেন, নমরূদের প্রভু কে? তখন মা তাকে চড় মারলেন এবং তিনি বুঝলেন এটিই হ’ল সেই ছেলে, যার সম্পর্কে বাদশাহ নমরূদ আগেই স্বপ্ন দেখেছেন। সুদ্দী, যাহহাক প্রমুখের বরাতে কাসাঈ স্বীয় ক্বাছাছুল আম্বিয়ার মধ্যে এ ধরনের অনেক অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করেছেন (ইবনু কাছীর, কুরতুবী)। অতঃপর ইবরাহীম গুহা থেকে বের হয়ে প্রথম তারকা দেখলেন, তারপর চন্দ্র দেখলেন, তারপর সূর্য দেখলেন। অতঃপর সবকিছুর ডুবে যাওয়া দেখে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, প্রকৃত পালনকর্তা তিনি, যিনি এগুলিকে সৃষ্টি করেছেন (কুরতুবী)। ইবনু জারীর দলীল এনেছেন ইবরাহীমের একথা দ্বারা, যেখানে তিনি বলেছেন, لَئِن لَّمْ يَهْدِنِي رَبِّي لأكُونَنَّ مِنَ الْقَوْمِ الضَّالِّينَ، ‘যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ না দেখান, তাহ’লে অবশ্যই আমি পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (আন‘আম ৬/৭৭)।
ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) বলেন, বরং সঠিক কথা এই যে, ইবরাহীমের উপরোক্ত ঘটনা ছিল তার কওমের সাথে একটি তর্কানুষ্ঠান মাত্র। এটি কখনোই তার শিশুকালের ঘটনা নয় এবং তিনি ক্ষণিকের তরেও কখনো মুশরিক হননি। কেননা তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتاً لِلّهِ حَنِيفاً وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ، ‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একটি উম্মত এবং আল্লাহর প্রতি অনুগত ও একনিষ্ঠ। আর তিনি কখনোই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’ (নাহল ১৬/১২০)। তাছাড়া প্রত্যেক মানব শিশুই জন্মগতভাবে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, خَلَقْتُ عبادى حُنَفَاءَ ‘আমি আমার বান্দাদের সৃষ্টি করি আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হিসাবে’।[8] সাধারণ মানবশিশু যদি এরূপ হয়, তাহ’লে শিশু ইবরাহীম কেন মুশরিক হবেন? আর এটা যে কওমের নেতাদের সাথে তাঁর একটি তর্কানুষ্ঠান ছিল, তার বড় প্রমাণ এই যে, ৮০ নং আয়াতে বলা হয়েছে وَحَآجَّهُ قَوْمُهُ ‘তাঁর কওম তাঁর সাথে বিতর্ক করল’। তাছাড়া তর্ক শেষে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, يَا قَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُونَ، ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসব বিষয়কে শরীক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত’ (আন‘আম ৬/৭৮)।
বলা বাহুল্য তারকা পূজারী নেতাদের সাথে ইবরাহীম (আঃ)-এর বিতর্কের ঘটনাটি কুরআন অত্যন্ত উঁচুমানের আলংকরিক ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছে, যা একটি বাস্তব ও অতুলনীয় বাণীচিত্রের রূপ ধারণ করেছে। যেমন ইবরাহীম (আঃ) উক্ত নেতাদের বলছেন, তোমাদের ধারণা অনুযায়ী ধরে নিলাম আকাশের ঐ নক্ষত্র, চন্দ্র ও সূর্য সকলেই ‘আমার রব’। কিন্তু ওরা যে ডুবে গেল। যারা নিজেরা ডুবে যায়, তারা আমাকে বা তোমাদেরকে কিভাবে রক্ষা করবে? অতএব আমি তোমাদের শিরকী আক্বীদা হ’তে মুক্ত। আমি এদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ ও অনুগত রইলাম। তোমরাও এদিকে ফিরে এসো। যেমন ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ মুশরিকদের ডেকে বলবেন, أَيْنَ شُرَكَائِيَ الَّذِينَ كُنتُمْ تَزْعُمُونَ ‘তোমাদের ধারণা অনুযায়ী আমার শরীকরা কোথায়? (ক্বাছাছ ২৮/৬২)। অর্থাৎ তোমাদের দাবী অনুযায়ী ওরা আমার শরীক। অথচ আল্লাহর কোন শরীক নেই।
ইবরাহীম মূর্তি ভাঙ্গলেন :

জ্ঞানীদের ইশারাই যথেষ্ট। কিন্তু মানুষ যখন কোন কিছুর প্রতি অন্ধভক্তি পোষণ করে, তখন শত যুক্তিও কোন কাজ দেয় না। ফলে ইবরাহীম ভাবলেন, এমন কিছু একটা করা দরকার, যাতে পুরা সমাজ নড়ে ওঠে ও ওদের মধ্যে হুঁশ ফিরে আসে। সাথে সাথে তাদের মধ্যে তাওহীদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। সেমতে তিনি সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় দেবমন্দিরে গিয়ে মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলার সংকল্প করলেন।
ইবরাহীম (আঃ)-এর সম্প্রদায় বছরের একটা বিশেষ দিনে উৎসব পালন করত ও সেখানে নানারূপ অপচয় ও অশোভন কাজ করত। যেমন আজকাল প্রবৃত্তি পূজারী ও বস্ত্তবাদী লোকেরা করে থাকে কথিত সংস্কৃতির নামে। এইসব মেলায় সঙ্গত কারণেই কোন নবীর যোগদান করা সম্ভব নয়। কওমের লোকেরা তাকে উক্ত মেলায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানালো। কিন্তু তিনি অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে সেখানে যেতে অপারগতা প্রকাশ করলেন (ছাফফাত ৩৭/৮৯)। অতঃপর তিনি ভাবলেন, আজকের এই সুযোগে আমি ওদের দেবমন্দিরে প্রবেশ করে মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেব। যাতে ওরা ফিরে এসে ওদের মিথ্যা উপাস্যদের অসহায়ত্বের বাস্তব দৃশ্য দেখতে পায়। হয়তবা এতে তাদের অনেকের মধ্যে হুঁশ ফিরবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান জাগ্রত হবে ও শিরক থেকে তওবা করবে।
অতঃপর তিনি দেবালয়ে ঢুকে পড়লেন ও দেব-দেবীদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, (তোমাদের সামনে এত নযর-নেয়ায ও ভোগ-নৈবেদ্য রয়েছে)। অথচ ‘তোমরা তা খাচ্ছ না কেন? কি ব্যাপার তোমরা কথা বলছ না কেন? তারপর তিনি ডান হাতে রাখা (সম্ভবতঃ কুড়াল দিয়ে) ভীষণ জোরে আঘাত করে সবগুলোকে গুঁড়িয়ে দিলেন (ছাফফাত ৩৭/৯১-৯৩)। তবে বড় মূর্তিটাকে পূর্বাবস্থায় রেখে দিলেন, যাতে লোকেরা তার কাছে ফিরে যায় (আম্বিয়া ২১/৫৮)।
মেলা শেষে লোকজন ফিরে এল এবং যথারীতি দেবমন্দিরে গিয়ে প্রতিমাগুলির অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গেল। ‘তারা বলাবলি করতে লাগল, এটা নিশ্চয়ই ইবরাহীমের কাজ হবে। কেননা তাকেই আমরা সবসময় মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে বলতে শুনি। অতঃপর ইবরাহীমকে সেখানে ডেকে আনা হ’ল এবং জিজ্ঞেস করল, أَأَنتَ فَعَلْتَ هَذَا بِآلِهَتِنَا يَا إِبْرَاهِيمُ؟ ‘হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ আচরণ করেছ’? (আম্বিয়া ২১/৬২)।
ইবরাহীম বললেন, بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا فَاسْأَلُوهُمْ إِنْ كَانُوا يَنْطِقُوْنَ- ‘বরং এই বড় মূর্তিটাই একাজ করেছে। নইলে এদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তারা কথা বলতে পারে’ (আম্বিয়া ২১/৬৩)। সম্প্রদায়ের নেতারা একথা শুনে লজ্জা পেল এবং মাথা নীচু করে বলল, قَدْ عَلِمْتَ مَا هَؤُلاَء يَنْطِقُوْنَ- ‘তুমি তো জানো যে, এরা কথা বলে না’। ‘তিনি বললেন, قَالَ أَفَتَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لاَ يَنفَعُكُمْ شَيْئاً وَّلاَ يَضُرُّكُمْ- ‘তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর, যা তোমাদের উপকারও করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না’ (আম্বিয়া ২১/৬৫-৬৬)। তিনি আরও বললেন,قَالَ أَتَعْبُدُونَ مَا تَنْحِتُونَ، وَالله خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ- ‘তোমরা এমন বস্ত্তর পূজা কর, যা তোমরা নিজ হাতে তৈরী কর’? ‘অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে ও তোমাদের কর্মসমূহকে সৃষ্টি করেছেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৫-৯৬)।أُفٍّ لَّكُمْ وَلِمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللهِ أَفَلاَ تَعْقِلُونَ- ‘ধিক তোমাদের জন্য এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাদের পূজা কর, ওদের জন্য। তোমরা কি বুঝ না’? (আম্বিয়া ২১/৬৭)।
তারপর যা হবার তাই হ’ল। যিদ ও অহংকারের বশবর্তী হয়ে সম্প্রদায়ের নেতারা ইবরাহীমকে চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করল। তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, একে আর বাঁচতে দেওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, একে এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে মারতে হবে, যেন কেউ এর দলে যেতে সাহস না করে। তারা তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার প্রস্তাব গ্রহণ করল এবং সেটা বাদশাহ নমরূদের কাছে পেশ করল। সম্রাটের মন্ত্রী ও দেশের প্রধান পুরোহিতের ছেলে ইবরাহীম। অতএব তাকে সরাসরি সম্রাটের দরবারে আনা হ’ল।
নমরূদের সঙ্গে বিতর্ক ও অগ্নিপরীক্ষা :

ইবরাহীম (আঃ) এটাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তাওহীদের দাওয়াত দেওয়ার সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করলেন। নমরূদ ৪০০ বছর ধরে রাজত্ব করায় সে উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে উঠেছিল এবং নিজেকে একমাত্র উপাস্য ভেবেছিল। তাই সে ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করল, বল তোমার উপাস্য কে? নমরূদ ভেবেছিল, ইবরাহীম তাকেই উপাস্য বলে স্বীকার করবে। কিন্তু নির্ভীক কণ্ঠে ইবরাহীম জবাব দিলেন, رَبِّيَ الَّذِيْ يُحْيِـيْ وَيُمِيْتُ ‘আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি মানুষকে বাঁচান ও মারেন’। মোটাবুদ্ধির নমরূদ বলল, أَنَا أُحْيِـيْ وَأُمِيْتُ ‘আমিও বাঁচাই ও মারি’। অর্থাৎ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে খালাস দিয়ে মানুষকে বাঁচাতে পারি। আবার খালাসের আসামীকে মৃত্যুদন্ড দিতে পারি। এভাবে সে নিজেকেই মানুষের বাঁচা-মরার মালিক হিসাবে সাব্যস্ত করল। ইবরাহীম তখন দ্বিতীয় যুক্তি পেশ করে বললেন, فَإِنَّ اللهَ يَأْتِيْ بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ ‘আমার আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন, আপনি তাকে পশ্চিম দিক হ’তে উদিত করুন’। فَبُهِتَ الَّذِيْ كَفَرَ ‘অতঃপর কাফের (নমরূদ) এতে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮)।
কওমের নেতারাই যেখানে পরাজয়কে মেনে নেয়নি, সেখানে দেশের একচ্ছত্র সম্রাট কেন পরাজয়কে মেনে নিবেন। যথারীতি তিনিও অহংকারে ফেটে পড়লেন এবং ইবরাহীমকে জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নির্দেশ জারি করলেন। সাথে সাথে জনগণকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বললেন, حَرِّقُوهُ وَانصُرُوا آلِهَتَكُمْ إِنْ كُنتُمْ فَاعِلِيْنَ ‘তোমরা একে পুড়িয়ে মার এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৮)। উল্লেখ্য যে, কুরআন কোথাও নমরূদের নাম উল্লেখ করেনি এবং সে যে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ উপাস্য’ দাবী করেছিল, এমন কথাও স্পষ্টভাবে বলেনি। তবে ‘আমিও বাঁচাতে পারি ও মারতে পারি’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮) তার এই কথার মধ্যে তার সর্বোচ্চ অহংকারী হবার এবং ইবরাহীমের ‘রব’-এর বিপরীতে নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করায় সে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ রব’ হিসাবে ধারণা করেছিল বলে প্রতীয়মান হয়। প্রধানত: ইস্রাঈলী বর্ণনাসমূহের উপরে ভিত্তি করেই ‘নমরূদ’-এর নাম ও তার রাজত্ব সম্পর্কে জানা যায়। কুরআন কেবল অতটুকুই বলেছে, যতটুকু মানব জাতির হেদায়াতের জন্য প্রয়োজন।
যুক্তিতর্কে হেরে গিয়ে নমরূদ ইবরাহীম (আঃ)-কে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হুকুম দিল। অতঃপর তার জন্য বিরাটাকারের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন, وَأَرَادُوْا بِهِ كَيْداً فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَخْسَرِيْنَ، ‘তারা ইবরাহীমের বিরুদ্ধে মহা ফন্দি অাঁটতে চাইল। অতঃপর আমরা তাদেরকেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম’ (আম্বিয়া ২১/৭০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَسْفَلِينَ، ‘আমরা তাদেরকে পরাভূত করে দিলাম’ (ছাফফাত ৩৭/৯৮)।
অতঃপর ‘একটা ভিত নির্মাণ করা হ’ল এবং সেখানে বিরাট অগ্নিকুন্ড তৈরী করা হ’ল। তারপর সেখানে তাকে নিক্ষেপ করা হ’ল’ (ছাফফাত ৩৭/৯৭)। ছহীহ বুখারীতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপের সময় ইবরাহীম (আঃ) বলে ওঠেন, حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ، ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’।[9]
একই প্রার্থনা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) করেছিলেন, ওহোদ যুদ্ধে আহত মুজাহিদগণ যখন শুনতে পান যে, আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরে না গিয়ে পুনরায় ফিরে আসছে মদীনায় মুসলিম শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, তখন ‘হামরাউল আসাদে’ উপনীত তার পশ্চাদ্ধাবনকারী ৭০ জন আহত ছাহাবীর ক্ষুদ্র দল রাসূলের সাথে সমস্বরে বলে উঠেছিল حَسْبُنَا اللّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيْلُ، ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’ ঘটনাটি কুরআনেও বর্ণিত হয়েছে’।[10] এভাবে পিতা ইবরাহীম ও পুত্র মুহাম্মাদের বিপদ মুহূর্তের বক্তব্যে শব্দে শব্দে মিল হয়ে যায়। তবে সার্বিক প্রচেষ্টার সাথেই কেবল উক্ত দো‘আ পাঠ করতে হবে। নইলে কেবল দো‘আ পড়ে নিষ্ক্রিয় বসে থাকলে চলবে না। যেমন ইবরাহীম (আঃ) সর্বোচ্চ পর্যায়ে দাওয়াত দিয়ে চূড়ান্ত বিপদের সময় এ দো‘আ করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিরোধী পক্ষের সেনাপতি আবু সুফিয়ানের পশ্চাদ্ধাবনের পরেই উক্ত দো‘আ পড়েছিলেন।

বস্ত্ততঃ এই কঠিন মুহূর্তের পরীক্ষায় জয়লাভ করার পুরস্কার স্বরূপ সাথে সাথে আল্লাহর নির্দেশ এল قُلْنَا يَا نَارُ كُونِيْ بَرْداً وَّسَلاَماً عَلَى إِبْرَاهِيمَ، ‘হে আগুন! ঠান্ডা হয়ে যাও এবং ইবরাহীমের উপরে শান্তিদায়ক হয়ে যাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৯)। অতঃপর ইবরাহীম মুক্তি পেলেন।
অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইবরাহীম (আঃ) ফিরে আসেন এবং এভাবে আল্লাহ কাফিরদের সমস্ত কৌশল বরবাদ করে দেন। এরপর শুরু হ’ল জীবনের আরেক অধ্যায়।
হিজরতের পালা :

ইসলামী আন্দোলনে দাওয়াত ও হিজরত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তৎকালীন পৃথিবীর সমৃদ্ধতম নগরী ছিল বাবেল, যা বর্তমানে ‘বাগদাদ’ নামে পরিচিত।[11] তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে এবং মূর্তিপূজারী ও তারকাপূজারী নেতাদের সাথে তর্কযুদ্ধে জয়ী হয়ে অবশেষে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে ইবরাহীমের দাওয়াত ও তার প্রভাব সকলের নিকটে পৌঁছে গিয়েছিল। যদিও সমাজপতি ও শাসকদের অত্যাচারের ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ ইসলাম কবুলের ঘোষণা দেয়নি। কিন্তু তাওহীদের দাওয়াত তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল এবং তা সাধারণ জনগণের হৃদয়ে আসন গেড়ে নিয়েছিল।
অতএব এবার অন্যত্র দাওয়াতের পালা। ইবরাহীম (আঃ) সত্তরোর্ধ্ব বয়সে অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হন। এই দীর্ঘ দিন দাওয়াত দেওয়ার পরেও নিজের স্ত্রী সারাহ ও ভাতিজা লূত ব্যতীত কেউ প্রকাশ্যে ঈমান আনেনি। ফলে পিতা ও সম্প্রদায় কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি আল্লাহর হুকুমে হিজরতের সিদ্ধান্ত নেন। যাওয়ার পূর্বে তিনি নিজ সম্প্রদায়কে ডেকে যে বিদায়ী ভাষণ দেন, তার মধ্যে সকল যুগের তাওহীদবাদী গণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় লুকিয়ে রয়েছে।
ইবরাহীমের হিজরত-পূর্ব বিদায়ী ভাষণ:

আল্লাহর ভাষায়, قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوْا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآؤُا مِنكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَداً حَتَّى تُؤْمِنُوْا بِاللهِ وَحْدَهُ إِلاَّ قَوْلَ إِبْرَاهِيْمَ لِأَبِيْهِ لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللهِ مِنْ شَيْءٍ، رَبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ-
‘তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, আমরা সম্পর্ক ছিন্ন করছি তোমাদের সাথে এবং তাদের সাথে যাদেরকে তোমরা পূজা কর আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে। আমরা তোমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করছি এবং আমাদের ও তোমাদের মাঝে স্থায়ী শত্রুতা ও বিদ্বেষ বিঘোষিত হ’ল যতদিন না তোমরা কেবলমাত্র এক আল্লাহর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করবে। … প্রভু হে! আমরা কেবল তোমার উপরেই ভরসা করছি এবং তোমার দিকেই মুখ ফিরাচ্ছি ও তোমার নিকটেই আমাদের প্রত্যাবর্তন স্থল’ (মুমতাহানাহ ৬০/৪)। এরপর তিনি কওমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, إِنِّي ذَاهِبٌ إِلَى رَبِّي سَيَهْدِيْنِ، ‘আমি চললাম আমার প্রভুর পানে, সত্বর তিনি আমাকে পথ দেখাবেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৯)। অতঃপর তিনি চললেন দিশাহীন যাত্রাপথে।
আল্লাহ বলেন, وَنَجَّيْنَاهُ وَلُوطاً إِلَى الْأَرْضِ الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا لِلْعَالَمِيْنَ، ‘আর আমরা তাকে ও লূতকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম সেই দেশে, যেখানে বিশ্বের জন্য কল্যাণ রেখেছি’ (আম্বিয়া ২১/৭১)। এখানে তাঁর সাথী বিবি সারা-র কথা বলা হয়নি নারীর গোপনীয়তা রক্ষার শিষ্টাচারের প্রতি খেয়াল করে। আধুনিক নারীবাদীদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী সারা ও ভাতিজা লূতকে পথ প্রদর্শন করে নিয়ে গেলেন পার্শ্ববর্তী দেশ শাম বা সিরিয়ার অন্তর্গত বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অদূরে কেন‘আন নামক স্থানে, যা এখন তাঁর নামানুসারে ‘খালীল’ (الخليل ) নামে পরিচিত হয়েছে। ঐ সময় সেখানে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অস্তিত্ব ছিল না। এখানেই ইবরাহীম (আঃ) বাকী জীবন অতিবাহিত করেন ও এখানেই কবরস্থ হন। এখানে হিজরতের সময় তাঁর বয়স ৮০ থেকে ৮৫-এর মধ্যে ছিল এবং বিবি সারা-র ৭০ থেকে ৭৫-এর মধ্যে। সঙ্গী ভাতিজা লূতকে আল্লাহ নবুঅত দান করেন ও তাকে পার্শ্ববর্তী সমৃদ্ধ নগরী সাদূমসহ পাঁচটি নগরীর লোকদের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয় ও তিনি সেখানেই বসবাস করেন। ফলে ইবরাহীমের জীবনে নিঃসঙ্গতার এক কষ্টকর অধ্যায় শুরু হয়।
উল্লেখ্য যে, মানবজাতির প্রথম ফসল ডুমুর (তীন) বর্তমান ফিলিস্তীনেই উৎপন্ন হয়েছিল আজ থেকে এগারো হাযার বছর আগে। সম্প্রতি সেখানে প্রাপ্ত শুকনো ডুমুর পরীক্ষা করে এ তথ্য জানা গেছে।[12]
কেন‘আনের জীবন :

জন্মভূমি বাবেল শহরে জীবনের প্রথমাংশ অতিবাহিত করার পর হিজরত ভূমি শামের কেন‘আনে তিনি জীবনের বাকী অংশ কাটাতে শুরু করেন। তাঁর জীবনের অন্যান্য পরীক্ষা সমূহ এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। কিছু দিন অতিবাহিত করার পর এখানে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। মানুষ সব দলে দলে ছুটতে থাকে মিসরের দিকে। মিসর তখন ফেরাঊনদের শাসনাধীনে ছিল। উল্লেখ্য যে, মিসরের শাসকদের উপাধি ছিল ‘ফেরাঊন’। ইবরাহীম ও মূসার সময় মিসর ফেরাঊনদের শাসনাধীনে ছিল। মাঝখানে ইউসুফ-এর সময়ে ২০০ বছরের জন্য মিসর হাকসূস (الهكسوس ) রাজাদের অধীনস্থ ছিল। যা ছিল ঈসা (আঃ)-এর আবির্ভাবের প্রায় ২০০০ বছর আগেকার ঘটনা’।[13]
মিসর সফর :
দুর্ভিক্ষ তাড়িত কেন‘আন হ’তে অন্যান্যদের ন্যায় ইবরাহীম (আঃ) সস্ত্রীক মিসরে রওয়ানা হ’লেন। ইচ্ছা করলে আল্লাহ তাঁর জন্য এখানেই রূযী পাঠাতে পারতেন। কিন্তু না। তিনি মিসরে কষ্টকর সফরে রওয়ানা হ’লেন। সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল এক কঠিন ও মর্মান্তিক পরীক্ষা এবং সাথে সাথে একটি নগদ ও অমূল্য পুরষ্কার।
ঐ সময় মিসরের ফেরাঊন ছিল একজন নারী লোলুপ মদ্যপ শাসক। তার নিয়োজিত লোকেরা রাস্তার পথিকদের মধ্যে কোন সুন্দরী মহিলা পেলেই তাকে ধরে নিয়ে বাদশাহকে পৌঁছে দিত। যদিও বিবি ‘সারা’ ঐ সময় ছিলেন বৃদ্ধা মহিলা, তথাপি তিনি ছিলেন সৌন্দর্য্যের রাণী। মিসরীয় সম্রাটের নিয়ম ছিল এই যে, যে মহিলাকে তারা অপহরণ করত, তার সাথী পুরুষ লোকটি যদি স্বামী হ’ত, তাহ’লে তাকে হত্যা করে মহিলাকে নিয়ে যেত। আর যদি ভাই বা পিতা হ’ত, তাহ’লে তাকে ছেড়ে দিত। তারা ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করলে তিনি সারাকে তাঁর ‘বোন’ পরিচয় দিলেন। নিঃসন্দেহে ‘সারা’ তার ইসলামী বোন ছিলেন। ইবরাহীম তাকে আল্লাহর যিম্মায় ছেড়ে দিয়ে ছালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন ও আল্লাহর নিকটে স্বীয় স্ত্রীর ইয্যতের হেফাযতের জন্য আকুলভাবে প্রার্থনা করতে থাকলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ নিশ্চয়ই তার স্ত্রীর ইয্যতের হেফাযত করবেন।
সারাকে যথারীতি ফেরাঊনের কাছে আনা হ’ল। অতঃপর পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
فلمَّا دَخلتْ سارةُ على الْمَلِكِ قامَ إليها فأَقبلتْ تتوضأُ و تُصَلىِّ وتقولُ: أللَّهم إِنْ كنتَ تعلمُ أَنِّي آمنتُ بِكَ وبرسولكَ وأَحْصنتُ فَرْجِي إلا على زوجي فلا تُسلِّطْ علىَّ الكافرَ ু رواه البخارىُّ و أحمد بإِسنادٍ صحيحٍ-
‘যখন সারা সম্রাটের নিকটে নীত হ’লেন এবং সম্রাট তার দিকে এগিয়ে এল, তখন তিনি ওযূ করার জন্য গেলেন ও ছালাতে রত হয়ে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! যদি তুমি জেনে থাক যে, আমি তোমার উপরে ও তোমার রাসূলের উপরে ঈমান এনেছি এবং আমি আমার একমাত্র স্বামীর জন্য সতীত্ব বজায় রেখেছি, তাহ’লে তুমি আমার উপরে এই কাফিরকে বিজয়ী করো না’।[14]
সতীসাধ্বী স্ত্রী সারার দো‘আ সঙ্গে সঙ্গে কবুল হয়ে গেল। সম্রাট এগিয়ে আসার উপক্রম করতেই হাত-পা অবশ হয়ে পড়ে গিয়ে গোঙাতে লাগলো। তখন সারাহ প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! লোকটি যদি এভাবে মারা যায়, তাহ’লে লোকেরা ভাববে আমি ওকে হত্যা করেছি’। তখন আল্লাহ সম্রাটকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু শয়তান আবার এগিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে আবার মরার মত পড়ে রইল।
এভাবে সে দুই অথবা তিনবার বেহুঁশ হয়ে পড়লো আর সারা-র দো‘আয় বাঁচলো। অবশেষে সে বলল, তোমরা আমার কাছে একটা শয়তানীকে পাঠিয়েছ। যাও একে ইবরাহীমের কাছে ফেরত দিয়ে আসো এবং এর খেদমতের জন্য হাজেরাকে দিয়ে দাও। অতঃপর সারাহ তার খাদেমা হাজেরাকে নিয়ে সসম্মানে স্বামী ইবরাহীমের কাছে ফিরে এলেন’(ঐ)। এই সময় ইবরাহীম ছালাতের মধ্যে সারার জন্য প্রার্থনায় রত ছিলেন। সারা ফিরে এলে তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। আল-হামদুলিল্লাহ! যে আল্লাহ তাঁর বান্দা ইবরাহীমকে নমরূদের প্রজ্জ্বলিত হুতাশন থেকে বাঁচিয়ে এনেছেন, সেই আল্লাহ ইবরাহীমের ঈমানদার স্ত্রীকে ফেরাঊনের লালসার আগুন থেকে কেন বাঁচিয়ে আনবেন না? অতএব সর্বাবস্থায় যাবতীয় প্রশংসা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য।
‘আবুল আম্বিয়া’ (أبو الأنبياء ) হিসাবে আল্লাহ পাক যেভাবে ইবরাহীমের পরীক্ষা নিয়েছেন, উম্মুল আম্বিয়া (أم الأنبياء ) হিসাবে তিনি তেমনি বিবি সারা-র পরীক্ষা নিলেন এবং উভয়ে পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হ’লেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ।

ধারণা করা চলে যে, ফেরাঊন কেবল হাজেরাকেই উপহার স্বরূপ দেয়নি। বরং অন্যান্য রাজকীয় উপঢৌকনাদিও দিয়েছিল। যাতে ইবরাহীমের মিসর গমনের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায় এবং বিপুল মাল-সামান ও উপঢৌকনাদি সহ তিনি কেন‘আনে ফিরে আসেন।
শিক্ষণীয় বিষয় :

উপরোক্ত ঘটনার মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, বান্দা যখন নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে সোপর্দ করে দেয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই সকল কাজ করে, তখন আল্লাহ তার পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে নেন। তার জান-মাল-ইয্যত সবকিছু তিনিই হেফাযত করেন। আলোচ্য ঘটনায় ইবরাহীম ও সারাহ ছিলেন একেবারেই অসহায়। তারা স্রেফ আল্লাহর উপরেই নির্ভর করেছেন, তাঁর কাছেই কেঁদেছেন, তাঁর কাছেই চেয়েছেন। ফলে আল্লাহ তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন।
দ্বিতীয় শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, বান্দার দায়িত্ব হ’ল, যেকোন মূল্যে হক-এর উপরে দৃঢ় থাকা ও অন্যকে হক-এর পথে দাওয়াত দেওয়া। ইবরাহীম দারিদ্রে্যর তাড়নায় কাফেরের দেশ মিসরে গিয়েছিলেন। কিন্তু নিজেরা যেমন ‘হক’ থেকে বিচ্যুত হননি, তেমনি অন্যকে দাওয়াত দিতেও পিছপা হননি। ফলে আল্লাহ তাঁকে মর্মান্তিক বিপদের মধ্যে ফেলে মহা পুরষ্কারে ভূষিত করলেন।
ইবরাহীমের কথিত তিনটি মিথ্যার ব্যাখ্যা :

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন যে, لم يَكْذِبْ إبراهيمُ عليه الصلاةُ والسلام إلاّ ثلاثَ كَذَباتٍ، ‘ইবরাহীম (আঃ) তিনটি ব্যতীত কোন মিথ্যা বলেননি’। উক্ত তিনটি মিথ্যা ছিল- (১) মেলায় না যাবার অজুহাত হিসাবে তিনি বলেছিলেন إِنِّيْ سَقِيْمٌ ‘আমি অসুস্থ’ (ছাফফাত ৩৭/৮৯)। (২) মূর্তি ভেঙ্গেছে কে? এরূপ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا ‘বরং এই বড় মূর্তিটাই এ কাজ করেছে’ (আম্বিয়া ২১/৬৩)। (৩) মিসরের লম্পট রাজার হাত থেকে বাঁচার জন্য স্ত্রী সারা-কে তিনি বোন হিসাবে পরিচয় দেন।[15]
হাদীছে উক্ত তিনটি বিষয়কে ‘মিথ্যা’ শব্দে উল্লেখ করা হ’লেও মূলতঃ এগুলির একটাও প্রকৃত অর্থে মিথ্যা ছিল না। বরং এগুলি ছিল আরবী অলংকার শাস্ত্রের পরিভাষায় ‘তাওরিয়া’ (الةورية) বা দ্ব্যর্থ বোধক পরিভাষা। যেখানে শ্রোতা বুঝে এক অর্থ এবং বক্তার নিয়তে থাকে অন্য অর্থ। যেমন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন হযরত আয়েশার কাছে তার এক বৃদ্ধা খালাকে দেখে বললেন, কোন বৃদ্ধা জান্নাতে যাবে না। একথা শুনে খালা কান্না শুরু করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তারা তখন সবাই যুবতী হয়ে যাবে’।[16] হিজরতের সময় পথিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সম্পর্কে জনৈক ব্যক্তির প্রশ্নের জওয়াবে আবুবকর (রাঃ) বলেন, هذا الرجلُ يَهْديني الطريقَ ‘ইনি আমাকে পথ দেখিয়ে থাকেন’।[17] এতে লোকটি ভাবল, উনি একজন সাধারণ পথপ্রদর্শক ব্যক্তি মাত্র। অথচ আবুবকরের উদ্দেশ্য ছিল তিনি আমাদের নবী অর্থাৎ ধর্মীয় পথপ্রদর্শক (يهديني الى طريق الجنة)। অনুরূপভাবে যুদ্ধকালে রাসূল (ছাঃ) একদিকে বেরিয়ে অন্য দিকে চলে যেতেন। যাতে তাঁর গন্তব্য পথ গোপন থাকে। এগুলি হ’ল উক্তিগত ও কর্মগত তাওরিয়ার উদাহরণ।
তাওরিয়া ও তাক্বিয়াহঃ

উল্লেখ্য যে, এই তাওরিয়া ও শী‘আদের তাক্বিয়াহর (ةقية) মধ্যে পার্থক্য এই যে, সেখানে পুরাটাই মিথ্যা বলা হয় ও সেভাবেই কাজ করা হয়। যেমন উদাহরণ স্বরূপ, (১) শী‘আদের ৬ষ্ঠ ইমাম আবু আব্দুল্লাহ জাফর, যিনি আছ-ছাদিক্ব বা সত্যবাদী বলে উপাধিপ্রাপ্ত, একদিন তাঁর নিকটতম শিষ্য মুহাম্মাদ বিন মুসলিম তাঁর নিকটে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার জন্য আমার জীবন উৎসর্গীত হৌক! গতরাতে আমি একটি অদ্ভূত স্বপ্ন দেখেছি। তখন তিনি বললেন, তোমার স্বপ্ন বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। এখানে একজন স্বপ্ন বিশেষজ্ঞ মওজূদ আছেন। বলে তিনি সেখানে উপবিষ্ট অন্যতম শিষ্য ইমাম আবু হানীফার দিকে ইঙ্গিত করলেন। অতঃপর শিষ্য মুহাম্মাদ বিন মুসলিম তার স্বপ্ন বর্ণনা করলেন এবং আবু হানীফা তার ব্যাখ্যা দিলেন। ব্যাখ্যা শুনে ইমাম জাফর ছাদেক খুশী হয়ে বললেন, আল্লাহর কসম! আপনি সঠিক বলেছেন হে আবু হানীফা। রাবী বলেন, অতঃপর আবু হানীফা সেখান থেকে চলে গেলে আমি ইমামকে বললাম, আপনার প্রতি আমার জীবন উৎসর্গীত হৌক! এই বিধর্মীর (নাছেবী) স্বপ্ন ব্যাখ্যা আমার মোটেই পসন্দ হয়নি। তখন ইমাম বললেন, হে ইবনু মুসলিম! এতে তুমি মন খারাব করো না। এদের ব্যাখ্যা আমাদের ব্যাখ্যা থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। আবু হানীফা যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা সঠিক নয়। আমি বললাম, তাহ’লে আমি আল্লাহর কসম করে তার ব্যাখ্যাকে সঠিক বললেন কেন? ইমাম বললেন, نعم حلفت عليه انه اصاب الخطأ হ্যাঁ, আমি কসম করে এটাই বলেছি যে, উনি যথাযর্থভাবেই ভুল বলেছেন।’
অথচ এই মিথ্যা বলার জন্য সেখানে কোন ভয়-ভীতির কারণ ছিল না। কেননা উভয়ে ইমামের শিষ্য ছিলেন। উপরন্তু আবু হানীফা তখন সরকারের অপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন।’[18] এটাই হ’ল শী‘আদের তাক্বিয়া নীতি, যা স্রেফ মিথ্যা ব্যতীত কিছুই নয় এবং যার মাধ্যমে তারা মানুষকে ধোঁকা দিয়ে থাকে ও প্রতারণা করে থাকে। এই মিথ্যাচারকে ইমাম জাফর ছাদেক তাদের দ্বীনের ১০ ভাগের নয় ভাগ মনে করেন। তিনি বলেন, ঐ ব্যক্তির দ্বীন নেই, যার তাক্বিয়া নেই (ঐ, পৃঃ ১৫৩)। (২) ব্যাকরণবিদ হুসায়েন বিন মু‘আয বিন মুসলিম বলেন, আমাকে একদিন ইমাম জাফর ছাদিক বললেন, শুনছি তুমি নাকি জুম‘আ মসজিদে বসছ এবং লোকদের ফৎওয়া দিচ্ছ? আমি বললাম, হাঁ। তবে আপনার কাছ থেকে বের হবার আগেই আমি আপনাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম যে, আমি জুম‘আ মসজিদে বসি, তারপর লোকেরা এসে আমাকে প্রশ্ন করে। আমি যখন বুঝি যে, লোকটি আমার ইচ্ছার বিরোধী, তখন আমি তাকে তার চাহিদা অনুযায়ী ফৎওয়া দেই।’ একথা শোনার পর ইমাম জাফর ছাদিক আমাকে বললেন, اصنع كذا فانى اصنع كذا ‘তুমি এভাবেই করো। কেননা আমিও এভাবে করে থাকি’ (ঐ, পৃঃ ১৭১-৭২)। অথচ সত্য কখনোই মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত হয় না এবং সত্য সংখ্যক সর্বদা একটিই হয়, তা কখনোই বহু হয় না। আল্লাহ বলেন, যদি সত্য তাদের প্রবৃত্তির অনুগামী হ’ত, তাহ’লে আকাশ ও পৃথিবী এবং এর মধ্যস্থিত সবকিছু ধ্বংস হয়ে যেত’ (মুমিনূন ২৩/৭১)। বস্ত্তত: এই তাক্বিয়া নীতি শী‘আদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অঙ্গীভূত। যা ইসলামের মৌল নীতির ঘোর বিরোধী। কিন্তু তাওরিয়ায় বক্তা যে অর্থে উক্ত কথা বলেন তা সম্পূর্ণ সত্য হয়ে থাকে। যেমন- (১) ইবরাহীম নিজেকে سقيم (অসুস্থ) বলেছিলেন, কিন্তু مريض (পীড়িত) বলেননি। নিজ সম্প্রদায়ের শিরকী কর্মকান্ডে এমনিতেই তিনি ত্যক্ত-বিরক্ত ও বিতৃষ্ণ ছিলেন। তদুপরি শিরকী মেলায় যাওয়ার আবেদন পেয়ে তাঁর পক্ষে মানসিকভাবে অসুস্থ (سقيم من عملهم) হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এরপরেও তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকতেও পারেন। (২) সব মূর্তি ভেঙ্গে তিনি বড় মূর্তিটার গলায় বা হাতে কুড়াল ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। যাতে প্রমাণিত হয় যে, সেই-ই একাজ করেছে। এর দ্বারা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কওমের মূর্খতাকে হাতে নাতে ধরিয়ে দেওয়া এবং তাদের মূর্তিপূজার অসারতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। তাই মূর্তি ভাঙ্গার কাজটি তিনি বড় মূর্তির দিকে সম্বন্ধ করেন রূপকভাবে। তাছাড়া ঐ বড় মূর্তিটির প্রতিই লোকেদের ভক্তি ও বিশ্বাস ছিল সর্বাধিক। এর কারণেই মানুষ পথভ্রষ্ট হয়েছিল বেশী। ফলে সেই-ই মূলতঃ ইবরাহীমকে মূর্তি ভাঙ্গায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। অতএব একদিক দিয়ে সেই-ই ছিল মূল দায়ী।
(৩) সারা-কে বোন বলা। নিঃসন্দেহে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে দ্বীনী ভাই-বোন। স্ত্রীর ইযযত ও নিজের জীবন রক্ষার্থে এটুকু বলা মোটেই মিথ্যার মধ্যে পড়ে না।
এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল, তবুও হাদীছে একে ‘মিথ্যা’ বলে অভিহিত করা হ’ল কেন? এর জবাব এই যে, নবী-রাসূলগণের সামান্যতম ত্রুটিকেও আল্লাহ বড় করে দেখেন তাদেরকে সাবধান করার জন্য। যেমন ভুলক্রমে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়াকে আল্লাহ আদমের ‘অবাধ্যতা ও পথভ্রষ্টতা’ (وَعَصَى آدَمُ رَبَّهُ فَغَوَى )[19] বলে অভিহিত করেছেন। অথচ ভুলক্রমে কৃত অপরাধ ক্ষমার যোগ্য। উল্লেখ্য যে, মাওলানা মওদূদীর ন্যায় কোন কোন মুফাসসির এখানে হাদীছের রাবী আবু হুরায়রাকেই উক্ত বর্ণনার জন্য দায়ী করেছেন, যা নিতান্ত অন্যায়

3 thoughts on "ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) দ্বিতীয় পর্ব"

  1. Nashurollah Contributor says:
    অসাধারণ!
  2. tahmid habib Contributor Post Creator says:
    ধন্যবাদ

Leave a Reply