:::মায়ের কবিতা:::


মা


– কাজী নজরুল ইসলাম

যেখানেতে দেখি যাহা
মা-এর মতন আহা
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!
হেরিলে মায়ের মুখ
দূরে যায় সব দুখ,
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
মায়ের শীতল কোলে
সকল যাতনা ভোলে
কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।
কত করি উৎপাত
আবদার দিন রাত,
সব স’ন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা!
আমাদের মুখ চেয়ে
নিজে র’ন নাহি খেয়ে,
শত দোষী তবু মা তো তাজে না।
ছিনু খোকা এতটুকু,
একটুতে ছোট বুক
যখন ভাঙিয়া যেতো, মা-ই সে তখন
বুকে করে নিশিদিন
আরাম-বিরাম
-হীন
দোলা দেয় শুধাতেন, ‘কি হোলো
খোকন?’
আহা সে কতই রাতি
শিয়রে জ্বালায়ে বাতি
একটু আসুখ হলে জাগেন মাতা,
সব-কিছু ভুলে গিয়ে
কেবল আমায়ের নিয়ে
কত আকুলতা যেন জাগন্মাতা।
যখন জন্ম নিনু
কত আসহায় ছিনু,
কাঁদা ছাড়া নাহি জানিতাম কোনu
কিছু,
ওঠা বসা দূরে থাক-
মুখে নাহি ছিল বাক,
চাহনি ফিরিত শুধু আর পিছু পিছু।
তখন সে মা আমার
চুমু খেয়ে বারবার
চাপিতেন বুকে, শুধু একটি চাওয়ায়
বুঝিয়া নিতেন যত
আমার কি ব্যথা হোতো,
বল কে ওমন স্নেহে বুকটি ছাওয়ায়।
তারপর কত দুখে
আমারে ধরিয়া বুকে
করিয়া তুলেছে মাতা দেখো কত বড়,
কত না সে সুন্দর
এ দেহে এ অন্তর
সব মোর ভাই বোন হেথা যত পড়।
পাঠশালা হ’তে যবে
ঘরে ফিরি যাব সবে,
কত না আদরে কোলে তুলি’ নেবে
মাতা,
খাবার ধরিয়া মুখে
শুধাবেন কত সুখে
কত আজ লেখা হোলো, পড়া কত
পাতা?’
পড়া লেখা ভাল হ’লে
দেখেছ সে কত ছলে
ঘরে ঘরে মা আমার কত নাম করে।
বলে, ‘মোর খোকামনি!
হীরা-মানিকের খনি,
এমনটি নাই কারো!’ শুনে বুক ভরে।
গা’টি গরম হলে
মা সে চোখের জলে
ভেসে বলে, ‘ওরে যাদু কি হয়েছে
বল’।
কত দেবতার ‘থানে’
পীরে মা মানত মানে-
মাতা ছাড়া নাই কারো চোখে এত
জল।
যখন ঘুমায়ে থাকি
জাগে রে কাহার আঁখি
আমার শিয়রে, আহা কিসে হবে ঘুম।
তাই কত ছড়া গানে
ঘুম-পাড়ানীরে আনে,
বলে, ‘ঘুম! দিয়ে যা রে খুকু-চোখে চুম’।
দিবানিশি ভাবনা
কিসে ক্লেশ পাব না,
কিসে সে মানুষ হব, বড় হব কিসে;
বুক ভ’রে ওঠে মা’র
ছেলেরি গরবে তাঁর,
সব দুখ হয় মায়ের আশিসে।
আয় তবে ভাই বোন,
আয় সবে আয় শোন
গাই গান, পদধূলি শিরে লয়ে মা’র;
মা’র বড় কেহ নাই-
কেউ নাই কেউ নাই!
নত করি বল সবে ‘মা আমার! মা আমার!
================********************************
=====================


মনে-পড়া


– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে হঠাৎ অকারণে
একটা কি সুর গুনগুনিয়ে কানে আমার
বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন আমার
খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত আমার দোলনা
ঠেলে ঠেলে-
মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি
গেছে ফেলে।
মাকে আমার পড়েনা মনে।
শুধু যখন আশ্বিনেতে ভোরে
শিউলিবনে
শিশির-ভেজা হাওয়া বেয়ে ফুলের
গন্ধ আসে
তখন কেন মায়ের কথা আমার মনে
ভাসে।
কবে বুঝি আনত মা সেই ফুলের সাজি
বয়ে-
পূজোর গন্ধ আসে যে তাই মায়ের গন্ধ
হয়ে।
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন বসি গিয়ে শোবার ঘরের
কোণে,
জানলা থেকে তাকাই দূরে নীল
আকাশের দিকে-
মনে হয় মা আমার পানে চাইছে
অনিমিখে।
কোলের পরে ধরে কবে দেখত আমায়
চেয়ে,
সেই চাউনি রেখে গেছে সারা
আকাশ ছেয়ে।
=============************************************

===================


কত ভালবাসি


– – কামিনী রায়

জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,-
“মা, তোমারে কত ভালোবাসি!”
“কত ভালবাস ধন?” জননী শুধায়।
“এ-ত।” বলি দুই হাত প্রসারি’ দেখায়।
“তুমি মা আমারে ভালবাস কতখানি?”
মা বলেন “মাপ তার আমি নাহি
জানি।”
“তবু কতখানি, বল।”
“যতখানি ধরে
তোমার মায়ের বুকে।”
“নহে তার পরে?”
“তার বাড়া ভালবাসা পারি না
বাসিতে।”
“আমি পারি।” বলে শিশু হাসিতে
হাসিতে!
======================**********************==
==========================


কখনো
আমার মাকে


– শামসুর
রাহমান

কখনো আমার মাকে কোনো গান
গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া
গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না
আজ মনেই পড়ে না।
যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার
আসেনি,
যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে
বেড়ানো
বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো
কোনো গান
লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে
সন্ধ্যায়,
পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং
স্বামীর
সংসারেও এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি
নেপথ্যচারিণী। যতদূর
জানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল
তাঁকে করেনি দখল
কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ
বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায়
ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে
আদরে
অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান
গেয়েছেন কি না
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে
পারিনি।
যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া
কোনো কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ ক’রে আজীবন,
কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে
আসে!
===================*****************************
===============================

কোথায় ছিলাম আমি

–কাজী নজরুল ইসলাম


মা গো! আমায় বল্তে পারিস কোথায়
ছিলাম আমি-
কোন্ না-জানা দেশ থেকে তোর
কোলে এলাম নামি?
আমি যখন আসিনি, মা তুই কি আঁখি
মেলে
চাঁদকে বুঝি বল্তিস-ঐ ঘর-ছাড়া মোর
ছেলে?
শুকতারাকে বল্তিস কি, আয় রে নেমে
আয়-
তোর রূপ যে মায়ের কোলে বেশি
শোভা পায়।
কাজলা দিঘির নাইতে গিয়ে
পদ্মফুলের মুখে
দেখ্তিস কি আমার ছায়া, উঠ্ত কাঁদন
বুকে?গাঙে যখন বান আস্ত, জান্ত না
মা কেউ-
তোর বুকে কি আসতাম আমি হয়ে
স্নেহের ঢেউ?
===================****************************=
==========================

খোকার গপ্প বলা

–কাজী নজরুল ইসলাম


মা ডেকে কন, ‘ খোকন-মণি! গপ্প তুমি
জান?
কও তো দেখি বাপ!’
কাঁথার বাহির হয়ে তখন জোর দিয়ে
এক লাফ
বললে খোকন, গপ্প জানি, জানি আমি
গানও!’
ব’লেই ক্ষুদে তানসেন সে তান জুড়ে
জোর দিল-
‘একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ
ফুটিয়াছিল!’
মা সে হেসে তখন
বলেন, ‘উহুঁ গান না, তুমি গপ্প বল খোকন!’.
=====================***************========
===================

লুকোচুরি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমি যদি দুষ্টুমি করে
চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,
ভোরের বেলা, মা গো, ডালের ’পরে
কচি পাতায় করি লুটোপুটি-
তবে তুমি আমার কাছে হারো-
তখন কি, মা, চিনতে আমায় পারো?
তুমি ডাকো ‘ খোকা কোথায় ওরে’,
আমি শুধু হাসি চুপটি করে।।
==========***********************************====
=====

বীরপুরুষ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চ’ড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক ক’রে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ‘পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধূলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।
সন্ধ্যে হল, সূর্য নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।
ধূ ধূ করে যে দিক-পানে চাই,
কোনোখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপন-মনে তাই
ভয় পেয়েছ-ভাবছ, ‘এলেম কোথা।’
আমি বলছি, ‘ভয় কোরো না মা গো,
ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।’
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা
জানে-
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
‘দিঘির ধারে ওই-যে কিসের আলো!’
এমন সময় ‘হাঁরে রে রে রে রে’
ওই – যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে!
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর-দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,
‘আমি আছি, ভয় কেন, মা, করো!’
তুমি বললে, ‘যাস নে খোকা ওরে,’
আমি বলি, ‘দেখো-নাচুপ করে।’
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের
মাঝে,
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।।
এত লোকের সঙ্গে লড়াই ক’রে,
ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে,’
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল’
কী দুর্দশাই হত তা না হলে!’

নোলক

আল মাহমুদ


আমার মায়ের সোনার নোলক
হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা
বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে
তোমার কাছে?
-হাত দিওনা আমার শরীর ভরা
বোয়াল মাছে।
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণ
বেড়ের বাঁকে
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ
ছড়িয়ে থাকে।
জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম
বনের দিক
সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে
ঝিকমিক
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে
দেবে ভাই,
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে
যেতে চাই।…
****************************************************

জননী জন্মভূমি

সুভাষ মখোপাধ্যায়

আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মা-
কে
-কখনও মুখ ফুটে বলি নি।
টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে
কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলালেবু
-শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভ’রে উঠত
আমার ভালাবাসার কথা
মা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে
পারি নি।
হে দেশ, হে আমার জননী-
কেমন ক’রে তোমাকে আমি বলি…
***************************************************

আঁকতে আঁকতে

ফারুক নওয়াজ


আঁকাই আমার শখ;
আঁকতে বসে আঁকি যদি
একটি পাহাড়, একটি নদী
শাদা ডানায় উড়ে যাওয়া
ধবধবে এক বক-
শেষ হয়ে যায় আঁকা যখন
অবাক লাগে ভারী-
তাকিয়ে দেখি আমার মায়ের
সবুজ রঙের শাড়ি।…
****************************************************

কোন এক মাকে

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

“কুমড়ো ফুলে-ফুলে
নুয়ে পড়েছে লতাটা,
সজনে ডাঁটায়
ভরে গ্যাছে গাছটা
আর, আমি ডালের বড়ি
শুকিয়ে রেখেছি,
খোকা তুই কবে আসবি।
কবে ছুটি?”
-চিঠিটা তার পকেটে ছিলো,
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।
“মাগো, ওরা বলে,
সবার কথা কেড়ে নেবে
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না।
বলো মা, তাই কি হয়?
তাই তো দেরি হচ্ছে।
তোমার জন্যে কথার ঝুড়ি নিয়ে
তবেই না ফিরবো।
লক্ষী মা রাগ ক’রো না,
মাত্র তো কটা দিন।”…
******************************************************

মা

কাজী কাদের নেওয়াজ

মা কথাটি ছোট্ট অতি
কিন্তু জেনো ভাই
ইহার চেয়ে নাম যে মধুর
ত্রিভূবনে নাই।ই।
*******************************************************
*****

Leave a Reply